স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-২৭)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-২৭)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

হৃদয়গ্রাহী একটা স্বপ্নের সংমিশ্রণে ঘুমের ঘোরে ভালোই ডুবেছে জাওয়াদ। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত নির্ঘুম এক রাত পাড়ি দিয়ে হোটেলে ফেরার পর ঘুমটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল। নামাজ পড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের কোলে হেলে পড়েছে। স্বপ্নময় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল কানের কানে বেজে উঠা প্রকট কোন শব্দে। বিকট শব্দে বেজে যাচ্ছে ফোন, সেই সাথে ভাইব্রেট হচ্ছে। কপালে বিরক্তির ভাজ পেলে চোখ মেলল জাওয়াদ। ফোনটা উপুড় করে পড়ে ছিল। ঘুম চোখে খেয়াল হলো ফোনটা ওর নয়, মুশরাফার। বিরক্তির ভাজটা গাঢ় হলো। তিক্ততার সাথে বলে উঠল,
‘ মুশরাফা, তোমার ফোন ঘণ্টার মতো বেজে যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছো না? থামাও, না হয় আমার হাতে তোমার ফোনের মৃত্যু হবে।’

মুশরাফার কোন সাড়াশব্দ নেই। ফোন বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। জাওয়াদ আবার চোখ বন্ধ করল। খানিক পর আবার বেজে উঠল ফোন। পুরো রুমে চোখ বুলাল, মুশরাফা নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।

জাওয়াদ একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোন বন্ধ করতে হাতে নিল। পাওয়ার বাটনে হাত দেয়ার সময় স্ক্রিনে চোখে গেল। ‘মা’ নামটা ভেসে উঠেছে। জাওয়াদ এবারও মা বলতে মায়মুনাকেই ভেবেছে। সে অবাক হলো, মা ওকে ফোন দিয়েছে! বউ শ্বাশুড়ির ভাব হয়ে গেল না কি! তেমন হলে ভালোই হবে। অন্তত প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে মায়ের অভিযোগ শুনতে হবে না।
নিজের মা যেহেতু তাই রিসিভ করাই যায়। জাওয়াদ ফোন রিসিভ করে কানে দিল।

অপাশ থেকে কর্কশ স্বর ভেসে এলো,
‘বিয়ে করে খুব বাড় বেড়েছে না তোর? আসতে বললাম আসলি না কেন? নেহাৎ তোর ফুফু বিদেশ থেকে এসে তোকে দেখতে চেয়েছেন বলে, তোকে ডাকতে হচ্ছে। নয়তো তোর ওই মুখ দেখার ও ইচ্ছে নেই আমার। মুখপুড়ি, তোর জন্মই হয়েছে আমাদের অপমান করার জন্য।….

নারী কন্ঠটা ঝাঁজালো স্বরে বলে গেল। জাওয়াদের কপালে বিরক্তির ভাজ মিলিয়ে বিস্ময়ের ভাজ মেলল। আকস্মিক কথার বাণে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। অবাক হয়ে শুনে গেল। স্বরটা ওর মায়ের নয়। জাওয়াদ ফোন সামনে আনল। এতক্ষণে খেয়াল হলো নাম্বারটাও ওর মায়ের নয়। তার মানে এটা মুশরাফার মা লায়লা আঞ্জুমান!

নামটা মনে আসতেই জাওয়াদের চোয়াল শক্ত হলো। নাজমুল সাহেবের মুখে এই মহিলার সম্পর্কে সব শুনেছে ও, শুনেছে মেয়ের সাথে তার ব্যবহার। মুশরাফার উপর অত্যাচারের বর্ণনা ও বাদ যায়নি। তখন জাওয়াদের অবিশ্বাস্য লেগেছে ব্যাপারটা। কোন মা এত পাষাণ হতে পারে! নিজের সন্তানের সাথে এমন ব্যাবহার করতে পারে! কিন্তু এই ক্ষণে মহিলার কথা শুনে মনে হচ্ছে আসোলেই পৃথিবীতে হিংস্র মা আছেন। ইনিই তার উদাহরণ। মহিলার জন্য জাওয়াদের মনে রাগ ক্ষোভ মিলেমিশে একাকার। সেই ক্ষোভের মাত্রা বাড়ল, যখন কানের অপাশ থেকে মহিলা বলে গেলেন,
‘ চুপচাপ কাল সকালে এ বাসায় এসে পড়বি। তবে হ্যাঁ, একদম ব্যাগপত্র নিয়ে থাকার জন্য আসবি না। আপাকে দেখেই বিদায় হবি। তুই আসলেই ঘরে অশান্তি শুরু হবে।আমি তা চাই না। আর শুন, পারলে তোর হতচ্ছাড়া জামাইকে ও নিয়ে আসবি।’

রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেল জাওয়াদ। চোয়ালের রগ ফুলে উঠল। কয়েকটা কটা শুনিয়ে দেবার ইচ্ছেটা প্রবল হলো। এই মহিলাকে সামনে পেলে কী করবে ও নিজেই জানে না। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে এখন কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইছে না। তাই খট করে ফোন কেটে দিল। তারপর নিজমনেই রেগে বলল,
‘ জামাইকে পাগলে পাইছে না, জামাই ও বাড়িতে গিয়ে উঠবে। জামাই মরে গেলেও সেচ্ছায় ও বাড়ি যাবে না। বউকেও যেতে দিবেনা। কেউ মরে গেলে ও না।’

জাওয়াদ রাগে ফোসফাস করছে। লায়লার রাগের আগুনে ঘি ঢেলে একটা ম্যাসেজ করল ও। ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকাল। ভেতর থেকে এখনো পানির আওয়াজ আসছে। ভাগ্যিস কলটা মুশরাফার কাছে পড়েনি। পড়লে এখন কী হতো!

ম্যাসেজ সেন্ট হওয়ার পরপরই নাম্বারটা ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দিল জাওয়াদ। তারপর ডায়াল লিস্ট থেকে ডিলিট করল, ম্যাসেজ ও ডিলিট করে দিল। কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজে মা, ভাই, বোন লেখা সবার নাম্বার ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দিল। ওই পরিবারের কারো সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন নেই। মেয়েটা এত কিছুর পরও কী ভেবে ওই বাসায় যেতে চেয়েছে ভেবেই রাগ হচ্ছে ওর। সে হলে তো জীবনে ও এমন পরিবারের দিকে ফিরে ও তাকাতো না।

শ্বাশুড়ির কথাগুলো কানে বাজছে জাওয়াদের। কী অশালীন ভাষা! কেউ নিজের মেয়ের সাথে এমন আচরণ করতে পারে! সেদিন যখন নাজমুল সাহেব ওকে মুশরাফাকে মারধরের কথা বলছিল, তখন কম হলেও দশবার জাওয়াদ প্রশ্ন করেছে, রাফা উনাদের পালিত মেয়ে? উনি সত্যিই মা? নাজমুল সাহেব প্রতিবারই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্যিই লায়লা ওকে গর্ভে ধারণ করেছে।

জাওয়াদের মস্তিষ্কে রক্ত চলকে উঠছে। চোখের শিরা উপশিরা লাল হয়ে আছে। এতটা রাগ বোধহয় ইতঃপূর্বে হয়নি। মুশরাফার প্রতি এতটা টান ও অনুভব করেনি। এই ক্ষণে এসে ওর মনে হচ্ছে মুশরাফাকে আগলে রাগা ওর দায়িত্ব। যত যাইহোক দ্বিতীয়বার মুশরাফাকে ওই আগুনে ঠেলে দিতে পারবেনা। হতে পারে সে অপছন্দের, কিন্তু শত্রু তো নয়। দিন বাড়ার সাথে সাথে মেয়েটা নিজেই ওর মনে জায়গা করে নিচ্ছে, ওকে নিজের সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করছে। এটা সহানুভূতি নয়, এটা টান। প্রথম দেখায় জন্ম নেয়া সেই টান, যা দিনের সাথে বিলীন হয়েছিল, তা যেন আবার উঁকি দিচ্ছে। এই টান কী তা ও জানে না। শুধু জানে, মুশরাফা এত কষ্টের দাবি রাখেনা। কোনভাবে ওকে আর কষ্টে দেখা যাবে না। ও ভালো মানুষ, ভালো মানুষদের সুখী হতে হয়, সুখে রাখতে হয়।

ওয়াশরুমে দরজা খোলার আওয়াজ এলো। জাওয়াদ সব মিটমাট করে পাওয়ার অফ করে ফোন রেখে দিল নিজের জায়গায়। মুশরাফা ওকে দেখেই সালাম দিল। হেসে বলল,
‘ ঘুম ভাঙল তবে!’

জাওয়াদ উত্তর দিল না, তাকাল ও না। এখন মুখ খোলা মানে রাগের বহিঃপ্রকাশ। ও রেগে গেলে সামনে যাকে পায় তার উপরই প্রকাশ করে। এখন রাগটা প্রকাশ করার ব্যাপারে ও ঘোর বিরোধী। তাই চুপচাপ উঠে বারান্দায় চলে গেল।


সূর্যরশ্মি আছড়ে পড়ছে সমুদ্রে। চিকচিক করছে জলকণা। উঁচু উঁচু ঢেউ উঠছে। একেকটা ঢেউ তীরের শুকনো বালি ভিজিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে গহীনে। বারান্দা থেকে চমৎকার সি-ভিউ দেখা যায়। আধখোলা বারান্দা। অর্ধেকাংশে সিমেন্টের রেলিঙ, উপরাংশ খোলা। জাওয়াদ রেলিঙে দুই হাত দিয়ে বিচের দিকে তাকিয়ে আছে। রোদের জন্য তাকানো যাচ্ছে না, কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রোদটাও গায়ে লাগছে। গা পুড়ে যাচ্ছে। তবুও রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না। রাগটা কিছুতেই কমছে না। মস্তিষ্ক ধপ ধপ করছে।

মুশরাফা বারান্দায় এলো। পাশে দাঁড়িয়ে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ এখনো রাগ কমেনি?’

জাওয়াদ ওর দিকে তাকাল না। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ কিছুক্ষণ একা থাকতে দাও। ‘

মুশরাফা হাসল। জাওয়াদের ছড়ানো দুই হাতের মাঝে গিয়ে দাঁড়াল। একবারে জাওয়াদের মুখোমুখি, কাছাকাছি । তারপর হেসে বলল,
‘ একা থাকতে দেয়ার জন্য তো আমি আপনার জীবনে আসিনি। একাকিত্ব দূর করব বলেই এসেছি। আমি থাকতে আপনার জীবনে একাকিত্বের জায়গা নেই।’

জাওয়াদ ওর দিকে রাগ নিয়ে তাকাল। সেই দৃষ্টিতেই আটকাল। মুশরাফা কালো শাড়ি পরেছে, খোলা এলোচুল বেয়ে পড়ছে পানি, ভেজা পাপড়ির চোখজোড়ায় কাজল টেনে হাসি হাসি চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদের চোখে কিসের যেন ঝলকানি লাগল। স্নিগ্ধ মুশরাফা ওর দৃষ্টি আটকে রাখল কিছুক্ষণ। কপালের ভাজ মিলিয়ে যেতে চাইল। সেটা টেনে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ মাথা মুছোনি কেন?’

মুশরাফা হেসে বলল, ‘ শুনেছি, ভেজা চুলে, চোখে কাজল দিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে গেলে না কি স্বামী বশ হয়ে যায়। আপনাকে বশ করার চেষ্টা করছি।’

জাওয়াদ বিরক্তির ভান করে বলল, ‘আমাকে বশ করা এত সহজ না। আমি পটছিনা। যাও মাথা মুছো। পরে আবার মানুষ অন্যকিছু ভাববে। ‘

মর্মার্থটা বোধগম্য হতেই লজ্জা পেল মুশরাফা। লোকটা কী পাজি! জাওয়াদ বিপদের আশঙ্কায় তড়িৎ চোখ ফেরাল। বলল,
‘চারদিক থেকে মানুষ দেখছে। রুমে যাও।’

মুশরাফা গেল না। আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনে নিল মাথায়। ওর মুখে হাসি। জাওয়াদ ওকে পর্দা নিয়ে ওকে সতর্ক করছে। এটাই ওর খুশির জোগান দিচ্ছে। রোদের তাপে জাওয়াদের মুখ ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। চোয়াল লাল হতে শুরু করেছে। মুশরাফা আঁচলটা একটু টেনে ওর মুখের ঘাম মুছে দিল। বলল,
‘ আপনি না গেলে আমি ও যাচ্ছিনা। ‘

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। রাগ রাগ ভাব নিয়ে বলল,
‘ এত বিরক্ত করো কেন? তোমার জ্বালায় দেখবে একদিন আমি দেশ ছেড়ে চলে যাব।’

মুশরাফা হেসে বলল,
‘পারবেন না।’
‘কেন?’

‘ বিদেশ যেতে হলেও কিন্তু আমার অনুমতি নিতে হবে।’

‘ হাও ফানি! তোমার অনুমতি নিতে হবে? না নিলে কী করবে? ভিসা, টিকেট হাতে পেলে ও পারব না!’ বিদ্রুপের সুরে বলল জাওয়াদ।
মুশরাফা শান্ত স্বরে বলল,
‘ ভিসা, টিকেট, থেকে শুরু করে সব প্রসেস হয়ে গেল। আপনার পরিবার, রাষ্ট্র, সমাজ সবাই যদি অনুমতি দিয়ে দেয়।। তবুও আপনি বিদেশ যেতে পারবেন না। যদি না আমি অনুমতি দিই। ‘

জাওয়াদ কথাটা হাওয়ায় ভাসানোর মতো করে বলল, ‘ নিলাম না অনুমতি। কে আটকাবে? তুমি?’

মুশরাফা হেসে বলল, ‘আমার ইসলাম আটকাবে। এই অনুমতির অধিকার দিয়েছে ইসলাম আমাকে।’

জাওয়াদের চোয়াল এবার গম্ভীর হলো। কৌতুক ছেড়ে বিস্মিত স্বরে বলল,
‘আর ইউ সিরিয়াস? বিদেশ যেতে হলে তোমার অনুমতি নিতে হবে?’

‘হ্যাঁ। আমার অনুমতি ছাড়া আপনি বিদেশ বা দূরে কোথাও যেতে পারবেন না। আমার অনুমতি নিয়ে তবেই যেতে হবে। আমার কাছে থেকে নিশ্চয়তা নিতে হবে, যে আপনি গেলে আমি ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারব। আমি যদি বলি আমি পারব না, তাহলে একা যেতে পারবেন না। আমাকে সাথে নিয়ে যেতে হবে। ‘ বিজয়ী হেসে বলল মুশরাফা।

জাওয়াদ অবাক হলো। এমন কিছু শুনেনি আগে সে। ওর মুখ থেকে রাগ বিলীন হয়ে কৌতুহল উঁকি দিল। উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,
‘ কেন অনুমতি নিতে হবে?’

মুশরাফা ধীর স্বরে বলতে শুরু করল,
‘ স্ত্রীর জৈবিক চাহিদা পূরণ করা স্বামীর অন্যতম একটি কর্তব্য। ভাত, কাপড়ের পাশাপাশি এটিও তার মৌলিক অধিকার। আর সামাজিক শৃঙ্খলার জন্যও এটি অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বিয়ের পর বিদেশ গমনকারীরা স্ত্রীর এ অধিকার পূরণে ব্যর্থ হয়। স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রী একা হয়ে পড়ে। সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না, চরিত্র রক্ষা করতে পারেনা। নিজের চাহিদা পূরণে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়। এ কারণে স্বামী যদি স্ত্রীকে রেখে বিদেশ যেতে চায় তবে সবার আগে স্ত্রীর কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। তার থেকে নিশ্চয়তা নিতে হবে, তার অবর্তমানে সে নিজেকে ঠিক রাখবে, ধৈর্যধারণ করবে। স্ত্রী যদি কথা দেয়, আপনার অবর্তমানে আমি নিজের চরিত্র হেফাজত করব, নিজেকে ঠিক রাখব, ধৈর্যধারণ করে থাকবে। আপনি নিশ্চিন্তে যান। তবেই স্বামী বিদেশ যেতে পারবে। আর স্ত্রী যদি বলে, আপনার অবর্তমানে আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারব না, তবে স্বামী যেতে পারবে না। অতীব আবশ্যকীয় হলে, স্ত্রীকে নিয়ে যেতে হবে, নয়তো স্ত্রীকে মানাতে হবে। যত যাই হোক, স্ত্রীর নিশ্চয়তা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ‘

মুশরাফা থামল। জাওয়াদ হতবাক হয়ে শুনল। মুশরাফা আবার বলল,
‘ ব্যাপারটা অনেকাংশেই নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রীর চাহিদার উপর। স্বামী ছাড়া একজন স্ত্রী কতদিন ধৈর্যধারণ করতে পারে, এটা তার সহজাত ব্যাপার। তারপরও এ ব্যাপারে ইসলাম সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। হজরত ওমর (রাঃ) এর এক বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়, এর সময়সীমা সর্বোচ্চ চারমাস। অর্থ্যাৎ একজন স্বামী তার স্ত্রীকে চারমাস দূরে রাখতে পারবে।’

জাওয়াদ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি আজ প্রথম শুনেছি।’

মুশরাফা গর্বের সাথে বলল, ‘দেখেছেন, আমার ইসলাম আমাকে (একজন স্ত্রীকে) নিয়ে কত ভাবে? কত মর্যাদা দিয়েছে আমাদের? এদিক দিয়ে ভিসা, টিকেট, এজেন্সি, সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার, এমনকি মায়ের ও উপরে স্ত্রীকে সর্বাধিক ক্ষমতা দিয়েছে। এজেন্সিতে শিক্ষিত লোকের দামি সাইন থেকেও একজন অশিক্ষিত স্ত্রীর একটা ‘না’ শব্দ ক্ষমতাধর। ইসলাম দিয়েছে সেই ক্ষমতা। ইসলাম একজন স্ত্রীকে বলেছে, রাব্বিয়াতুল বাইত (ঘরের রাণী) রানীর অনুমতি ছাড়া রাজা এতদূর যেতে পারে না। ইসলাম নারীকে রাণী বানিয়েছে। অথচ এসব না জানা মানুষ বলে, ইসলাম নারীর মূল্য দেয়নি। তাদের এগুলো জানা উচিত। জানলে তারাও বিশ্বাস করবে, আমার ধর্ম সুন্দর, সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ।’

গর্বে মুশরাফার মুখ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠেছে। ঠোঁটে হাসি, চোখে খুশি দেখা যাচ্ছে। নতুন কিছু জেনে জাওয়াদ বিস্ময় কাটিয়ে তখনো উঠতে পারেনি। ইসলামকে যেন নতুন রূপ জানছে ও। এভাবে বিশ্লেষণ করে জানা হয়নি। আসোলেই সুন্দর ইসলাম।

জাওয়াদ বিস্ময় কাটিয়ে উঠল। কৌতুকের সুরে বলল,

‘ তাও আমি বিদেশ যাব। ‘

মুশরাফা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘আমি কিন্তু অনুমতি দিব না।’

জাওয়াদ দুষ্টু হেসে বলল, ‘ কেন দিবে না? তুমি এত অধৈর্য! ‘

মুশরাফা লজ্জা পেয়ে চোখ সরাল। পরমুহূর্তেই জাওয়াদের চোখে চোখ রেখে মধুর সুরে বলল,
‘ আমি তো আল্লাহর জন্য আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। আপনার জন্য উত্তাল হওয়া আমার মন কিছুতেই অনুমতি দিবে না। আমি আপনাকে সারাজীবন পাশে চাই। জান্নাতে ও চাই। দূরত্ব সইতে পারব না। ‘

মুশরাফা সরল স্বীকারোক্তিতে জাওয়াদ থমকাল, ভড়কাল। মেয়েটা এখনো ওর দু’হাতের মাঝে আটকানো। দূরত্বহীনভাবে দাঁড়িয়ে হৃদয়গ্রাহী কথা বলে ফেলল। ও কিভাবে যেন কথা বলে, একবারে বুকে গিয়ে লাগে। ও স্পষ্ট টের পেল হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়াটা। বারান্দায় বয়ে আনা রাগটার অস্তিত্ব ও বিলীন হলো এই ক্ষণে। খোলস ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে ওকে বিচলিত দেখাল। নড়ে উঠল ও। পাশ ঘুরে দাঁড়াল।

বিড়বিড় করে বলল,
‘সাদাফ ভাই, তুই ভুল জানোস। ধার্মিক মেয়েগুলো আনরোমান্টিক হয়না। রোমান্টিকতার উচ্চ লেভেলে থাকে ওরা। ওদের কথা, কাজে স্বামীরা এলোমেলো, লণ্ডভণ্ড হয়ে যেতে বাধ্য।
শালা, আমি মানুষকে প্রেম শিখাতাম, অথচ এই মেয়ে আমাকেই প্রেম শিখাচ্ছে। বিনা মদে নেশা ধরাচ্ছে, বিনা তাবিজে বশ করছে। আমি আর আমি রইলাম না। সাংঘাতিক ব্যাপার স্যাপার। ‘

তারপর গলা ঝেড়ে কাশল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
‘ নাস্তা অর্ডার করেছো?’

মুশরাফা রুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলল, ‘না।’
জাওয়াদ ও পা বাড়াল, ‘কেন?’
‘ আপনার সাথে খাব বলে অপেক্ষা করছি।’

জাওয়াদ ভ্রু নাড়ল। ল্যান্ডলাইন থেকে কল দিয়ে অর্ডার দিল। তারপর ওয়াশরুমে ছুটল। দ্রুত ফিরে এলো। ওয়েটার এলো একটু পর। নাস্তা করার সময় মুশরাফা ওকে পরখ করল। চোখমুখ স্বাভাবিক হয়েছে অনেকটা, রাগ ভাব নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও। জাওয়াদ নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করল,
‘ বিচে যাবে এখন?’

মুশরাফা ঘড়ি দেখে বলল,
‘ বারোটা বাজে। বাইরে কড়া রোদ। এই রোদে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। আর মাঝে জোহরের আজান দিবে। নামাজ পড়ার জন্য আবার আসতে হবে। তারচেয়ে বরং দুপুরের পর যাই? রোদ ও কমে আসবে। আসরের নামাজ পড়ে বের হবো। সূর্যাস্ত দেখে একবারে ফিরব। ‘

চমৎকার ব্যালেন্স। জাওয়াদ মনে মনে ওর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে পারল না। সায় জানিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে। ‘

বিকেলেই বের হলো ওরা। জাওয়াদ ক্যাজুয়াল পরেছে, মুশরাফা বোরকা। বিচে তখন হাজার মানুষের ঢল। রোদ ও পড়ছে। মুখরাফা তাকাতে পারছে না। হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে এত মানুষ দেখে দাঁড়িয়ে গেল ও। জাওয়াদ ভীড়ের দিকে ছুটছিল। মুশরাফাকে দাঁড়াতে দেখে বলল,
‘ যাবে না?’

মুশরাফা ধীর স্বরে বলল, ‘এত ভীড়ে হাঁটতে পারব না। ধাক্কা ধাক্কিতে ছেলেদের গায়ে গা লাগবে। যাওয়া ঠিক হব না। গেলে অস্বস্তিতে ইনজয় করতে পারব না। ‘
মুশরাফা থামল বাঁ দিকে ইশারা করে বলল,
‘প্রাণকেন্দ্র বেশি ভীড়। অন্যদিকে অতটা নেই। আমরা নির্জন দেখে হাঁটি?’

জাওয়াদ ও পরখ করে দেখল। আসোলেই অনেক ভীড়। দাঁড়ানোর ও জায়গা নিই। ও মুশরাফার দিকে তাকাল এক পলক। তারপর অন্যদিকে হাঁটা ধরল। মুশরাফা ওকে অনুসরণ করে আসছে। হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘আপনার হাত ধরি?’

জাওয়াদ উত্তর দিল না। মুশরাফা ওর উত্তর ‘না’ই ধরে নিল। এখনো ওর সাথে হাঁটতে আপত্তি। চাপা শ্বাস ফেলে হাঁটা ধরল। সেখানেই সারি সারি হকার দোকান। জাওয়াদ একটা চশমা দোকানে ঢুকল। মুশরাফা দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জাওয়াদ ওকে ডেকে বলল,
‘পছন্দ করো।’
মুশরাফা ভাবল, জাওয়াদের জন্য পছন্দ করতে বলছে। ও কালো চতুর্ভুজাকৃতির একটা সানগ্লাস পছন্দ করে দিল। জাওয়াদ অন্য একটা ট্রায়াল দিতে দিতে বলল,
‘আমারটা আমি পছন্দ করতে পারি। নিজের জন্য পছন্দ করো।’

মুশরাফা খুশি হলো। এই প্রথম জাওয়াদ ওকে কিছু কিনে দিচ্ছে, ওর প্রতি আগ্রহ দেখাল। মুশরাফা কালচে খয়েরি একটা সানগ্লাস দেখিয়ে বলল,
‘এটা নিব?’

সানগ্লাসটা সুন্দর। মেয়েটা চয়েজসেন্স ভালো। আধুনিক। জাওয়াদ মাথা নাড়াল। তারপর দাম মিটিয়ে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে। মুশরাফা নিকাবের উপরই পরল সানগ্লাস। কয়েক কদম বাড়ায়েই জাওয়াদ ওর হাত ধরল।
গম্ভীরমুখে বলল,
‘ একা হাঁটবে না। হারিয়ে যাবে আর এখানে অজ্ঞান পার্টি থাকে, সুযোগ খুঁজে ওরা। আমার সাথে সাথে হাঁটো।’

মুশরাফা হাসল। লোকটা সরাসরি বলে না, সায় দেয় না। বাহানা দিয়ে ঠিকই পূরণ করে। ওর চোখ গেল জাওয়াদের প্যান্টের পকেটে। একটা সানগ্লাস দেখা যাচ্ছে। লোকটা বোধহয়, সানগ্লাস নিয়েই বেরিয়েছে। ওর কাছে নেই বলে, সরাসরি কিনে দিতে পারেনি। নিজেরটা লুকিয়ে নিজের সানগ্লাস কেনার বাহানায় ওকে কিনে দিল। হাসিটা এবার চওড়া হলো।

ওরা শুকনো বালুতে হাঁটছে। রোদ কোমল হয়ে আসছে। গায়ে তেমন লাগছে না। হাঁটতে হাঁটতে নির্জনে এসে গেছে ওরা। এদিকে মানুষজন নেই তেমন। মুশরাফা জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিল। মুশরাফা উৎফুল্ল হয়ে গেল আকস্মিক। জাওয়াদের হাত টেনে সমুদ্রের দিকে নিয়ে গেল।

ঢেউ যেখানে এসে মিশে যাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে বলল,
‘জুতা হাতে নিয়ে হাঁটুন। খালি পায়ে ভেজা বালিতে হাঁটার মজাই আলাদা। সেই মজা দিগুণ হয়, যখন ঢেউ এসে পা ভিজিয়ে দিয়ে যায়। ‘

ইতঃপূর্বে বন্ধুরা মিলে এসে ঘন্টার পর ঘন্টার পানিতে বসে ছিল, গোসল করেছে। হাঁটার অভিজ্ঞতা ও আছে। তবুও আজ কেন যেন নতুনত্ব লাগল ওর কাছে। জুতা হাতে নিয়ে হাঁটা ধরল ও। রোদ কমে আসছে। কোমল আলোয় সমুদ্রের কোল ঘেঁষে প্রিয়তমার হাত ধরে হাঁটার অনুভূতিটা বুঝি অনন্য। আজ টের পেল জাওয়াদ। মেয়েটার অভিজ্ঞতা ভালো। মুশরাফা প্রফুল্লচিত্তে বলল,

‘আমি যতবার এসেছি, ততবারই এভাবে হেঁটেছি। তবে এবার নতুন লাগছে। হানিমুন বলেই বোধহয়। ‘

জাওয়ার কিছু বলল না। সমুদ্রের দিকে তাকাল। মুশরাফা ও তাকাল। সূর্য হেলে পড়ছে। মুশরাফা ঠিক যেখানটায় শুকনো বালি শুরু হয়েছে, সেখানে জুতা রেখে, জুতার উপর বসে পড়ল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘বসলে কেন?’
‘সুর্যাস্ত দেখব। আপনি ও বসুন।’ জাওয়াদকে টেনেই বসাল।

মুশরাফা পা ভেঙে মেলে দিল। ঢেউ এসে পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। ঠান্ডা লাগছে, গায়ে হিমেল হাওয়া বইছে। সানগ্লাস খুলে হাতে নিয়েছে। দৃষ্টি রক্তিম সূর্যটার দিকে। ওর চোখে মুখে মুগ্ধতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে জাওয়াদের কাধে মাথা রাখল। ওদের হাত একটু একে অপরের ভাজে আটকানো। মুশরাফা হাতের বাধন শক্ত করে বলল,
‘ বৃদ্ধ হলে ও লাঠি ভর দিয়ে এখানে চলে আসব, আপনার কাধে মাথা রেখে এভাবেই সুর্যাস্ত দেখব ইন শা আল্লাহ। মনে থাকবে?’

জাওয়াদ ওর দিকে চাইল। এত অনুভূতি নিয়ে, ঘটা করে সুর্যাস্ত দেখতে কাউকে দেখেনি সে।

সূর্য ডুবার পরপরই মাগরিবের আজান ভেসে এলো। আজান কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই মুশরাফা উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ নামাজের সময় হয়ে গেছে। চলুন, হোটেলে ফিরি।’

‘এখনই চলে যাবে?’
‘হ্যাঁ। এশার নামাজ পড়ে আবার আসব। চাঁদের আলোয় সমুদ্রকোলে হাঁটব, সমুদ্রে নামব।’

মানুষের সাধারণত ঘুরতে গিয়ে প্রকৃতিতে এতটাই মুগ্ধ হয় যে, নামাজ মিস দেয়। নামাজের জন্য ফিরে না, হেলেদুলে ঘুরাফিরা শেষ হলেই ফিরে। অথচ এই মেয়েটা টাইম মেইনটেইন করে এসেছে। ঘুরেছে, একটা নামাজ ও কাযা হয়নি, আবার ফিরে যাচ্ছে। জাওয়াদ অবাক হয়ে দেখে গেল সব। এভাবেও ঘুরাঘুরি হয়! করা যায়!

চলবে…

ফুটনোট:

খলিফাতুল মুসলিমিন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি ফরমান স্মরণীয়। একদা তিনি এক বিরহিণী নারীকে এই কবিতা পাঠ করতে শুনলেন—
(বাংলাতে যার অর্থ)
বীভৎস এ রজনী হয়েছে আরও প্রলম্বিত
নাহি আজ প্রেমাস্পদ মোর আকাঙ্ক্ষিত।
আল্লাহর ভয় যদি না থাকতো এ অন্তরে
পালঙ্ক মোর কলঙ্কিত হতো প্রণয়ের ভারে।

এরপর তিনি তার কন্যা উম্মুল মুমিনিন হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞেস করলেন,

‘মেয়েলোক স্বামী ছাড়া সর্বোচ্চ কতদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধরে থাকতে পারে?’

হাফসা বললেন, ‘চার মাস অথবা ছমাস।’

তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন,
‘মুজাহিদদের মধ্যে কাউকে আমি এ সময়ের অধিক যুদ্ধে আটকে রাখব না।’

তিনি খলীফাতুল মুসলিমিন হিসেবে সব সেনাপতিকে লিখে পাঠালেন। উপরোক্ত সময়ের অধিক কোনো বিবাহিত মুজাহিদই যেন তার স্ত্রী-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন না থাকে। [ইবনু কাসির : ১/৬০৪, বাইহাকি : ১৮৩০৭]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here