নেকড়ে মানব,সূচনা পর্ব

#নেকড়ে মানব,সূচনা পর্ব
#আমিনা_আফরোজ

ভরা পূর্ণিমার গোল চাঁদ। পূর্নিমার ঝলমলে চাঁদের আলোয় বড়কলের নেকড়েটিলার আন্ধাঘেরা জঙ্গলটি জেগে ওঠেছে মায়াবী আলোয়। নিশুতি এই রাতে চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে শোনা যাচ্ছে পেঁচার পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ। রাতের এই নিস্তব্ধ প্রহরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গাছ। বড় বিচিত্র সে সব গাছ। নেকড়েটিলার এই অন্ধাঘেরা জঙ্গলে গাছপালার ঘনত্ব এত বেশি যে পূর্নিমার ঝলমলে আলো অব্দি এসে পৌঁছাতে পারে না এ গহিন অরণ্যে। সুগভির এই অন্ধকার জঙ্গলের কোনায় কোনায় ওত পেতে আছে মৃত্যুর ফাঁদ। হঠাৎ এই নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে শোনা গেল এক আর্তনাদ।

ইট সিমেন্টের গড়া ঘরের কাঠের আরাম কেদারায় বসে টিভি দেখতে দেখতে বেশ আয়েশ করেই খাবার খাচ্ছে তরুন বয়সি এক যুবক। নাম তার নিলয় আহমেদ। বয়স আনুমানিক পঁচিশ বছর। দেখতে সুদর্শন, শরীরের গড়ন মানানসই। পেশাগত জীবনে একজন নিষ্ঠাবান একজন পুলিশ অফিসার। কর্মজীবনে অনেক জটিল থেকে জটিলতর কেস সে একাই সামলিয়েছে। এ কারনে উপরমহলে বেশ নামডাক আছে ওর। নিলয়রা এক ভাই-বোন। নিলয়ের বাবা আশরাফ সাহেব ছিলেন একজনঅবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা , মা রাবেয়া বেগম গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখেই একজন সৎ পুলিশ অফিসার হওয়ার ইচ্ছে ছিল নিলয়ের। প্রথম প্রথম রাবেয়া বেগম ছেলের ইচ্ছের বিরুদ্ধে থাকলেও নিলয় মাকে রাজি করিয়েই এসেছে এই প্রফেশনে। নিলয়ের ছোট বোনের নাম প্রিয়ন্তি। সবে দশম শ্রেণিতে ওঠেছে সে। নিলয়ের পরিবারের সবাই ঢাকাতেই থাকে । শুধু নিলয়কেই ওর জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমাতে হয়েছে এই পাহাড়ি এলাকায়।

দুই রুম বিশিষ্ট একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে নিলয়। অফিস থেকে অবশ্য কোয়ার্টারের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল কিন্তু নিলয় তাতে রাজি হয় নি। এর পিছনে অবশ্য অন্য একটা কারন আছে। থানার কাছে-পিঠেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকে সে। ব্যচেলর হিসেবে এই দুই রুম বিশিষ্ট বাড়িটিই যথেষ্ট নিলয়ের জন্য। একজন কাজের বুয়া রেখেছে ও। সে এসে দু-বেলা রেঁধে বেড়ে দিয়ে যায়।

প্রতিদিন সকালবেলা নাস্তা করার সময় টিভিতে খবর দেখার অভ্যাস আছে নিলয়ের। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি ওর । তাই তো অভ্যাস মত খাবারের থালা হাতে নিয়ে বসে গেছে টিভির সামনে । কিন্তু আজ আর খাওয়া সম্পন্ন করতে পারেনি নিলয়। এর কারণ অবশ্য কিছুক্ষণ আগে রমজান মিয়ার কাছ থেকে শোনা একটি খবর। কিছুক্ষন আগে রমজান নামক এক পুলিশ সদস্য নিলয়কে ফোন দিয়ে জানায় কোন এক অঙ্গাত লোক থানায় ফোন করে জানিয়েছে যে,

“রাঙ্গামাটি জেলার নেকড়ে টিলার গহীনে কোন এক অংশে রয়েছে একটি অজ পাড়া গ্রাম। নাম তার বড়কল। সে গ্রামের সীমান্তে আজ সকালে পাওয়া গেছে একটি লাশ। লাশের বিবরনীতে যতটুকু জানা গেছে তা হলো লাশের গলার দিকে দুটো ফুটো আর বুকের বাম পাশে রয়েছে এক বিশাল গর্ত।”

রমজান মিয়ার কাছ থেকে খবরটা শোনা মাত্রই নিলয় পড়িমড়ি করে ছুটে চলে গেল তৈরি হতে। তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে চলতে লাগল সামনের দিকে। নিলয়ের বাসা থেকে থানার দুরুত্ব খুব বেশি নয়। পায়ে হেঁটে গেলে মিনিট পনেরো সময় লাগে। থানায় পৌঁছিয়েই জনা কয়েক পুলিশ সদস্য নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গ্রামটির উদ্দেশ্যে। পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রমজান মিয়া নামের এক বয়ষ্ক হাবিলদারও ছিল।এই রমজান মিয়া নামক লোকটির সাথে নিলয়ের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। শ্যাম বর্ণের এই বয়ষ্ক লোকটির উচ্চতা ছিল মানানসই। বয়স বড়জোড় পঞ্চাশের ঘরে হবে তার। অর্থ্যাৎ বয়সের দিক থেকে নিলয়ের থেকে বেশ বড় তিনি। বড়কল নামক গ্রামটি নিলয়দের থানার অন্তর্গত হলেও এর আগে কখনো ঐ গ্রামে যাওয়া হয়নি নিলয়ের।

প্রায় ঘন্টা খানেক পর নিলয়দের গাড়ি গিয়ে থামল সেই বড়কল নামক গ্রামটিতে। গ্রামটি মূল শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে অবস্থিত। গ্রামটিকে অজ পাড়া গা বললেই চলে। বনের শেষ মাথায় গুটি কয়েক পরিবার নিয়েই গড়ে ওঠেছে এই গ্রামটা। গ্রামটির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এক পাহাড়ি নদী। নাম তার মাদানী(কাল্পনিক নাম)। মাদানী নদীর কলকল শব্দে মুখরিত হয়ে আছে চারিদিক। এখন বর্ষাকাল। তাই নদীর দুকূল ছাপিয়ে ওঠেছে বর্ষার পানিতে। গ্রামটির চারিপাশে বেশিরভাগই বনভূমি। তবে গ্রামটির লোকসংখ্যা বাহিরে থেকে যতটা কম মনে হয় ততটাও কম নয়। চারিদিক পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিলয় এবার এগিয়ে গেল লাশটির দিকে। ইতিমধ্যেই লাশের জায়গাটার চারিদিকে হলুদ রঙের পুলিশ টেপ
দিয়ে কর্ডন করে দেওয়া হয়েছে। যাতে কেসটির কোন এভিডেন্স হারিয়ে না যায়। যদিও এই কেসটিতে বন্য প্রাণীর আক্রমনের সম্ভাবনা রয়েছে তবুও একবার সব কিছু পরিক্ষা করে দেখতে চায় নিলয়।

মৃত লাশটির কাছে এগিয়ে গেল নিলয়। কাছে গিয়ে আঁতকে উঠল ও। এত দিনের ক্যারিয়ারের মধ্যে এমন লাশ কখনো দেখেনি নিলয়। লাশটি রক্ত শূন্য হয়ে ফ্যাকাশে বর্ন ধারন করছে। যেন তার শরীরের সমস্ত রক্ত বের করে নিয়েছে ক্ষত বলতে শুধু বুকের ওপর একটি গর্ত কেউ যেন ছিঁড়ে নিয়ে গেছে বুকে রেখো আর সেই পথেই বেরিয়ে গেছে দেহের সমস্ত লোকদের আর কোথাও কোনো রকমের কাটাছেঁড়ার নিশানা পাওয়া যায় নি। গতরাতের বাসি পচা লাশ থেকে কিছুটা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। নিলয় বুঝতে পারল লাশ পচতে শুরু করে দিয়েছে। তাই আর দেরি না করে লাশটিকে পর্যবেক্ষণ শেষ করে রমজান মিয়াকে লাশটিকে অজিত স্যারের ল্যাবে পাঠাতে বলল ফরেনসিক এর জন্য। তারপর নিজে গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যায় নিলয়।

লাশটিকে প্রথম দেখে এই গ্রামেরই একজন মধ্যবয়স্ক লোক । নাম তার আনিস মিয়া। প্রতিদিন বনে কাঠ কাটতে যায় সে। সহজ কথায় যাকে বলে কাঠুরে । নীলয় তাকে দিয়েই প্রথমে ইনভেস্টিগেশন শুরু করলো।

–“আসসালামু আলাইকুম চাচা।”

–” ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

–” আপনি কখন দেখেছেন লাশটি?”

–” আঙ্গে ভোর বেলা। আমি তো প্রেতেক দিন ভোরে ওইঠায় কাঠ কাটতে বেরোই।

–” তো এই লোকটিকে কি চিনেন আপনি?”

–” হ্যাঁ। চিনুম না ক্যান? এইডা আমাগোর আনোয়ার ভাই। বড় ভালা মানুষ আছিলো ।”

–” তা কি করতেন তিনি?”

–” আনোয়ার ভাই তো মাছ ধরত।রোজ ভোরে রাইতে মাছ ধরতে তাইতো ফিরতো বেশ রাত কইরা।”

–” আচ্ছা। সকালে কি লাশটির আশেপাশে কাউকে দেখেছিলেন?”

–“না তো সাহেব।”

–” আপনি কি আনোয়ার সাহেবের বাড়ি চিনেন?”

–“তা চিনমু না ক্যান? একই গ্রেরামে থাকি আমরা। আসেন আপনারে লইয়া যাইতেছি।”

–” হুম চলুন।”

আনিস নামক লোকটির সাথে গ্রামের সরু রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল নিলয়। উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা। গ্রামের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। বিভিন্ন পেশার লোক আছে এই বড়কল গ্রামে। কেউ নদীতে মাছ ধরে, কেউবা আবার যায় বনে কাঠ কাটতে। এই গ্রামের সবাই বেশ পরিশ্রম করেই জীবিকা নির্বাহ করে তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারল ও। লোকগুলো জীবনে সংগ্রাম করেই টিকে রেখেছে তাদের অস্তিত্ব।

আনোয়ার মিয়ার বাড়ি বড়কল গ্রামের শেষের প্রান্তে। ওনার বাড়ির পরেই আবারো শুরু হয়েছে আন্ধাঘেরা জঙ্গলটি। আনোয়ার মিয়ার বাড়িতে আছে তার স্ত্রী আর ছয় বছরের একটি ছোট মেয়ে। ছয় বছরের মেয়ে ছাড়াও ওনাদের সংসারে আরো একটি ছেলেও রয়েছে। সেও নাকি প্রতিদিন তার বাবার সাথে মাছ ধরতে যেত। গতকালও তার বাবার সাথেই মাছ ধরতে গিয়েছিল সে কিন্তু এখনো ফিরে নি। আনোয়ারা মিয়ার স্ত্রী জানালো, মাঝে মাঝে মাছ বিক্রি করতে করতে রাত হয়ে গেলে সেদিন আর শহর থেকে গ্রামে ফিরে আসত না তারা। তাই আনোয়ার মিয়ার স্ত্রী আছিয়া বেগম ততটাও চিন্তিত ছিল না গতকাল। কেননা এমন অনেক দিনই হয়েছে। কিন্তু আজ সকালে স্বামীর লাশ দেখে ভেঙে পড়েন তিনি। স্বামীকে হারানোর পর ছেলের চিন্তায় মর্মাহত তিনি। নিলয় গ্রামের বাহিরে এসে পুলিশ সদস্যদের নিয়ে চলে গেল সুগভির বনটিতে। ওদের সাথে অবশ্য জনা কয়েক গ্রামবাসীও গেল যারা এই আন্ধাঘেরা জঙ্গলটি বেশ ভালো ভাবেই চিনে‌ । তা না হলে এই গহিন অরণ্যে দিক হারিয়ে ফেললে সারাদিনই এই গোলক ধাঁধায় পড়ে থাকতে হবে তাদের।

নীলয়কে বনের ভেতরে যেতে দেখে রমজান মিয়া বলে ওঠলেন,

–” স্যার আমরা ঐদিকে কেন যাচ্ছি?”

রমজান মিয়া প্রশ্নের জবাবে নিলয় ঝটপট করে উওর দিল। যেন আগে থেকেই রমজান মিয়ার প্রশ্নের কথা জানতো সে।

–” আসিফকে খুঁজতে যাচ্ছি।”

–” এই আসিফটা আবার কে স্যার?”

–” আসিফ মৃত আনোয়ার মিয়ার বড় ছেলে। দুজনেই একসাথে মাছ ধরতে যায় পাশের মাদানী নদীতে । তারপর মাছ ধরে সেই মাছ বিক্রি করে শহরের বাজারে। মাছ বিক্রি করে যে টাকা পায় তা দিয়েই কোন রকমে সংসার চলে তাদের। মাছ বিক্রি করে ফেরতে ফেরতে রাত হয়ে যায় তাদের। গতকালও একসাথেই বেরিয়ে ছিল দুজনে। যেহেতু দুজনে একসাথে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তাহলে একসাথেই গ্রামে ফিরে আসার কথা তাদের। কিন্তু এখন অব্দি নাকি আসিফ গ্রামে ফেরে নি।”

–” স্যার এই কেসটাতে কেমন যেন রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।”

–” রহস্য তো বটেই।”

–” তবে আমার মনে হচ্ছে এইটা কোন জন্তু জানোয়ারের কাজ। হয়তো ক্ষুদ্ধার্ত ছিল তাই আনোয়ার মিয়াকে দিয়েই তার ক্ষুধা নিবারণ করেছে সে।”

–” হতে পারে।”
কথাগুলো বলেই নিলয়রা এগিয়ে গেল সুগভীর বনটির দিকে।

বনটির গভিরতা অনেক। গহিন অরণ্যে গা ছমছমে পরিবেশ। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। চারিদিক নিস্তব্ধ। যেন অজানা কোন এক আতঙ্গ ঘিরে রেখেছে এই বনটিকে। ছোট বড় নাম না জানা অনেক গাছ আছে এখানে। এই জায়গাটার নাম নেকড়ে টিলার করার একটা পুরোনো কল্প কাহিনী আছে। যা এই গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে কিছুক্ষণ আগেই শুনছে নিলয়। অনেক প্রবীন লোকদের কাছ থেকে জানা যায় , অনেক বছর আগে সিভিয়ার এক বিরল প্রজাতির মানুষ নাকি এক অদ্ভুত মন্ত্রবলে অসীম শক্তির অধিকারী হয়। মানুষের বদলে তারা নেকড়ের রূপ ধরে যুদ্ধ করতে পারত । হয়তো সেই থেকেই এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে নেকড়ে টিলা। প্রবীন লোকেরা বিশ্বাস করে সেই নেকড়ের মানবরা নাকি আজও রয়ে গেছে সুগভির অন্ধকার কোনায়। আজও পূর্নিমার রাতে শোনা যায় তাদের ক্ষুব্ধ হিংস্র চিৎকার।

চলবে

( আসসালামু আলাইকুম। এই ধরনের গল্প এইবারোই প্রথম লেখা আমার। জানিনা সব কিছু গুছিয়ে লিখতে পেরেছি কি না। এই গল্পটিতে রয়েছে একের পর এক রহস্যের মায়াজাল যা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে। নতুন এই গল্পটি কেমন লেগেছে আপনাদের জানাবেন কিন্তু। আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দয়া করে গল্পটা সবাই বেশি বেশি করে শেয়ার করবেন। যেন সবাই পড়তে পারে। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here