#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি,পর্ব-২০,২১
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
২০
তখন মধ্যবেলা। উদ্ভ্রান্তের মতো পুরো রুম উলোটপালোট করছে জাওয়াদ। ক্লথ কেবিনেটে থাকা ভাজ করা কাপড় গড়াগড়ি খাচ্ছে ফ্লোরে। জুম’আর নামাজে যেতে হবে। কিন্তু একটা পাঞ্জাবি ও খুঁজে পাচ্ছে না। ওদিকে বাবা অপেক্ষা করছে বসার ঘরে। কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল, যোগ হলো বিরক্তির রেখা। আকস্মিক মনে পড়ল, তার পাঞ্জাবি না পাওয়ার পিছনে মুশরাফার হাত থাকতে পারে। বিরক্তির সাথে চাপা রাগ ও এসে হানা দিল। চেঁচিয়ে ডাকল,
‘মুশরাফা, এদিকে এসো।’
মুশরাফা ব্যস্ত হাতে রান্না করছে। শুক্রবার বলে সকালে টিফিন তৈরির তাড়া ছিল না। ফলে রান্না করা ও হয়নি। বেলা বাড়তেই রান্নাঘরমুখো হয়েছে। জাওয়াদের ডাক শুনে রুমে এলো। রুমের অবস্থা দেখে ওর চক্ষুচড়ক। কী হাল করেছে রুমের! যেন কোন ময়লার স্তুপ। মুশরাফা অবাক হয়ে বলল,
‘এ অবস্থা কেন রুমের?’
জাওয়াদ বলল, ‘আমার একটা পাঞ্জাবি ও খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি ধরেছো?’
মুশরাফা ফ্লোরে ফেলে রাখা কাপড় তুলে ভাজ করতে করতে বলল,
‘আমি ধুয়ে দিয়েছি। ‘
জাওয়াদের রাগ বাড়ল। রাগে গরগর করে বলল,
‘ আমাকে একটাবার জিজ্ঞেস করেছো? এখন আমি নামাজে যাব কিভাবে?’
মুশরাফা শীতল স্বরেই বলল, ‘ পাঞ্জাবি পরেই যাবেন।’
‘ পাঞ্জাবি কোথায় পাব এখন? বানাব আমি?’
ধমকে উঠল জাওয়াদ। মুশরাফা কেবিনেটের দিকে এগুলো। নিজের কাপড় রাখা তাক থেকে একটা প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল,
‘ এটা পরে যান।’
জাওয়াদ প্যাকেট নিয়ে দেখল। ভেতরে একটা পাঞ্জাবি। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘ এটা কার?’
‘আপনার জন্য অর্ডার করেছিলাম।’
‘কেন?’
বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করল জাওয়াদ। মুশরাফা ধীর স্বরেই বলল,
‘স্বামী স্ত্রী একে অপরকে উপহার দেয়া ও সাওয়াবের কাজ। আমি এই সাওয়াবটা লুফে নিতে চেয়েছিলাম, তাই।’
বিয়ের পর থেকে জাওয়াদ ওকে কোন উপহার দেয়নি। সাধারণত, স্বামীরা স্ত্রীদের উপহার দেয়, শাড়ি, গহনা কত কী? জাওয়াদ সেসব কিছুই করেনি। না ঘুরতে নিয়ে গেছে, আর না কিছু কিনে দিয়েছে। বিয়ের শপিং ও মা বোন কিনেছে। মোহরানার টাকা ছাড়া মুশরাফাকে ওর কিছুই দেয়া হয়নি। মুশরাফা আগ বাড়িয়ে ওকে পাঞ্জাবি দিয়ে দিল। ব্যাপারটা লজ্জায় ফেলে দিল জাওয়াদকে। মেয়েটা কি ওকে ওর দায়িত্ববোধ মনে করিয়ে দিচ্ছে! জাওয়াদ স্বরে বিরক্ত মিশিয়ে পাঞ্জাবিটা মুশরাফার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘লাগবে না। আমি শার্ট পরেই যাচ্ছি।’
মুশরাফা ওকে জোর করল না। দায়িত্ব নিয়ে জোর করা যায়, উপহার নিয়ে নয়। উপহার, মন থেকে দেওয়া নেওয়া করতে হয়। মুশরাফা ফ্লোরে ফেলে রাখা শার্ট দেখিয়ে বলল,
‘এই ময়লায় গড়াগড়ি খাওয়া কোন শার্টটা পরে যাবেন? বলুন, আমি ঝাড়ু দিয়ে ঝেড়ে দিই।’
বলে মুখটিপে হাসল। জাওয়াদ ফ্লোরে তাকিয়ে মুখ কুঁচকাল। ফ্লোর থেকে তুলে শার্ট পরবে? অসম্ভব। একটা শার্ট ও ভালো নেই। নিজের উপরই রাগ হলো, রাগের বশত এত হুলস্থুল না করলে কী এমন হতো। অন্তত একটা শার্ট পাওয়া যেত। এখন কী হবে? সব হয়েছে এই মেয়েটার জন্য। মেয়েটা ধুরন্ধর। এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যাতে জাওয়াদের ওর দেয়া পাঞ্জাবি না পরার উপায় থাকে না। আবার দেখো মজা নিচ্ছে! বেয়াদব! জাওয়াদ রেগে তাকাল। মুশরাফা ওর দিকে তাকাল না। তাকালেই জোরে হেসে ফেলবে। হাসি চেপে নতুন পাঞ্জাবি ভাজ করে কেবিনেটের দিকে এগুলো। সেই সাথে বলল,
‘ মানুষ ভালোর মূল্য বুঝে না। যাই, পাঞ্জাবিটা রেখে দিই। ‘
জাওয়াদ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। ওর হাত থেকে পাঞ্জাবিটা চো মেরে টেনে নিল। অগ্নিচোখে তাকিয়ে বলল,
‘আল্লাহ, তোমার বিচার করবে, দেখো।’
মুশরাফা হেসে ফেলল এবার। হেসেই বলল,
‘ স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসাবাসির জন্য আল্লাহ বিচারের আওতায় না নিয়ে শুধু সাওয়াব দেন। হালাল সম্পর্কে প্রতি পদে পদে সাওয়াব। ‘
থেমে চোখ মেরে বলল, ‘ এসব তো ভালোবাসা বাসির মধ্যে পড়ে, তাই না? ‘
জাওয়াদ অবাক। কী সাংঘাতিক মেয়ে! ওকে চোখ মারছে! জাওয়াদ রেগে বলল,
‘তুমি মেয়েটা ভীষণ অসভ্য।’
মুশরাফা দমল না। আবার চোখ মেরে বলল,
‘ এই অসভ্যতা জায়েজ। চাইলে আপনি ও অসভ্য হতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। বিশ্বাস করুন!’
জাওয়াদ পাঞ্জাবি পরে নিল। সাইজটা ঠিক দেখে অবাক হলো। এই মেয়ে ওর সাইজ জানল কিভাবে? উত্তরটা মুশরাফাই দিল,
‘ কেবিনেটে আপনার পাঞ্জাবি দেখে নিয়েছিলাম। ‘
মেয়েটার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। জাওয়াদ কিছু বলল না। বোতাম লাগাতে লাগল । মুশরাফা চুপচাপ দেখল। হঠাৎ বলে উঠল,
‘ মাশা আল্লাহ! পাঞ্জাবিটায় সুন্দর লাগছে আপনাকে।’
জাওয়াদ চুল সেট করে গর্বের সাথে বলল,
‘আমাকে সবসময় সুন্দর লাগে। পাঞ্জাবিতে আমার সৌন্দর্য আটকে নেই।’
মুশরাফা বুঝে গেছে, জাওয়াদ কোনভাবে ওকে ক্রেডিট দিবে না। নিজেও স্বীকার করবে না। তাই আর কথা বাড়াল না। জাওয়াদ পারফিউম লাগাতে নিল। মুশরাফা বাধা দিল। নিজে লাফজের ম্যান বডি স্প্রে নিয়ে এগিয়ে দিল,
‘ওটায় এলকোহল আছে। হারাম। এটা লাগান, এটা হালাল। জুম’আর দিন সুগন্ধি মেখে মসজিদে যাওয়া সুন্নত। সুন্নত সঠিকভাবে পালন হোক, হারাম না থাকুক।’
জাওয়াদ নিল না। বলল,
‘এগুলো কেন নিয়েছো? আমি বলেছি?’
মুশরাফা নিজেই স্প্রে করে দিয়ে বলল,
‘ রাসূল (সাঃ) তার স্ত্রীকে ফুল উপহার দিতেন। আপনি চাইলে তাকে অনুসরণ করে আমাকে ফুল উপহার দিতে পারেন। আমি কিছু মনে করব না। আপনার মতো এত প্রশ্ন ও করব না। চুপচাপ নিয়ে নিব।’
প্রতি পদে পদে মেয়েটাকে নতুন ভাবে আবিস্কার করে জাওয়াদ। সেই সাথে কত অজানা তথ্য জানা হয় ওর। ইসলাম যে স্বামী স্ত্রীকে এত রোমান্টিক হতে বলেছে, এত শখ আহ্লাদ করতে বলেছে ইতঃপূর্বে জানতোই না সে। স্মেলটা সুন্দর। জাওয়াদের খুব একটা খারাপ লাগে নি। তাও জাওয়াদ মুখ কুঁচকে বলল,
‘ এটার স্মেল ভালো না। আমার গুলোই ভালো।’
মুশরাফা হেসে বলল,
‘আমি আপনার মন পড়তে শিখে গেছি। ‘
জাওয়াদ বিরক্তমাখা চোখে তাকাল। তারপর কিছু না বলে চলে গেল সে।
•
জয়নাল আবেদীন তার তিন ছেলেকে নিয়ে নামাজে গেছেন। মসজিদ থেকে ফিরেই স্ত্রীকে টেবিলে খাবার দিতে বললেন।
রান্না শেষে খাবার টেবিলে রেখে রুকে ঢুকে গেছে মুশরাফা। আর বের হয়নি। কাকন ও গোসলে ঢুকেছে। অগত্যা খাবার সার্ভ করার ভার মায়মুনার কাধে গিয়ে পড়ল। প্লেট বাটি নিয়ে কিচেন আর ডাইনিং রুমে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে রাগ জন্মাল মুশরাফার উপর। মেয়েটা রান্না করে দেই দেই করে চলে গেল। বেড়ে দিলে কী হতো! বেয়াদব মেয়ে!
খাবার সাজিয়ে সবাইকে ডাকলেন। ছেলেরা এসে বসল। কাকন ও বেরিয়ে টেবিলে উপস্থিত হয়েছে। খেতে বসার পর মুশরাফাকে না দেখে জয়নাল আবেদীন জিজ্ঞেস করলেন,
‘ মুশরাফার খাওয়া শেষ? ‘
মায়মুনার রাগে যেন ঘি ঢালল কথাটা। নিজের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে ফুঁসে উঠলেন,
‘ ওই মেয়ের নাটকের শেষ নেই। সে খাবে না একসাথে। রুমে গিয়ে একা একা খাবে। বেয়াদব মেয়ে! ‘
জয়নাল আবেদীনের এতক্ষণে মনে পড়ল মুশরাফা পর্দার কথা। তিনি স্ত্রীকে থামিয়ে গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ থামো তো! এখানে আসলে ওর পর্দার খেলাপ হবে, তাই আসেনি। সমস্যা তো নেই, ও না হয় পরে খাবে। মেয়েটা যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে থাকুক। তুমি কোন ঝামেলা কোরো না।’
মায়মুনা আবার ফুঁসে উঠলেন। ছেলেদের বিচার দিয়ে বললেন,
‘ দেখলি, তোর বাবা কি বলছে? আমি না কি ঝামেলা করি! ঝামেলা করে ওই মেয়ে। আসতে না আসতেই অশান্তি শুরু করেছে। এর সাথে দেখা করবে না, ওর সাথে দেখা করবে না। এত সমস্যা হলে বিয়ে করেছিস কেন? অসভ্য, বেয়াদব মেয়ে!’
জয়নাল আবেদীন ধমকে উঠলেন, ‘ ওর সম্পর্কে তোমাকে আগেই জানানো হয়েছে। তখন তো তোমার আপত্তি ছিল না। সব জেনেশুনে ছেলেকে বিয়ে করিয়ে এনেছো। তবে এখন তোমার আপত্তি কেন?’
মায়মুনা চুপ মেরে গেলেন। শুধুমাত্র ওই মেয়ের জন্য স্বামী তাকে ছেলেদের সামনে ধমকালেন। ব্যাপারটা মানতে পারলেন না তিনি। মনে মনে মুশরাফার প্রতি ক্ষুদ্ধ হলেন। জয়নাল আবেদীন গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ চুপচাপ খাও। ‘
সবার খাওয়া থেমে গেছে। জাওয়াদ ভাত নাড়াচাড়া করছে, খাচ্ছেনা। সে বসেছে মায়ের পাশে। মায়ের দিকে তাকাল এক পলক। মা খাওয়া থামিয়ে থম ধরে বসে আছেন। জাওয়াদ বাটি থেকে এক পিস মাছ মায়ের পাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘ ও থাক ওর মতো। আমরা আমাদের মতো থাকি। তুমি ওর কথা না ভেবে খাও তো মা। ‘
মায়মুনা ছেলের দিকে অগ্নিচোখে তাকালেন। জাওয়াদ ভয়ে চোখে সরাল। খাওয়ায় নজর দিল। মাকে বুঝ দিতে বলা কথাটা পছন্দ হলো না জয়নাল আবেদীনের।
তিনি এবার ছেলেকে ধমকালেন,
‘ আমাদের মতো থাকি মানে কী? আমাদের মাঝে তোকে টানলি কেন? মুশরাফা তোর বউ। ওর সব দায়িত্ব তোর। মেয়েটা এ বাসায় তোর উছিলায় এসেছে। ওর ভালোমন্দ সব দেখার দায়িত্ব তোর। কোন হেলাফেলা করবি না। খাওয়া শেষ করে গিয়ে ওর খবর নিবি। পারলে কাল থেকে আমাদের সাথে না বসে ওর সাথে বসবি। ঠিক আছে?’
বউ আর মায়ের দ্বন্দ্ব সবচেয়ে অসহায় ব্যক্তি হলো স্বামী। সে দুই দিক থেকে চেপে থাকে। একদিকে কথা বলতে গেলে অন্যদিক চেপে যায়। মায়ের সাপোর্ট নিলে বউ ক্ষেপে, বউয়ের সাপোর্ট নিলে মা ক্ষেপে। ওর বউ কপাল ভালো। বউ ক্ষেপে না। বউয়ের হয়ে বাবা ক্ষেপে।
মায়মুনা ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছেন ছেলের দিকে, তার চোখ বলে দিচ্ছে বউয়ের সাপোর্ট নিবি তো, তোর রক্ষে নেই। বাবা ও রেগে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ বলছে, বউয়ের বিপক্ষে গেলে তোকে আস্ত রাখব না। মহা বিপদে পড়ল জাওয়াদ। এখন জবাব দেয়া মানে বিপদ। নিজে ভীষণ অসহায় মনে হলো ওর। বাবা মায়ের রোষানল থেকে বাঁচতে হলে কেটে পড়তে হবে। জাওয়াদ চট করে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কারো দিকে তাকাল না, আর না কোন উত্তর দিল। দিক বেদিক না ভেবে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।
সোজা চলে গেল অনিকের বাসায়। এই ভরদুপুরে বন্ধুকে দেখে চমকাল অনিক। বলল,
‘কীরে, এই অবেলায় কোথা থেকে উদয় হলি?’
জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। বিরক্তচোখে তাকিয়ে বলল,
‘তোরে একটা ফ্রিতে এডভাইজ দিই, জীবনে ও বিয়া শাদী নাম নিস না। বউ আর মায়ের দ্বন্দ্বে পড়লে বিয়ের শখ মিটে যাবে। ‘
অনিক ঘটনা আঁচ করতে পেরেছে কিছুটা। তাও জিজ্ঞেস করল, ‘কাহিনি কী?’
জাওয়াদ ঘটনা খুলে বলল। ওর পালানোর কথা শুনে হেসে কাহিল। হাসতে হাসতে বলল,
‘তুই শালা, লক্ষণ সেনের মতো পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে আসলি?’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘ তো আমি বখতিয়ার খিলজির মতো সামনে গিয়ে কড়া জবাব দিব? পাগল না কি! তখন জবাব দেয়া মানেই বিপদ সঙ্কেত। বাদ দে, চল লাঞ্চে যাব। শান্তিমতো খাওয়াটাও খেতে পারলাম না। শালা, এমন জানলে বিয়ের নাম ও নিতাম না।’
অনিক ক্যাটক্যাট করে হাসল। তারপর বন্ধুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। ঘুরেফিরে রেস্টুরেন্টে ঢুকল। তখন বিকেল চারটা বাজে। খাবার এলে জাওয়াদ খাওয়ায় মন দিল। অনিক জিজ্ঞেস করল,
‘ভাবির খোঁজ নিয়েছিস?’
‘নেয়া লাগবে না। ‘ আবার খাওয়ায় মন দিল জাওয়াদ।
গ্রীষ্মের আবহাওয়া ক্ষণিকে বদলে যায়। এই কাঠফাটা রোদ ছিল, এখন আকাশ কালো করে মেঘে ধরেছে। বাতাস শুরু হয়েছে, যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। খাওয়ার মাঝে জাওয়াদের ফোন বেজে উঠল। ‘রাফা’ নামটা দেখে ভ্রু কুঁচকাল। বাসায় আবার ঝামেলা হয়নি তো! বিপদের আশঙ্কায় ফোন তুলল। মুশরাফা ধীর স্বরে সালাম দিল। পরপরই বলল,
‘ আপনি কোথায়?’
জাওয়াদ নামাজ থেকে ফিরে রুমে যায়নি। তাই মুশরাফার সাথে দেখা হয়নি। মুশরাফা ভেবেছে জাওয়াদ এখনো ফিরেনি। ওয়াশরুমে থাকায় ঝগড়া শুনেনি সে। জাওয়াদ উত্তর দিল,
‘বাইরে আছি।’
‘ কখন ফিরবেন?’
‘দেরি হবে। কেন?’
‘বাতাস শুরু হয়েছে, ছাদ থেকে কাপড় আনা হয়নি। ‘
‘তো নিয়ে আসো।’
‘আমার বোরকা ধুয়ে দিয়েছি, শুকায়নি এখনো। আশপাশের ছাদে অনেক মানুষ, বোরকা ছাড়া কিভাবে যাব?’ মলিন স্বরে বলল মুশরাফা।
‘জিহান বা জিশান নেই?’
‘জিহান খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জিশান ভাইয়ার কথা তো জানি না। উনার রুমের দরজা খোলা, নেই সম্ভবত। ‘
‘তাহলে আর আনা লাগবে না। থাকুক।’
‘কত কষ্ট করে ধুয়েছি আপনার কাপড়। বাতাসে সব নিচে ফেললে, ময়লা লেগে যাবে। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন না! ‘ অনুরোধ ঝরে পড়ল মুশরাফার স্বর থেকে।
জাওয়াদ আকস্মিক ধমকে উঠল,
‘আমি বলেছি ধুতে? ধুয়েছো কেন? এখন ভিজুক। আমি অনেক দূরে আছি। আসতে পারব না। বিরক্ত করবে না, ফোন রাখো।’
মুশরাফা আরও কিছু বলতে চাইল। জাওয়াদ নিজেই ফোন কেটে দিল। অনিক খাওয়া থামিয়ে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ এবার অন্তত মানুষ হ!’
জাওয়াদ চোখ রাঙাল, ‘ আজাইরা না বকে চুপচাপ খা। ‘
আবার খাওয়ায় মন দিল। অনিক খেতে খেতে বলল,
‘ ভাবি খেয়েছে? জিজ্ঞেস তো করলি না।’
‘খেয়েছে।’ গম্ভীরমুখে বলল জাওয়াদ।
ফোন রেখে চাপা শ্বাস ফেলল মুশরাফা। জাওয়াদ অনেক দূরে আছে, এত দূর থেকে আসতে আসতে বৃষ্টি এসেছে যাবে। তাছাড়া, ওর কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে আসবে না সে। মুশরাফা বারান্দা থেকে আধভেজা বোরকা পরেই তৈরি হয়ে নিল বেরুনোর জন্য। তবে ওর মন বলছে, জাওয়াদ কোন ব্যবস্থা করবে। কোন বাহানা দিবে, ঠিক সকালের মতো। সকালে বাহানা দিয়ে কাপড় মেলে এসেছে। কাজটা মুশরাফার অকল্পনীয় ছিল। কথা শেষ করে কাপড় মেলতে গিয়ে অবাকের চূড়ায় পৌঁছেছে। নিচে এসে ফোন ফেরত দিতে গিয়ে মুখ চেপে হেসে বলল,
‘ ধরুন, আপনার ফোনের ব্যালেন্স শেষ। ‘
জাওয়াদ ঘুমের ভান ধরে রইল। কিছু বলল না। মুশরাফা আবার বলল,
‘ বউয়ের কাজে সাহায্য করা সুন্নত। সুন্নত পালন করার জন্য এত বাহানার প্রয়োজন হয়না। বিশ্বাস করুন, আমি কিছু মনে করিনি।’
জাওয়াদ নড়েনি তবু। এমন ভান করেছে, যেন শুনেইনি। মুশরাফার মনে হচ্ছে সকালের মতো কোন বাহানা দিয়ে জাওয়াদ তাকে সাহায্য করবে। কিছু কিভাবে? অতদূর থেকে উড়ে আসা ছাড়া খানিকের আগে আসা সম্ভব নয়
চলবে…
#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-২১)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
প্রাচীন রোমান দার্শনিক,মার্কাস টালিয়াস বলেছেন,
‘যতক্ষণ জীবন আছে, ততক্ষণ আশা আছে।
আল্লাহর উপর ভরসা করে একরাশ আশা নিয়ে কদম বাড়াল মুশরাফা। দরজার কাছে যেতেই ফোনটোন বেজে উঠল। আশারা সব ঝিলিক দিয়ে উঠল। ওর মন বলছে, এই ম্যাসেজেই সমাধান আছে। দ্রুত পায়ে ফিরে গিয়ে ফোন হাতে নিল। জাওয়াদের নাম্বার থেকে ম্যাসেজ,
‘ওপেন দ্যা ডোর।’
জাওয়াদ এসেছে! অবাক হলো মুশরাফা। উনি না দূরে ছিলেন, তবে কিভাবে আসলেন? ওর ভাবনার মাঝে কলিংবেল বেজে উঠল। সঙ্কেত বুঝে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। লুকিং মিররে তাকিয়ে বাইরে কারো অস্তিত্ব খুঁজে পেল না। ওড়নায় মুখ ঢেকে দরজা খুলল। উঁকি দিয়ে বাহিরটায় চোখ বুলাল। জাওয়াদকে চোখে পড়ল না। তবে তাকে বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে দিয়ে সিড়ির রেলিঙের উপর রাখা কাপড় চোখে পড়ল।
ছাদে মেলা জাওয়াদের কাপড়! এখানে কিভাবে এলো! সিড়ির নিচের দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল। ফাঁক দিয়ে তৃতীয় তলা বেয়ে নামতে দেখল এক বয়স্ক লোককে। লোকটাকে চিনে মুশরাফা। এ বিল্ডিংয়ের দারোয়ান। এ বাসায় আসার সময় দেখেছিল। লোকটাকে দেখেই দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল। মুখে চওড়া হাসির রেখা ফুটল। মনে আনন্দরা ঝিলিক দিয়ে উঠল।
মুশরাফার পর্দার ব্যাপারে স্বামীর পক্ষ থেকে প্রথম সাপোর্টিভ স্টেপ দেখে আনন্দে আত্মহারা হলো ও। লোকটা ওকে পর্দার ব্যাপারে সাপোর্ট দিতে শুরু করেছে! ভেবেই হাসি চওড়া হলো। কাপড় গুলো হাতে নিয়ে দ্রুত রুমে এলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে কল করল জাওয়াদের নাম্বারে। কল বাজল, কিন্তু উঠানো হলো না। দ্বিতীয়বারে কেটেই দিল। যেন অপাশের মানুষটা জানে সে কী বলবে। আর এই কথাগুলো শুনতে সে আগ্রহী নয়।
বিরিয়ানির প্লেট শেষ করে ডেজার্টে চামচ ডুবিয়েছে জাওয়াদ। এর মাঝে ওর ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে কানে দিল। অপাশ থেকে কী বলল শুনা গেল না। জাওয়াদ কৃতজ্ঞতার সুরে বলল,
‘ধন্যবাদ চাচা। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, মনে কষ্ট নিবেন না। আমি এসেই আপনাকে বকসিস দিব। ‘
পরপরই ফোন রাখল জাওয়াদ। সামনে তাকাতেই দেখলে অনিক তীক্ষ্ম চোখে ওকে পরখ করছে। ওর চোখে বিস্ময়। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার রূপ বেয়ে বেয়ে পড়ছে?’
বন্ধুর কথায় অনিকের দৃষ্টি নরম হয়ে এলো। পুরো ব্যাপারটা পরখ করেছে ও। দূরে বসে ও চট করে সমাধান করা ব্যাপারটায় অনেক চমকিয়েছে বেশ। বন্ধুর মাঝে নতুন কাউকে আবিস্কার করেছে যেন সে। আকস্মিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। কত চিন্তা ছিল এদের নিয়ে! এবার বোধহয় নিশ্চিন্ত হওয়ার সময় এসে গেছে। অনিক বিজয়ী হাসি দিয়ে বলল,
‘ শালা, তুই মানুষই আছিস। হুদাই অমানুষের ভান করে থাকিস।’
জাওয়াদ বিরক্তমাখা গলায় বলল,
‘কাপড়গুলো আমার। নয়তো আমার ঠেকা পড়েনি। ‘
অনিক হাসল,
‘কাপড়ের চেয়ে বড়ো কথা, বউটাও তোর। ঠেকাটা এখানেই।’
জাওয়াদ চোখ রাঙাল, ‘ এক লাইন বেশি বুঝিস তুই।’
অনিক ক্যাটকেট করে হাসল, ‘ বেশি হলে ও ঠিকটাই বুঝি। ‘
জাওয়াদের ফোন বাজল আবার। পর্দায় ‘রাফা’ নামটা ভাসছে। দেখেই কপাল কুঁচকাল । বিরক্তির সাথে বলল,
‘এই মেয়ে আমায় শান্তি দিবে না।’
ফোন কেটে বন্ধ করে রাখল। অনিক ঠোঁট চেপে হাসল। জাওয়াদ ঘুরে ফিরে বাড়ি ফিরল রাত আটটা নাগাদ। বাসায় গিয়ে সোজা মায়ের রুমে গেল। মা সেই যে রুমে ঢুকেছেন, আর বের হননি। মাকে এটা সেটা বলে রুম থেকে বের করল। জিশান বাইরে থেকে আসার সময় সবার জন্য বার্গার নিয়ে এসেছিল। মায়ের সাথে বসে বার্গার খেল। রুমে গেল না। সবার সাথে আড্ডায় বসল। আড্ডার ফাঁকে পানি খেতে ডাইনিংরুমে যেতে গিয়ে চোখ পড়ল রান্নাঘরে ভেতর। মুশরাফাকে দেখা গেল। মুশরাফা অন্যদিকে ফিরে বার্গার খাচ্ছে, বার্গার উপুড় করে দু’হাতে চেপে ধরে। সেদিনের মতো পড়ে যাচ্ছে না এদিক ওদিক। বেশ কায়দা করেই খাচ্ছে। এসব খাওয়ায় যে সে অভ্যস্ত তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। জাওয়াদের সেদিনকার ধারণা আবারও ভ্রান্ত প্রমাণ হলো।
ওর তাকানোর মাঝে মুশরাফা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। চোখাচোখি হতেই চমৎকার হাসল। আধখাওয়া বার্গারটা একটু এগিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, ‘খাবেন?’
জাওয়াদ চোখ সরাল, হাঁটা ধরল। পানি খেয়ে আবার বসার ঘরে চলে গেল। রাতের খাবার খেয়ে রুমে গেল না। জিশানের সাথে বসে খেলা দেখল। রুমে গেল রাত এগারোটা নাগাদ। মুশরাফা ওকে দেখে হেসে সালাম দিল। জাওয়াদ সালামের উত্তর নিল মনে মনে। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,
‘আমার জন্য এক কাপ কফি আনো।’
মুশরাফার অনেক কিছু বলার ছিল। অনেক কিছু করার ও ছিল। সামনে পেলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছটাও ছিল প্রবল। কিন্তু এই ক্ষণে এসে মত পাল্টাল। মানুষটা যখন কোন ক্রেডিট নিতে চাচ্ছে না, তখন তাকে জোর করে ক্রেডিট দেয়া ঠিক হবে না। মনভর্তি খুশিমাখা কথাগুলো মনেই চেপে রাখল। হেসে বলল,
‘ নিয়ে আসছি। আর কিছু লাগবে?’
‘ না। খেয়েছো রাতে?’ জাওয়াদের প্রশ্নে মুশরাফা ভীষণ খুশি হলো। লোকটা ওর খোঁজ নিচ্ছে। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘না।।’
মুশরাফার খুশির মাত্রাকে বিনাশ করে জাওয়াদ বলল,
‘রাতের খাবার খেয়ে আসবে। তুমি খাওনি শুনলে বাবা আমাকে বকবেন। তোমার জন্য আমি বাবার বকা শুনতে পারব না। ‘
মুশরাফা বুঝে উঠতে পারল না তার খাওয়া না খাওয়ার সাথে জাওয়াদকে বকার কী সম্পর্ক। সে ভ্রু কুঁচকাল। জাওয়াদ বলল,
‘ খেয়ে আমার জন্য কফি নিয়ে আসো। ‘
জাওয়াদ পাশ কাটল। মুশরাফা প্রশ্নবিদ্ধ মনেই রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। সেই বিকেলে আকাশ বেয়ে পড়া বৃষ্টির বহার এখনো কমেনি। অবিরত বৃষ্টি ঝরছে। ঝিরিঝিরি শব্দ হচ্ছে। শব্দটা শুনতে ভালো লাগছে মুশরাফার। বৃষ্টি ওর বেশ পছন্দ। কফি বানাতে বানাতে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখল কিছুক্ষণ। হুট করেই মনে এক ইচ্ছে জাগল। কফি নিয়ে রুমে এসে বলল,
‘ছাদে যাবেন?’
জাওয়াদ ল্যাপটপে ফেসবুকিং করছিল। মুশরাফার কথা শুনে বাইরে তাকাল। বৃষ্টির অস্তিত্ব দেখে ভ্রু কুঁচকাল,
‘ এই বৃষ্টির মধ্যে ছাদে কেন যাব?’
‘ আমি বৃষ্টিতে ভিজব।’
জাওয়াদ দায়সারাভাবে বলল, ‘তো আমি কী করব? তুমি কি আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে বলছো? তেমন হলে বলি, আশা ছেড়ে দাও। আমি ওসবে নেই।’
‘আপনি কফি নিয়ে সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে থাকবেন, না হয়। আমি ভিজব। চলুন না! আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে ভিজার!’ অনুরোধ ঝরে গেল মুশরাফার স্বর থেকে।
জাওয়াদ বিরক্তিমাখা গলায় বলল,
‘সকাল থেকে এই ছাদে না যাওয়ার জন্য কত কী করলে? পর্দার খেলাপ হবে এই সেই। এখন সব কোথায় গেল?’
‘তখন তো দিন ছিল। আলোতে চারদিক থেকে সব দেখা যাচ্ছিল। তাকিয়ে দেখুন এখন বাইরে অন্ধকার। কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি ছাদে থাকলে কেউ দেখবে না। আর বৃষ্টিতে ভেজা সুন্নত।’
ধীরেই বলল মুশরাফা। জাওয়াদ যেতে রাজি হলো না। মুশরাফা বুদ্ধিমত্তার সাথে চমৎকার এক গুটি চালল,
‘আমি কিন্তু খাইনি। আপনি যদি ছাদে না যান, তবে আমি খাব না। বাবার বকা খাবেন আপনি।’
এতেই কাজ হলো। জাওয়াদ রেগে তাকাল। তারপর যেতে রাজি হলো। মুশরাফা খেয়ে এলে দুজন ছাদে গেল। মুশরাফা খিমারের উপরে অংশ উপরে চাপাল গায়ে। ছাদের সিড়ির ঘরে গিয়ে খুলে ফেলল। অন্ধকারে জাওয়াদকে ও দেখা যাচ্ছে না। মুশরাফা হাতড়ে রেলিঙের উপর রাখল। তারপর সামনের দিকে পা বাড়িয়ে বলল,
‘ বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করুন। আমি যাই।’
জাওয়াদ বলল,
‘আমি কফি শেষ হলেই কিন্তু চলে যাব।’
মুশরাফা না শোনার ভান করেই ছুটে গেল ছাদে। বৃষ্টিতে উচ্ছল কিশোরীর মতো ভিজতে লাগল। জাওয়াদ দাঁড়িয়ে রইল দরজায়। একবার বিদ্যুৎ চমকাল। খনিক আলোতে দেখল মুশরাফার প্রাণোচ্ছল রূপ। এক নতুন রূপ। কে বলে পর্দা করা মেয়েদের শখ আহ্লাদ নেই? আছে, বোধহয় একটু বেশিই।
আকস্মিক জোরে বজ্রপাত হলো। আওয়াজে জাওয়াদ কেঁপে উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে কড়া স্বরে জানাল,
‘ আমি চলে যাচ্ছি। তুমি যাবে? ‘
জাওয়াদের কথা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মুশরাফা আকুল আবেদন করল,
‘আর একটু থাকি না!’
জাওয়াদ ধমকে উঠল,
‘তোমার এই বজ্রপাতে স্ট্যাচু হয়ে থাকতে ইচ্ছে হলে থাকো। আমি কি না করেছি? আমি চলে যাচ্ছি।’
জাওয়াদ ফোনের ফ্লাশ জ্বালাল। দেহ ঘুরিয়ে ফেরা ধরল। অগত্যা মুশরাফাকে ও আসতে হলো। ভেজা গায়ে খিমার পরে শরীর ঢাকল। তারপর নিচে নামতে ধরল। ঠান্ডাজনিত ধাত থেকে সিড়ি পথেই হাঁচি শুরু হলো।
জাওয়াদ বলল,
‘বড়োদের বিরক্ত করার আর বেয়াদবি করার শাস্তি দিচ্ছেন আল্লাহ। চমৎকার। আর ভিজবে?’
মুশরাফা দমল না। হাঁচি দিতে দিতে বলল,
‘ মজা লেগেছে আবার ভিজব। ‘
জাওয়াদ আর কিছু বলল না। এই মেয়ের সাথে কথা বলে পারা যায় না। রুমে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল মুশরাফা। জাওয়াদ শুয়ে পড়ল। মুশরাফা ফিরেই লাগাতার হাঁচি দিতে লাগল। মাথা নাড়াতেই চুলের পানি গিয়ে পড়ল জাওয়াদের মুখে।
জাওয়াদ ধমকে উঠল,
‘ তোমার নুডলস হেয়ার মুছো, আমার মুখে পানি পড়ছে। আর একদম হাচ্চু হাচ্চু করো না। তোমার জন্য আমার ঘুমে ডিস্টার্ব হচ্ছে। ‘
বিড়বিড় করে বলল, ‘অসভ্য মেয়ে। ‘
মুশরাফা কিছু বলল না। টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে জাওয়াদের রাগ দেখে হাসল। ওর হাসি চওড়া হলো ড্রেসিংটেবিলের উপর ওষুধের বক্সটা দেখে।
•
ওষুধ খেয়ে ঘুমানোয় জ্বর এলো না। হাঁচি বন্ধ হলো মাঝরাতে। আর সর্দির উৎপত্তি হলো। ঘুম হলো না । ফজরের সময় জাওয়াদকে জাগিয়ে তুলল। আজ বেশি গড়িমসি করল না। বাবার কল পেয়ে অযু করে মসজিদের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। বৃষ্টি নেই তখন। বাবা ছেলে নামাজ পড়ে ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে হাঁটতে বেরুলো। আপন করে বাবা ছেলে একে অপরকে পেল। কত গল্প গুজব হলো!
মুশরাফার শরীর খারাপ লাগলেও বসে রইল না। উঠে নাস্তা বানাল। জাওয়াদের টিফিন রেড়ি করল, ফরমাল ড্রেসাপ বের করে রাখল। যত যাই হোক মুশরাফার দায়িত্ব পালনে নড়বড় নেই। সকাল সবার সামনে মায়মুনা মুশরাফাকে কিছু বললেন না। স্বামী, ছেলেরা অফিসে চলে যেতেই কাল স্বামীর ধমক দেয়া নিয়ে কথা শুনালেন। অপবাদ দিলেন, মুশরাফা তাবিজ করে তার পরিবারের সবাইকে নিজের দিকে করে নিচ্ছে। যার কারণে জয়নাল আবেদীন পুত্রবধুর জন্য স্ত্রীকে বকছেন। সংসারে অশান্তি করছে.. আরও কত অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনলেন।
মুশরাফা চুপ রইল। মনে মনে বলল, ‘আল্লাহ উনাকে হেদায়েত দান করো। ‘
বকাঝকা যখন চেঁচানোর পর্যায়ে চলে গেল। তখন মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ বিশ্বাস করুন মা, আমি আপনাদের সবার ভালো চাই, শান্তি চাই। সেই সাথে নিজের ও সুখ চাই। আল্লাহর সন্তুষ্টি চাই। এই চাওয়া থেকেই আমাকে কঠোর হতে হচ্ছে। আর কিছুই নয়।’
মায়মুনা দমলেন না। বখে গেলেন। উছিলা ধরে ধরে বকলেন সারাদিন। এভাবে কাটল কদিন। রুমের বাইরের ঝামেলা কখনো রুমের ভেতর টানে না মুশরাফা। শ্বাশুড়ির কৃতকর্মের জন্য স্বামীর কাছে অভিযোগ করে না। মায়মুনা ও সেদিনের পর ছেলে বা স্বামীর সামনে মুশরাফাকে কিছু বলেন না। তাদের অনুপস্থিতিতেই অপমানের ছুতো খুঁজেন। সে হিসেবে জাওয়াদ ও খুব একটা আঁচ পায়না। স্বাভাবিক চলছে জীবন। বাবা আর বউয়ের ডাকাডাকিতে নামাজ পড়ছে।
একদিন হলো কী? মুশরাফা ওকে পরীক্ষা করতে চাইল যে, ওর নামাজে অভ্যাস হয়েছে কি না। সেদিন নিজে উঠল, জাওয়াদকে জাগাল না। জাওয়াদ উঠতে পারল না। মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল।
জাওয়াদের নামাজ কাযা হবে ভেবে না শেষ দিকে আর না জাগিয়ে পারল না। জাগাল, উঠল না। জয়নাল আবেদীন ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে একাই নামাজে চলে গেলেন। জাওয়াদ পরীক্ষায় ফেল করল।
মুশরাফা অভিমানে মুখ ফুলাল। সিদ্ধান্ত নিল, আজ সারাদিন জাওয়াদের সাথে কথা বলবে না। যার নামাজের প্রতি টান নেই, তার সাথে কিসের কথা? নিত্যকার নিয়মে সকালে রান্নায় মগ্ন হলো। টিফিন রেডি করল ঠিকই, কিন্তু রুমে দিল না। কিচেনেই রেখে দিল। রুমেই এলো না আর।
জাওয়াদের ঘুম ভাঙল সাড়ে ন’টার পর। অফিসটাইম পেরিয়ে গেছে। ঘুম ভাঙতেই ঘড়ি দেখে যারপরনাই অবাক হলো। নামাজের আগে অফিসের কথাই মাথায় এলো ওর। তড়িঘড়ি করে উঠে ওয়াশরুমে দৌড় দিল। জাওয়াদের অফিসের ড্রেসাপ মুশরাফা বের করে। সব রেড়ি করা থাকে। আজ সময়ের মতো সব কিছুই এলোমেলো পেল জাওয়াদ। কিছুই ঠিকঠাক নেই। মুশরাফার ও দেখা নেই। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হুলস্থুল লেগে গেল। শার্ট প্যান্ট পাচ্ছে না, ওয়ালেট পাচ্ছে না, ঘড়ি পাচ্ছে না।
জাওয়াদ দিশেহারা হয়ে মুশরাফাকে ডাকল,
‘মুশরাফা, মুশরাফা! ‘
জবাব এলো না। জাওয়াদে চেঁচিয়ে ডাকল। মুশরাফা সকালের নাস্তা করছে। যে সে জাওয়াদের ডাক শুনেইনি। মায়মুনা বসার ঘরে টিভি দেখছেন। ছেলের ডাকাডাকিতে বেরিয়ে এলেন। মুশরাফাকে খেতে দেখে ধমকালেন,
‘জাওয়াদ ডাকছে, শুনতে পাচ্ছিস না? কানে তুলো দিয়েছিস? তোর খাওয়া তো চলে যাচ্ছে না। ফকিরের মতো সারাদিন খাওয়ার পিছনে ছুটিস। বেয়াদব। যা দেখে আয়, আমার ছেলে কেন ডাকছে।’
মুশরাফা খাওয়া থামিয়ে রুমে গেল। ওকে দেখেই জাওয়াদ ও ধমকে উঠল,
‘ এই মেয়ে থাকো কোথায় তুমি? এতবার ডাকা লাগে কেন? আমার অফিসের সময় পেরিয়ে গেছে, জাগাওনি কেন? অফিসটা মিস হয়ে যাচ্ছে।’
মুশরাফা জাওয়াদের স্বরে অনুতাপের ছায়া খুঁজল, পেল না। লোকটার মনে ও নেই সে যে নামাজ পড়েনি। শুধু অফিস মিস হওয়ার চিন্তায় অস্থির, এদিকে যে নামাজ মিস হয়ে গেছে তার ক্ষীণ চিন্তাও নেই। মুশরাফার অভিমানের মাত্রা বাড়ল। সে উত্তর দিল না। তাকাল ও না। জাওয়াদ আদেশের সুরে বলল,
‘আমার শার্ট প্যান্ট নামিয়ে দাও।’
মুশরাফা চুপচাপ নামিয়ে রাখল। তারপর পাশ কাটিয়ে বারান্দায় চলে গেল। জাওয়াদ ওর নির্লিপ্ত ভাব দেখে ভ্র কুঁচকাল। তবে বিশেষ প্রাধান্য দিল না। তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। টিফিনটা রয়ে গেল কিচেনে। তাড়াহুড়ায় মনে নেই। প্রতিদিন লাঞ্চ আওয়ারে মুশরাফা কল দিয়ে খবর নেয়, লাঞ্চ করেছে কি না। আজ ফোন দিল না, খোঁজ ও নিল না। টিফিন না নেয়ার ব্যাপারটা তখন টের পেল জাওয়াদ । নিজেই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আজ টিফিন দাও নি কেন?’
মুশরাফা উত্তর দিল না । খট করে ফোন রেখে দিল । জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। হলো কী এই মেয়ের? আবার কল দিল। এবার ধরল না। জাওয়াদ ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে পৌঁছাতে পারল না। তবে মুশরাফার যে কিছু একটা হয়েছে তা আঁচ করতে পারল। বাসায় ফিরেও মুশরাফার আচরণ অদ্ভুতই পেল। তবে এবার কারণটা ঠিক টের পেয়ে গেল। তারপর…
চলবে…