স্বর্নাভ_সুখানুভূতি,পর্ব-২২,২৩

#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি,পর্ব-২২,২৩
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
২২

প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে রুমে পা রাখতেই এক রূপসী এগিয়ে এসে হৃদয়গ্রাহী একটা সালাম দিয়ে অভিবাদন জানায়। আজ কেউ অভিবাদন জানাল না। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। ভেতরে চোখ বুলিয়ে দেখল, মুশরাফা খাটে বসা। দরজার আওয়াজ শুনে এদিকে একবার তাকিয়েছে, তড়িৎ চোখ ফিরিয়ে আবার। অনান্য দিন মুশরাফা সুমিষ্ট হেসে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়। চঞ্চলতার মতো চাঞ্চল্য দিয়ে রুমটাকে মাতিয়ে রাখে। কত দুষ্টুমি, কত ফাজলামো করে জাওয়াদের রাগ বিনাস করে। আজ সেসব কিছুই হলো না। মুশরাফা পানি এগিয়ে দিল না। বরং ওকে দেখে পাশ কাটিয়ে বারান্দায় চলে গেল। জাওয়ার টাইয়ের নাট ঢিলে করতে করতে দেখল তা। হলো কী এই মেয়ের?

অতঃপর জাওয়াদ নিজেই বলল, ‘মুশরাফা, এক গ্লাস পানি দাও তো। ‘

মুশরাফা পানি নিয়ে এলো। তবে জাওয়াদের হাতে দিল না, সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। রেখেই চলে গেল বারান্দায়। একবার তাকাল ও না জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদের মনে সন্দেহের দানা বিধল এবার। সন্দেহটা পাকাপোক্ত হলো ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল মেলতে বারান্দায় যাওয়ার পর। মুশরাফা গ্রীল ঘেঁষে আকাশ পানে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে বিষন্নতার স্পষ্ট। জাওয়াদ টাওয়াল মেলে দিতে দিতে বলল,
‘ সকালে অফিসের জন্য আমাকে জাগাওনি কেন? তোমার জন্য কতগুলো কথা শুনতে হয়েছে আমার। ‘

আবার মনোক্ষুণ্ণ হলো মুশরাফার। লোকটার এখনো বোধদয় হয়নি যে, সে নামাজ ও মিস করেছে। এক ওয়াক্ত নামাজ মিস হলে মুশরাফার কষ্টে বুক ফেটে যায়, কান্না আসে। এমন ও হয়েছে, নামাজ পড়তে না পারায় কেঁদে ভাসিয়েছে। অথচ সে সহজে কাঁদেনা।
লোকটার কি একটু ও কষ্ট হচ্ছে না? এতদিন নামাজ পড়ে এ টুকু টান ও জন্মায়নি? হতাশা, বিষন্নতা এসে ভর করল মুশরাফার মাঝে। বিয়ের পর মামার বাড়ি যাওয়া হয়নি। মামা মামী প্রতিদিন ফোন করে জোর করছেন যেতে। শুধু এই লোকটাকে নামাজে অভ্যস্ত করানোর জন্য সে যাচ্ছে না। মামীকে বলেছে আর কিছুদিন পর যাবে। সবকি তবে বৃথা!
আকাশের দিকে তাকিয়ে মনের দুঃখ বলা সুন্নত। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুশরাফা আকাশ পানে চেয়ে নিজের অভিমান ঝাড়ছে। সে জাওয়াদের প্রশ্নের জবাব দিল না। জাওয়াদ ফিরতি বলল,

‘এই মেয়ে আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি! উত্তর দাও! আমাকে জাগাওনি কেন?’

মুশরাফা উত্তর দিল না। পাশ কাটিয়ে রুমে যেতে নিল। জাওয়াদ হাত ধরে কিছুটা রেগে বলল,
‘ সমস্যা কি তোমার? তুমি আমাকে ইগ্নোর করছো কেন? উত্তর দাও।’

মুশরাফা চোখে রাগ নিয়ে তাকাল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ অফিসে দেরি হলে বসের বকা খাওয়ার ভয় আছে, অথচ এক ওয়াক্ত নামাজ মিস করে আগুনে যে জ্বলতে হবে তার ভয় নেই। এত গুনাহের কাজ করেও বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই। আবার জিজ্ঞেস করছে ইগ্নোর করছি কেন! বদলোক। ‘

জাওয়াদ শুনল না সে কথা। তবে মুশরাফার দৃষ্টি ওকে বুঝিয়ে দিল, রাগটা কার উপর। মুশরাফা হাত ছাড়িয়ে চলে গেল। রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

মাঝরাতে আকস্মিক ঘুম ভেঙে গেল জাওয়াদের। কারণ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মুশরাফার কান্নার শব্দ আবিষ্কার করল। তাহাজ্জুদে সেজদায় লুটে স্বামীর হেদায়েত চেয়ে কাঁদছে মুশরাফা। জাওয়াদ সেসব টের পেল না, শুধু কান্নাটা শুনল। আবার ও রাগ হলো ওর। ভীষণ রাগ। মুশরাফাকে কটা কথা শুনানোর ইচ্ছাটা প্রবল হলো। কিন্তু ইচ্ছেটাকে সায় দিল না। রাগটা মুশরাফার সামনে প্রকাশ না করে, নিজ মনেই বিড়বিড় করল। রাতের ভারি ঘুমটা আবার এসে ঝেকে ধরল। ঘুমের কোলে তলিয়ে পড়ল।

মুশরাফা নামাজ পড়ে শেষ রাতের দিকে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল কারো ডাকে।
‘মুশরাফা? এই? উঠো?’

মুশরাফা ঘুমজড়ানো চোখ মেলল খানিক। আধোচোখে ধবধবে সাদা পাঞ্চাবি পরিধেয় জাওয়াদকে চোখে পড়ল। ওকে তাকাতে দেখে জাওয়াদ শান্ত স্বরে বলল,
‘আমি বাবার সাথে মসজিদে যাচ্ছি। দরজা লাগিয়ে দাও।’

মুশরাফা দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখল। ফজরের সময়। আজ লোকটাকে জাগানো লাগেনি? নিজে উঠে গেছে! আবার তাকেও জাগিয়ে দিয়েছে! অবিশ্বাস্য চোখে চাইল মুশরাফা। ওর মনে হলো, এটা স্বপ্ন। ঘুম ভাঙার সাথে সাথে ভেঙে যাবে। স্বপ্ন, বাস্তবতার বেড়াজালে পড়ে গেল ও। সত্য যাচাইয়ে নিজের হাতেই চিমটি কাটল। জাওয়াদের হাসি পেল তা দেখে। তবে হাসল না। ধীর স্বরে বলল,
‘ উঠো, দরজা দিয়ে এসে নামাজ পড়ে নাও। ‘

জাওয়াদ নিজ থেকেই নামাজে যাচ্ছে, আবার ওকে ও নামাজের জন্য জাগাচ্ছে! আদৌ সম্ভব! গত এক দিনে জমে থাকা অভিমান ঝরানোর জন্য আশ্চর্যজনক এই দৃশ্যটাই যথেষ্ট! মুশরাফার সিদ্ধান্তে পাটল ধরল। কথা না বলে পারল না। বিস্মিত স্বরে বলল,
‘আপনি সত্যিই নিজ থেকে নামাজের জন্য যাচ্ছেন? আর আমাকে ও নামাজের জন্য জাগাচ্ছেন? ‘

জাওয়াদ বিরক্ত হওয়ার ভান করল, ‘তুমি মেয়েটা একটু বেশি কথা বলো। উঠো, আমার নামাজের দেরি হচ্ছে। এমনিতেই তোমার জন্য কাল নামাজ মিস হয়েছে। আজ আবার মিস হতে যাচ্ছে। ‘

জাওয়াদের স্বরে অনুতাপের আভা খুঁজে পেল। সেই ছাপ, যা মুশরাফা গতকাল হন্ন হয়ে খুঁজেছে। নামাজের জন্য আগ্রহ, আন্তরিকতা ও খুঁজে পেল। কাঙ্খিত কিছু পেয়ে একরাশ খুশি হাতছানি দিল মুশরাফাকে। ঘুম জড়ানো মুখে হেসে ফেলল। চওড়া, সুখময় একটা হাসি। সেই হাসিটা সোনায় রাঙানো, সুখে রাঙানো। যেই হাসি থেকে চারদিকে স্বর্ণাভ সুখানুভূতি ছাড়াচ্ছে। প্রথমদিন বাসার সাথে নামাজ পড়তে যাবার পর বাবার চেহারায় ভাসা খুশিটা জাওয়াদ আজ আবার দেখল, মুশরাফার মুখে। দিগুন প্রজ্জ্বলিতভাবে। এ বাসায় আসার পর ওকে এত খুশি হতে দেখেনি। জাওয়াদ অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করল হাসিটা, কত কী খুঁজে পেল।

মুশরাফা তড়িৎ উঠে দাঁড়াল। উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘ জাযাক-আল্লাহু খায়রান। (আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুক।) চলুন।’

জাওয়াদ এবার সামনের দিকে পা বাড়াল। মুশরাফা পিছুপিছু গেল। জয়নাল আবেদীন বসার ঘরে অপেক্ষা করছেন। ছেলেকে দেখে বললেন,
”নামাজের জন্য বেরিয়ে, ‘আসি’ বলে কোথায় হাওয়া হয়ে গিয়েছিলি! ”

ভুল সময়ে ভুল কথা বলায় জাওয়াদ বিরক্ত হলো বাবার উপর। এই সময় বাবা কথাটা না বললে কী হতো? সে চোরা চোখে মুশরাফার দিকে তাকাল। মুশরাফা ঠোঁট চেপে হাসছে। বেচারা ধরা পড়ে গেছে। জাওয়াদ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন,
‘ নামাজের দেরি হচ্ছে। বাবা চলুন।’

জয়নাল আবেদীন আগে হাটা ধরলেন। মুশরাফা আর জাওয়াদ পিছনে যাচ্ছে। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ অযু করে বেরিয়ে আবার ফিরলেন কেন? চলে যেতেন। কিসের টানে ফিরে আমাকে জাগালেন?’

জাওয়াদ বিরক্তচোখে তাকাল। তারপর বলল,
‘টান ফান কিছু না। ঘরের দরজা বন্ধ করতে বলতে গিয়েছি।’

মুশরাফা চমৎকার একটা হাসি দিল। বলল,
‘ সত্যিই!’

জাওয়াদ কিছু বলল না। দরজা অবধি চলে এসেছে। জয়নাল সাহেব আগেই সিড়ি বেয়ে নেমেছেন। জাওয়াদ দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। মুশরাফা দরজার এ পাশে দাঁড়ানো। জাওয়াদ সামনের দিয়ে পা বাড়িয়ে পিছনে তাকাল। বলল,
‘ তোমাকে না নিষেধ করেছি, আমার নামে কারো কাছে বিচার দিতে?’

মুশরাফা ভাবুক সুরে বলল,
‘আমি কারো কাছে বিচার দিই নি। ‘
‘আবার মিথ্যা বলো!’ রেগে গেল জাওয়াদ। মুশরাফা বলল,
‘ আমার কথা মিথ্যা হলে, আপনি সত্যটা বলুন! আমি কার কাছে বিচার দিয়েছি?’

‘ কিছু হলেই সেজদায় কেঁদেকেটে আল্লাহর কাছে বিচার দাও। আর কখনো আল্লাহর কাছে আমার বিচার দিবে না, পারলে দোয়া করবে। মনে থাকে যেন। ‘ কড়া স্বরে শাসিয়ে চলে গেল জাওয়াদ।
যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,
‘শালা, ধার্মিক মানুষকে বিয়ে করার এই এক সাইড ইফেক্ট। আল্লাহর কাছে বিচার না দিয়ে দেয়, এই ভয়ে কিছু বলার আগে ও ভাবা লাগে। ‘

এই ক্ষণে এসে সেদিন বিচার না দেয়ার ব্যাপারটা বোধগম্য হলো মুশরাফার। লোকটা আল্লাহকে ভয় করতে শুরু করেছে, ভেবেই খুশি লাগল। যে আল্লাহকে ভয় করে সে খারাপ কিছু করতে পারবে না। জাওয়াদের আকস্মিক রেগে যাওয়ার কথা মনে পড়তেই ফিক করে হেসে ফেলল মুশরাফা।

বাবা ছেলে নামাজ পড়ে হাঁটাহাঁটি করে ফিরল। বসার ঘরে বসল বাবা ছেলে। মুশরাফা চা নিয়ে গেল। নিজের জন্য বরাদ্দ চায়ের কাপ হাতে রুমে ফিরতে গেলে জয়নাল আবেদীন বাধ সাধলেন। হেসে বললেন,
‘বসো, একসাথে চা খাই। ‘

মুশরাফা সিঙ্গেল সোফায় বিনয়ী ভাব ধরে বসল। তিনজনে চায়ে চুমুক দিল। জয়নাল আবেদীন চায়ের কাপ টেবিলে রেখে মুশরাফার উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ বিয়ের প্রায় দিন পনেরো পেরিয়ে গেল। সেই যে বিয়ের দিন এলে তোমার আর বাবার বাড়ি যাওয়া হয়নি। ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে সরে গিয়েছিল, বললে না কেন?’

মুশরাফা পাশের সোফায় বসা জাওয়াদের দিকে তাকাল এক পলক। সত্যটা বলতে গিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগল। জয়নাল আবেদীন নিজেই বললেন,
‘ বাসায় ঝামেলার জন্যই বলতে সাহস করো নি, তাই না? আমাকে বলতে পারতে। যাক গে, তোমার মামা ফোন দিয়েছেন। মেয়ে নাইওর নিতে চেয়েছেন। সেই সাথে আমাদের ও দাওয়াত দিয়েছেন। ‘

জয়নাল আবেদীন থামলেন। মুশরাফা উৎফুল্ল হয়ে বলল,
‘আপনারা যাবেন?’

জয়নাল আবেদীন পরবর্তী কথা বলার আগে কিছুক্ষণ সময় নিলেন। তারপর বললেন,

‘তুমি এখন এই পরিবারের সদস্য। পরিবারের সদস্য হিসেবে তোমার যতটা সম্মান পাওয়া উচিত তুমি তা এক অংশ ও পাচ্ছো না। এর জন্য দায়ী আমার স্ত্রী। তুমি না বললেও আমি জানি আমাদের অনুপস্থিতিতে মায়মুনা তোমাকে কতভাবে অপদস্ত করেন। আমি ওকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি, করছি। বুঝার চেষ্টা করছে না সে। এটা আমার ব্যর্থতা। মায়মুনা তোমার উপর ক্ষেপে আছেন, এমতাবস্থায় আমি ওকে তোমাদের বাসায় যেতে বলব না। গেলে আবার কী না কী করে তখন তোমার পরিবারের কাছে, তুমি আমি আমরা সবাই অপমানিত হবো। তারচেয়ে বরং সে না যাক। বাকি আমরা সবাই যাবে, তুমি কি কোন এক ভাবে তোমার শ্বাশুড়ির না যাওয়ার ব্যাপারটা ঢেকে দিতে পারবে? যাতে ব্যাপারটা খারাপভাবে উপস্থাপন না হয়। তুমি কি পারবে?’

লম্বা কথা বলে থামলেন জয়নাল আবেদীন। চায়ের কাপ তুলে চুমুক দিলেন, তারপর জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন পুত্রবধুর দিকে। মুশরাফা মনোযোগ দিয়ে শুনল শ্বশুরের কথা, তারপর বলল,
‘ আমার দুটো পরিবার। তারমধ্য এটা একটা। আমি আমার এক পরিবারের কাছে অন্য পরিবারের সম্মান নষ্ট করতে চাইনা। আপনি চিন্তা করবেন না বাবা, আমি সামলে নিব।’

মুশরাফার স্বর স্বাভাবিক। ওর কথাটা ভারি সুন্দর লাগল জয়নাল আবেদীনের। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ যাক, নিশ্চিন্ত হলাম। নাজমুল ভাই আজ ডিনারের দাওয়াত দিয়েছেন। অফিস থেকে ফিরে রওনা হবো সবাই। আমরা ডিনার সেরেই ফিরব, তুমি কদিন বেড়িয়ে এসো। জাওয়াদ ওখান থেকেই অফিস করবে না হয়।’

মুশরাফা জাওয়াদের দিকে তাকাল। জাওয়াদ মনোযোগ দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। এদিকে খেয়াল নেই তার। লোকটা কি আদৌ যাবে? নিশ্চিত হতে পারছেনা মুশরাফা। তাও হেসে বলল,
‘আচ্ছা বাবা, আমি তৈরি হয়ে থাকব।’

মুশরাফা জাওয়াদের সাথে কথা বলার অপেক্ষায় রইল। নাস্তা আর টিফিন তৈরির তাড়া থাকায় রান্নাঘরে ছুটতে হলো ওকে। রান্নার কাজে রুমে যাওয়ার ফুরসত মিলল না। সবার নাস্তার পর টিফিন রেডি করে গেল রুমে। জাওয়াদ তখন তৈরি হচ্ছে। মুশরাফা টিফিন ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল,
‘ আপনি সত্যিই আমার সাথে নাইওর করবেন!’

জাওয়াদ ঘড়ি পরছিল। মুশরাফার কথা শুনে বলল,
‘ওসব নাইওর টাইওর করতে পারব না। আজ যাব শুধু। কাল সকালে ফিরে আসব। বাবা আদেশে যেতে হচ্ছে। নয়তো…’

মুশরাফা এমন কিছু ধারণা করেছিল। সত্যতা পেয়ে চাপা শ্বাস ফেলল। বলল,
‘আমি চলে গেলে, আর যাই করেন দয়া করে নামাজটা ঠিকমতো পড়বেন। রাতে ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাবেন না, আমি ফজরের সময় কল দিব। ‘

‘দেখা যাবে।’ দায়সারা জবাব দিল জাওয়াদ।

‘এবার অন্তত নিজের জন্য নামাজটা পড়ুন!’ অনুরোধ করল মুশরাফা।

জাওয়াদ ভ্রু বাঁকাল,
‘ আমার কবরে আমি যাব, তোমার কবরে তুমি যাবে। এমন না যে, এক কবরে যাব দুজন। আমার জন্য তুমি ও শাস্তি পাবে। আমার জন্য তোমাকে ধরবে না। তাই আমাকে নিজেরটা নিজেকে বুঝতে দাও।’

মুশরাফা টিফিন ব্যাগে রেখে ড্রেসিংটেবিলের দিকে এগুলো। জাওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে আলতো গলায় বলল,
‘ কবর আলাদা হলেও আমি আপনার সাথে একই জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। আমি মোনাজাত হাত তুলে আল্লাহর কাছে আপনাকে জীবনসঙ্গীর পর আমার জান্নাতসঙ্গী হিসেবে ও চাই।
আমার স্বপ্নপথে যাওয়ার স্বপ্নটা আপনি ও দেখুন না দয়া করে! নামাজ পড়ুন, আল্লাহর বিধান মানার চেষ্টা করুন। বিশ্বাস করুন, বিনিময়ে আপনি জান্নাতে দুনিয়া থেকে কোটি গুন বেশি পাবেন। ‘

মুশরাফার কথাতেই আটকাল জাওয়াদ। মুগ্ধতা না কি স্তব্ধতা কে জানে, ওকে বাকরুদ্ধ করে দিল। প্রতিত্তোর করতে পারল না। ‘আমি আপনাকে আমার জান্নাতসঙ্গী হিসেবে চাই’ কথাটা চমৎকার লাগল জাওয়াদের কাছে। কী সুন্দর কথা! জাওয়াদ ওর জান্নাতসঙ্গী হওয়া মানে জাওয়াদ ও জান্নাতি হওয়া। ঘুরিয়ে মেয়েটা ওর জান্নাত কামনা করছে। মর্মার্থটাও কী হৃদয়গ্রাহী!
কেউ যে ওকে এভাবে ও চাইতে পারে ইতঃপূর্বে জানতো না জাওয়াদ। ও এক পলক চাইল মুশরাফার দিকে। ওর দৃষ্টিতে কোমলতা ছিল আজ। দৃষ্টি ফেরাল। একবারে শান্ত স্বরে বলল,
‘ ইন শা আল্লাহ।’

চলবে…

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-২৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

ঘড়ির কাটায় রাত দশটা। জয়নাল আবেদীনের কালো রঙা কারটা চলতে শুরু করেছে সবে। ভেতরে অল্প সল্প গল্প চলছে। সাত সিটের কারটায় বসেছে ছ’জন। ড্রাইভিং সিটে বসেছেন মধ্যবয়সী ড্রাইভার রাশেদ। ফ্রন্ট সিটে বসেছেন জয়নাল আবেদীন। দ্বিতীয় সিটে বসেছে জিশান, যায়েদ, জাহিন। মূলত জিশান, যায়েদ বাবার সাথে আলাপ করছে রাস্তাঘাট নিয়ে,আগ এটা এমন ছিল, এখন এমন হয়েছে। এমন কথাবার্তা চলছে। জয়নাল আবেদীন সেই আশি দশকে কেমন ছিল তাও বলছেন। ওদের গল্পের মাঝে রাশেদ ও জবাব দিচ্ছেন টুকটাক। রাশেদ পুরনো ড্রাইভার। সবার পরিচিত, সে হিসেবে গল্প জমেছে।

পিছনের সিটে বসা জাওয়াদ মুশরাফা। তারা নিরব শ্রোতার মতো সবার কথা শুনছে। কোন উত্তর দিচ্ছে না। জাওয়াদের চোয়ালে গম্ভীর্যে ভরা। মুশরাফা নিশ্চুপ বসে আছে। নিকাবের ফাঁকে বেরিয়ে আসা চোখজোড়ার দৃষ্টি জাওয়াদের পানে আবদ্ধ হচ্ছে খানিক পরপর। জাওয়াদের গম্ভীরতর মুখের পেছনকার কারণ পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা চলছে জোরদারভাবে।
দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, মুশরাফার বহিরাগত এই পোশাক।
লোকটা এখনো ওর এই বাইরের যাওয়ার পোশাককে গ্রহন করতে পারেনি। এই পোশাকটা এখনো জাওয়াদের চোখে বেমানান লাগছে। ওর হতাশ হবার কথা, কিন্তু ওর চোখে কোন হতাশা নেই। ওর চোখমুখ একবারে স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতার কারণ হলো, আল্লাহর উপর বিশ্বাস, ধৈর্যশীলতা। মুশরাফা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, জাওয়াদের চোখে একদিন এই বিতৃষ্ণা থাকবে না। লোকটা ওর পর্দাকে সাপোর্ট করতে শুরু করেছে, একদিন মেনে ও নিবে। সবকিছু একসাথে পাওয়া যায় না। অপেক্ষা করতে হয়। পাওয়ার মাত্রা খুব ধীরগতিতে চলে। দুই একদিনেই জাওয়াদ সবটা মেনে নিবে এমন ভাবাও অনুচিত। ওকে সময় দিতে হবে, সম্মানটা মন থেকে আসতে হবে। ওকে পর্দার মর্ম বুঝতে হবে। তারপর সে পর্দাকে সম্মান করবে, বাঁকা চোখে দেখবে না। এর মধ্যকার সময়টা ওকে ধৈর্য ধরে কাটাতে হবে। কোনভাবে হতাশ হওয়া যাবে না। মুশরাফা হতাশ হচ্ছে না।

দুই, মায়মুনা। মায়মুনা ওদের এখানে আসাকে ভালো চোখে দেখেন নি। জয়নাল আবেদীন সৌজন্যতাবোধে স্ত্রীকে সেধেছেন একবার। মায়মুনা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি যাবেন না। এবং তার পরিবারের কাউকে যেতে ও দিবেন না। এ নিয়ে স্বামীর সাথে একচোট ঝগড়া হয়েছে তার। মায়মুনা দমেন নি তবুও। কাকনের সাথে যুক্তি করে কাকনকে বাড়িতে রেখে দিলেন। জাওয়াদকে ও নিষেধ করলেন সেখানে যেতে। জাওয়াদ শুধু বলল, ‘বাবা যাবে, আমি না গেলে খারাপ দেখা যাবে মা।’ ব্যাস এর পর ছেলের উপর ও ক্ষেপেছেন। ছেলেকে বকাঝকা করে মুশরাফার উপর চড়াও হয়েছেন। জাওয়াদের সামনে ওকে অপবাদ দিলেন,
‘ তুই আমার ছেলেকে তাবিজ করেছিস, সবাইকে নিজের করে নিচ্ছিস। সংসারে অশান্তি লাগাচ্ছিস। তোর উপর গজব পড়বে। ‘

মুশরাফা তখন ব্যাগ গুছাচ্ছিল। শ্বাশুড়ির কথা থেমে গেল। নিষ্প্রাণ চোখে তাকাল শ্বাশুড়ির দিকে। নিজেকে গজব দেয়ার জন্য কষ্ট হলো না ওর। তৎক্ষনাৎ একটা হাদিস মনে এলো।
রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন কোনো বান্দা কোনো ব্যক্তিকে অভিশাপ দেয়, তখন অভিশাপ আকাশে চলে যায়, আকাশের দরজাগুলো তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়, অতঃপর তা জমিনের দিকে নেমে আসে। তখন জমিনের দরজাগুলোও তার থেকে বন্ধ করে দেয়া হয়, অতপর তা ডানে বাঁয়ে ঘুরতে থাকে, যখন কোনো উপায় না পায়, তখন যাকে অভিসম্পাত করা হয়েছে, সে যদি এর যোগ্য হয়, তাহলে তার প্রতি পতিত হয়। অন্যথায় অভিশাপকারীর দিকেই ধাবিত হয়। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০৭)

মানুষটা না জেনে গজব দিচ্ছেন, এখন যদি তার উপর এসে বর্তায়! আল্লাহ মাফ করো! আঁতকে উঠল মুশরাফা। জাওয়াদ রুমে ছিল। শ্বাশুড়ির কথার উত্তর না দিয়ে জাওয়াদের দিকে তাকাল। মায়ের আকস্মিক আক্রমণে জাওয়াদ ও হতভম্ব। নিজেকে ধাতস্থ করে মাকে বলল,
‘আমি কাল অফিস থেকে এখানেই ফিরব, মা। আর যাব না। ‘

মায়মুনা থামলেন না। রেগে মেগে ছেলেকে কতগুলো কথা শুনিয়ে চলে গেলেন। জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই প্রথম সে অনুরোধের সুরে বলল,
‘ তুমি মায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বিচার দিও না। মায়ের রাগটা একটু বেশি। তবে মনটা ভালো।’

জাওয়াদের এই বিচার ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা বেশ ভালো লাগে মুশরাফার। ও হেসে ফেলল। হেসেই বলল,
‘উনি আমার মা না? মায়ের বিরুদ্ধে কেউ বিচার দেয়? আমি তো দিইনা। ‘

মুশরাফা আশ্বাস দিল। তবে জাওয়াদ গ্রহন করতে পেরেছে কি না বুঝা গেল না। সে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মুশরাফা নিজেকে পর্দায় ঢেকে বের হলো। বসার ঘরে বেরুনোর সময় চোখাচোখি হতেই জাওয়াদের গম্ভীর্য চোখে পড়েছে। এই গাম্ভীর্যের কারণ দুটোই হতে পারে।

মুশরাফা ধীর স্বরে জিজ্ঞেস করল,
‘ সাইলেন্ট মুডে বসে আছেন কেন?’

মুশরাফার অদ্ভুত কথা শুনে জাওয়াদ ওর দিকে দৃষ্টি ঘুরাল। সাইলেন্ট মুডে বসে থাকে কিভাবে! কী অদ্ভুত কথা। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘ তো আমি এখন রিংটোন মুডে গিয়ে চিল্লাব?’

‘ চিল্লাবেন কেন? ভলিউম কমিয়ে বাবা, ভাইয়াদের সাথে কথা বলুন। চাইলে ভলিউম তার থেকেও কমিয়ে বউয়ের সাথে প্রেমালাপ ও করতে পারেন। বউ পাশে থাকলে কেউ চুপ থাকে?’
ফিসফিস করে বলল মুশরাফা। সামনের সিটে জিশান, যায়েদ বসা। কিছু বললেই শুনবে তারা।

জাওয়াদ ও স্বর খাদে নামিয়ে বাঁকা স্বরে বলল,
‘ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, এটা আমার প্রথম বিয়ে। সে হিসেবে অভিজ্ঞতা নেই। বউয়ের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় জানা নেই আমার। সেই জন্যই আমি চুপ থাকি। দয়া করে আপনি ও চুপ থাকুন, এবং আমার মাথা খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।’

মুশরাফা ও বলল,
‘ পাঁচ টাকার কচকচে নোটের মতো আমার ও বিয়ের অভিজ্ঞতা একবারেই নতুন। পঞ্চ ইন্দ্রীয় নড়াচড়া করেই পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমার পঞ্চইন্দ্রীয় তাদের দেখা অভিজ্ঞতা থেকে বলছে, নতুন বউ পাশে থাকলে স্বামীর চুপ থাকা সাঝেনা। সুতরাং, মুখে খই ফুটিয়ে আমাকে ধন্য করুন। ‘

রম্যক ভঙিমায় বলল মুশরাফা। জাওয়াদের গম্ভীর্যটা টিকল না। চোয়াল কোমল হলো। বিড়বিড় করে বলল, ‘পাজি মেয়ে।’

সেই ক্ষণে জয়নাল আবেদীন ওকে ডেকে বললেন, ‘ জাওয়াদ, অনিক যাচ্ছে আমাদের সাথে? ‘

জাওয়াদ বলল,
‘হ্যাঁ। মামা ওকে আলাদা করে বলেছেন। ‘

কথার পসরা আগাল। জাওয়াদ আর চুপ রইল না। ওকে স্বাভাবিক হতে দেখে হাফ ছাড়ল মুশরাফা। পথের শেষে গন্তব্য এলো। নাজমুল সাহেবের বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়ি থামল। অনিককে ও দেখা গেল। বাইরে থেকে আসছে। ওর হাতে দুটো প্যাকেট। কর্মজীবী মানুষ কারো বাসায় গেলে খালি হাতে যেতে পারে না।
জয়নাল আবেদীন পথে এক গাদা ফলমূল, মিষ্টি কিনেছেন। প্যাকেটের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবার দুই তিনটা করে নিতে হলো। মুশরাফার এক হাতে ট্রলি, অন্য হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিতে চাইল। জয়নাল আবেদীন দিলেন না। দুটো বাড়তি প্যাকেট নিজে নিয়ে সামনে এগুলেন। নাজমুল সাহেবদের বিল্ডিংয়ে লিফট নেই। প্যাকেট গুলো নিয়ে উঠতে বেগ পেতে হচ্ছে সবাইকে। সবার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে মুশরাফার। জিলবাবটা একটু বড়ো হওয়ায় পায়ে বাজছে, তারউপর ভারি ট্রলি। সবার শেষে ধীরে ধীরে উঠছে সে। পুরুষরা সবাই আগে উঠে গেছে। জাওয়াদ উঠে গিয়েছিল। আবার ফিরে এলো। দুহাতের প্যাকেট এক হাতে নিয়ে খালি হাতে মুশরাফার হাত থেকে ট্রলিটা টেনে নিল। কোন রা না করে সিড়ি বাইতে লাগল। মুশরাফা হকচকিয়ে বলল,
‘এতগুলো নিতে পারবেন না আপনি। আমাকে দিন।’

জাওয়াদ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
‘ নিজের আলখাল্লা সামলাও আগে। নাহলে উষ্ঠা খেয়ে গুষ্ঠি ভুলে যাবে। ‘

জিলবাব যে পায়ে ভাজছিল, লোকটা খেয়াল করেছে! মুশরাফার অপ্রত্যাশিত ছিল ব্যাপারটা। চমকাল ও। থামকাল ও কিছুটা। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। বরাবরের মতো সেই হাসি চওড়া হলো, হতেই হলো। জাওয়াদের হাঁটার গতি কমিয়ে দেয়া আর কয়েক কদম এগিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মুশরাফাকে পরখ করা দেখে হাসিদের চওড়া না হয়ে উপায় রইল না।

নাজমুল সাহেবের বাসায় হৈচৈ কলরব। বিয়ের পর মেয়ে, মেয়ে জামাই, শ্বশুর দেবর এসেছে। আপ্যায়নে ব্যস্ত পুরো পরিবার। নাজমুল সাহেব দু’হাতে বাজার করেছেন, ফরিদা সকাল থেকেই ব্যস্ত রান্নাঘরে। ফাবিহা এসেছে গতকাল, সেও মায়ের সাথে রান্নায় হাত দিয়েছে, ফাইজা ঘর গুছিয়েছে। কলিংবেলের শব্দ শুনে ফরিদা মেয়েকে রান্নাঘরে রেখে দ্রুত হেটে বসার ঘরে গেলেন। মুশরাফা মামীকে দেখে ধীর স্বরে সালাম দিল। ফরিদা ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। আদুরে গলায় বললেন,
‘কেমন আছে আমার মেয়েটা?’
‘ আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে। ‘
হেসে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ পাশে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকাল। সত্যিই ভালো আছে সে!
সে মামী শ্বাশুড়িকে সালাম দিল, মামা শ্বশুরের সাথে কোলাকুলি করল। সবার সাথে কুশল বিনিময় করার পর ফরিদা প্রশ্ন করলেন,
‘ বেয়ান আর কাকন এলো না কেন?’

জাওয়াদ বাবার দিকে তাকাল। জয়নাল আবেদীন মুশরাফার দিকে। বাকি জিশান যায়েদ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,

‘মায়ের হাঁটুর জয়েন্টে ব্যাথা। ডাক্তার বেশি হাটাঁহাটি করতে মানা করেছেন। মায়ের জন্যই ভাবি আসেনি।’

বাস্তবিকভাবেই মায়মুনার হাঁটুতে ব্যাথা। ডাক্তারের কথাটাও মিথ্যা নয়। আর মায়মুনার ঝগড়ার জন্য কাকন আসেনি, এটাও সত্য। সে হিসেবে একটা কথাও মিথ্যা নয়। মুশরাফা শুধু ঘুরিয়ে বলেছে। সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক বাঁচা গেল। ফরিদা আফসোস করলেন, ‘আহারে! আল্লাহ ভালো করুক।’

মুশরাফা ভেতরে চলে গেল। বোরকা খুলে রান্নাঘরে ফাবিহার সাথে গল্পে বসল। নাস্তা দেয়া হলো। বসার ঘরে বসা সবাই। আকস্মিক জয়নাল আবেদীন প্রশ্ন করলেন,
‘ মুশরাফার বাবা মাকে দেখছি না যে? উনারা আসেন নি?’

এবার বাহানা দেয়ার পালা নাজমুল সাহেবের। তিনি ক্ষিপ্ত মনে বোনকে বকাঝকা করলেন। উত্তরটা সাজানো ছিল তার কাছে। তাই দিতে দেরি হলো না,
‘ মাহবুব ভাইয়ের ব্যবসায় একটু ঝামেলা চলছে। ব্যবসায়িক কাজে লন্ডন গেছে। লায়লা সাথে গেছে। তাই আসতে পারেনি। ‘

উপস্থিতমহল কথাটা বিশ্বাস করলেন কি না বুঝা গেল না। তবে এ বিষয়ে আর কেউ প্রশ্ন করলেন না। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল কেবল। ভরপুর আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাতের খাবার শেষ হলো। খেয়েই জয়নাল আবেদীন দুই ছেলে, আর নাতিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। জাওয়াদ রয়ে গেল। মুশরাফা ওকে ঘুমানোর বিছানা ঠিক করে দিয়ে মামা মামীর সাথে যে গল্পে বসেছে তার আর দেখা নেই। জাওয়াদ ঘুমিয়ে পড়ল।

ফজর নামাজ পড়ার জন্য আজ জাগাতে হয়নি। নিজেই উঠে নামাজ পড়েছে। নামাজ পরে আবার ঘুমিয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল জাওয়াদ। ওর মনে হলো এর চেয়ে বিস্ময়কর দৃশ্য দুটো নেই। ওর চোখের ঘুম উবে গেল। লাফিয়ে উঠে বসল, অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল মুশরাফার দিকে। মুশরাফা ট্রেডমিলে হাঁটছে। পরনে ঢিলেঢালা লং টি-শার্ট আর প্লাজো। গলায় ওড়না প্যাঁচানো, পায়ে ওয়াকিং শু। কানে হেডফোন গুজানো। মুখ দিয়ে আবার কী যেন বিড়বিড় করছে। ওর এই লুক দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল না জাওয়াদ। ট্রেডমিল আর মুশরাফা! ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না ওর। মেয়েটা এক্সেরসাইজ ও করে! ওর হাঁটার গতি বেশ দ্রুত। ৫হবে বোধহয়। ওর হাটা দেখে মনে হচ্ছে না আজ নতুন হাটছে। বরং মনে হচ্ছে বেশ অভ্যস্ত ও।
আর এই পোশাক ও পরে! বিয়ের পর থেকে ওকে ঢিলেঢালা থ্রি-পিস পরতে দেখা গেছে। এসব টি-শার্ট প্লাজো পরতে দেখা যায়নি। আজ পরল কেন? এগুলো ও কি জায়েজ? ইসলাম এত স্মার্ট?

হাঁটার মাঝে খাটে নজর পড়ল মুশরাফার। কিছুটা চমকাল, তবে ভড়কাল না। তৎক্ষনাৎ হাটা থামাল না। হাঁটতে হাঁটতে গতি কমাল। ধীরে হাঁটল কিছুক্ষণ। তারপর দক্ষতার পরিচয় দিয়ে দ্বিতীয় ধফায় গতি কমিয়ে বন্ধ করল। কান থেকে হেডফোন নামাল। সাইডে রাখা বোতল হাতে নিয়ে ট্রেডমিল থেকে নামতে নামতে বলল,
‘ এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে! সবে সাড়ে আটটা বাজে। ‘

জাওয়াদ ওকে অন্তর্ভেদী চোখে পরখ করছে। এই মেয়ে এত কিছু কিভাবে রপ্ত করেছে! জাওয়াদ প্রশ্ন করল,
‘ হঠাৎ ট্রেডমিল নিয়ে পড়লে কেন?’

মুশরাফা বোতরের ক্যাপ খুলে ট্রেডমিলের উপর বসল। বসে বলল,
‘ হঠাৎ না, বিয়ের আগে সকালে ট্রেডমিলে হাঁটা আমার নিত্যরুটিনে ছিল। শরীর ফিট ছিল। বিয়ের পর শুয়ে বসে খেয়ে ভুড়ি বেড়ে যাচ্ছে, আনফিট হয়ে গেছি। আজ ট্রেডমিল কাছে পেয়ে নিজেকে ফিট রাখার ক্ষুদ্র চেষ্টা করলাম আর কি!’

জাওয়াদ প্রশ্ন না করে পারল না, ‘ গুনাহ হবে না?’

‘না। বরং ইসলাম বলেছে নিয়মিত ব্যায়াম করতে, শরীর ফিট রাখতে। শরীর ফিট রাখার জন্য ব্যায়াম করা জায়েজ। ছেলে মেয়ে উভয়ে। তবে মেয়েরা পর্দার ভেতর থেকে ব্যায়াম করবে। বিবাহিতদের তো বিশেষভাবে বলেছে।’

‘বিবাহিতদের বিশেষভাবে কেন?’ জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফা পানি খেল। মুখ চেপে হেসে বলল,
‘ স্বামী স্ত্রীর সৌন্দর্য একে অপরের জন্য। নিজেকে ফিট, এবং টিপটপ করে রাখতে বলেছে দুজনকে, যাতে একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হয়। বেগানা কারো প্রতি আগ্রহ না জন্মে। এইজন্যই আপনাকে বলি ব্যায়াম করতে, হেলদি ফুড খেতে। অন্তত আমার মনোরঞ্জনের জন্য হলেও আপনার নিজেকে ফিট রাখা উচিত।’

নতুন কিছু জানল জাওয়াদ। কিছুটা বিস্মিত হলো। পরবর্তী প্রশ্ন করল,
‘ এই ড্রেসাপ? এটাও জায়েজ?’

মুশরাফার চোখে মুখে দুষ্টুমি ফুটে উঠল। ও চোখ মেরে বলল, ‘আপনার সামনে সব ড্রেসাপ জায়েজ?’

জাওয়াদ ভ্রু বাঁকিয়ে বিস্ময়ের সাথে বলল, ‘সব?’

জাওয়াদকে যে বাঁকা ইঙ্গিত করেছে তা ঢের বুঝতে পারল মুশরাফা। ওর গাল লাল হলো। দৃষ্টি সরাল। নিচের দিকে ফিরে বলল,
‘ হ্যাঁ সব। ইস্ট ওয়েস্ট সব কিছুই স্বামীর সামনে পরা যাবে। শরীয়তের ব্যাসিক মূলনীতি লংঘন না হলে পরা যাবে। তবে, ফাসেক মেয়েদের পোষাক না পরাই উত্তম। যেমন অনেক বেশি টাইট বা পাতলা হয় এমন ড্রেসাপ। এমন পোশাক মাহরামদের সামনেও না পরাই গাইরাত এর পরিচয়। এই শর্ত মেনে পরা যাবে। এখানে উদ্দেশ্য হতে হবে শুধুমাত্র স্বামীর মনোরঞ্জন, আর কিছু নয়।’

জাওয়াদ মুগ্ধস্বরে বলল, ‘ইসলাম তো দেখি স্বামীকে অনেক গুরুত্ব দিয়েছে! ব্যাপারটা সুন্দর। ‘

মুশরাফা গর্বিত গলায় বলল, ‘আমার ইসলাম সুন্দর। সুন্দর তার বিধান। আপনি ইসলামের বিধান গুলো বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারবেন। প্রতিটা বিধানের পিছনে চমৎকার একটা লজিক থাকে। মানুষ এই যুগে এসে স্মার্ট হচ্ছে, অথচ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চৌদ্দ’শ বছর আগে ইসলামের সাথে স্মার্ট হতে শিখিয়ে গিয়েছেন। ‘

মুশরাফার কথা বলার ভঙ্গি সুন্দর। কী সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে! কথার বলার হেডফোনটা গলা থেকে টেনে খুলতে গেল। কোমরে বাধা মোবাইল ব্যাগে ফোন ছিল। হেডফোন টান লেগে ফোন থেকে খুলে গেল। জোরে কুরআন তেলাওয়াত বেজে উঠল।
মানুষ ট্রেডমিলে হাঁটার সময় গান শুনে, এই মেয়ে কুরআন তেলাওয়াত শুনছে। তখন কুরআন শুনেই গুনগুন করছিল! কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে ব্যায়াম! কী চমৎকার ব্যাপার! জাওয়াদ আবার অবাক হলো।
ইসলামের মতো মেয়েটাও স্মার্ট। ইসলাম মেয়েদের এমন স্মার্ট হতে শিখায়? প্রতি পদে পদে চমকপ্রদ তথ্য জানে জাওয়াদ। এই মেয়ে সত্যিই একটা মিস্ট্রি বক্স।

সেদিন অফিস থেকে বাসায় চলে গেল জাওয়াদ। আর ফিরল না দু’দিন। মুশরাফা ফোন দিয়ে খবর নেয়। ফজরের সময় কল দিয়ে জাগিয়ে দেয়। প্রথমদিন জাগিয়ে দিল। দ্বিতীয়দিন কল দিল না, জাওয়াদ নিজেই কল দিয়ে বলল, ‘ আমার সাদা পাঞ্জাবিটা কোথায় রেখেছো?’

মুশরাফা ঘুমের ঘোরেই হাসল। ঘুমজড়ানো গলায় বলল,
‘এলার্ম দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই নামাজের সময়টা টের পাইনি। ‘
জাওয়াদ স্বরে বিরক্তির আভা মিশিয়ে বলল, ‘ আমি পাঞ্জাবির কথা জানতে চেয়েছি। ‘

মুশরাফা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘আপনি পাঞ্জাবির নয় আমার নামাজের খোঁজ নিতে ফোন দিয়েছে, আমার এমনটা কেন মনে হচ্ছে বলুন তো?’

জাওয়াদ বলল, ‘ কারণ তুমি দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছো। পাগলরাই গ্রীষ্মে শীত খুঁজে, আর পাঞ্জাবিতে ঘুম।’

খট করে ফোন রাখল জাওয়াদ। মুশরাফা দমল না। ম্যাসেজ করল, ‘আমাকে পাগল বানানোর দায়টা কিন্তু আপনার। বাই দ্যা ওয়ে, আপনার সাদা পাঞ্জাবি আপনি সেচ্ছায় সজ্ঞানে ওখানে রেখে গিয়েছিলেন। এখন অজ্ঞান হবার ভান করা মানুষটাকে ও কিন্তু আমি বাহানার পাগল বলতে পারি। ‘

উত্তর এলো না। মুশরাফা বাসায় যেতে সাধল কয়েকবার। জাওয়াদ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে আর যাবে না। নাজমুল সাহেব ফোন দিয়ে ও সাধলেন, জাওয়াদ অফিসের বাহানা দিল। নাজমুল সাহেব বৃহস্পতিবার বিকেলে ফোন দিয়ে রাতে অফিস থেকে ফিরতে বললেন। এবার কোন বাহানা দিতে পারল না জাওয়াদ। অগত্যা যেতে হলো। রাত হলো পার। ফজর নামাজ মামা শ্বশুরের সাথে মসজিদে গিয়ে পড়ল।

নামাজ থেকে ফিরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মুশরাফা নেই রুমে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সুর্যোদয় দেখছে। জাওয়াদ আকস্মিক ঢেকে উঠল,
‘ মুশরাফা? এদিকে এসো?’

মুশরাফা এলো। জাওয়াদ বলল,
‘আমার মাথা ধরেছে, মাথাটা টিপে দাও তো!’

জাওয়াদকে কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। মুশরাফা ভ্রু কুঁচকে পাশে গিয়ে বসল। মাথায় হাত রাখতে গিয়ে টের পেল, জাওয়ার গা কাঁপছে। চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। মুশরাফা আঁতকে উঠে বলল,
‘ আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কী হয়েছে আপনার? ‘

জাওয়াদ চোখে মেলে তাকাল। ওর চোখ লাল হয়ে আছে। ওর রক্তিম দৃষ্টি দেখে মুশরাফা ভয় পেল। হলো কী লোকটার? মুশরাফা আলতো স্বরে বলল,
‘ কী হয়েছে আপনার? বলুন না! কোন ঝামেলা হয়েছে? আমায় বলুন না। আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমার ভয় লাগছে। ‘

তীক্ষ্ম যত্নবোধ মুশরাফার স্বরে। আতঙ্কে মেখে একাকার চোয়াল। জাওয়াদ চোখ বন্ধ করে ফেলল। মুশরাফার হাত দুটো চেপে নিজের মাথায় রেখে বলল,
‘ মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে। একটু মালিশ করে দাও। ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। ‘

কথাটা বিশ্বাসযোগ্য হলো না মুশরাফার। মাইগ্রেনের ব্যাথার মতো লাগছে না। এটা অন্য ব্যাথা। কোন ব্যাথায় ব্যথিত উনি?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here