#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি,পর্ব-২৪,২৫
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
২৪
মুশরাফা আলতো হাতে জাওয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জাওয়াদের চোখ বন্ধ। গায়ের কাঁপুনি তখনো থামেনি, মুখভঙ্গি ও পরিবর্তন হয়নি। মুশরাফার চেহারায় আতঙ্কের রেখা, মনে মনে দোয়া পড়ছে। সে নিশ্চিত মাইগ্রেনের ব্যাথা নয় এটা, মাইগ্রেনেএ ব্যাথায় গায়ে কাপুনি দেয়না। মুশরাফা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করল,
‘ মাইগ্রেনের ব্যাথায় গায়ের কাঁপুনি হয়না। আপনার কী হয়েছে বলুন তো! কোথায় ব্যাথা হচ্ছে? আমাকে বলুন!’
জাওয়াদ নিশ্চল শুয়ে রইল, উত্তর দিল না। মুশরাফা আবার বলল,
‘আচ্ছা আপনি বসেন, আমি জমজমের পানি নিয়ে আসি। ‘
মুশরাফা উঠতে নিল। জাওয়াদ ওর হাত ধরে বসিয়ে বলল, ‘ কিছু আনতে হবে না। এমনিই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি মাথা টিপে দাও।’
মুশরাফা আবার বলল, ‘ একবারে খাচ নিয়তে, দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে জমজমের পানি পান করলে মনের আশা পূর্ণ হয়, সেই সাথে রোগ সারে। নিয়ে আসি না একটু!’
জাওয়াদ দিল না। অগত্যা ওকে থাকতে হলো। জাওয়াদের মাথা টিপে দিলে। মিনিট পাঁচেক গড়াল এভাবে। আকস্মিক জাওয়াদ উঠে বসল। বলল,
‘আমি বাসায় যাব।’
মুশরাফা পরখ করল ওকে। ওর চোখ মুখ স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। মুশরাফা প্রশ্ন করল,
‘আপনার তো আজ থাকার কথা ছিল।’
জাওয়াদ বিরক্তভরা চোখে বলল, ‘তোমাদের এখানে মশাগুলো ঠিক তোমার মতো। ভীষণ বিরক্ত করে। রাতে ঘুম হয় নি। বাসায় গিয়ে ঘুমাব।’
‘আর আসবেন না?’
জাওয়াদ উত্তর দিল না। উঠে তৈরি হয়ে নিল। বিদায় বেলা ওকে দরজা অবধি এগিয়ে দিল মুশরাফা। দরজা বন্ধ করার সময় বলল,
‘ দুপুরে না হলে রাতের খাবারে যোগ দিয়েন। মামা মনে কষ্ট নিবেন।’
‘দেখা যাক।’
জাওয়াদ নিচে না গিয়ে উপরে গেল, অনিকের বাসায়। হেসে বলল,
‘কিরে বিয়াত্তা ভদ্রলোক, কী খবর তোর?’
জাওয়াদ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল, ‘বউ নেই বাসায়। কোথায় একটু বন্ধুর বাসায় গিয়ে চিল করব। তার জো নেই। তুই শালা, থাকোস শ্বশুরের মাথার উপর। তোর বাসা বদলা। ‘
অনিক ও হেসে বলল, ‘ তুই এই বিল্ডিংয়ে বিয়ে করার পর ব্যাপক সুবিধা পাচ্ছি। নাজমুল আংকেলের বাসায় ভালো মন্দ রান্না হলেই বক্স ভর্তি খাবার চলে আসে। সেই সাথে ফ্রি দাবাত সাবাত তো আছে। আমার মাসিক খাবার খরচ অর্ধেক বেঁচে যায়। একটা ফ্ল্যাট দেখেছি, খাবার টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনব। তারপর ও এই বাসা ছাড়ব না। ফ্রিতে খেয়ে যাব। এত সুবিধা কই পাব বল? বাসা বদলানো যাবে না। ‘
জাওয়াদ রেগে বলল, ‘আমার চিল উড়াই নিয়ে তুই ফ্ল্যাট কিনবি? কিনাচ্ছি তোরে। আমি আজই মামীকে বলব, তোর ডায়েবিটিস ধরা পড়ছে, মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া মানা। আর পাইলসের সমস্যা বেড়েছে। মশলা জাতীয় খাবার হারাম তোর জন্য।’
অনিক ক্ষুব্ধ হয়ে তাকাল, ‘ অল্প একটু খাবারের জন্য আমাকে পাইলস আর ডায়েবেটিসের রোগী বানিয়ে দিলি! তোর মতো বন্ধু শত্রুর ও না হোক। যাহ খাবো না তোর মামা শ্বশুরের বাসার খাবার। ‘
জাওয়াদ দায়সারাভাবে বলল,
‘খাস না। চল এখন বেরুবো।’
‘কই যাবি।’
‘লং ড্রাইভে যাব।’
অনিক ওকে পরখ করল অন্তর্ভেদী নজরে। তারপর বলল,
‘ তুই কি কোন কারণে আপসেট?’
জাওয়াদ সরাসরি উত্তর দিল না। বিরস মুখে বলল,
‘ কেমন যেন অশান্তি লাগছে। চল কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।’
অনিক কয়েকবার জিজ্ঞেস করল, জাওয়াদ মুখ খুলল। বার দুয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
নাজমুল সাহেব বাইরে থেকে এসে শুয়েছেন। উঠে জাওয়াদকে নাস্তার টেবিলে জাওয়াদকে খুঁজলেন। মুশরাফা চেয়ার টেনে বসে বলল,
‘নামাজ থেকে ফিরেই উনার শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাই বাসায় চলে গেছেন। নামাজ পড়তে গিয়ে কোন সমস্যা হয়েছিল মামা?’
কথা শুনে দুঃখিত হওয়ার কথা থাকলেও নাজমুল সাহবকে একটুও ব্যথিত দেখাল না। উনি প্রশান্তিময় হাসি দিলেন। তাকে ভীষণ খুশি দেখাচ্ছে। হাসি থামিয়ে বললেন,
‘কিছু হয়নি। বাসায় যাবে বলছিল। গেছে বোধহয়। ফিরে আসবে আবার। ‘
মামা কিছু মনে করেন নি, এতে স্বস্তি ফেল মুশরাফা। খাবার শেষ করে উঠে গেল। ফরিদা স্বামীকে পরখ করে বললন,
‘ তোমাকে এমন খুশি দেখাচ্ছে কেন?’
‘ মেয়ে বিয়ে দেয়ার পর বাবা যখন নিশ্চিত হয়, পাত্রটা ভালো পড়েছে। তার মেয়ের খেয়াল রাখবে। অতীতের কষ্ট ভুলিয়ে দিবে। তখন বাবাদের খুশি হতে হয়।’ আবার হেসে বললেন নাজমুল সাহেব।
ফরিদা চমকালেন। অবাক চোখে চাইলেন স্বামীর দিকে,
‘তুমি সব বলে দিয়েছো?’
নাজমুল সাহেব সে উত্তর দিলেন না। হেসে বললেন,
‘ তখন তুমি যদি ওর মুখভঙ্গি দেখতে, খুশিতে মরে যেতে। আমরা এমন কাউকেই চেয়েছি ওর জন্য।’
•
অমীমাংসিত রহস্যের সাথে পাল্লা দিয়ে এগুচ্ছে সময়। মুশরাফা এখনো ভেবে উঠতে পারছে না, জাওয়াদের হয়েছেটা কী? বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক ও যেন কাজ করছে না। আন্দাজ করতে পারছে না কোন কারণ? কী হতে পারে? এখন কেমন আছে? বেশ কয়েকবার ফোন দিল, জাওয়াদ ধরল না। দুপুরের পর মুশরাফা ভিডিয়ো কল দিল। জাওয়াদ তখন জুম’আর নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বেরিয়েছে। এখানে অনেক মানুষ। জাওয়াদ ফোন ধরল না। মানুষ কমে এলো। ওরা মসজিদ থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরল। মসজিদের সামনে বিশাল খালি মাঠ। চারপাশে গাছ, জায়গাটা নিরিবিলি। জাওয়াদ জায়গাটা পরখ করতে করতে অনিককে বলল,
‘তুই দাঁড়া, আমি কথা বলে আসি।’
অনিক সায় জানাল। জাওয়াদ একটা গাছের নিচে দাঁড়াল। চারদিকে চোখ বুলাল কেউ আছে কি না, নাহ্ নেই। নিশ্চিত হয়ে কল ব্যাক করল। মুশরাফা ওর কলেরর অপেক্ষাতেই ছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কল ধরল। মিষ্টিসুরে বলল,
‘আসসালামু আলাইকুম। আপনি ঠিক আছেন? কল দিলাম ধরলেন না কেন? এখন কেমন আছেন? মাথা ব্যাথা কমেছে? ‘
উদ্ধিগ্ন হয়ে প্রশ্নঝুলি খুলে বসল মুশরাফা। রোদের চটা পড়ছে। তাকানো যাচ্ছে না। জাওয়াদ চশমা পরে নিল। তারপর ফোন বাকিয়ে তাকাল ফোনের দিকে। অন্তর্ভেদী চোখে মুশরাফার কপালের চিন্তার ভাজ, উদ্ধিগ্ন চোখ পরখ করল। ধীর স্বরে বলল,
‘ আমি ঠিক আছি।’
‘ অন্তত একটা ফোন বা ম্যাসেজের রিপ্লাই দিতে পারতেন।’ কাতর গলায় বলল মুশরাফা। জাওয়াদ বলল,
‘ফোনে চার্জ ছিল না। ‘
মুশরাফা লম্বা শ্বাস নিল। তারপর বলল, ‘খেয়েছেন কিছু? ‘
‘ যাচ্ছি।’
‘খাওয়া শেষে চা কফি, চকলেট ফ্লেভারের কিছু নিবেন না। মাইগ্রেনের ব্যাথা বাড়বে। ‘
মুশরাফা ল্যাপটপ খাটে কোলে বালিশ নিয়ে বসে কথা বলছে। বালিশের উপর কনুই ঠেকিয়ে হাতের তালুতে মুখ রেখে, গালে হাত দিয়ে এটা সেটা বলছে। হাত হাতা হওয়ায় হাতের কনুইর আশপাশে বেশ কটা কালসিটে দাগ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আকস্মিক দাগ গুলোয় চোখ পড়ল জাওয়াদের। তৎক্ষনাৎ চোখে ভাসল মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালের বেডে বসে থেকে মুশরাফার চেহারাটা। গা শিউরে উঠল ওর। বলল,
‘ আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না। খেয়ে ঘুমাও। ‘
মুশরাফা এলেই নাজমুল সাহেব ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। আজ ফাবিহা ও আছে। ভাবলেন সবাইকে নিয়ে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসবেন। দুপুরের খাবার টেবিলে জানালেন খবরটা। মুশরাফার মনে আক্ষেপ জাগল, যদি জাওয়াদ ও যেত! মুখ ফুটে কিছু বললেন না। বিকেলে ওরা ফুলের সমারোহ এক বাগান বাড়িতে ঘুরতে গেল। সবাই আছে, তবুও মুশরাফার একা একা লাগছিল। একজন মানুষের শূন্যতা ওকে পোড়াচ্ছিল। ফাইজা এসেই ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাকিরা সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে। কিছুক্ষণ হেঁটে নাজমুল সাহেব আর ফরিদা হাঁফিয়ে উঠল। কিছুদূর পর পর বসার বেঞ্চ আছে।
তারা বেঞ্চে বসে পড়লেন। ফাবিহা আর মুশরাফা ঘুরে ঘুরে দেখছে। ফাইজা ও যোগ দিয়েছে ওদের সাথে। ফাইজা জিজ্ঞেস করল,
‘ হানিমুনে যাচ্ছো না আপু?’
মুশরাফা খানিক চুপ থেকে বলল, ‘যাব ইনশা আল্লাহ। ‘
ফাবিহা বলল,
‘জাওয়াদকে কল দিয়ে আসতে বল। নবদম্পতির একটু ঘুরাঘুরি হয়ে যাক। ‘
মুশরাফা কী বাহানা দিবে খুঁজে পেল না। ওকে সাধলে ও আসবেনা। সত্য ও বলতে পারল না, মিথ্যা তো পারলই না। চুপ রইল। খানিক পরে ফাইজা বলল,
‘ তোমার একাকিত্ব কাটাতে ভাইয়া এসে হাজির। ‘
মুশরাফা চমকে তাকাল। জাওয়াদ নাজমুল সাহেব আর ফরিদার সাথে কথা বলছে। মুশরাফা অবিশ্বাস্য চোখে চাইল। উনি সত্যিই এসেছেন! মুশরাফার বোরকাটা দেখলেই ওর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়, এখন সেই বোরকার সাথে থাকতে হবে জেনে ও এসেছেন! ফাবিহা বলল,
‘চল ওদিকে।’
সবাই মিলে জাওয়াদদের কাছে গেল। মুশরাফা অবাক চাহনি দিল। জাওয়াদ তাকাল না। ফাইজা চট করে বলে ফেলল,
‘ ভাইয়া এসে গেছে রাফাপু এবার একটু হাসো। ‘
তারপর জাওয়াদের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ভাইয়া জানেন, রাফাপু এতক্ষণ মন খারাপ করে ছিল। আপনাকে মিস করছিল।’
মামা মামীর সামনে এভাবে বলায় লজ্জা পেল মুশরাফা। ইতিউতি করল। জাওয়াদ চোখ তুলে তাকাল, মুশরাফার চোখে চোখে রেখে ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফা ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ফাবিহা মিটিমিটি হাসছে।
নাজমুল সাহেব আর ফরিদা ইতস্ততবোধ করে উঠলেন। নাজমুল সাহেব উঠে বললেন, ‘তোমরা বসো, আমি কিছু অর্ডার দিই।’
একটা ফুচকাওয়ালা দেখা গেল। ফাইজা এক প্রকার লাফিয়ে উঠে বলল, ‘ফুচকা খাব, বাবা।’
নাজমুল সাহেব মুশরাফাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কী খাবি?’
মুশরাফাও ফুচকার কথা বলল। সবাইকে জিজ্ঞেস করে অর্ডার দেয়া হলো। তিন প্লেট ফুচকা আর তিন প্লেট চটপটি। খাবার এলো। জাওয়াদ অন্তর্ভেদী চোখে চেয়ে রইল। চারপাশে মানুষের ভীড়। এত মানুষের সামনে মুশরাফা খাবে কিভাবে এটাই দেখার বিষয়।
ফরিদা বেঞ্চে বসা ছিলেন। নাজমুল সাহেব উনার হাতে চটপটি প্লেট তুলে দিতেই উনি দাঁড়িয়ে গেলেন। মুশরাফাকে বসতে বললেন। মুশরাফা চুপচাপ বসে গেল। ফরিদা মুশরাফার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চটপটির প্লেট হাতে নাজমুল সাহেব ও ফরিদার পাশে দাঁড়ালেন। ফুচকার প্যাকেট প্লেট হাতে ফাবিহা এসে দাঁড়াল ফরিদার অন্যপাশে। ফাইজাও যোগ দিল। নাজমুল সাহেব জাওয়াদকে মুশরাফার পাশে দাঁড় করালেন। মুশরাফা নিকাব খুলে একটা ফুচকা মুখে নিল। সবার খাওয়া শুরু হলো। জাওয়াদ অবাক হয়ে চাইল। মুশরাফাকে ঘিরে দাঁড়ানো সবাই।ওকে বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে না। সবার হাতে খাবার প্লেট, খেতে খেতে কথা বলছে। বাইরে থেকে মনে হবে একটা গ্রুপ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কী চমৎকার পদ্ধতি! মুশরাফার পর্দা রক্ষার জন্য এদের পদক্ষেপটা ভালো লাগল জাওয়াদের। পর্দা রক্ষা করেও পাব্লিক প্লেসে যে খাওয়া যায় আজ না এলে জানতো না ও। কী সুন্দর! মেয়েটা উৎফুল্লতার খাচ্ছে খাচ্ছে, এতে যেন সে অভ্যস্ত। খাওয়া শেষ হলো, মুশরাফা আবার নিকাব করে ফেলল।
সবাই প্রাণখুলে ঘুরছে। সবার মাঝখানে মুশরাফা। হাজার লোকের ভীড়। ধাক্কা লাগছে। নাজমুল সাহেব ডাল হয়ে ওকে পার করছেন, কারো সাথে লাগতে দিচ্ছেন না। ওর পর্দা লঙ্ঘন যাতে না হয় তার খেয়াল রাখছে সবাই। ওকে সবাই আগলে রাখছে। মজা করছে, খাচ্ছে। পর্দা নিকাব কোন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না। এদের দেখে মনে হচ্ছে, পর্দা কোন ইস্যুই না। জাওয়াদ অবাক হয়ে দেখে গেল, শিখে গেল নতুন কিছু। প্রশ্ন জাগল মনে, আমাকে ও এমন ঢাল হওয়া উচিত।
ফাবিহা ওদের স্পেচ দিল। বাবা মাকে ইশারা করে সরে গেল। অন্যদিকে চলে গেল সবাই। মুশরাফা ওর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
‘ হাঁটবেন আমার সাথে? ‘
জাওয়াদ হাত ধরল না। হাঁটা ধরল। সময় গড়ানোর সাথে সাথে। মানুষের ভীড় বাড়ছে। ভীড়ের কাছে গিয়ে জাওয়াদ নিজেই হাত ধরল। বলল,
‘ একা হাঁটবে না। হারিয়ে গেলে সবাই আমাকে দোষ দিবে।’
মুশরাফা হাসল। হাতে হাত রেখেই এগুলো। ঘুরে ফিরে ওরা রেস্টুরেন্টে গেল। প্রবেশ পথের একটা টেবিলে এক দম্পতি বসে আছে। মেয়েটা শাড়ি পড়েছে, ছেলেটা পাঞ্জাবি। হাতে হাত বসে হেসে গল্প করছে। হুট করেই ওর আফসোস হলো। ও কখনো ওর স্ত্রীর সাথে এভাবে বসে খেতে পারবেন। ওর স্ত্রী তো শাড়িই পরে না, সাজে ও না। এই ইচ্ছেটা বোধহয় অপূর্ণ রয়ে যাবে। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল ও।
এবার গোয়েন্দা চোখে তাকাল। মুশরাফা সবার মাঝে কিভাবে খায় দেখার জন্য। জাওয়াদ একটা টেবিলে বসতে গেলে নাজমুল সাহেব বললেন,
‘ দুই মিনিট অপেক্ষা করো বাবা।’
বলে উঠে গেলেন। কৌতুহল বশত জাওয়াদ ও গেল পিছু। ওকে অবাক করে দিয়ে নাজমুল সাহেব একটা কেবিন বুক করলেন। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল,
‘কেবিন বুক করলেন কেন মামা? টেবিল তো খালিই ছিল।’
নাজমুল সাহেব হেসে বলল, ‘ এখানে বসে খেতে গেলে রাফার পর্দা লঙ্ঘন হবে। নিকাবের ভেতরকে খেতে চাইলে ও স্বস্তিতে খেতে পারবে না। তাই আমরা যখনই আসি কেবিন বুক করে নিই।’ নাজমুল সাহেব কথার ভাজে জাওয়াদকেও একটা ইঙ্গিত দিলেন। জাওয়াদ বুঝল এবার। কেবিনে গিয়ে বসল সবাই। মুশরাফা নিকাব খুলে ফেলেছে। সবার সাথে গল্প করছে। চিকেন শর্মা, চিজ পাস্তা, বড়ো সাইজের পিৎজা অর্ডার করা হয়েছে। অর্ডার এলো। মুশরাফা বাসায় থাকার মতো নিঃসঙ্কোচে খেতে শুরু করল। জাওয়াদ ওর পাশেই বসা। চিকেন শর্মায় কামড় বসিয়ে বলল,
‘এখানকার চিকেন শর্মা ভীষণ মজা। টেস্ট করে দেখুন।’
জাওয়াদ পরতে পরতে নতুন তথ্য জানতে পারছে। রেস্টুরেন্টে বসে এভাবেও খাওয়া যায়? আজ অবাক হওয়ার পালা ওর। বিস্ময়ের সাথে মুখে নিল। আসোলেই টেস্ট ভালো। এই মেয়ের রেস্টুরেন্টে আসা হয় তবে। সাদাফের কথাটা ভুল প্রমাণ হলো।
খাওয়া দাওয়া শেষে রেস্টুরেন্টে বের হলো সবাই। জাওয়াদ মুশরাফা পিছনে আসছে। বাকিরা আগে আগে হাঁটছে। একটা লোক ফোন টিপতে টিপতে এগিয়ে আসছে। কয়েক কদম বাড়ালেই মুশরাফার সাথে ধাক্কা লাগবে। জাওয়াদ দেখল ব্যাপারটা। লোকটা কাছাকাছি আসতেই বলল,
‘ভাই, সাবধানে হাঁটেন।’
লোকটা ফোন থেকে চোখ তুলে তাকাল। পরিস্থিতি বুঝে স্যরি বলে পাশ কাটল। মুশরাফা মুচকি হাসল। বলল,
‘ এখন বাসায় যাবেন না?’
‘না। এক বন্ধুর হলুদ। ওখানে যাব।’
‘ফিরবেন কখন?’
‘রাত হবে।’
‘একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন।’
‘কেন?’
‘আপনার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে?’
‘সারপ্রাইজ! ‘ অবাক হলো জাওয়াদ। মুশরাফা হেসে বলল,
‘হ্যাঁ।’
জাওয়াদ বিড়বিড় করে বলল, ‘ তোমার প্রতি পদে পদে সারপ্রাইজ হচ্ছি। আবার ঘটা করে কী সারপ্রাইজ দিবে? তুমি মেয়েটাই তো একটা সারপ্রাইজ।’
মুখে বলল, ‘কী সারপ্রাইজ! ‘
‘ এলেই দেখতে পাবেন।’
চলবে..
#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। (পর্ব-২৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
গহীন রাত। নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে গেছে প্রকৃতি। ঝিঁঝিপোঁকা ডাকছে দূরে। ঘুমন্ত শহরের কোল ঘেঁষে বন্ধুর হলুদের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছে জাওয়াদ। দরজার সামনে এসে ঘড়িতে সময় দেখল, ২টা ২২মিনিট। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়। এত রাতে কলিংবেল চেপে সবাইকে জাগানো ঠিক হবে না। তাই মুশরাফাকে ম্যাসেজ করল,
‘ জেগে আছো? দরজা খুলো।’
ম্যাসেজের রিপ্লাই এলো না। জাওয়াদ ধরে নিল মুশরাফা ঘুমিয়ে পড়েছে, সে অনিকের বাসায় যাওয়ার মনস্থির করল। অনিক ও ওর সাথে ফিরেছে। জেগে আছে এখনো। ওর ভাবনার মাঝে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল,
‘দরজার কাছে যে ফুলের টবটা আছে, সেখানে গাছের শিকড়ের উপর পাথর চাপা দেয়া আছে বাসার এক্সট্রা চাবি। পাথর সরালেই পেয়ে যাবেন। চাবি দিয়ে চলে আসুন।’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মেয়েটা যখন জেগে আছে নিজে এসেই তো দরজা খুলতে পারে। এত রহস্য করছে কেন? কী জানে মেয়েটার মাথায় কী চলছে। বন্ধুর হলুদে নাচানাচি হৈ-হুল্লোড় হয়েছে। ক্লান্ত লাগছে এখন। ক্লান্ত শরীরটা বিশ্রাম চায়। জাওয়াদ আর কিছু না ভেবে এক্সট্রা চাবি নিয়ে সদর দরজা খুলে ভেতরে গেল। মুশরাফার রুমের কাছে গিয়ে দেখল দরজা ভেতর থেকে বন্ধ । জাওয়াদ নক না করে ডাকল,
‘মুশরাফা?’
তড়িৎ দরজা খুলে গেল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে এক অপরূপা। পরনে যার মেরুন রঙা ভারি কাজের শাড়ি। চেহারায় আবৃত প্রসাধনীতে। ঠোঁটে মেরুন লিপস্টিক, চোখ টানা কাজলে, শ্যাডো, আইলাইনার, মাশকারায়। সুন্দর মুখটায় গোলাপী আভা টানতে ব্লাশ ও লাগিয়েছে। মোমবাতি হাতে তার, মোমবাতির আলোয় মুখে ছোঁয়া হাইলাইটার তার রূপের সাথে তাল মিলিয়ে ঝিলিক দিচ্ছে। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! নজর ফেরানো দায়! মেয়েটা সাজতে ও পারে! সাজলে তো ওকে সুন্দর লাগে, তবে সাজে না কেন?’
জাওয়াদের একবার মনে হলো এসব মনের কল্পনা। হলুদে ওর বিবাহিত বন্ধুরা বউ নিয়ে গিয়েছিল। সেজেগুজে টিপটপ হয়ে আসা ভাবিদের সুন্দর লাগছিল। বন্ধুদের সাথে কাপল পিক তুলছিল। সবাই জিজ্ঞেস করছিল, ওর বউকে আনেনি কেন। ও জবাব দিতে পারেনি। বলতে পারেনি, ওর বউ সাজেনা, এভাবে বাইরে যায়না। ওদের দেখে জাওয়াদের মনে আফসোসের পাল্লা ভারি হয়েছিল। সেই আফসোস থেকেই মনের কল্পনা হতে পারে। জাওয়ার চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল। ওকে সত্য মিথ্যার দ্বিধা থেকে মুক্ত করতে মুশরাফা চমৎকার হেসে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
জাওয়াদের ঘোর কাটল। অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,’
‘ এটি সত্যিই তুমি!’
মুশরাফা হেসে ফেলল। মোমবাতির আলোয় হাসিটা চমৎকার লাগল। ঘোর লাগছে আবার। মুশরাফা হেসেই বলল,
‘ এটা আমিই, আপনার অর্ধাঙ্গিনী।’
জাওয়াদের বিস্ময় কাটছেনা। ও স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, কিছুক্ষণ, অনেক্ষণ। আকস্মিক ঘোর থেকে বেরিয়ে ভ্রু কুঁচকাল,
‘এত রাতে সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো?’
মুশরাফা ভারি অবাক হওয়ার ভান করে বলল,
‘আপনার মনে হচ্ছে, আমি সেজেগুজে অন্যকোথাও, অন্যকারো সামনে যাব! ‘
‘ মানুষ বাইরে বেরুনোর আগেই তো সাজে। না বেরুলো সেজেছো কেন?’ ভ্রু কুঁচকাল জাওয়াদ। মুশরাফা বলে,
‘ বাইরে বেরুনোর আগে লোক দেখানোর জন্য সাজা হলো আপনার সমাজের প্রথা। কিন্তু আমার ইসলামের প্রথা হলো, ঘরে সাজা, একান্ত ব্যক্তিগত ব্যক্তির জন্য। আমাকে এভাবে দেখার অধিকার তো তারই।’
‘মানে?’ বুঝল না জাওয়াদ।
‘ আপনিই আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যক্তি, যে আমাকে এই রূপে দেখার অধিকার রাখে। আমার সৌন্দর্য আপনার জন্যই উৎসর্গ। শুধু আপনার জন্য।’ আলতো স্বরে জাওয়াদের চোখে চোখ রেখে চমৎকার হেসে বলল মুশরাফা।
এই মনকাড়া হাসি, এই নজরকাড়া চাহনি, আর হৃদয়গ্রাহী কথা তীরের মতো বুকে গিয়ে বিধল। ওর ভেতরটা নাড়িয়ে দিল। মনে মনে বিস্মিত স্বরে বলল, ‘আমার জন্য!’
মুশরাফা ওর চোখে চোখ রেখে চেয়ে আছে। মোমবাতির আলোয় ওকে সুন্দর লাগছে, আকর্ষণীয় লাগছে। মোহনীয় একটা ঘ্রাণ আসছে। এই মেয়ে পারফিউম ও ইউজ করে? অবাক হলো জাওয়াদ।
জাওয়াদ স্পষ্ট টের পেল, ভেতর থেকে গুড়িয়ে যাচ্ছে ও। নিজেকে ঠিক রাখার জন্য গম্ভীরটা টানল মুখে। বলল,
‘তো আমাকে কী করতে বলছো তুমি?’
মুশরাফা জাওয়াদের হাত ধরে বারান্দার দিকে নিয়ে গেল। বারান্দার ভেতরে চোখ যেতেই আরও অবাক হলো। বারান্দায় ফুলে ভরা টবে ঘেরা। দেয়ালে আটকানো ফেইরি লাইট। ঠিক মাঝে একটা টেবিল। মুখোমুখি দুটো চেয়ার। টেবিলে কয়েক পদের খাবার রাখা। মাঝে একটা কেক ও রাখা। টেবিলের মাঝে মোমবাতি জ্বলছে। চারপাশে বর্ণিল মরিচ বাতি আলো ছড়াচ্ছে। মোহনীয় এক পরিবেশ তৈরি করেছে। মুশরাফা জাওয়াদের হাত ছেড়ে দিল। পরপরই ওর দিকে মেহেদি রাঙানো হাত বাড়িয়ে দিয়ে প্রেমময় স্বরে বলল,
‘Will you join me for a lovely midnight dinner date?’
মুশরাফার বলার ভঙ্গি অসাধারণ। ওর কথাবার্তা, মুখভঙ্গি, সাজসজ্জায় দারুণভাবে স্মার্টনেস প্রকাশ পাচ্ছে। ঠিক আজকালকার মর্ডান মেয়েদের মতো। মুশরাফার এই পদক্ষেপ জাওয়াদের কল্পনাতীত ছিল। প্রতি পদে পদে অবাক হয়েছে জাওয়াদ। ও ঘুরতে যায়, ও ভালো খাবার বানায়, ও রূপচর্চা করে, ও ব্যায়াম করে, ও রোমান্টিক, এমন সবের ইঙ্গিত আগেই পেয়েছে। সাদাফের বলা সব কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়েছিল, শুধু সাজগোছের ব্যাপার ছাড়া। মেয়েটা শ্বাশুড়বাড়ি যাবার সময় সাজেনি, ঘরে সাজেনি, মামা বাড়ি আসতে ও সাজেনি, ঘুরতে যাবার সময় ও সাজেনি। ওদের বাসায় যাবার দিন যে শাড়ি পরেছিল আর শাড়ি পরেনি। জাওয়াদের ধারণা জন্মেছিল হয়তো শাড়ি পরা, আর সাজগোছ এই মেয়ের নীতিবিরুদ্ধ কাজ। কিন্তু এই ক্ষণে এসে এর এই ধারণা ও বদলে গেল। সাদাফের বলা কথাগুলোর সব কথা ভুল। মেয়েটা সব করে। তবে গন্ডির মধ্যে থেকে, তার সাথে তার জন্য। জাওয়াদ এ যবত সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে আজ। মুশরাফা রোমান্টিক জানে, কিন্তু এই রোমান্টিকতায় যে স্মার্টনেস আছে সেটাও জানতো না। মুশরাফার প্রপোজালে ওকে এলোমেলো করে দিল। এই ক্ষণে এসে আফসোসের পাল্লা বিলীন হলো। জাওয়াদ ওর হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। মেহেদি রাঙানো হাতে নিজের নামটাও চোখে পড়ল। জাওয়াদ মুশরাফার অনুভূতির প্রতি লাইনে নিজের নাম দেখতে পেল। যা ওকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিল।
ওর নিরবতা দেখে মুশরাফা আবার বলল,
‘উইল ইউ জয়েন মি?’
জাওয়াদ ভাবনা থেকে বের হলো। মুশরাফার সামনে নিজেকে ধরা দিতে চাইল না। গম্ভীরমুখে বলল,
‘বাইরে থেকে এসেছি। ক্লান্ত লাগছে। ফ্রেশ হয়ে ঘুমাব। সরো।’
মুশরাফাকে একটু ও হতাশ দেখাল না। ও ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। হাত দুটো টেবিলে উঠাল। কনুইয়ে ভর দিয়ে উঁচু করে আঙুলে ভাজে আঙুল রাখল। সেই আঙুলের উপর থিতুনী রেখে জাওয়াদের পানে তাকিয়ে হেসে বলল,
‘ আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করব।’
জাওয়াদ দেহ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি আসব না।’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘ টেবিলে সব আপনার পছন্দের খাবার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আপনি আসবেন। হয়তো পেটের টানে , নয়তো মনের টানে। আমি অপেক্ষায় থাকব।’
জাওয়াদ কিছু না বলে রুমে ফিরে গেল। ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ল। রুমের লাইট বন্ধ। বারান্দা থেকে মৃদু আলো আসছে। মুশরাফা গুনগুন করছে। নিস্তব্ধতা সুরটা রুমে এসে পৌঁছাচ্ছে। সব ঠেলে জাওয়াদ ঘুমানোর চেষ্টা করছে। অস্থির মনে ঘুম আসেনা। এখনো আসছে না। চোখে খানিক আগের দৃশ্য ভাসছে। বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। রেগে বলল,
‘মা ঠিকই বলে, এই মেয়ে আমাকে তাবিজ করছে।’
মুশরাফা প্রফুল্লচিত্তে বসে আছে। ওকে একটু ও হতাশ দেখাচ্ছেনা। কানে ইয়ারফোন গুজে একটা গজল শুনছে, আর গুনগুন করছে। সেই সাথে মোবাইল দেখছে। ঠোঁটের কোণে হাসি। মিনিট বিশেক পরেই বারান্দায় জাওয়াদের অস্তিত্ব টের পেল। মুশরাফা ঠোঁট চেপে হাসল। আজ মাথায় ঘোমটা নেই ওর। আঁচলটা কাধেই ছেড়ে দেয়া। এক পাশে সিথি করে কিছু চুল সামনে এনেছে, বাকি চুল পেছনে। মুশরাফা মেহেদি রাঙানো হাত দিয়ে চুল আঁচড়িয়ে প্রসন্ন হাসল। মোবাইল থেকে চোখ সরাল না। এমন ভান করল যে, ও ফোন দেখেই হাসছে।
জাওয়াদ কিছুদূর দাঁড়িয়ে ওকে পরখ করল। তারপর দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে রাখল কিছুক্ষণ। ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। পরপরই হনহন করে এসে চেয়ার টেনে বসল। কিছুটা রেগে বলল,
‘ক্ষিধে পেয়েছে। খাবার বাড়ো।’
মুশরাফা চমকে তাকাল। জাওয়াদকে সামনে বসা দেখে অবাক হওয়ার ভান করল। কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বলল,
‘আপনি সত্যিই এসেছেন! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
জাওয়াদ কপালে বিরক্তির ভাজ টেনে বলল,
‘ ভেবোনা তোমার টানে এসেছি। ওখান থেকে খেয়ে আসিনি। ক্ষিধে পেয়েছে। পেটের টানে এসেছি।’
মুশরাফা ফোন ইয়ারফোন রেখে দিল পাশেই। তিনটা প্লেট সরাল। পুটিন, স্টেক, পাস্তা। সবটাই জাওয়াদের পছন্দের খাবার। পরিবেশনটাও চমৎকার! জাওয়াদ খাবার দেখে চমকে তাকাল। এই মেয়ে এসব ও বানাতে জানে! টেস্টটাও ভালো। জাওয়াদ চুপচাপ খাবার চিবোচ্ছে। মুশরাফার দিকে তাকাচ্ছে না একবার ও। মুশরাফা নিজের জন্য শুধু পাস্তাটা নিয়েছে। পাস্তা নেড়েচেড়ে বলল,
‘ আমার ধারণা সত্য হলো। ‘
জাওয়াদ খেতে খেতে বলল,
‘ উল্টোপাল্টা ভেবো না। আমি খেতে এসেছি। খেয়েই চলে যাব।’
‘আপনি যাবেন না। খাওয়া শেষ করে বসে থাকবেন, আমার সাথে গল্প করবেন। আমরা পাশাপাশি বসে আকাশে তারা মেলেনো দেখব। ততক্ষণ অবধি আপনি রুমে যাবেন না ইন শা আল্লাহ। ‘ মুশরাফা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল। জাওয়াদ বলল,
‘সব তোমার কল্পনা।’
মুশরাফা হাসল। আলতো স্বরে বলল, ‘শুনুন! ‘
জাওয়াদ না তাকিয়ে বলল, ‘কী?’
‘তাকান আমার দিকে।’
জাওয়াদ তাকাল না। তাকালেই সর্বনাশ। কেউ যেন বলে উঠল, তাকাস না জাওয়াদ। ওদিকে ফাঁদ আছে, তাকালেই আটাকাবি। বেরুতে পারবিনা। জাওয়াদ নিজের উপর বিরক্ত হলো। মনে তিক্ততা আনতে চাইল। বিয়ের প্রথমদিকে মুশরাফার জন্য ওর মনে তিক্ততা ছিল। সেই তিক্ততার জন্য ওর রূপ গ্রাস করতো না। এখন সময়ের সাথে তিক্ততা হ্রাস পাচ্ছে। রূপ গ্রাস করছে। নিজেকে ঠিক রাখা দায় হচ্ছে। চোখ তুলে তাকাল। মুশরাফা ওর চোখে চোখ রেখে হাসল, চমৎকার দেখাল হাসিটা। জাওয়াদ ঢোক গিলল। মুশরাফা বলল,
‘আপনার জন্য সেজেছি। বললেন না তো, আমাকে কেমন লাগছে?’
জাওয়াদ চোখ সরাল। মুখ কুঁচকে বলল,
‘ একটু সুন্দর লাগছেনা। আর কখনো এভাবে সাজবেনা।’
মুশরাফা হাসল আবার। ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ এইজন্যই বোধহয় প্রথম দেখায় দুই মিনিট পঁচিশ সেকেন্ড তাকিয়ে ছিলেন। সুন্দর লাগলে হয়তো দুই ঘন্টা তাকিয়ে থাকতেন। বুঝতে পেরেছি আমি।’
জাওয়াদ খাচ্ছিল। মুশরাফার কথায় বিষম খেল। মুশরাফা উঠে এলো। গ্লাস এগিয়ে দিল। আলতো হাতে পিঠ ঢলল। জাওয়াদ নড়ে উঠল। পারফিউমের ঘ্রাণটা ভীষণ জ্বালাচ্ছে। কাশতে কাশতে বলল,
‘নিজের জায়গায় নিয়ে বসো। ‘
পানি খেয়ে জাওয়াদ ঠিক হলো। মুশরাফা নিজের জায়গায় আর গেল না। চেয়ার টেনে ওর পাশেই বসল। কেক টেনে সামনে আনল। চকলেট কেকের উপর একটা সাদা চকলেট বার। তার উপর লেখা,
‘আপনার মনে আমার জন্য একটু জায়গা হবে?’
লেখাটা সবে খেয়াল করল জাওয়াদ। ভ্রু কুঁচকাল। মানুষ প্রেম করতে চায়, বিয়ে করতে চায়, ভালোবাসতে চায়। এই মেয়ে মনে জায়গা চাইছে?
মুশরাফা অভিমানী স্বরে বলল,
‘ মনে একটু জায়গা চাইছি, আপনি এমন ভাব করছেন যেন আপনার কেনা বসুন্ধরার জায়গা চাইছি। ‘
ওর বলার ভঙ্গিতে জাওয়াদের হাসি পেল।হাসল না। গম্ভীরমুখে বলল,
‘জায়গা দিব না। কী করবে?’
‘লুট করে নিব।’
‘ লুটপাট করা কোন সন্ত্রাসিনীকে আমি মনে জায়গা দিই না।’
মুশরাফা ও হেসে উঠল। নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
‘মনে জায়গা নাইবা দিলেন। আমি ক্ষীণ আশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকব। অন্তত কেকটাকে জবাই করে কোরবান করুন!’
বিরহকালীন সময়কালে এই প্রথম জাওয়াদ মুশরাফার উদ্দেশ্যে হাসল। মেয়েটা এমনভাবে কথা বলে, না হেসে পারা যায় না। হাসতে হাসতে বলল,
‘ এত নাটক করো কেন!’
মুশরাফা ওর হাসিটা দেখল অন্তর্ভেদী নয়নে। বাসার সবার সামনে লোকটা প্রাণবন্ত। জাহিনের সাথে কথা বলতে গিয়ে হেসে খুন হয়। কেবল ওর সামনে এলেই মুখ মলিন হয়ে যায়, মুখে গম্ভির্য টানা থাকে। বিয়ের পরদিন থেকে ওকে আর হাসতে দেখেনি, প্রাণবন্ত হতে দেখেনি। আজ এই হাসিটা মুশরাফাকে ভীষণ খুশি দিল। মনে হলো এই মানুষটা ওর আপন। মুশরাফা আবেগী সুরে বলল,
‘ আমার সাথে এভাবে হেসে কথা বললে খুব কি ক্ষতি হয়?’
জাওয়াদ তড়িৎ হাসি থামাল। কেকে ছুরি বসিয়ে এক পিস কাটল। কাটল ঠিকই, তুলল না। না নিজের মুখে নিল, আর না মুশরাফার মুখে তুলল। মুশরাফা বিরক্ত হলো। এত জড়তা কেন লোকটার মাঝে? সে এতগুলো কদম বাড়িয়েছে, লোকটা এক কদম বাড়াতে পারছে না! অভিমান হলো ওর। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। এক টুকরো কেক মুশরাফার সামনে রাখা প্লেটে তুলে দিল। বলল,
‘ এবার কেক খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো। ঘুম পাচ্ছে আমার। ‘
মুশরাফা তাকাল ও না, নেয়া তো দূরের কথা। মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে বসে রইল। জাওয়াদ এক টুকরো কেক নিয়ে একটুখানি খেল। মুশরাফাকে অন্যদিকে বসে থাকতে দেখে বলল,
‘বসে আছো কেন? খাও?’ মুশরাফা এবার ও তাকাল না।
জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ আমার খাওয়া শেষ। চললাম, আমি ঘুমাব। তোমার যা ইচ্ছে করো। আমাকে অন্তত বিরক্ত করোনা।’
সেই সন্ধ্যা থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে শুধু মাত্র একটুখানি সুন্দর সময় কাটাবে বলে। বারান্দা সাজানো, খাবার রান্না, সাজগোছ, হাতে মেহেদি দেয়া ফাবিহা, ফাইজার টিপ্পনী সহ্য করা আর কত কী, সব যেন বৃথা গেল। সে সাজেনা, আজই এত সাজল। শুধুমাত্র এই মানুষটার জন্য। বিয়ের আগে দরকারের বেশি একটা কথা ও বলতো না সে। বিয়ের পর সে বাঁচালে পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র মানুষটাকে সহজ করার জন্য। এখন ও আগ বাড়িয়ে কত প্রেম নিবেদন করেছে। ওর বিশ্বাস ছিল, মানুষটা আর যাই হোক আজ একটু সহজ হবে। শারীরিক না মানুষিকভাবে তাকে একটু কাছে পাবে। মানুষিক দূরত্ব গুছাবে। কিন্তু না, তার ধারণা ভুল। মানুষটা এখনো দূরত্বেই আটকে আছে। এখনো জড়তা তার মাঝে। এই জড়তা আজ না কাটলে হয়তো আদৌ কাটবে না। সব যেন বিফলে গেল। মুশরাফার চোখে পানি চলে এলো। ছলছল চোখে চেয়ে রইল জাওয়াদের পানে।
জাওয়াদ পা বাড়ানোর আগে ওর দিকে চাইল এক পলক। চোখের ভেতর মুক্তোর দানার মতো চিকচিক করা পানি ও দৃষ্টি এড়াল ও না। তাও সে থামল না। দেহ ঘুরিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। ওর হাতে আধখাওয়া কেক। মুশরাফা ছলছল চোখে ওর যাওয়া দেখল।
দরজা অবধি গিয়ে আকস্মিক পিছু ফিরল জাওয়াদ। আধখাওয়া কেকটা দেখিয়ে মুখ কুঁচকে বলল,
‘ কেকটা মজা নেই। একটু খেয়ে ও হজম করতে পারছিনা। বাকি খেতে পারব না। কী করি বলো তো? ‘
থামল ও। খানিক ভাবল। দৈবাৎ কেকটা একটু এগিয়ে বলল,
‘তুমি চাইলে খেতে পারো। তোমার তো আবার এঁটো খাবার পছন্দ।’
সবুজ ইঙ্গিত ছিল বোধহয় কথাটায়। মুশরাফার মন থেকে সব বিষন্নতা দূর হয়ে গেল। মুখে হাসি ফুটতে চাইল। সে সফল করল না। লোকটা আজ নিজ থেকে কেক খাওয়াতে হবে । নয়তো নড়বেনা। নিজের অবস্থার পরিবর্তন করল না মুশরাফা। নিশ্চল বসে রইল। জাওয়াদ এগিয়ে এলো ওর দিকে। কেকটা ওর মুখের সামনে ধরে বলল,
‘ খাবে? খেলে হা করো।’
মুশরাফা তড়িৎ ঘাড় ঘুরাল। হা করল। জাওয়াদ ওর এঁটো কেক মুশরাফাকে খাইয়ে দিল। তারপর বলল,
‘এবার শান্তি?’
মুশরাফার মন প্রাণ শীতল হয়ে এলো। এই ব্যাপারটার মাঝে অব্যক্ত একটা ইতিবাচক ইঙ্গিত ছিল। প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত, মানষিক দূরত্ব গুছানোর ইঙ্গিত। মুশরাফার মনঃপুত একটা ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। ওর মনে হলো, এত কষ্ট, এত পরিশ্রম সব সফল। খুশিতে আত্মহারা হলো মন। বিজয়ী হাসি ফুটল মুখে, ভাসল চেহারায়। ও যেন নিজের মধ্যে রইল না। কেকটা মুখে নিয়েই জাওয়াদকে জড়িয়ে ধরল।
জাওয়াদ ধরল না। অসাড় দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্তিভরে বলল,
‘ তুমি মেয়েটা সুবিধার না। জড়িয়ে ধরার সুযোগ খুঁজো সবসময়। ছাড়ো!’
মুশরাফা তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিল। ওর চোয়ালে লজ্জার আভা। খোলা চুল এলোমেলো হয়ে গিয়েছি। হাত দিয়েই আঁচড়ে নিল ও। দৃষ্টি নিচের দিকে। জাওয়াদ ওকে পরখ করে বলল,
‘এই যে এতসব করলে, এগুলো সব জায়েজ?’
মুশরাফা মাথা নাড়ল। কেন যেন একটু বেশিই লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জা আড়াল করতে খাবার গুছানো শুরু করল। খাবারগুলো যাতে অপচয় না যায়। গুছাতে গুছাতে বলল,
‘আপনি দাঁড়ান। আমি এগুলো ফ্রিজে রেখে আসি।’
বলে তড়িৎ প্লেট গুলো এবড়োখেবড়ো করে রেখে এলো। একবারে নিজেকে স্বাভাবিক করে এলো। এসে চেয়ার টেবিল একদিকে নিয়ে গেল। আকাশমুখো হয়ে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। বলল,
‘এখন আকাশে তারা খসতে শুরু করবে। বসুন এখানে। তারা দেখতে দেখতে কথা বলি।’
রাত জাগা হয় বলে তারাদের খসা দেখা হয় জাওয়াদের। আগে প্রায়ই বারান্দায় গিয়ে বসে থাকতো। ওর ভালো লাগে তারা খসা দেখতে। তাই দ্বিরুক্তি করল না। মুশরাফার পাশে বসে পড়ল। বলল,
‘এবার বলো।’
মুশরাফা বলল,
‘ মেয়েদের সাজসজ্জা কেবল স্বামীর জন্য। স্বামীর জন্য মেয়েরা ইচ্ছেমতো সাজতে পারবে। তবে লক্ষ রাখতে হবে, প্রসাধনীতে যাতে ক্ষতিকর বস্তু, বা হারাম পদার্থ মেশানো না থাকে। আমাদের শরীর আল্লাহর দেয়া আমানত। এটার কোন ক্ষতি করা যাবে না। যে প্রসাধনী স্কিনের ক্ষতি করে তা ব্যবহার করা জায়েজ নেই। হালাল এবং ভালো মানের প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে। আমি হালাল ব্র্যান্ডের মেকাপ ইউজ করি, আর এগুলো হার্মফুল না। আর পারফিউম ও স্বামীর জন্য লাগানো জায়েজ। বেগানা কারো সামনে লাগানো যিনা( অবৈধ মিলনের) মতো কবিরা গুনাহ। আমি তো আপনার জন্য লাগিয়েছি। এটা জায়েজ। আর আমার পারফিউম এলকোহল ফ্রি। ‘
জাওয়াদ জবাব পেল। আবার ও অবাক হলো! মেকাপের দিকটা ও ভালো লাগল ওর। আবার মনে হলো ইসলাম সুন্দর। কী সুন্দর সব দিক খেয়াল। মেকাপ করো, তবে যেন স্কিনের ক্ষতি না হয়। বাহ্! ব্যাপারটা সুন্দর। মুশরাফা বলল,
‘ এবার বলুন কেমন লাগছে আমায়?’
জাওয়াদ সরাসরি উত্তর দিল না। বলল, ‘মাঝেমধ্যে শাড়ি টাড়ি ও পরতে পারো।’
‘তারমানে শাড়িতে আপনার চোখে আমাকে সুন্দর লাগে?’ ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল মুশরাফা। জাওয়াদ উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ বদলে বলল,
‘ তোমার চুল নুডলস টাইপ ছিল না?’
‘স্ট্রেইট করেছি। ভালো লাগছে না?’ মুশরাফা ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে মাথার উপর ধরল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘কেন করেছো?’
‘আপনার পছন্দ না তাই।’
‘আমি বলেছি?’ অবাক হলো জাওয়াদ। মুশরাফা হেসে বলল,
‘আমি বুঝেছি।’
আগের থেকে এখন বেশি সুন্দর লাগছে ওকে। জাওয়াদ খেয়াল করল মুশরাফার সামনের দিকের চুলগুলো ভিন্ন রঙ লাগছে। পুরোটা কালো, একদিকে ক্যারামেল ব্রাউন। কালার করেছে! অবাক হয়ে বলল,
‘কালার ও করেছো!’
মুশরাফা আবার ও হাসল। জাওয়াদ বলল,
‘এগুলো ও জায়েজ?’
মুশরাফা উত্তর দিল,
‘ চুল বাঁকা হলে সোজা করা যাবে। কিন্তু সোজা হলে বাঁকা করা যাবে না। এক কথায় আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করা যাবে না।
আর চুলে সব কালার করা যাবে। তবে সেই রঙ যে চুলের জন্য ক্ষতিকর না হয়। এবং সেটা যেন কোন কাফের মুশরিকের অনুসরণ করে না হয়। শুধুমাত্র কালো ছাড়া। কোনভাবেই কালো রঙ করা যাবে না। ‘
জাওয়াদ কৌতুকের সুরে বলল, ‘তুমি তো জায়েজ জায়েজ করে স্মার্ট, মর্ডান হয়ে যাচ্ছো।’
মুশরাফা গর্বের সাথে বলল, ‘আমার ইসলাম স্মার্ট। স্মার্ট তার বিধান। এই যে আমি আপনার জন্য সেজেছি, এতেও আমার সাওয়াব হবে। কত সুন্দর না?’
‘আসোলেই সুন্দর। আমি ইসলাম সম্পর্কে এত কিছু জানিনা। এখন জানছি নতুন করে।’ জাওয়াদ বলল। মুশরাফা বলল,
‘ইসলাম নিয়ে জানতে গেলে বুঝতে পারবেন ইসলাম এই যুগ থেকেও আধুনিক। মানুষ ভাবে একজন ধার্মিক মানুষ কিছুই করতে পারেনা। আমি বলি, সে মঙ্গলকর সব করতে পারে। ‘
এই ক্ষণেই এসে জাওয়াদের ও মনে হলো, একজন ধার্মিক মানুষ সব করতে পারে। সাদাফ বলেছিল, ধার্মিক মেয়ে বিয়ে করলে ‘জায়েজ নেই’ কথাটাই শুনতে হবে। অথচ জিশানের ব্যাপার ছাড়া মুশরাফা কোন ব্যাপারে ‘জায়েজ নেই’ কথাটা বলেনি। সব ব্যাপারে জায়েজ আছে বলে, একটা সুন্দর পদ্ধতি দাঁড় করিয়েছে। আজকের মুশরাফাকে দেখে জাওয়াদের মনে হলো, এই মেয়ে শুধু স্মার্ট না, অভার স্মার্ট। সে সব কিছুতে পারদর্শী। পর্দা তার কমতি নয়, হতেই পারেনা। একটা সম্মান কাজ করল ওর, ইসলামের প্রতি। ইসলামের বিধানের প্রতি।
মশা কামড়াচ্ছে। কয়েল শেষ বোধহয়। জাওয়াদ বলল,
‘মশা কামড়াচ্ছে, রুমে চলো।’
মুশরাফা কেমন করে বলল,
‘ আপনাকে তো এভাবে পাই না কখনো। আজ পেলাম। আরেকটু সময় পাশে থাকতে দিন! দেখুন তারারা খসতে শুরু করেছে। ‘
জাওয়াদ আবার আটকাল। গেল না। বসে রইল চুপচাপ। আকাশে একটা দুইটা করে তারা খসে মিলিয়ে যাচ্ছে। মুশরাফা উৎফুল্ল হয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। এই যে এই তারা মিলেছে। এই যে এটা মিলেছে। জাওয়াদের আজ আকাশের তারায় মন বসছে না। আজ তার মন অন্য তারায় ডুবেছে। মরিচ বাতির বর্ণিল আলোয় বসে থাকা তারায় মুগ্ধতা কাজ করছে ওর। চেয়ে আছে সেই তারার মাঝে।
আকাশের একটা দুটো করে তারা খসে মিলিয়ে গেছে। খালি হয়ে গেছে আকাশটা। মুশরাফা তারা দেখতে দেখতে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেল। ঘুমের মাঝে অন্যদিকে হেলে পড়তে নিলে একটা হাত আগলে নিল। আটকে রাখল নিজের বাহু বন্ধনে। মুশরাফা জানতে পারল না, টের ও পেল না।
সে দেখল শুধু তারাদের খসে যাওয়া। আর কিছুক্ষণ জেগে থাকলে হয়তো সূর্যোদয়টাও দেখতে পেতে। প্রেমের সুর্যোদয়।
চলবে…