স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব -৩৪)

স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব -৩৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

পড়ে গিয়ে হাঁটুতে লেগেছে মায়মুনার। ব্যাথায় অস্থির তিনি। চাপা আর্তনাদ প্রতিধ্বনি তার রুমের দেয়ালে দেয়ালে। মায়ের এহেন অবস্থা দেখে রক্তশূণ্য হলো তিন ছেলের মুখ। জয়নাল আবেদীন হতবুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছেন। হাঁটুর ভেতরে দুটি এবং বাইরে দুটি লিগামেন্ট এবং দুটি মিনিস্কাস থাকে, যা একে স্থিতিশীল করে রাখে। বাইরে যদি তীব্র আঘাত পায়, তাহলে সাধারণত ভেতরের লিগামেন্টেও ওই তিন রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অনেক আশঙ্কা থাকে। এমনকি হাঁটুর ভেতরে লিগামেন্ট পুরোপুরি ছিঁড়ে যেতে পারে।
মায়মুনার অবস্থা দেখে সবার ধারণা হাঁটুর অবস্থা গুরুতর, যেহেতু আগেও সমস্যা ছিল। এবার বড়ো ধরনের সমস্যা হবে। এই আশঙ্কায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল যেন সবাই। নিজেদের ধাতস্থ করেই মাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে। মুশরাফা উদ্ধিগ্ন হয়ে শ্বাশুড়ির সাথে যেতে চাইল। জাওয়াদ কী ভেবে নিল না। জিহানকে ওর কাছে রেখে বাকি সবাই চলে গেল।

জিহানকে রাতের খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফ্যাকাশে মুখে রুমে এলো মুশরাফা। জাওয়াদকে ফোন দিল। প্রথমবার রিসিভ হলো না। দ্বিতীয়বার রিসিভ হলো। উদ্ধিগ্ন হয়ে জানতে চাইল,
‘মা কেমন আছে এখন? ডাক্তার কী বলছে?’

জাওয়াদ প্রাণহীন মলিন স্বরে বলল,
‘ পরীক্ষা নিরিক্ষা চলছে। এলে বলা যাবে। ‘

ওর এই মলিন স্বর ভালো লাগল না মুশরাফার। সে অভয় দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। মা বাবার জন্য সন্তানের করা দোয়া কবুল হয়। হতাশ হবেন না, পারলে নামাজ রুমে গিয়ে নামাজে দাঁড়ান। আল্লাহ মাকে দ্রুত সুস্থ করে দিবেন। ‘

জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ তুমি মায়ের উপর রেগে থেকো না। মাকে মাফ করে দাও প্লিজ! আর মায়ের জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করবে? আল্লাহ তোমার দোয়া কবুল করবেন হয়তো। ‘ কত আকুতি, কত অনুরোধ মাখানো ছিল ওর স্বরটা।

মুশরাফা শান্ত স্বরে বলল,
‘ আমি মায়ের উপর রেগে নেই, আর মাফ ও করে দিয়েছি। নামাজে দাঁড়াচ্ছি। আপনি ও নামাজে দাঁড়ান। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহই বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করার ক্ষমতা রাখেন।’

সেই কথার ইতি টানল এখানেই। দুই প্রান্তে থাকা দুজন মানুষ ফোন রেখে নামাজে দাঁড়াল। সেজদায়, জায়নামাজে আল্লাহর কাছে মায়মুনার সুস্থতা প্রার্থনা করল। নামাজ পড়ে মোনাজাতের পর জায়নামাজে গা এলিয়ে দিয়েছিল মুশরাফা। কখন চোখ লেগে এলো টের পেল না। ঘুম ভাঙল ফোনের শব্দে। তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। পর্দায় জাওয়াদের কল দেখেই বুক কাঁপল, মায়ের আবার ভালো খারাপ কিছু হলো না তো!
ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়েই বলল,
‘সব ঠিক আছে?’

জাওয়ার ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খুলো।’

মুশরাফা কিছু না ভেবেই সদর দরজার দিকে এগুলো। দরজা খুলে দেখল জাওয়াদ দাঁড়ানো। মুশরাফা বলল,
‘মায়ের কী অবস্থা? ডাক্তার কী বলল?’

‘বড়োধরণের ক্ষতি হয়নি। বাইরের লিগমেন্টে আঘাত লেগেছে। ফুল বেডরেস্টে থাকতে হবে কদিন। ‘ রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল জাওয়াদ। মুশরাফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সব ঠিকঠাক রেখেছেন। চিন্তায় অস্থির লাগছিল আমার।’

জাওয়াদ হাঁটা থামিয়ে পিছু ফিরে চাইল। মুশরাফার চোখেমুখে খুশির রেখা। গালে শুকানো পানির ধারার দাগ। সেজদায় মাথা ঠেকিয়ে কেঁদেছে বোধহয়।
রাত দিন কথা শুনানো মানুষটার জন্য ও এত চিন্তা করা যায়! অবাকই লাগল ওর। মুশরাফা ওর পিছু এলো। বলল,
‘চলে এলেন যে?’
‘ তুমি একা বলে, বাবা পাঠিয়ে দিয়েছেন। জিহান কোথায়?’
‘ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছি।’

জাওয়াদ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকাল স্ত্রীর পানে। ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মুশরাফা ওর শিওরে বসে ওর মাথায় আলতো হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল,
‘ সারাদিন অনেক ধকল গেছে। আপনার বিশ্রাম দরকার। আমি বিলি কাটছি, আপনি ঘুমান।’

মুশরাফা আলতো হাতে অনন্যচিত্তে বিলি কেটে দিচ্ছে। ওর হাতটা ঠান্ডা। জাওয়াদের মনে হলো মাথার সাথে সাথে ওর মনটাও মুশরাফার সংস্পর্শে শীতল হয়ে এলো। কিছু মানুষকে দেখলে, কিছু মানুষের আশপাশে থাকলেই সাহস, ভরসা এসে যায়। এই মেয়েটা সেই মানুষের দলে।

পরদিন মায়মুনাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। কদিন বিশ্রামে থাকতে বলা হয়েছে। বিছানায় পড়ে রইলেন তিনি। মুশরাফা শ্বাশুড়ির সেবায় এগিয়ে গেল। সন্ধ্যার নাস্তা রাতের খাবারের প্লেট হাতে রুমে গেল। মা আপনার নাস্তা? প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ নিয়ে হাতে তুলে দিল। মায়মুনা অসন্তোষ মনেই নিলেন। এই মেয়ের সঙ্গ ওর পছন্দ না, কিন্তু এখন না নিয়ে উপায় নেই। কাকন ওদিকটা সামলাচ্ছে।

পরদিন সকালে জাওয়াদ অফিসের জন্য তৈরি হয়ে মায়ের কাছে গেল। তখন মায়মুনা বললেন,
‘তোর বউকে বলবি আমার রুমে যেন না আসে। আমার এত সেবা যত্নের দরকার নেই। ‘

জাওয়াদ উদ্ধিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, ‘ও কিছু বলেছে তোমায়?’
‘না।’
‘ তাহলে? জিহানের পরীক্ষা, ভাবি জিহানকে নিয়ে স্কুলে চলে যাবে। ফিরবে সেই দুপুরে। মুশরাফা ও যদি এখানে না আসে, তবে এতক্ষণ তুমি একা থাকবে? তোমার যদি কিছুর দরকার হয়?’ চিন্তিত স্বরে বলল জাওয়াদ।
মায়মুনা কড়া স্বরে বলল,
‘ বুয়া আছে। আমার কিছু লাগলে বুয়ার সাহায্য নিব। তাও ওই মেয়ের কোন সাহায্য আমার চাই না। ওকে আমার সহ্য হয় না।’

জাওয়াদ মনে মনে বলল, ‘সহ্য তো আমারও হতো না। অথচ এখন?.. জাওয়াদ কী যেন ভাবল,তারপর বলল, ‘ তুমি যখন চাইছো না, তখন কী আর করার। আমি ওকে নিষেধ করব।’

মায়মুনা খুশি হলেন। জাওয়াদ মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজার দিকে না গিয়ে রুমে চলে গেল। জোর গলায় ডাকল, ‘মুশরাফা, মুশরাফা?’

খানিক পর এসে হাজির হলো মুশরাফা । হাতে টিফিন বক্স। আজ টিফিন রেডি করতে দেরি হয়ে গেল। ও ভেবেছে জাওয়াদ টিফিনের জন্য ডাকছে। রুমে ঢুকে অনুতাপের সুরে বলল,
‘স্যরি, টিফিন রেডি করতে দেরি হয়ে গেল।’

মুশরাফা ব্যাগে টিফিন বক্স ঢুকাচ্ছে। জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল,
‘শুনো?’
‘কী!’ চোখ তুলে চাইল মুশরাফা। জাওয়াদ শান্ত স্বরে বলল,
‘ কয়েকদিন বুয়া আসবে না। তুমি সব সামলাতে পারবে?’

মুশরাফা উত্তর দিতে সময় নিল না, ‘ মায়ের দেখাশুনা আর টুকটাক রান্নাই তো। তেমন বেশি কাজ নেই। পারব।’

তেমন বেশি কাজ নেই! অথচ এই মুহুর্তে ওর ঘর্মাক্ত ক্লান্ত মুখটা দেখলে যে কেউ বলবে ও রাজ্যের কাজ সামলে এসেছে। তাও কোন অভিযোগ নেই! জাওয়াদ দৃষ্টি কোমল করে তাকাল। শীতল কণ্ঠে বলল,
‘ কষ্ট হবে। তাও একটু ম্যানেজ করে নিও। মায়ের অসুস্থ থাকাকালীন সময়ে মায়ের পাশে থেকো, যতক্ষণ পারো। অবসর সময়ে তার পাশ ছেড়ো না। আমরা কেউ বাসায় নেই, আমার মায়ের দায়িত্ব কিন্তু তোমার হাতে দিলাম। দেখে রেখো, কেমন?’

স্ত্রীদের সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি হচ্ছে, ওর কষ্টটা স্বামীর বুঝতে পারাটা। বাংলাদেশে শতকরা ৯৫% পুরুষ স্ত্রীর কষ্ট বুঝেনা। একটা গৃহিণী সংসারের পেছনে কত শ্রম দেয়, কত কষ্ট করে তারা তা দেখে না, বুঝে না। উলটো হেয় করে। তারা হরহামেশাই বলে থাকেন, ‘ঘরে থেকে কী করো? কোন কাজ করো? ঘরে আর কীইবা কাজ? সারাদিন শুয়ে বসে থাকা।’ অথচ তারা যদি একদিন সংসার সামলাতে যান তবে হয়তো বুঝতে পারবেন, সংসার সামলাতে গিয়ে একটা গৃহিণী বিশ্রামের সময় পান না। প্রতিটা গৃহিণী চায়, তার স্বামী তাকে সাহায্য না করুক, অন্তত তার কষ্টটা বুঝুক। এই চাওয়াটা যখন পূরণ হয় তখন আনন্দে ভাসেন তারা। মুশরাফার ও আনন্দ হলো। চমৎকার হাসল সে। বলল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি থাকতে মায়ের কোন অসুবিধা হবে না।’

জাওয়াদ একটা দোয়া মনে করতে চাইল। এলো না। শেষে হেসে বলল,
‘আল্লাহ তোমাকে সবচেয়ে উত্তম, সবচেয়ে সুন্দর প্রতিদান দিক।’

ওর দোয়াটায় কী ছিল কে জানে? মুশরাফার হাসি চওড়া হলো। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
‘আল্লাহ উত্তম কিছু আমাকে দেয়ার সময়, আমার ভাগিদার হিসেবে আপনাকে ও দিক। সুখ, দুঃখ আমরা তো একসাথেই কাটাব। ‘

কী সুন্দর কথা! জাওয়াদ হাসল। ব্যাগ হাতে নিয়ে বলল,
‘ কাল থেকে টিফিন দিও না। বুয়া আসা অবধি আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নিব। ‘
থেমে বলল,
‘আর মায়ের সাথে সাথে নিজের ও খেয়াল রেখো। কোন সমস্যা হলে বা কিছু লাগলে ফোন দিও। আসি?’

জাওয়াদ যেন যাওয়ার অনুমতি চাইল। মুশরাফা হেসে বলল,
‘ আল্লাহ হাফেজ। ফি আমানিল্লাহ( আল্লাহর কাছে আমানত)’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here