কৃষ্ণ কলির গল্প-০৫

#কৃষ্ণ কলির গল্প-০৫
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

দেখতে দেখতে তিনমাস চলে গেলো। প্রিয়তা এখন পুরোপুরি সুস্থ। বৈশাখ মাসের দিন। তেতে উঠা টিনের চালে যেনো অগ্নিঝরা রোদ। দুপুরের রান্না করতে গিয়ে বেসামাল অবস্থা প্রিয়তার। গা গতর ঘামে চুপচুপ করছে। দুপুরের খাবারের আয়োজন শেষে তড়িঘড়ি করে করে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সে।লম্বা একটা সাওয়ার নিয়ে ঘন্টা খানিক পর বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে বাবা নাজির হোসেন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে দীর্ঘ ১৫ বছর যাবত চাকরি আসছেন তিনি। ভদ্রতা ও সততার খাতিরে গ্রামে বেশ নাম ধাম আছে তার।

‘বাড়ি ফিরে হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসতেই খাবার সামনে দেয় প্রিয়তা। পাশের চেয়ারে বসে হাত পাখা নিয়ে বাতাস দিতে থাকে বাবার গায়ে। নাজির হোসেন তৃপ্তি নিয়ে তাকায় মেয়ের দিকে। স্বস্তির একটা নিঃশাস ফেলে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দেন।

‘ঘরে একটা মেয়ে থাকা মানেই একজন বাবার জন্য পাওয়া অমূল্য রত্ন। মেয়ে মানেই ঘরের লক্ষী। আল্লাহর পক্ষ থেকে বাবাদের অর্জিত জন্মধাত্রী মা সমতুল্য বিশেষ উপহার। যে ঘরে মেয়ে আছে সে বাবার দুনিয়াতেই একটি জান্নাতি ঘর আছে।’

‘নাজির হোসেনের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে। প্রিয়তা আগের মতোই নিরলস ভাবে বাবাকে বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ই হাত পাখা টা একটু স্থির করে নড়েচড়ে বসে প্রিয়তা। বাবার দিকে তাকিয়ে খুব রয়েসয়ে বলে,

‘বাবা আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাই। এভাবে ঘর বন্দী হয়ে থাকতে আমার একদমই ভালো লাগছেনা।

‘প্রিয়তার কথায় নাজির হোসেন এর খাওয়ার কোনো হেলদোল হলো না। মনোযোগ সহকারে খাওয়া দাওয়া শেষ করে প্লেটে পানি ঢালেন তিনি। চেয়ার থেকে গামছা নিয়ে হাতের এটো পানি মুছতে মুছতে প্রিয়তার দিকে নজর দেন। শান্ত গলায় বলেন,

‘আমি কাল ই তোর কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলে আসবো। সব কিছু পাকাপোক্ত করে এসে তোকে জানাবো। তুই নিশ্চিন্তে থাক মা।

কথা টা বলে নাজির হোসেন নিজের ঘরে চলে গেলেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে এক বেলা ঘুমানো তার অভ্যাস। দুই রুমের টিন শেড বাড়িটাতে বাপ-মেয়ে দুইজন ছাড়া আর কেউ নেই। প্রিয়তার যখন চার বছর বয়স তখন তার মা মারা যায়। মেয়ের কথা চিন্তা করে আর দ্বিতীয় বিয়ের সাহস করেন নি নাজির হোসেন। তখন থেকেই মাতৃহীন প্রিয়তা কে একাই কোলে পিঠে করে বড় করেছেন। সময় মতো বিয়েও দিলেন। কিন্তু বিধি বাম। বিয়ের সুখ প্রিয়তার কপালে আর সইলো কই!

‘নাজির হোসেন নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর শীতল চোখে প্রিয়তা চেয়ে থাকে তার বাবার চলে যাওয়ার পথে। প্লেটে দু চামচ ভাত নিয়ে প্রথম লুকমা মুখে তুলে নিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে, ‘

‘আজকের এই অবহেলিত প্রিয়তার মুখ আমি বদলে দিবো। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে নিজেকে নিয়ে যাবো উন্নতির সুউচ্চ শিকড়ে।

তারপর চলে গেলো বেশ কিছু মাস। প্রিয়তা নিয়মিত কলেজে আসা যাওয়া করছে। কলেজ থেকে ফিরে ঘরের কাজ শেষে বই ই তার একমাত্র সঙ্গী। সব কিছু ঠিকঠাক মতো চললেও প্রিয়তাকে মাঝে মাঝে বেশ গম্ভীর দেখা যায়। চোখে মুখে ফুটে উঠে বিষাদের ছাপ। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। টেবিলের উপর বই রেখে জানালা দিয়ে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিয়তা। বাবা নাজির হোসেন বারান্দায় বসে খেয়াল করলেন বিষয়টা। তিনি অনেকক্ষণ যাবত দেখছেন প্রিয়তা বই সামনে নিয়ে বসে থাকলেও একটা অক্ষরও পড়ছেনা। অথচ কয়দিন পর তার ফাইনাল পরীক্ষা। তার চোখ দুটো দারুন মন খারাপে টলমল করছে। মুখটা চাপা কষ্টে চুপসে গেছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি চোখ বেয়ে ঝপঝপিয়ে বৃষ্টি নামবে।

‘,নাজির হোসেন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। সতর্ক পায়ে গিয়ে দাড়ালেন মেয়ের পাশে। আলতো করে কাঁধে হাত রাখতেই অপ্রত্যাশিত ছোয়ায় চমকে উঠে প্রিয়তা। কিন্তু কোনো কথা বললো না। আগের মতোই বাইরে দৃষ্টিবদ্ধ করে চেয়ে রইলো খোলা আকাশের দিকে।

‘আমার মায়ের কি আজ ভীষন মন খারাপ? কেউ কিছু বলেছে আমার মাকে?

প্রিয়তার দু কাধে হাত রেখে গালের কাছে মুখ নিয়ে আদুরে গলায় কথা গুলো বলেন বাবা নাজির হোসেন। এমন আদুরে ভঙ্গিতেও প্রিয়তার তেমন কোনো পরিবর্তন হলো না। সে আগের মতোই নিরব রইলো। দ্বিতীয় বারের মতো বাবা একই কথা জিজ্ঞেস করলেন,

‘ এবার প্রিয়তা আর চুপ থাকলো না। বাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। সমস্ত কষ্ট গলায় ঢেলে দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো প্রিয়তা।

নাজির হোসেন যেনো থমকে গেলেন। এই প্রথম চোখের সামনে প্রিয়তাকে এভাবে কাঁদতে দেখছেন তিনি। তিনি খেয়াল করেন প্রথম বারের মতো প্রিয়তা এতোটা ছন্নছড়া হয়ে পড়েছে,নিজের কাছে ভেঙে পড়েছে। ছিটকে পড়েছে তার শক্তপোক্ত পৃথিবী টা ছেড়ে।

কিন্তু তিনি প্রিয়তাকে আটকালেন না। তিনি প্রত্যক্ষ ভাবে যেনো প্রিয়তাকে কাঁদতেই বলছেন। কাঁদলে শরীর মন হালকা হয় কি না!

প্রিয়তা কাদছে। অনবরত কাদছে। সাথে কাঁদছে এক অসহায় বাবার মন।

কেটে গেলো বেশ কিছুক্ষন। কান্নার আওয়াজ কমে গেলেও এখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছে প্রিয়তা। মেয়েকে ছেড়ে চেয়ার টেনে প্রিয়তার মুখোমুখি বসলেন বাবা নাজির হোসেন।
শান্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। কন্ঠ খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কি হয়েছে প্রিয়? আকাশ পাতাল এক করে এভাবে কাঁদলি কেন?

‘প্রিয়তা একটু নড়েচড়ে বসে। হাতের তালুতে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নেয়। প্রিয়তার চোখ বলছে সে সমস্ত ব্যথা বাবার কাছে গচ্ছিত করে নিজে হালকা হতে চাইছে। মেয়ের চোখের ভাষা যেনো মুহুর্তেই পড়ে নিলেন বাবা নাজির হোসেন। সমস্ত ভাবনা তুচ্ছ করে মেয়ের দিকে মনোযোগী হলেন। প্রিয়তা আহত গলায় বলা শুরু করলো,

‘নিহিতা, আমার সহপাঠী। দেখতে শুনতে বেশ সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা। গত মিডটার্ম পরীক্ষায় ও সেকেন্ড হয়েছে। আমি ফার্স্ট। অথচ ক্লাসে আমি সঠিক কিছু বললেও সেটা অতোটা গ্রাহ্য করা হয় না যতোটা ও ভুল বললেও করা হয়। কিছু স্যার মেডাম থেকে শুরু করে ক্লাসের অনেক সহপাঠী আমার গায়ের রং নিয়ে বিদ্রুপ করে। মুখ টিপে হাসে। আজ আমাদের কলেজে একটা সমাজ সেবি টিম এসেছিলো। তাদের উদ্দেশ্য মেধার ভিত্তিতে স্কলারশিপ দেওয়া। মেয়েদের সহায়তা করা। সেখানে নিহিতা সহ অনেক মেয়েই নাম দিয়েছে। আমি নিজের নাম দিতে যাবো তখন নিহিতা সবার সামনে বলে উঠলো,

‘একবার স্বামীর ঘর থেকে ফেরত এসেছিস। এসব পরীক্ষা টরীক্ষা না দিয়ে তোর মতো কাউকে আবার বিয়ে করে সংসার শুরু কর। ওটাই ভালো হবে।

নিহিতার কথায় সেখানে আমার নামটা আর নিলো না তারা। বললো, এটা শুধু মাত্র অবিবাহিত মেয়েদের জন্য। বিবাহিতদের জন্য নয়।

‘জানো বাবা আজ খুব কষ্ট পেয়েছি। শুধু মাত্র গয়ের রং কালো বলে কোথাও দাম পাইনা। কেউ এতোটুকু মূল্য দেয় না। সবাই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। শুধু বাইরের সৌন্দর্য্যটাই কেনো মানুষ খুজে? ভেতরটা কেনো দেখে না? বলতে পারো বাবা?

‘মেয়ের এমন বাধ ভাঙা আর্তনাদে চোখ টলমল করে উঠে বাবা নাজির হোসেনের। মেয়ে কে স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা তার অজানা। কোনো পথ তার জানা নেই। শুধু ছলছল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘এমন কুৎসিত কিছু কীট আর ছাইয়ের ভেতর থেকেই তোকে সোনা কুড়িয়ে নিয়ে আসতে হবে রে মা। থেমে গেলে চলবে না। সবার অগোচরে থেকেই তুই দেখিয়ে দে

‘বৃক্ষের পরিচয় ফলে’ হয়। সাদা চামড়ার খোলসে নয়।

বাবার কথার মাঝে কি ছিলো প্রিয়তা জানে না। নিজের অজান্তেই হাত দুটো মুষ্টি বদ্ধ হয়ে আসে। মস্তিষ্কের জেদ আসে। শক্ত হয় মন। এরপরই রচিত হয় কৃষ্ণকলির এক একটা অদম্য বিজয়ীর গল্প।

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here