নেকড়ে মানব,পর্ব:-০৩

#নেকড়ে মানব,পর্ব:-০৩
#আমিনা_আফরোজ

সময় সকাল সাতটা বেজে ত্রিরিশ মিনিট। ছোট কামরার একটি সোফায় চুপচাপ বসে আছে নিলয়। মিনুর মা তখনো রান্নার কাজে ব্যস্ত। ছোট জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে পড়ছে সূর্যের সোনালী কিরন। শীতকালে সূর্য মামা এই পাহাড়ি এলাকায় দেরী করে ওঠলেও আজ বোধহয় তিনি তাড়াতাড়িই উদয় হয়েছেন। নিলয় আজও নাশতা না করেই বেরিয়ে পড়ল থানার উদ্দেশ্যে। এতো বড় দুঃসংবাদ শোনার পর খাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আর।পুলিশ স্টেশনে পৌঁছে রমজান মিয়া সহ জনা কয়েক পুলিশ সদস্য নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল বড়কল গ্রামটির উদ্দেশ্যে। গ্রামের সীমান্তে গাড়ি থামতেই নিলয় গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই গেলো লাশটির দিকে। এই লাশটিরও একই অবস্থা। গলার পাশে দুটো ফুটো আর বুকে গর্ত। রক্তশূন্যতায় ইতিমধ্যে লাশটি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। মৃতের চোখ দুইটি যেন আকাশ বরাবর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু দেখেছে সে।

লাশের পাশে আসিফের মাকে চোখের পানি ফেলতে দেখল নিলয়। তাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা জানা নেই ওর। আসিফের লাশটিকেও পোসমোটার্মের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হলো । নিলয়ের ধারনা পূরবর্তী আর আজকেই এই খুনটির ধরন যেহেতু এক সেহেতু পোস মোর্টাম রিপোর্টাও একই আসবে। লাশটি নিয়ে এসে নিজের কেবিনেই বসে ছিল নিলয়। কেসের কিছু জিনিস মিলিয়ে নিচ্ছিল তখন ও। হঠাৎ করেই নিলয়ের মনে হলো বরকল গ্রামে সে নিজে কিছু পুলিশ ফোর্স নিয়ে পাহারা দিবে। দেখবে রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে কে করছে এই খুনগুলো? কোন মানুষ নাকি কোন জন্তু?

পরের দিন ডাঃ অজিত রায় এর কাছ থেকে পোস মোর্টাম রিপোর্টা কালেক্ট করে নিলয় কিছু পুলিশ সদস্য নিয়ে আবারো রওনা দিল বড়ল গ্রামটির উদ্দেশ্যে। গ্রামে পৌঁছিয়ে নিলয় প্রথমে বাকিদের নিয়ে বন ও গ্রামের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গায় তাবু টাঙ্গানোর কাজ সেরে ফেলল। নিলয় সহ পুলিশ সদস্য রয়েছে মোটে পাঁচজন। তিনটে তাঁবু টাঙ্গিয়ে নিল সবার জন্য। আজ রাতে এখানে থেকেই পুরো গ্রাম পাহারা দিবে তারা। এই স্থান বেছে নেওয়ার কারন অবশ্য আছে । কারনটা হলো এখান থেকে যেমন গ্রামের দিকে নজর রাখতে তেমন বনের দিকেই ভালো করে নজর রাখতে পারবে অর্থাৎ দুই দিকেই সমান পাহারা দিতে পারবে।

আকাশে ঝকমকে পূর্নিমার চাঁদ। আজ যেন চাঁদ আকাশে তার দ্বিগুন আলো ছড়াচ্ছে। পুরো নেকড়ে টিলা ভেসে যাচ্ছে চাঁদের আলোয়। এমন চাঁদের আলোয় সবুজ গাছপালায় ভরা বনটাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। এমন মনোরম পরিবেশ যেন নিলয়কে দুহাত বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। নিলয়ের কেন যেন মনে হচ্ছে এই নেকড়ে টিলার অতল গহ্বরে লুকিয়ে আছে কোন অজানা রহস্য। যেখানে নেই কোন মানুষের পদচারনা,নেই কোন কোলাহল ,আছে শুধু নিঃস্তব্ধতা।

নিলয় রাত জেগে তিন জন পুলিশ সদস্য নিয়ে তাঁবুর বাইরে পাহরায় ব্যস্ত। বাকি তিনজনকে সে গ্রামের ভিতরে টহল দিতে পাঠিয়েছে। সবার হাতেই গুলি ভর্তি রাইফেল রয়েছে। আজ যে করেই হোক এই কেসটার সুরাহা করেই ছাড়বে নিলয়। রাত একটা বেজে ত্রিশ মিনিট। চারিদিক শুনশান নিস্তব্ধ। হঠাৎ এই নিস্তব্ধতার বুক চিরে শোনা গেল এক আর্তনাদ। নিলয়ের শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে গেল শীতল ঠান্ডা হাওয়া। নিলয় একটু এগিয়ে গিয়েই বুঝতে পারল এই আর্তনাদের উৎস নেকড়ে টিলার আন্ধাঘেরা জঙ্গল। তাই আর বিন্দুমাত্র দেরি না করে তিনজন পুলিশ সদস্য আর জনাকয়েক গ্রামবাসীদের নিয়েই ছুটে চলে গেল আন্ধাঘেরা জঙ্গলটির অতল গহ্বরে।

গ্রামবাসীদের হাতে জ্বালানো মশালের আলোতে ধীর পায়ে এগিয়ে চলছে নিলয়দেল ছোট দলটি। মশালের আবছা আলোয় বনের মধ্যে ভাগের একটি গাছের তলায় দেখতে পেল মাটিতে পড়ে থাকা একটি নিথর দেহ। সবাই মিলে এগিয়ে গেল সেদিকে। দেখতে পেল এই লাশটির ঠিক আগের দুইটির মতো অবস্থা। ফ্যাকাশে শরীর,গলায় দুটো ফুটো আর বুকে বিশাল গর্ত। মৃত ব্যাক্তিটি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে।

গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা গেল লোকটির নাম অতনু। বয়স আঠাশ বছরের কাছাকাছি। বনে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করে সে। অতনুর পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রায় দেড় ঘন্টা আগে অতনুর পরিচিত এক লোক এসে ডাক দেয় তাকে। লোকটি কে ছিল তা কেউ জানে না। শুধু জানে কোন এক প্রয়োজনে অতনুর কাছে এসেছিল লোকটি। তারপর সেই র
যে লোকটির সাথে বেরিয়ে গেল আর ফিরে আসে নি। কিছুক্ষণ পরে শুনতে পাওয়া যায় তার আর্তনাদ।

এত কড়া পাহারা দিয়েও তৃতীয় নম্বর খুনটি আটকাতে পারলো না নিলয়। এই প্রথম কোনো কাজে ব্যর্থ হলো সে। লাশটিকে গ্রামবাসীদের সাহায্য তাঁবুতে আনা হলো। আপাতত তাবুতেই থাকবে লাশটি। সকাল হলেই হস্তান্তর করা হবে ডাঃ অজিত রায় এর কাছে। বাকী রাতটুকু আর ঘুম এলো না পুরো গ্রামবাসীদের। গ্রামে পাহারা আরো বেড়ে দিল নিলয়। অন্যদিকে অতনুর স্ত্রী অনুশ্রী একেবারে ভেঙে পড়েছে। কেননা অতনুই ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অনুশ্রী কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা তার একমাত্র মেয়ে আরান্ধ্যাকে নিয়ে এখন কী করবে সে?

আকাশের বুক চিরে দেখা যাচ্ছে সূর্যের লাল আভা। মোরগের ডাকে জানান দিল শুরু হচ্ছে আরো একটি নতুন দিনের সূচনা। গ্রামবাসী ইতিমধ্যে ভিড় জমিয়েছে নিলয়দের তাঁবুর সামনে। যেন তারা পুরোটা রাত জেগে এই সকালের অপেক্ষাতেই ছিল। অনুশ্রী ও তার মেয়ে অবশ্য গতকাল রাত থেকে এখানে নিলয়দের তাবুতেই অতনুর লাশের পাশে ঠাঁই বসে ছিল । নিলয় এবার উপস্থিত গ্রামবাসীদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
” আপনারা আপনাদের প্রয়োজনীয় কাজ সন্ধ্যার আগেই সেরে নেবেন। সন্ধ্যার পর পারতপক্ষে কেউ বাড়ির বাইরে বের হবেন না। কেউ ডাকতে আসলে আসলে আগে তার পরিচয় ভালোভাবে জেনে নিবেন একা বাইরে যাবেন না, অন্য কাউকে সাথে নিয়ে যাবেন। আমরা আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। গ্রামে পাহারা আজ থেকে আরও দ্বিগুন করে দেওয়া হবে ।”

কথাগুলো বলে নিলয় অতনুর লাশ আর রমজান মিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শহরের উদ্দেশ্যে। অতনুর লাশটি ফয়েন্সিক ল্যাবে পাঠিয়ে নিলয় গত কালের রিপোর্ট সহ চলে এলো মাঝারি আকারের এক ঘরে। ঘরটিতে দেওয়ালের বোর্ডে টাঙ্গানো আছে নানা ছবি। সবগুলোই কোন কোন কেস এর সাথে সম্পৃক্ত। বোর্ডের ঠিক পাশেই রয়েছে একটি ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গুটি কয়েক বই, দুই-তিনটে মার্কার পেন আর একটি খালি কাপ। টেবিলটির ঠিক পাশেই রয়েছে একটি কাঠের হাতল ওয়ালা চেয়ার। নিলয় হাতে থাকা ছবিগুলো বোর্ডের মাঝখানে পরপর পিন দিয়ে লাগিয়ে তার নিচেই একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকিয়ে রেখে দিল। তারপর কাঠের চেয়ারে বসে পূর্বের দুইটি রিপোর্ট বের করে টেবিলের উপর রেখে পড়তে লাগলো। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে দুইটি ব্যক্তিরই মৃত্যুর মূল কারন রক্তশূন্যতা । তাছাড়া মৃত দেহ দুইটি থেকে উধাও হয়ে গেছে তাদের হৃদপিন্ড। আরো একটি কথা লেখা আছে রিপোর্টে। তা হলো এই দুইটি খুনই হয়েছে রাত একটা ত্রিশ মিনিট থেকে দুইটার মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ রাতের দ্বি প্রহরে।

নিলয়ের গভীর ভাবনার মাঝেই কর্কশ কন্ঠে বেজে উঠল ওর সেল ফোনটি। এই সময় ফোনের রিংটোনের আওয়াজে খানিকটা বিরক্তই হলো নিলয়। বিরক্তিমাখা মুখে কল রিসিভ করে কানে লাগলো সে।

–” হ্যালো।”

–” হ্যালো স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”

–” ওয়ালাইকুমুস সালাম। কি ব্যপার রমজান চাচা এই সময় ফোন করলেন যে?”

–“স্যার আপনিই তো বলছিলেন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তৈরি হয়ে আপনাকে জানাতে।”

রমজান মিয়ার কথা শুনে আবারো সবটা মনে পড়ল নিলয়ের । এতক্ষণ সে সবকিছু ভুলে বসে ছিল।

–” কি হলো স্যার? কি করব এখন?”

–” আপনি গাড়ি নিয়ে থানায় অপেক্ষা করুন আর বাকি ফোর্সরা এসেছে কি?”

–” জি স্যার দশজন আইছে।”

–” এতেই হবে আপাতত। পরে লাগলে দেখা যাবে।”

–” ঠিক আছে স্যার।”

–” আপনি থানায় অপেক্ষা করুন আমি আসছি।”

–” আচ্ছা স্যার।”

রমজান মিয়ার সাথে কথা শেষ করেই নিলয় মাঝারি আকারের ঘরটি বাহিরে থেকে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল সামনের দিকে। সকলের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাসায় চলে আসলো নিলয় বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে নিল সে। অতঃপর মিনুর মাকে কয়েকদিনের জন্য ছুটি দিয়ে ছুটে চলে থানার দিকে। প্রায় মিনিট দশেক পরেই সবাইকে গাড়িতে উঠিয়ে ছুটতে লাগল বড়কলের উদ্দেশ্যে। গাড়িতে ওঠেই গতকালের অতনুর খুনটা নিয়ে ভাবতে লাগলো সে। হঠাৎই ওর মনে পড়ল অতনুকে ডাকতে আসা সেই অঙ্গাত লোকটির কথা। অপরিচিত সেই লোকটিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি গতকাল। খুনগুলো কি তবে সেই লোকটিই করেছে? কিন্তু কেন? লোকটি কি তবে কোন সিরিয়াল কিলার নাকি নতুন কোন রহস্য উন্মোচন করতে চলেছে সামনে? নাকি আবারো হতে চলেছে আরও একটি হত্যাযজ্ঞ?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here