স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি (পর্ব-২)

#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি (পর্ব-২)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

গ্রীষ্মের তপ্ততা মাড়িয়ে শেষ রাতের দিকে ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিকন্যা রুক্ষতা গ্রাস করে সুক্ষ্মতা উপহার দিল পরম যত্নে। গরমের কারণে রাতে ভালো ঘুম হয়নি মুশরাফার। বৃষ্টির প্রকোপে হিমেল হাওয়া জানালা বেধ করে ওর শরীরে লাগতেই চোখে ঘুম নেমেছিল। ফজর নামাজ পড়ে জায়নামাজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ঘুম ভেঙেছে বেলা গড়ানোর পরে। ফরিদা পারভীন বুয়ার সাহায্য সকালের নাস্তা তৈরি করে কোমল স্বরে ডাকলেন,
‘রাফা, নাস্তা করতে আয়।’

রাফার জবাব এলো না। ডাইনিং রুমের পাশে ড্রয়িংরিম। সোফায় বসে টিভিতে সংবাদ দেখছেন নাজমুল হোসেন। সম্পর্কে, ফরিদা পারভীনের স্বামী। ফরিদা পারভীন টেবিলে নাস্তা সাজাতে সাজাতে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘মেয়েটাকে একটু ডেকে দাও তো!’

নাজমুল সাহেব বসার ঘর থেকে হাক ছাঁড়লেন, ‘রাফা, রাফা? উঠ তাড়াতাড়ি। একসাথে নাস্তা করব। ‘

রাফার ঘুম পাতলা। মামার ডাক কানে গেল এই পর্যায়ে। তড়িৎ উঠে বসল। সর্বপ্রথম গায়ের ওড়না ঠিক করল। তারপর তাকাল দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে। ১০টা ৩২মিনিট! এত বেলা অবধি ঘুমাল সে! অবিশ্বাস্য চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। ফ্রেশ হয়ে রুম ছেড়ে বেরুল। তখন নাজমুল সাহেব এবং ফরিদা নাস্তা নিয়ে বসেছেন টেবিলে। ডাইনিং রুমের দরজায় করাঘাত করল মুশরাফা। অনুমতি চাইছে ভেতরে যাওয়ার। ফরিদা পারভীন প্রসন্ন হেসে বললেন,
‘আয় মা।’

মুশরাফা ভেতরে প্রবেশ করে কোমল স্বরে সালাম দিলো,
‘আসসালামু আলাইকুম।’

নাজমুল সাহেব আত্মসন্তুষ্টিজনক হেসে সালামের উত্তর নিলেন,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ঘুম কেমন হলো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো ঘুম হয়েছে।’ চেয়ারে বসল রাফা। ফরিদা অনন্যচিত্তে রাফার প্লেটে পরোটা আর মাংসের টুকরো তুলে দিলেন। রাফা খাওয়া শুরু করল। খাওয়ার মাঝে নাজমুল সাহেবের ফোন বেজে উঠল স্বশব্দে। আওয়াজটা বসার ঘর থেকে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ কল হতে পারে, এই শঙ্কায় ফোন আনার জন্য উঠতে নিলেন তিনি। মুশরাফা খাওয়া থামিয়ে উঠে দাঁড়াল। ধীর স্বরে বলল,
‘আমি নিয়ে আসছি।’

বসার ঘরে চলে গেল সে। নাজমুল সাহেব খাওয়ায় মনোযোগী হলেন। ফরিদা পারভীন তার পাশের চেয়ারে বসা। তিনি নিচু স্বরে বললেন,
‘আমাদের একটা ছেলে নেই কেন?’

নাজমুল সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন, ‘ ছেলে দিয়ে কী করবে?’

‘রাফার সাথে বিয়ে দিতাম। তারপর সারাজীবন মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে দিতাম। ইদানীং আমার ভীষণ আফসোস হয়, কেন একটা ছেলে হলো না আমাদের। এমন জানলে আমি একটা ছেলে দত্তক নিতাম। ‘ আফসোস ঝরে গেল ফরিদা পারভীনের গলা থেকে।

স্ত্রীর উদ্ভট কথায় নাজমুল সাহেব শব্দযোগে হেসে ফেললেন। ফোন নিয়ে ফেরত এলো মুশরাফা। নাজমুল সাহেব হাসতে হাসতে বললেন,
‘তোর মামী কী বলছে শুনবি, রাফা?’

মুশরাফা ফোন বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী বলছে?’
‘তার নাকি আফসোস হচ্ছে, কেন একটা ছেলে নেই আমাদের।’ আবার হাসলেন নাজমুল সাহেব।

মুশরাফা মামীর দিকে তাকাল। তারপর নির্মল হেসে বলল,
‘ কোন কিছু নিয়ে আফসোস করতে নেই মামী। আল্লাহ যা দিয়েছেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। এতেই সুখ মিলে।’

ফরিদা পারভীন উত্তর দিলেন না। কেবল চেয়ে রইলেন মুশরাফার মুখ পানে। তার ইহজীবনে এত সুন্দর ব্যক্তিত্ববান মেয়ে দেখেন নি তিনি। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব এত সুন্দর হয়! তাও বাইশ বছর বয়সী একটা মেয়ের উপচে পড়া ভদ্রতা লক্ষনীয় মেয়েটার মাঝে!

‘মুশরাফা’ বলতে বুঝায় এমন নারী, যে সৎ মনোভাবী হয়। নামের অর্থ বাস্তবিক জীবনে প্রতিফলিত হয়। এর একটা বাস্তব উদাহরণ বোধহয় মুশরাফা। নামের মতোই তার ব্যক্তিত্ব।
কখনো কারো সাথে রাগতে দেখা যায় না তাকে। কথা বলবে একবারে মেপে মেপে। স্বরটা থাকে সবসময় নিচু, কোমল। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলানো থাকে সবসময়। সব কিছু করবে রুটিন মাফিক। প্রয়োজনের বাইরে কিছুই করবে না। না খাবে, না ঘুমাবে, আর না কথা বলবে। ব্যবহারে যেমন শালীনতা, তেমনি পোশাকে ও তেমন শালীনতা। নিজে, নিজের রুম সবসময় পরিপাটি রাখে। গুছানো স্বভার তার।
নিজেকে সবকিছুতে সংযত রাখতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে সে। শত্রু সম্পর্কে ও পরনিন্দা করা তার নীতিবিরুদ্ধ কাজ। একটা মানুষ তার সাথে খারাপ ব্যবহার করলে, হয়তো সামনাসামনি নমনীয়তার সাথে জবাব দিবে। গুছিয়ে যুক্তি দিয়ে উত্তর দিবে। যেই কথা চিৎকার করে, রাগের প্রতিফলন ঘটিয়ে বলে মানুষ সেই কথাও কোমল স্বরে বলবে।
আর নয়তো চুপ থাকবে। সবচেয়ে বেশি যেটা করে তা হলো, এক গাল হেসে বলে, এই কথা বা কাজটা করা উচিত হয়নি আপনার। এটা না করলেই পারতেন।
কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে তার কাজ নিয়ে অন্যের কাছে নিন্দা করবে না।

রাফা অর্থ উদার, সহানুভূতিশীল। এটাই ওর সবচেয়ে ভালো গুন। ও ওর আশপাশের মানুষের মনটা সহজে পড়তে পারে। সুখ দুঃখে সাথে থাকে। এই যে মামার বাসায় এসেছে কদিনের জন্য। বুয়া ছিল না প্রথম কদিন। ফরিদা পারভীনের কাধে এসে পড়ল সব কাজ। রান্নাবান্না, ঘর মুছা, কাপড় ধোঁয়া, ছোটো মেয়েটাকে স্কুল থেকে আনা সব সামলাতে যখন হিমসিম খেলেন। সেই ক্ষণে রান্নাঘরে উদয় হলো মুশরাফার। ফরিদা পারভীনের হাত থেকে খুন্তি টেনে নিয়ে কোমল স্বরে বলল,
‘তুমি ফাইজাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসো। রান্নাটা আমি দেখছি।’
ক্লান্ত শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিয়েই যখন বিকেল পার হয়, তখন মুশরাফা উনার ঘুম ভাঙিয়ে ডেকে বলে,
‘ মাগরিবের আযান দিয়ে দিয়েছে। নামাজ পড়ে টেবিলে আসো। আজ নতুন একটা রেসিপি করেছি। খেয়ে দেখবে।’

কখনো আবার ফাইজার বিজ্ঞান বই টেনে বলবে, ‘আজ মামীর শরীর ভালো না। আসো, আমি তোমাকে হোমওয়ার্ক দেখিয়ে দিই।’

ফরিদা পারভীন চেয়ে থাকেন অপলক। বারেবারে মুগ্ধ হন। মামী-ভাগ্নি সম্পর্কটাকে বইয়ের পাতায় যতটা কঠিনভাবে উপস্থাপন করা হয়, তার অন্তরালে একটা অধ্যায় আছে। সেই অধ্যায়টা বড্ডো কোমল। সেই অধ্যায়ে মামীর চরিত্র হয় মমতাময়ী। ভাগ্নিদের মেয়ের মতো ভালোবাসেন তারা। অন্য সবার মতো মুখের খাবার কেড়ে নিয়ে বাঁকা কথা শুনান না। বছরের পর বছর থেকে গেলেও টু শব্দ করেন না। বরং ক্যাঙ্গারুর মতো বুকে ডুকিয়ে আগলে নেন। এই অধ্যায়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ফরিদা পারভীন। নিজের ভাই বোনের ছেলের মেয়ের মতো স্বামীর ভাই বোনের ছেলে মেয়েদের আদর করেন তিনি। কখনো বাঁকা চোখে দেখেন না। কদিন গেলেই ফোন দিয়ে আকুতি করেন, অনেকদিন হলো তোমরা বাসায় আসো না। এসে ঘুরে যাও। ননদ ননাশের বাড়ি গেলে বগলদাবা করে ভাগ্নিদের নিয়ে আসেন। লোভ দেখান, চলো তোমাকে ঘুরাব অনেক জায়গায়।
দিন দশেক আগে মেজো ননাশ তথা লায়লা আঞ্জুমানের বাসায় গিয়েছিলেন বেড়াতে। দুদিন থেকে আসার সময় লায়লার বড়ো মেয়ে মুশরাফাকে নিয়ে এসেছেন সাথে।

এই মেয়েটাকে তার অধিক পছন্দের। বাকি সব ভাগ্নিদের থেকে একটু বেশি ভালোবাসেন।
কোন কিছু নিয়ে দোটানা থাকলে, ওর কাছে বলেন তিনি। পরামর্শ চান। প্রথমে নিরব শ্রোতা হিসেবে পুরো কথা শুনবে, তারপর কিছুক্ষণ ভাববে। তারপর কোমল স্বরে যুক্তি,ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাপারটা সমাধান করবে। কী চমৎকার করে কথা বলে মেয়েটা! শুনেই বারংবার বিমোহিত হন তিনি। কথা বলতে গেলেই অন্তরাত্মা প্রশান্তিতে ভরে উঠে। মন থেকে দোয়া আসে।
মাঝে মাঝে তিনি অনুভব করেন, ফাইজা থেকেও বেশি ভালোবাসেন মুশরাফাকে। মুশরাফার ব্যক্তিত্ব এই ভালোবাসাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রতি ক্ষণে। মুগ্ধ হচ্ছেন বারেবারে। সেই সাথে আফসোসের পাল্লা ভারি হচ্ছে। কেন তার একটা ছেলে নেই? ছেলে হলে চোখ বন্ধ করে মুশরাফাকে ছেলে বউ করে নিতেন। এই মেয়ে যার ঘরে যাবে, তার ঘরে আলো ছড়াবে। স্বর্ণাভ সুখানুভূতিতে ছেয়ে যাবে তার জীবন।

দুই মেয়ে তার। বড়ো মেয়ে ফাবিহা বিবাহিত। ছোটো মেয়ে ফাইজা সবে ক্লাস এইটে পড়ে। দুটো মেয়ের একটাও মুশরাফার মতো হয়নি। দুটোই উগ্র মেজাজ। ছোটো মেয়েটা এই বয়সেই তার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলে, অথচ মুশরাফা কখনো কঠিন রেগে অবধি কথা বলেনি তার সাথে। এই আফসোস ও কম নেই তার।

অন্যমনস্ক হয়ে ভাবনার জগতে বিচরণ করছেন ফরিদা পারভীন। খাওয়ার হাত থেমে গেছে। খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়াতেই মামীর অন্যমনস্ক ভাব নজরে এলো মুশরাফার। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে ডাকল,
‘মামী?’
ধ্যানভঙ্গ হলো ফরিদার। তাকালেন মুশরাফার দিকে। মুশরাফা বলল,
‘কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি? ‘

‘নাহ।’

খাওয়ায় মন দিলেন ফরিদা। মনে চলা কথার জোয়ার মুশরাফার সামনে আনতে পারলেন না। মুশরাফা পানি ভর্তি গ্লাসটা ফরিদার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘খাওয়া শেষে মনে করে ওষুধ খেয়ে নিবে। তারপর কিছুক্ষণ ঘুমাবে। সকালে থেকে কাজ করেছো। বিশ্রাম দরকার। আজকের রান্নাটা আমি করব।’

ফরিদার আফসোসের পাল্লা ভারি হলো। তার দুই মেয়ে কখনো এভাবে বলেনি তাকে। এভাবে বুঝেনি তাকে। যে বুঝল, সে নিজের মেয়ে হলো না কেন?

মুশরাফার কড়া আদেশে খেয়ে রুমে গেলেন ফরিদা। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ক্লান্তিতে চোখে ঘুম ভর করল। মুশরাফা ব্যস্ত হাত লাগাল রান্নায়। নাজমুল সাহেব বেরুলেন বাজারের ব্যাগ হাতে। ফিরলেন ঘন্টাখানেক পর। দরজা খুলল মুশরাফা। দুহাত ভরতি বাজার নিয়ে পাঁচ তলা বেয়ে উঠে মেরুদণ্ড যেন বেকে গিয়েছে। এখন দাঁড়িয়ে থাকা কষ্টকর হলো নাজমুল সাহেবের। ফ্যাকাশে মুখে মামাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুশরাফা বলল,
‘আমাকে দিন। আপনি ভেতরে যান।’

নাজমুল সাহেব ভারি ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। হালকাটা রাখলেন মুশরাফার জন্য। মুশরাফা বাইরে চোখ বুলাল। সিড়িরুমে কেউ নেই। কারো সাড়াশব্দ নেই। এক কদম বাড়িয়ে পাপোশের উপর পা রাখল। ব্যাগ হাতে নেয়ার জন্য ঝুকতেই উপর থেকে দ্রুত বেগে সিড়ির কাছে আসতে দেখা গেল কাউকে। রাফা ব্যাগ নিয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেল। থামকানো পুরুষটার দিকে তাকাল না একবার ও। তবে পুরুষটির মুগ্ধ চাহনির বিচরণ তার চোয়ালে।

ব্যাগ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল মুশরাফা। সেই ক্ষণে ভেতর থেকে ‘রাফা’ ডাকটা ভেসে এলো। রাফা রাফা ডাকতে ডাকতে দরজায় এসে দাঁড়ালেন নাজমুল সাহেব। কোমল স্বরে বললেন,
‘ এই রাফা? ব্যাগটা আমাকে দে। তুই পারবি না।’

মুশরাফা ভেতরে ঢুকার সময় বলল,
‘আমি পারব।’

দরজা বন্ধ হলো। সিড়ির রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বিজয়ী হাসল জাওয়াদ। চোখে বিস্ময়, মুগ্ধতা মিশে একাকার। বিড়বিড় করল, ‘রাফা! নামটাও সুন্দর। মেয়েটার মতোই।’

ছোটো বেলা থেকে তার চঞ্চল স্বভাবের জন্য বকা খেয়ে এসেছে বাবার কাছ থেকে। একসাথে বেরুলে জাওয়াদ দ্রুত পায়ে হাটতো, লাফিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠতো। জয়নাল আবেদীন তখন ধমকে বলতেন, ‘ট্রেন ছুটে যাচ্ছে তোর! এত তাড়া কিসের? আস্তে হাট।’
বাবার হাজার বকার পরও সেই অভ্যাসে ভাটা পড়েনি জাওয়াদের। এখনো চলতে গিয়ে তার তাড়াহুড়ো লেগে থাকে। একবার সিড়ি গড়িয়ে পড়ে যখন পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, সেবার ব্যাথায় কাতরানোর ফাঁকে নিজেকেই গালমন্দ করেছে। নিজের অভ্যাসে বিরক্ত হয়েছে। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে এই স্বভাবটা ভালো। লাফাতে গিয়ে পা ভাঙার মতো খারাপ অভিজ্ঞতা যেমন আছে, তেমনি লাফিয়ে অনিকের আগে সিড়ি পার করতে গিয়ে প্রেয়সীর দেখা পাওয়ার মতো চমৎকার অভিজ্ঞতা ও আছে। সদ্য যোগ হয়েছে। ভাগ্যিস অভ্যাসটা বদলায় নি! ধীরে আসলে অনিকের মতো মিস করতো সে। ভেবেই বিজয়ী হাসল।

অনিক ধীর পায়ে এসে পৌঁছাল। জাওয়াদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,
‘ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এখানে কী তোর?’
জাওয়াদ হেসে বলল,
‘এখানেই তো সব।’

অনিক বুঝল না। বাঁকা চোখে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,
‘মেয়ে না পেয়ে এবার আমার বিল্ডিংয়ে চুরি করার পরিকল্পনা এঁটেছিস না কি! তেমন হলে বলে দিই, আমি তোকে চিনি না।’

জাওয়াদ হেসে বলল,
‘চুরি করে ভীতুরা। আমি সাহসী মানুষ। আমি করব ডাকাতি। এই বাসা থেকে মূল্যবান রত্ন তুলে সবার চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাব। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।’

অনিক কটাক্ষের সুরে বলল,
‘হ্যাঁ, রানী এলিজাবেথ তার মুকুট খুলে এই বাসার আলমারিতে রেখে গেছে। তুই মুকুট থেকে কোহিনূর নিতে ডাকাতি করবি।’

‘ আমি ডাকাতি করব, আমার রানীকে নিতে। রানী থাকতে রানীর মুকুটের কী কাজ? ‘ বিজয়ী সেনাপতির মতো খুশিতে গা এলিয়ে বলল জাওয়াদ।

অনিক ভ্রু কুঁচকাল। ভাবল খানিক। তারপর অবাক হয়ে বলল,
‘ কাহিনি কী মামা?’

‘কাহিনি হলো, নায়ক নায়িকার হঠাৎ দেখা। নায়িকার লাজুক মুখভঙ্গি দেখে নায়ক ফিদা। মনে প্রেম জন্মাল, বিয়ের ভাবনা এলো। উকিল বাবা প্রস্তাব পাঠাল। তারপর নায়ক নায়িকার মিল হলো। উকিল বাবা আড়ংয়ের পাঞ্জাবি পেল। ফুলের বাগানে গিয়ে নায়ক নায়িকা নাচল। ফুল দিয়ে মুখ ঢাকল। হঠাৎ ওঁয়া ওঁয়া শব্দ হলো। নায়ক নায়িকা মা বাবা হলো। উকিল বাবা নানা- মামা হলো। সেই সাথে কাহিনি শেষ হলো। অর্ধেক কাজ আমি করে দিছি। এবার বাকিটা উকিল বাবার কাজ!’ হেয়ালি করে বলল জাওয়াদ। অনিক ওর হেয়ালিতে গা না মাড়িয়ে অবাক হয়ে বলল,

‘তুই নায়িকা মানে মেয়েটার দেখা পেলি কই?’

‘ তুই তো ঠিকানা দিলি না। ঠিকানা নিজে এসে ধরা দিয়েছে। সিড়িতে হুট করে এসে দেখা দিয়েছে। ‘ ছোটো করে উত্তর দিল জাওয়াদ। ঠোঁটে প্রসন্ন হাসি।

ওরা সিড়ি বেয়ে তিন তলায় নেমে এসেছে। অনিক হাটা থামিয়ে আবার ভ্রু কুঁচকাল,
‘কয়তলায়?’

‘পাঁচতলায়। যে বাসার কাছে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। ওই বাসার কাউকে চিনিস তুই?’ আগ্রহী গলায় বলল জাওয়াদ। অনিক ভেবে বলল,
‘ওই বাসায় তো নাজমুল আংকেল পরিবার নিয়ে থাকেন। মেয়েটা নাজমুল আংকেলের মেয়ে!’ বিস্মিত স্বর অনিকের।

‘ভদ্রলোক কি তোদের বাড়িওয়ালা?’

‘না।’

‘তাহলে তোর আড়ংয়ের পাঞ্জাবি নেয়া কনফার্ম। ‘ উৎফুল্লতার সাথে বলল জাওয়াদ।

অনিক ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘ আমার পাঞ্জাবির চিন্তা না করে তুই তোর মদের চিন্তা কর। নাজমুল আংকেলের মেয়ের বিয়ে হলো কদিন আগে । আমাকে দাওয়াত দিয়েছে। মেয়েটা নাজমুল আংকেলের মেয়ে হলে ভাই তোর বাপ্পারাজ হওয়া কনফার্ম। মাতাল হয়ে টাল মাতাল ঘুরে বলবি, আমি বিশ্বাস করিনা।’

আতঙ্কে ঢেকে গেল জাওয়াদের মুখ। মাঝ সিড়িতেই থেমে গেল। করুণ চোখে তাকাল অনিকের পানে। অনিক পিছনে এসে বন্ধু কাধ চাপড়ে বলল,

‘ কাঁদিস না ভাই। আমি অন্য কোন বাড়িওয়ালার অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে দিব। তুই সুন্দর বলিস। আমাকে আড়ং এর পাঞ্জাবি দিস প্রতি ইদে। এখন চল তোকে সিগারেট কিনে দিই। ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা হওয়া ফিলিংস আনা বাধ্যতামূলক। ‘

চোখ মুখে কৌতুক ভাব বিদ্যমান ওর। জাওয়াদ ক্রুর চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ তুই নিশ্চিত বদদোয়া দিছিস। তোর বদদোয়া লাগছে, শালা। ‘

অনিক হেসে বলল,
‘আমি না, তোর বাবুনি বদদোয়া দিয়েছে দেখ গিয়ে। ‘
নিচে এসে পৌঁছাল ওরা। জাওয়াদ সিগারেট ধরাল। এক টান মেরে ধোঁয়া ছাড়ল। আকস্মিক বলে উঠল,
‘ ওকে দেখতে বিবাহিত মনে হয়নি। আচ্ছা নাজমুল সাহেবের আর কোন মেয়ে নেই?’

অনিককে ও ভাবুক দেখাল। এমনটাও হতে পারে। খানিক ভাবল। ছাদে গাছ লাগিয়েছেন ফরিদা পারভীন। নাজমুল সাহেব মাঝে মাঝে গিয়ে পানি দেন। শুক্রবারে দেখা হয় ছাদে। টুকটাক কথা হয়েছে দুই একবার। কথায় কথায় বলেছেন পরিবারের কথা। তা স্মরণে এনে বলল,

‘ আংকেলের দুই মেয়ে। বড়ো মেয়ে বিবাহিত। ছোটো মেয়ে স্কুলে পড়ে। মেয়েটা যদি বড়ো মেয়ে না হয় তবে ছোটো মেয়ে । ‘

স্কুল পড়ুয়া শুনে জাওয়াদ ভীত ঢোক গিলল। শেষ অবধি এটাই নিব্বি বের হলো! অনিক হেসে বলল,
‘ভাই, তোর কপালে বাবুনিই লেখা আছে।’

‘রাফা আরেকটু বড়ো হতে পারল না! দ্বিতীয়বার বাবুময় প্রেম সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। ‘ আতঙ্কিত গলা জাওয়াদের। অনিক প্রশ্ন করল,
‘এই রাফা’টা কে?’

‘ ছাদে দেখা মেয়েটা।’ ছোটো করে উত্তর দিল। অনিক অবাক হলো। নাম ও জানা হয়ে গেছে! পরপরই কৌতুকের স্বরে বলল,
‘মেয়েটা কী? বল, আমাল বাবুনি।’

জাওয়াদ ক্রুর চোখে তাকাল। অনিক কৌতুকের চেইন টেনে বলল,
‘ আমি উকিল বাবা হতে রাজি। আমি বরং নাজমুল আংকেলের সাথে কথা বলি। তোদের বিয়ে শাদী করিয়ে একটা বেবি সেন্টার খুলে দিই। সেখানে বাবু আর তার বাবুনি থাকবে। কদিন বাদে আরও বাবু পয়দা করবে। আর শুন? পাঞ্জাবিটা কালো রঙের দিস। জানিসই তো আমার কালো রঙ পছন্দ। মনে থাকবে বাবুনির বাবুতা?’

হো হো করে হেসে উঠল অনিক। জাওয়াদ শুধু রেগে তাকাল। সময়টাই খারাপ যাচ্ছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here