ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,অন্তিম_পর্ব

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,অন্তিম_পর্ব
#রোকসানা_রাহমান

“” তুমি আমাকে ততদিন স্পর্শ করতে পারবেনা যতদিননা মহসীন রুবিনাকে স্পর্শ করবে!””

রিপ্তির আকস্মিক বোমায় ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার উপক্রম অনুভবের। থম মেরে চেয়ে আছে রিপ্তির দিকে। অনুভবের হাতের বাধন শীথিল হতেই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো রিপ্তি। বিছানা থেকে নামতে নামতে বললো,,

“” আপনার জন্য এটাই প্রাপ্য ছিলো। আমাকে দুর্বল করে সব ঘেটে দিয়েছেন। কি থেকে কি হয়ে গিয়েছে আপনি কি আন্দাজ করতে পারছেন? আপনার জন্যই আমার আবারও মহসীনের কাছে যেতে হয়েছিলো। এমনি এমনিতো যায়নি নিরুপায় ছিলাম আমি। যার মোহ থেকে বের করার জন্য এতকিছু করেছিলেন,সেইতো তার কাছেই আমাকে ছুড়ে মারলেন। তবে,হ্যা হয়তো আপনার জন্যই সেই ছোট্ট রিপ্তিটা কঠিন মনের হতে পেরেছে। নাহলে মহসীনের এতো বড় দুর্বলতাটা যেনও আমি কি করে এতোটা পাষাণ হলাম।””
“” দুর্বলতা?””

রিপ্তি চুপ করে গেলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। সেদিন ভাবীর সাথে মহসীনের সব কথা সে শুনে নিয়েছিলো। ইচ্ছে করেই আড়াল থেকে সবটা শুনেছে। কারণ,তার মন যে খুব করে জানতে চাইছিলো মহসীন কেন রিপ্তিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো আর এতোদিন ধরে এখানে একসাথে আছে তবুও কেন তাকে কাছে টেনে নিচ্ছেনা। তখনি সবটা জানতে পারে,শুধু শারীরিক অক্ষমতা নয় ভবিষ্যতে কি হতে পারে সেই ভয়টাও মহসীনের মধ্যে চাপা নিষেধ কাজ করছিলো।

“” কোন দুর্বলতার কথা বলছো,রিপ্তি?””

রিপ্তি কথা এড়িয়ে বললো,,

“” আমি আপনার এতো কাছে অথচ আমাকে ছুতে পারবেন না,এটাই আপনার জন্য কঠিন শাস্তি! আপনাকে এমনি এমনি সব দিয়ে দিবো? আগে শাস্তি ভোগ করে নিজে শুদ্ধী হোন তারপর কাছে আসবো। খবরদার যদি জোরাজুরি করছেন,স্বামীর অধিকার ফলাতে আসছেন তাহলে..””
“” তাহলে?””
“” আমার বাবাইকে দেখছি না। কোথায় লুকিয়েছেন? আমি তাকে দেখবো,ছুবো,আদর করবো,আমার বুকের খনিটা এখন থেকে আমার বুকের গুপ্তঘরে থাকবে। ভালোবাসার আদরে!””

রিপ্তি আহ্লাদীপনায় কথাগুলো শেষ করে দরজার দিকে এগুলে,ওর হাত চেপে ধরে অনুভব। শুকনো গলায় বললো,,

“” তুমিইতো বলেছিলে,পাপের ভাগিদার দুজনের সমান সামন। তাহলে শাস্তি আমি একা কেন ভোগ করবো? তুমি দুর্ভোগে ভুগেছো,আমিও ভুগেছি। তাহলে এখন অতিরিক্ত শাস্তিটা শুধু আমার জন্য? পক্ষপাত হয়ে যাচ্ছেনা?””

রিপ্তি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুড়লে অনুভব বাঁকা হেসে বললো,,

“” তোমাকেও শাস্তি পেতে হবে। আমি যতদিননা তোমাকে স্পর্শ করছি,তুমিও ততদিন তোমার ছেলেকে স্পর্শ করতে পারবেনা। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য আমি ঠিক যতটা ফটফট করবো,ছেলেকে কাছে পাওয়ার জন্যও তুমিও ততটাই ছটফট করবে!””

রিপ্তি অবাক সাথে হতাশ। যুক্তিতে সে হেরো। সে বিনাবাক্যে পরাজয় স্বীকার করে বালিশে মাথা ঠেকালো। ডান কাথ হয়ে শুয়েছে। একবার ঘাড় বাকিয়ে চোখের ইশারায় শাসালো অনুভবকে,যার মানে এই– ভুল করেও আমাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখাবেন না।

~~~

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলো রিপ্তির। হাসফাস অনুভব হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে তার বাবাইটা তাকে কাছে চাইছে। খুব কান্না করছে। সাথে অভিমান। রিপ্তি নানারকম দুশ্চিন্তা নিয়ে বা-পাশে ঘুরতেই বুকে নরম ছোয়া পেলো। চোখ মেলতেই চোখের কোণে জল জমে গেলো। নরম নরম হাতদুটো নাড়িয়ে নাড়িয়ে রাতের আবছা আলোয় খেলছে তার গর্ভরত্ন! রিপ্তি আর অপেক্ষা করতে পারেনা। বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো নিজের সন্তানকে। সারা শরীর ভরিয়ে দিলো অজস্র মাতৃস্নেহের আদরী চুম্বনে। চুমু খেতে খেতে চোখ পড়ে হাতে। ছোট্ট আঙুলের মাঝে এক টুকরো কাগজ আকড়ে ধরে আছে সে। তৎক্ষনাৎ কাগজটি নিয়ে তাতে চোখ বুলায় রিপ্তি,,

**মায়ের কাছ থেকে সন্তানকে দুরে সরিয়ে রাখার দুঃসাহসটা করতে পারলাম না,বউ! বউটা আমার,সন্তানটাও আমার। দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা মানে নিজেকেই কষ্ট দেওয়া। এমন বোকামীতো আমি করবো না! আমার শেষ চেষ্টাটাও থাকবে তোমাদের দুজনের ঠোঁটে হাসি ফুটানোর জন্য। তারজন্য আমি সব করতে রাজি। শুধু বিছানা নয়,পৃথিবী ছাড়তেও একটিবার ভাববো না।**

রিপ্তি চট করে বিছানার অপর পাশে তাকালো। অনুভব নেই। দ্রুত চোখ রাখলো মেঝেতে। হ্যা,অনুভব মাটিতেই শুয়ে আছে। রিপ্তি কয়েক মুহুর্ত অনুভবের নিদ্রারত চেহারায় চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। চোখ বন্ধ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া রাখলো,সব ঠিক করে দাও,প্রভু!

~~~
“” তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন?””

রিপ্তির উদ্বেগময় প্রশ্নে প্রায় কেঁদেই দিবে এমন ভাব রুবিনার। ফোনটা এক কান ছেড়ে অন্যকানে ধরে বললো,,

“” তোর সাথে বন্ধুত্ব করাই ভুল হয়েছে। তোর জন্যই ঐ কঠিন মনের লোকটাকে বিয়ে করতে হলো। বান্ধুবী হয়ে বান্ধবীকে এভাবে ঠকালি? কি করে পারলি রিপি? এতো দুঃখ আমি কই থুমু?””

রিপ্তির মনে অজানা আসঙ্ক জায়গা করে নিচ্ছে। এমন করে বলছে কেন? তাহলে কি মহসীন রুবিনার সাথে খারাপ ব্যহার করেছে? রিপ্তি সঙ্কিতকন্ঠে বললো,,

“” কি হয়েছে?””
“” কি হয়নি বল। আমি তোর সাথে ফোনে কি বলেছি সব শুনেছে। সেই রাতেই আমাকে বাড়িতে দিয়ে গেলো। বলে কিনা,আমার সাথে এডজাস্ট হতে তোমার সময়ের প্রয়োজন। আমারও সেম। তোমাকে সঙ্গ দিতেই এই কয়দিন বাসায় ছিলাম,তবুও তুমি একা ফিল করেছো। কাল থেকে তো আমি রেগুলার ভার্সিটিতে চলে যাবো। একা একা কি করে থাকবে? তোমার কথা বলার মানুষতো জোগার করে দিতে পারছিনা। তাই তোমার বাবা-মায়ের কাছে রেখে গেলাম।””
“” তোকে দিয়েই চলে গিয়েছে?””
“” তা নয়তো কি? এমন বদমাস্টার আমি জীবনেও দেখিনি। তোর খুজে খুজে এর গলায় আমাকে ঝুলাতে হলো?””
“”তার সাথে বিয়ে হয়েছে বলে এতো রাগ নাকি,তার থেকে দুরে এসেছিস বলে অনুরাগ?””

রুবিনা কিছু সময় মৌন থেকে বললো,,

“” সে যেটাই হোক,কারণ দুটো তো একজনকে ঘিরেই তাইনা?””

রিপ্তি মুচকি হেঁসে বললো,,

“” কল করেই যার নামে এতো নালিশ দিস,তার প্রেমে পড়লি কি করে?””

রুবিনা লাজুককন্ঠে বললো,,

“” জানিনা!””

রিপ্তি উদাসী মনে বিড়বিড় করলো,,

“”মানুষটাই এমন,না চাইতেও অপ্রত্যাশিত প্রেম চলে আসে।””
“” কি বিড়বিড় করছিস?””

রিপ্তি নিজেকে সংযত করে বললো,,

“” তোকে যে শাড়ি পড়তে বলেছিলাম,পড়েছিলি?””

রুবিনা দাঁত দিয়ে জিভ কেটে বললো,,

“” ভুলে গিয়েছি!””
“” তুইতো দেখছি প্রেম দরিয়ার অতলে চলে গিয়েছিস। এবার একটু তীরে উঠ,এবার তাকেও তোর প্রেমে ফেলার জাল বুনন শুরু কর। শাড়ী দিয়েই..””
“” উনার গলা পাচ্ছি মনে হচ্ছে। রাখ পরে কল দিচ্ছি।””

রুবিনা অতিব্যস্ততায় লাইন কেটে দিয়েছে। রিপ্তি কান থেকে ফোন সরাতেই অনুভবের কন্ঠ পেলো,,,

“” তাদেরটা তাদের মতো গুছিয়ে দিতে দাও। তুমি যা করছো তা ঠিক নয়। আমি মহসীন স্যারের অনুরূপ সেজে তোমার ভেতরের ভয়টাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম তাও দোষী হয়ে গিয়েছি। কিন্তু রুবিনা? তোমার কি মনে হয় না,মহসীন স্যার যথেষ্ট বুদ্ধিচিত্তের মানুষ? এতো সহজে উনাকে বশ করে ফেলবে?””

রিপ্তি কোনো উত্তর দিলো না। অনুভব কিছু বলতে চেয়েও বললো না। বুক চিড়ে বের হয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস। তার শর্ততো আমি মেনে নিয়েছি,তবুও কি আমার সাথে একটু সহজ আচরণ করতে পারেনা? কথাটাতো বলতে পারে!

চুপকথা,,
একটু তো বুঝো,আমার মনের ব্যথা!(রোকসানা)

~~~
“” আপনি?””

ড্রয়িংরুমে মহসীনকে দেখে বেশ অবাক হয় রুবিনা। অবাকটা ভেতরে চাপা না পড়ে বেরিয়ে এসেছে রুবিনার কন্ঠের সাথে।

রুবিনার প্রশ্নে বেশ বিব্রতবোধ করছে মহসীন। এক ঝলক তার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। খানিকটা নড়চড়ে বসলো। তার প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে তাই ভাবছে। সে কি বলবে,হঠাৎ করেই তার এক অদ্ভুত রোগ ধরেছে। রাতে বিছানার অপরপাশে তাকে দেখতে না পেলে তার ঘুম আসছেনা। পরপর দু’রাত একি কান্ড ঘটার পরই তার ধারণা হয়েছে,রুবিনার সাথে সাথে এ বাসায় তার ঘুমকেও রেখে গিয়েছে। আজকের রাতটাও সে নির্ঘুমে কাটাতে চাচ্ছেনা। তার একটি বড় কারণ আছে। ঘুম আসছে না ভালো কথা,কিন্তু সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই আরো এক গভীর অদ্ভুত অনুভূতির সন্ধান পায় সে। তার মরে যেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় এই পৃথিবীতে সে এতোটাই একা যে,তার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। সেতো মরতে চায়না,বাঁচতে চায়! আর বেঁচে থাকার জন্য তার সাহস দরকার। সেই সাহসটা কি রুবিনা? তাই হবে,নাহলে এতোদিনতো এই রোগগুলো ধরা পড়েনি। সে চলে আসার পরেইতো রোগগুলো নজরে পড়েছে। মিশে যাচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তীব্র হচ্ছে মারাত্বকরূপে!

“”এতো ঘামছেন কেন? আমার রুমে আসুন। দক্ষিণের জানালার পাশে দাড়ালেই দেখবেন আপনার শীত লাগছে।””

রুবিনা কথার ফাঁকে মহসীনের হাত ধরে ফেললো। টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে নিজের রুমে। মাঝপথেই মহসীন শক্ত হয়ে দাড়ালো। রুবিনা বিরক্ত নিয়ে পেছনে তাকালে,মহসীন চোখ বন্ধ করে বললো,,

“” সবকিছু গুছিয়ে নেও। আমরা এখনি বের হবো।””
“” কোথায়?””
“” আমার বাসায়।””

রুবিনা খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,,

“” সত্যি?””
“” হুম।””

~~~

দুপুরের গোসল সেরেই নিজের শরীরে সুতি রঙিন শাড়ী জড়ালো রুবিনা। চোখে গাঢ় করে কাজল,ঠোটে লিপস্টিক,মুখে হালকা মেকাপ দিলো। পায়ে নুপুরজোড়া পড়ে গুটিগুটি পা ফেললো বসার রুমের দিকে। রুম থেকে বের হতে গিয়েও পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। উকি দিয়ে দেখতে চাইছে,মহসীনের কর্মকান্ড। লোকটা ভারী ব্যস্ত। সোফা পরিষ্কার করছে,টিভিটাও মুছে নিলো। হাতের টুকরো কাপড়টা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। রুবিনা বিড়বিড় করে বললো,ব্যস্ত স্বামী আপনার ব্যস্ততা কবে শেষ হবে? আমার সাজ দেখার সময়টুকু কি হবেনা?

“” কোথাও যাচ্ছো?””

হঠাৎ মহসীনের প্রশ্নে ছিটকে উঠলো রুবিনা। উনিতো রান্নাঘরে ছিলো,এখানে আসলো কখন? উফ! কি লজ্জা। রুবিনা লজ্জা সামলে বললো,,

“” না।””

মহসীন রুবিনার আপাদমস্তক পরখ করে বললো,,

“” তাহলে এমন সঙ সেজেছো কেন?””

রুবিনার লজ্জা হারিয়ে গেলো। লজ্জায় লাল হওয়া গালগুলো রাগে ফুলে উঠেছে। এমন করে বলতে পারলো? এতো কষ্ট করে সাজলাম,এমন ব্যাঙ্গার্থ কথা শোনার জন্য? রুবিনা কপট রাগ নিয়ে বললো,,

“” সামনে থেকে সরুন,আমি ঘুরতে যাবো।””
“” কোথায়?””
“” যেখানে দু’চোখ যায়।””
“” আচ্ছা যেও। রোদটা পড়ুক তারপর।””
“” নাহ,আমি রোদে ঘেমে ঘেমে ঘামবিলাস করবো।””
“” ঘামবিলাস?””

রুবিনা চক্ষুদ্বয় সরু করে বললো,,

“” হ্যা। সরুনতো!””

রুবিনা রাগে ফুসতে ফুসতে হাঁটা ধরেছে। তখনি কুঁচির সাথে প্যাচ খেলো। ধুপুস করে নিচে পড়বে,তার আগেই মহসীন ধরে ফেললো। শুকনো গলায় বললো,,

“” শাড়ীটা ছেড়ে অন্যকিছু পড়ে নেও।””

রুবিনার মেজাজ আরো চওড়া হয়ে গেলো। জিদ ধরে বললো,,

“” খুলবো না।””
“”হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেলে? রাতে কিন্তু খুব বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় কাদা। পড়ে দেখা যাবে ঘামবিলাস করতে গিয়ে কাঁদা বিলাস করে এসেছো!””
“” তাতে আপনার কি? আমার যা খুশি তাই করবো।””

মহসীন রুবিনাকে সোজা করে দাড় করালো। গম্ভীর গলায় বললো,,

“” আমিও তাই চাই।””
“” কি চান?””
“” তোমার ইচ্ছেমতো চলো।””
“” মানে?””
“” শাড়ীটা কেন পড়েছো? আমার পছন্দ তাইতো? কিন্তু সেটা অন্যের মুখ থেকে শুনেছো। তার কথামতো পড়েছো। এটা আমি চাইনা। আমার সামনে রিপ্তি নয়,রুবিনা সেজে আসবে। কারণ,আমি রিপ্তকে না রুবিনাকে বিয়ে করেছি।””

~~~
“”রিপ্তি কি রঙের শাড়ী পড়েছে?””

রাতের বিছানায় শুয়েছিলো মহসীন। আধশোয়া। চোখদুটো বন্ধ ছিলো। বুকের উপর বই পড়ে আছে। তারমধ্যেই রুবিনার এমন প্রশ্নে ভাবনায় হোচট খেলো মহসীন। বিস্ময় নিয়ে রুবিনার দিকে তাকালে,ও উৎসাহ নিয়ে বললো,,

“” চোখ বন্ধ করে রিপ্তিকে কল্পনা করছিলেন,তাইনা? আমি ঠিক ধরতে পেরেছি। বলেন না,আপনার কল্পনায় রিপ্তিকে কেমন দেখাচ্ছিলো?””

মহসীন বুকের বইটা খুলে ধরে বললো,,

“” ভালো।””

মহসীনের ছোট্ট শব্দে রুবিনার মন ভরলো না। সে কিছুটা মহসীনের দিকে এগিয়ে এসে বললো,,

“” আপনার কখনো রিপ্তিকে চুমু খেতে ইচ্ছে করেনি?””

মহসীন আরেকদফা বিস্মিত হলো। তারপর বললো,,

“” কেন করবেনা? অবশ্যই করেছে। চুমু হলো ভালোবাসার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বহিঃপ্রকাশ। আর এতো সুন্দর বহিঃপ্রকাশটা খুব কম সংখ্যক প্রেমিকরাই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।””

রুবিনা চটপট খেই ধরে বললো,,

“” তাদের মধ্যে আপনিও আছেন।””

মহসীন বইটা আগের ন্যায় বুকে বিছিয়ে নিয়ে বললো,,

“” কি করে জানলে?””
“” রিপ্তি বলেছে। আমি সব জানি।””
“” ও বললো আর তুমি বিশ্বাস করে নিলে? আমাকে দেখে কি এতোটাই সুপুরুষ মনে হয়?””
“” তার থেকেও বেশি।””
“” বাব্বাহ! বান্ধুবীর মুখে শুনেই এতো বিশ্বাস?””
“” উহু,নিজের স্বচক্ষে উপলব্ধি থেকে বিশ্বাসটা আরো বেশি মজবুত হয়েছে।””
“” তাই নাকি? আমার মধ্যে কি এমন দেখলে? আমিতো তোমার সাথে ঠিকমতো কথাই বলিনা।””
“” স্পর্শওতো করেননা।””

মহসীনের ঠোঁটে খুবই সামান্য পরিমানের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। রুবিনা আদ্র কন্ঠে বললো,,,

“” একি রুমে,একি বিছানায়,একটি মেয়ের সাথে ঘুমাচ্ছেন ইচ্ছাকৃততো দুর ভুলেও আমার ধারে কাছে আসেননা। ছোয়াতো দুরে। অপরিচিত হলেও একটা কথা ছিলে,তাতো নই। সম্পর্কে বউ হই আপনার।””

রুবিনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার বুকের ক্ষতটা যেন স্পষ্ট ভাসছে মহসীনের চোখে। এমন গাঢ় ক্ষতে আর দৃষ্টি রাখতে পারছেনা সে। চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,,

“” অনেক রাত হয়েছে,ঘুমিয়ে পড়ো।””

মহসীন পিঠের বালিশটা বিছানায় ঠিকমতো ফেলে শুয়ে পড়তেই রুবিনার ঠান্ডা কন্ঠ,,

“” আপনি বাইরে গেলে আমার একা একা লাগে। চলুন না আমরা একটা বাচ্চা এডপ্ট করি। আমারও ভালো লাগবে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবো। আপনাকে জ্বালাতন করবো না।””

মহসীন উল্টেঘুরেই বললো,,

“” সময় হোক। আগে পড়াটা শেষ করো।””

রুবিনা আর কিছু বললো না। সেও অন্যপাশে মুখ করে শুয়ে পড়লো। চোখ থেকে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়তেই মহসীনের হাতের বাধনে আটকে গেলো। রুবিনাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বললো,,

“” আমায় একটু সময় দাও,আমি নিজে…””
“” কাকে চুমু খেলেন?””

মহসীন নিজের বাক্যটা শেষ করতে পারলোনা। পাল্টা প্রশ্ন রাখে,,

“”মানে?””
“” চোখ বন্ধ করেতো রিপ্তিকে দেখতে পান,চুমুটা তো চোখ বন্ধ করেই খেয়েছেন। তারমানে আমাকে নয়,রিপ্তিকে খেয়েছেন।””

রুবিনার কথা শেষ হতেই ওর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুয়ালো মহসীন। মুখে দুষ্টুহাসি নিয়ে বললো,,

“” এবার চোখ খুলে খেয়েছি। বলোতো তোমাকে খেয়েছি নাকি রিপ্তিকে?””

রুবিনা লাজুককন্ঠে বললো,,

“” আমাকে!””

সাথে সাথে মহসীনের হাসি উবে গেলো। রুবিনার লাজুক মুখপানে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। হুট করেই রুবিনাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। ওর বুকে মাথা রেখে ধরা গলায় বললো,,

“” আমি চোখ বন্ধ করেও তোমাকে দেখতে চাই,রুবিনা। ভুলে যেতে চাই গতকালকে। হাসিখুশিতে বরণ করতে চাই ভবিষ্যৎ কে। প্লিজ হ্যাল্প মি!””

রুবিনা কাঁদছে,ফেলছে আনন্দের অশ্রু! মহসীনকে গাঢ় করে নিজের সাথে মিশিয়ে নেওয়ার প্রবল চেষ্টা। তারমধ্যেই বেজে উঠে রুবিনার মোবাইল। রিপ্তি কল দিয়েছে। ফোনের স্ক্রিণে চেয়ে বিড়বিড় করলো,শুধু আপনি নয়,আজ থেকে আমিও রিপ্তিকে ভুলে যাবো!

~~~

রুবিনা কল কেটে দিলে,পুনরায় কল দিতে চাইলো রিপ্তি। তখনি একটা মেসেজ আসলো,,

**tnx,amk poripurno korar jonno!**

রুবিনার মেসেজটার দিকে নিষ্পলকে চেয়ে আছে রিপ্তি। শুকনো ঠোঁটদুটো ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। ফোন ফেলে বিছানা ছাড়ে সে। অনুভব মেঝেতে শুয়ে আছে। শরীরে চাদরটা পর্যন্ত নেয়নি। কেমন দেখাচ্ছে! রিপ্তি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না। টুপ করে শুয়ে পড়লো অনুভবের বুকে।

বুকের উপর ভারী কিছুর উপস্থিতি পেতেই ঘুম ভেঙে গেলো অনুভবের। অবাককন্ঠে বললো,,,

“” কি ব্যাপার! মহারানী হঠাৎ প্রজার সিন্দুকে হামলে পড়লো কেন? আমাকে বুঝি মিস করছিলে? আমার স্পর্শ…””
“” মোটেওনা। ভয় পাচ্ছিলাম তাই।””

রিপ্তি অনুভবের বুক থেকে সরে যেতে চাইলে ও আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,,

“” কিছু বলার আগেই রেগে ফেটে পড়ো। একটুতো মায়া করতে পারো? ভয় যখন পাচ্ছো,তাহলে উঠে যাচ্ছো কেন? ঘুমাও। তোমার শর্তের নড়চড় হবেনা। আগেরবার আবেগে ডুবে আমার শিক্ষা হয়ে গিয়েছে। এক ভুল দু’বার করবো না।””

রিপ্তি আবার অনুভবের বুকে শুয়ে পড়ে। বেশ সময় পর অনুভব বললো,,

“” বাচ্চাদের মতো এমন ছটফট করছো কেন? চুপচাপ ঘুমাও। ঘুমপাড়ানির গান শুনাবো?””

রিপ্তি মাথা তুলে বিরক্তসুর তুললো,,

“” ঘুমাতে চাইলে তো ঘুমাবো। আমিতো আদর…””

রিপ্তি কথার মাঝেই জিভ কাটে। তার ছেড়ে দেওয়া কথাটা পড়ে ফেললো অনুভব। বিস্ময় নিয়ে বললো,,

“” তোমার মহসীন কি তাহলে নারীর নেশায় ডুবে গিয়েছে?””

রিপ্তি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। অনুভবকে ফেলে বসে পড়ে বললো,,

“” নারীর নেশা মানে? সে কি অন্য মেয়েকে ছুয়েছে? নিজের বউকে ছুয়েছে। সবাই কি তোমার মতো যে মেয়ে মানুষ দেখলেই উতলা হয়ে যায়?””

অনুভবও উঠে বসে বললো,,

“” আমি উতলা? আমি মেয়ে দেখলে উতলা হয়ে যায়?””

রিপ্তি তাৎক্ষণিক উল্টোঘুরে গেলো। দাঁতে দাঁত কেটে ভাবছে,কি বলে ফেললাম? দেখেতো মনে হচ্ছে ইগো হার্ট হয়েছে। কথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে? ক্ষমা চেয়ে নিবো? রিপ্তি ভাবনা ছেড়ে মিনমিনিয়ে কিছু বলবে,তারমধ্যেই ওর জামার পেছনের চেইনে হাত পড়ে অনুভবের। একটানে খুলে ফেললো।

সাথে সাথে মূর্তির রূপ ধরলো রিপ্তি। শুকনো ঢোক গিলে মিহিকন্ঠে বললো,,

“” আমি আর ভুলেও পেছনে চেইন দিয়ে জামা বানাবো না।””

রিপ্তির কাধ থেকে জামার একাংশ সরিয়ে ঠোঁট ছুয়ালো অনুভব। ঘোরকন্ঠে বললো,,

“” তাহলে সামনে দিও।””
“” ছি!””

অনুভবের সেই চেনা হাসিটি নতুন শব্দে বেজে উঠলো। রিপ্তির কোমড় পেচিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বললো,,,

তুমি আমার–
সকাল,দুপুর,রাত
আমি তোমার–
সুখ,দুঃখ আর দুষ্টু আঘাত(রোকসানা)

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here