কৃষ্ণকলির গল্প-০৪

#কৃষ্ণকলির গল্প-০৪
লেখনীতে -বর্ষা ইসলাম

‘আমি আর ও ঘরে ফিরবো না বাবা। প্রয়োজনে আমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দাও। তবুও ও ঘরে আমাকে আমাকে ফিরে যেতে বলো না।

‘বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে কয়েকবার দম নিয়ে কথা গুলো বললো প্রিয়তা। প্রিয়তার বাবা নাজির হোসেন মাথায় হাত দিয়ে নিচু হয়ে দরজায় ঠেস দিয়ে বসে আছেন। মেয়ের কথায় অসহায় চোখে একবার উপর দিকে তাকালেও সাথে সাথেই আবার চোখ নামিয়ে ফেললেন। নাজির হোসেন কিছু বলে উঠার আগেই দরজার ওপাশ থেকে ফুঁসে উঠলেন প্রিয়তার ফুপু নাজমা বেগম। বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন,

‘যাবো না বললেই হলো? স্বামীর ভাত ছাড়ার মানে বুঝিস? সংসার করতে হলে এই একটএ আকটু ঝামেলা হবেই। তাই বলে সংসার ভেঙে চলে আসলে হবে নাকি? কালো হয়ে জন্মেছিস কথা একটু শুনতেই হবে। এতো দেমাগী হলে চলবে না। মানিয়ে নেওয়ায় নারীর জীবন।

‘তুমি এটা কে একটু আকটু ঝামেলা বলছো ফুপু? আমি তো দিনের পর দিন মুখ কামড়ে পরেই ছিলাম। কি পেলাম? শেষ অবদি তো নিজের জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে হলো। কালো হয়ে জন্মেছি বলে তুচ্ছ হয়ে যাই নি। ভাঙা কুলো দিয়ে পড়ে যাই নি। মানিয়ে নেওয়া যেমন নারীর জীবন, তেমনি মেনে না নেওয়াটাও নারীর জীবন। সব কিছু মেনে নিতে নেই। মেনে নিতে গেলেই মানুষ পিষে দিয়ে যাবে মাটিতে ঝরে পড়া পরিত্যক্ত শিউলি ফুলের মতো। অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে। পারবো না মানিয়ে নিতে। এটা মানিয়ে নেওয়ার মতো ছোটো কোনো বিষয় নয় ফুপু।

‘নাজমা বেগম খেয়াল করে প্রিয়তা অনবরত কাঁপছে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। অসুস্থ শরীরটা নিয়ে ভারী ভারী দম ফেলছে। সেদিকে তেমন মালুম করলেন না তিনি। আগের মতোই ঠাট ধরে রেখে শক্ত গলায় বললেন,

‘তবে কি ডিভোর্স চাইছিস?

‘আমি উনার কাছে অনেক আগে থেকেই মৃত ফুপু। ডিভোর্সের কোনো প্রয়োজন নেই।

‘তোর এমন বাঁকা তেরা কথা আমার মোটেও ভালো লাগছে না প্রিয়। এ সমাজে স্বামী ছাড়া নারী ঠিকে থাকার পরিনতি বুঝিস? এ সমাজ তাদের ভালো চোখে দেখে না। পাড়া প্রতিবেশী উঠতে বসতে খোঁটা দিবে। রাস্তায় বের হলে আঙুল উঁচিয়ে বলবে,

‘ঐ দেখো স্বামী পরিত্যক্ত নাজির হোসেনের মেয়ে যাচ্ছে। মাস খানিকও টিকতে পারিনি স্বামীর ঘরে। ফেরত এসেছে। নিশ্চয়ই মেয়ের চরিত্রে দোষ আছে।

‘কি কি বললো না বললো সেদিকে কান দেওয়ার এতো সময় আমার নেই ফুপু। আমি দু বেলা না খেয়ে উপোস করে মরলেও এ সমাজ আমাকে চেয়েও দেখবে না। দিনের পর দিন কষ্টে থাকলেও এ সমাজ আমার দু পয়সার উপকারেও আসবে না। তাহলে আমি কেনো সমাজের লেজ ধরে পড়ে থাকবো? আমি যখন রক্তাক্ত হয়ে হসপিটালের বেডে কাতরাচ্ছিলাম তখন তোমার সমাজ কি করেছিলো আমার জন্য? দিনের পর দিন যখন স্বামীর ঘরে অপমান,অবহেলা সহ্য করে আকাশ সমান যন্ত্রণা নিয়ে দাতে দাত চেপে বেঁচে ছিলাম তখন তোমার সমাজ কোথায় ছিলো? তখন তো সে বলে নি, কালো হয়ে জন্ম নেওয়া কোনো অপরাধ নয়! বিধাতার সৃষ্টি সব ই সুন্দর। বলেছিলো? বলেনি। বরং এ সমাজ আমায় চোখে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে,

‘কালো হয়ে জন্ম নেওয়াটা আমার জন্য মহা পাপ। আজন্ম পাপ। এ জগৎ সংসার শুধুই শ্বেত চামড়া মানুষের জন্য। আমার মতো কৃষ্ণকলির জন্য নয়। এ বৈষম্য আর কত দিন ফুপু?

প্রিয়তার কথায় নাজমা বেগম চুপসে গেলেন। প্রিয়তার সাথে কথা না বাড়িয়ে মোড় ঘুরালেন নাজির হোসেনের দিকে। মেঝেতে ঠেস দিয়ে বসে বিদ্রুপের গলায় বিলাপ করতে করতে বললেন

‘আপনাকে সেদিন কত করে বললাম ভাইজান শুধু মাত্র শুভ্রর বাবার কথায় মেয়েটাকে ও ঘরে পাঠিয়েন না। ছেলেকে আগে ভালো মতো বুঝেন,শুনেন। তারপর না হয় কথা আগান। কথা শুনলেন না আমার। এখন দেখলেন তো মেয়েটার কি দশা হলো। ছয় মাস না হতে হতেই স্বামী হারালো,ঘর হারালো। পেটে নাকি বাচ্চা ছিলো সেটাও গেলো। কি দুর্গতি! কি দুর্গতি!

নাজির হোসেনের চোখের কোনে পানি টলমল করছে। মা মরা একমাত্র মেয়ের এমন করুন পরিনতি চোখের সামনে দেখতে হবে তা তিনি কল্পাতেও ভাবেন নি। চোখভর্তি পানি নিয়ে মায়া মাখা মুখে প্রিয়তার দিকে তাকান বাবা নাজির হোসেন। কয়েকদিনে চেহারার কি হাল হয়েছে মেয়েটার। মোটা সোটা শরীর টা কেমন ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছে। চোখের নিচে কালি জমেছে। গায়ের রং কালো থেকে আরও তীব্র হয়েছে। নিজেকে আর সামলানো গেলো না । দু হাতে মুখ ঢেকে বুক ডুকড়ে কেঁদে উঠলেন নাজির হোসেন। এ কান্নার যেনো কোনো স্বস্তি নেই। যেনো চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে কত শত সপ্ন ভেঙে যাওয়ার আর্তনাদ, ঝরে পড়ছে নিষ্পাপ শিশুর পাঁজর ভাঙা গুনগুন কান্নার নিষ্ঠুর, ভয়াবহ আকুতি।

‘এ সমাজে পুরুষদের নাকি কাঁদতে নেই। সমাজ সেটা ভালোভাবে নেয় না,ভালো চোখে দেখে না। পুরুষের চোখের জল মানেই তার মাঝে পুরুষত্বের দাম্ভিকতা নেই,আছে নারী সুলভ মেয়েলি ভাব। আমাদের শিক্ষিত সমাজ এটাই মানে, এটাই জানে।

তবে বাবারা কেনো কাঁদেন? মেয়ের মলিন মুখ দেখে বাবারা কেনো ভেঙে পড়েন? কেনো চাপা আর্তনাদে ফেটে পড়ে তাদের সুস্থ সুন্দর শরীর? বিধস্ত হয় মন! তবে কি তারা পুরুষ নয়? নাকি ভুল করে পৃথিবীতে চলে আসা পুরুষের আদলে গড়া মমতাঘেরা বৃহৎ ছায়াকুন্জ?

‘কত রাত চলে গেলো আমি ঘুমোতে পারিনা। আমার সব কিছু হাহাকারে ভরে আছে। চৈত্রের দারুন খরার মতো খা খা করছে আমার রুম,বিছানা, বারান্দা থেকে শুরু করে সব কিছু। প্রিয়তা নেই আজ পাঁচ মাস গড়ালো। অনেক ভাবে খুঁজেছি প্রিয়তা কে। কিন্তু পাইনি। শেষমেশ গ্রামে গেলাম অন্তত প্রিয়তার কবর টা এক নজর দেখবো বলে। শেষ বারের মতো ক্ষমা চেয়ে নিবো বলে। আমার জীবন তো এখন কচু পাতার পানির মতো। কখন জানি টুপ করে ঝরে পড়ে। শারীরিক অবস্থা দিনকে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এই অসুস্থ শরীর টা নিয়ে সেদিন গ্রামে গিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হলোনা। বাবা মা সবাই এক প্রকার অপমান করেই কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিলেন। তারা আমার শুকনো মুখ টা দেখেও কিছুই বুঝলেন না। বুঝলেন না আমি আর কয়েকদিনের মেহমান পৃথিবীতে। নিজে থেকে বলতেও ইচ্ছে হলো না ‘ ও বাবা, ও মা, আমি ভীষন অসুস্থ্য। আমাকে কিছু দিন থাকতে দাও এখানে। বুক ভরা যন্ত্রণা আর আফসোস নিয়ে চলে এলাম সেখান থেকে। আসার সময় প্রিয়তার বাড়ির আঙিনায় গিয়েও চোরের মতো ফিরে আসলাম। ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না। রাত তখন ১১ টা। গ্রামের রাস্তাঘাট পুরোপুরি জনমানবহীন। প্রিয়তার খোঁজ দেওয়ার মতো একটা মানুষের দেখাও পেলাম না। তবে মনের কোথাও একটু নিভু নিভু আলো জ্বলছে। মন বলছে প্রিয়তা মরে নি। সে এ পৃথিবীতেই আছে। খুব সুন্দর ভাবে বেঁচে আছে।

‘তারপর চলে গেলো অনেক দিন। এখন গভীর রাত। পুরো বাড়ি অন্ধকার। ইদানীং আলোতে খুব ভয় হয়। আর অন্ধকার এখন ভীষন প্রিয়। আমার প্রিয়তার মতোই খুব আপন। জানালার ফাঁক গলে একটু একটু চাদের আলো আসছে। সে আলো গড়াগড়ি খাচ্ছে আমার মেঝেতে। আমি অবাক হয়ে দেখছি। পলকহীন ভাবে উপভোগ করছি আমার প্রানহীন ঘরের চাঁদের অপরুপ সৌন্দর্য। মনে হলো প্রিয়তা কে আর একবার পেয়ে গেলে কোনো ভাবেই এ সৌন্দর্য্য হারিয়ে যেতে দিতাম না। প্রিয়তার কোলে মাথা রেখেই কাটিয়ে দিতাম এ রাত। মাঝে মাঝে খুনসুটিতেও মেতে উঠতাম। প্রিয়তা লাজুক মুখে আমার নাক চেপে বলতো,

আজকাল আপনি খুব দুষ্ট হয়েছেন শুভ্র।

মানুষ তো কল্পনাতেই সুখী। কল্পনার সুখ স্রোতে ভেসে ভেসেই হঠাৎ ই চোখ বুঝে এলো। অনেক দিন এমন শান্তি তে ঘুমাই না। অথচ একটু স্বস্তি নিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করতেই লাফ দিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়।আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। কন্ঠনালী কাঁপছে। ঘুমের ঘোরে আমি স্পষ্ট দেখেছি,

‘ক্ষত বিক্ষত একটি শিশু রক্তাক্ত অবস্থায় গড়াগড়ি খাচ্ছে আমার ঘরের মেঝেতে। কি ভয়ংকর তার গুঙানির আওয়াজ। গড়াগড়ি করতে করতেই সে ধেয়ে আসছে আমার দিকে। কি ভয়াবহ তার ছোট চোখের চাহনী। আমার অন্তর আত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। বারবার ফাঁকা ঢোক গিলছি। সেই তীব্র গুঙানির মাঝেই আমি আবারও স্পষ্ট শুনতে পেলাম,

‘তুমি খুনী! তুমি খুনী! তোমার রেহাই নেই।রেহাই নেই।

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here