#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে,পর্ব (১৯)
#রোকসানা_রাহমান
রিপ্তি দৌড়ে বেরিয়ে এলো। ছুটছে তো ছুটছেই। চোখদুটো কাউকে খুজছে। অধীরচিত্তে!
রিপ্তিকে এভাবে ছুটে বেরিয়ে আসতে দেখে অনুভব সামনে এগিয়ে গেলো। দুকদম এগুতেই রিপ্তি ঝাপিয়ে পড়লো অনুভবের বুকে।ব্যাকুল কন্ঠে বললো,,
“” আমাকে দুরে নিয়ে যান। এখান থেকে অনেকদুর। যেখানে কোনো ফুলের গন্ধ নেই!””
অনুভব শীথিলভাবে দাড়িয়ে আছে। মনের চাওয়া তো অনেক,কিন্তু আকস্মিক কিছু কিছু নিজ থেকে চলে আসলে,মনটা নেচে উঠে,উড়তে চায় প্রজাপতির মতো! অনুভব উড়লোনা। তার তো আর ডানা নেই! ডানা থাকলে ঠিক উড়তো,এই মেয়েটিকে নিয়ে। ও কি রাগ করতো?
রিপ্তি বা’হাতে অনুভবের শার্ট খামচে আছে,চোখ শক্ত করে বন্ধ করা। গালটা অনুভবের শক্ত বুকটা ভেদ করে ভেতরে ঢুকে যেতে চাচ্ছে,তা কি সম্ভব?? রিপ্তি ভারী নিশ্বাস নিয়েই পুনরায় বললো,,
“” অনেক দুর যাবো,অনেকদুর। প্লিজ!””
অনুভব নিজের মোহতা কাটিয়ে খোঁচা মেরে বললো,,
“” কেন? ফুলের কি দোষ? হিংসে হয় বুঝি? তাহার সৌন্দর্যে,তাহার সুবাসে?? তুমি ফুলের মতো সুন্দর না হলেও অতো খারাপও না। তবে সুবাসহীন ফুলের মতো। একটু পারফিউম টারফিউম মাখো,তাহলেইনা হাজার প্রেমিক ছুটে আসবে,তোমার গন্ধ নিতে!””
রিপ্তি চোখ মেললো,অনুভবের বুক থেকে মুখ তুললো। একটু আগে সিটিয়ে যাওয়া মুখটায় কঠিন ভাব। চোখে তেজ,নাকে রাগ! হাতের খামচিটা গাঢ় করে বললো,,
“” আপনার কাছে আসাই ভুল হয়েছে। বিরক্তকর মানুষ একটা!””
অনুভবকে ছেড়ে হাঁটা ধরলো রিপ্তি। দুকদম এগুতেও পারলোনা,অনুভবের বাধা পেলো। রিপ্তির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে সে। সরল গলায় বললো,,
“” কোথায় যাচ্ছো?””
“” ফুলহীন জগৎে।””
“” ক্লাসটা করে যাও।””
এতক্ষণ উল্টোপথে থেকে জবাব দিয়ে যাচ্ছিলো রিপ্তি। এবার আর পারলোনা। অনুভবের দিকে ঘুরলো। তবে চোখ তার অন্যদিকে চেয়ে আছে। ক্লাসপথে। ইটের প্রাচীরভেদ করে চাহনি আঁকছে একটি মানুষের দিকে। যার সুবাসে শুধুই রজনীগন্ধা! মুহুর্তেই রিপ্তি চোখ নামিয়ে নিলো। কঠিনভার দুর হয়ে গিয়েছে। মুখে অসহায়ত্বতা,মাথা নিচু করে বললো,,
“” পারবোনা!””
অনুভব মন্হরগতিতে রিপ্তির নিকটে এলো,ডানহাতে গাল ছুয়ে,বা’হাতে অসাবধানতায় সরে আসা চুলগুলো কানে গুজে দিলো। নরমসুরে বললো,,
“” পারবে।””
মাথাটা আরো ঝুকিয়ে দুদিকে দুলালো রিপ্তি। সে পারবে না,কিছুতেই না।
অনুভব রিপ্তির দুগালে নরম স্পর্শ রাখলো। চোখে আদুরী ভাব,মিহি গলায় বললো,,
“” ভয় পাচ্ছো? কিন্তু কেন? তুমি কি ভুল কিছু করেছো? যদি করে থাকো,শুধরিয়ে নাও। যার ভুল তাকেই শুধরাতে হবে,অন্যজন শুধু তাকে সাহত দিতে পারবে,উৎসাহ দিতে পারে,ভরসা দিতে পারে আর কিছু নয়। আমি নাহয় সেই অন্যজন হলাম। এবার ভুল শুধরিয়ে নাও। দেখবে,মাথাটা চট করে উপরে উঠে যাবে। রিপ্তি তুমি এতোটা দুর্বল নও। তুমি তো সাহসী। সেটা আমার থেকে তুমি ভালো জানো। নিজেকে আর কত গুটিয়ে রাখবে?? দু্র্বলতা খুব খারাপ। একবার মনে ঢুকে গেলে,তা আর বেরোতে চায়না। ভয়ের প্রধান উৎসই কিন্তু দুর্বলতা! দুর্বলতা যখন ভয়ের রূপ নিবে তখন তুমি চাইলেও সেই ভয়কে দুর করতে পারবেনা। এখনো সময় আছে,শুধরে নাও। পরিস্থিতির সাথে খাপ খায়িয়ে নাও। মেয়েরা এই জিনিসটা খুব ভালো পারে। খুব দ্রুত নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে। তুমিও পারো। শুধু নিজের উপর ভরসা রাখো। ফিরে যাও সেই সাহসী রিপ্তির কাছে,যে অচেনা শহর পাড়ি দিতে ভয় পায়না। নিশীরাতের অন্ধকারকে ভয় পায়না! তখন যা ছিলো এখনো তা আছে। শুধু তোমাকে অনুভব করতে হবে!””
রিপ্তি অনুভবের হাতের উপর হাত রাখলো। মায়াদৃষ্টি রেখে বললো,,
“” যন্ত্রণা হয়,খুব। সহ্য করতে পারিনা।””
“” মেয়েরা তো সহ্যের প্রদীপ। প্রদীপ জ্বলছে বলেই পৃথিবী এতো সুন্দর! পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কঠিন যন্ত্রণাগুলো তো তাদের দখলেই। আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে চমৎকার সৃষ্টি হলো নারী। ভালোবেসে নরম মনের অধিকারী বানালেও তাদের সহ্যশক্তি কঠিন! কঠিনতার ধারের পরিমানটা অসীম! সেই অসীমতাটাই আজ তোমাকে দেখাতে হবে। তুমি পারবে। আচ্ছা,চেষ্টা তো করে দেখ। না পারলে ফিরে এসো।””
“” ফিরে এসে যদি আপনাকে না পাই।””
অনুভব রিপ্তির হাতের নিচ থাকে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। মুচকি হেসে বললো,,
“” আমাকে পেয়ে কি হবে? জরুরী কাজ আছে নাকি?””
রিপ্তির মুখ আবারও কঠিন হয়ে এলো,লাল রাগে পুরোমুখ ঢাকা পড়েছে। রিপ্তি কঠিনসুরে বললো,,
“” আপনার মতো লাল ব্যাঙের সাথে আমার কোনো জরুরী কাজ নেই। থাকতে পারেনা। আমি থাকতে দিবোওনা। যেখানে খুশি সেখানে যান। আমার কি?””
রিপ্তি গটগট করে চলে গেলো। অনুভব জানে সে ক্লাসেই যাবে। তবে কতক্ষণ থাকবে,তা নিশ্চিত নয়। অনুভব দুহাত দুদিকে মেলে আকাশমুখো হলো। নীলআকাশের সাদামেঘের দিকে মধুরদৃষ্টি রেখে গানের সুর তুললো,,
তোমার অপেক্ষা,সারাবেলায়
চাইলেই কি দুরে যাওয়া যায়??
তোমার নরম গালের স্পর্শে
বুকটা যে যেতে চায় তোমার বশে!!!
বারবার
শতবার
অনন্তবার!!(রোকসানা)
~~~
ক্লাসরুমের সামনের দরজায় দাড়িয়ে আছে রিপ্তি। জড়োসড়ো হয়ে। সামনে তাকাতে পারছেনা। চোখদুটো দরজার অপাশের মেঝেতে আটকে আছে। কালো সু দেখা যাচ্ছে। আসতে আসতে জুতোজোড়া সরে যাচ্ছে। স্যার আর স্টুডেন্টের মধ্যে পরিচয়পর্ব চলছে। এমনি ভেতরে চলে যাবে,নাকি অনুমতি চাইবে? ম্যা আই কাম ইন বলবে? নাকি ভেতরে আসবো বলবে?? উফ! লাল ব্যাঙটা আমায় এমন অসস্থিতে ফেলে দিলো??
“” কাম ইন!””
রিপ্তি চলকে গেলো। ভাবনার সুতো কেটে গেলেও আবার তা জোরা লাগালো সে। অনুমতি চাইলামনা তাও অনুমতি পেয়ে গেলাম? উনি কি ইংলিশের সাথে মনোবিদ্যাও চর্চা করেছেন??
রিপ্তি নিজের ভাবনা নিজেই বন্ধ করে দিলো। চটপটে ভেতরে ঢুকলো। আগের জায়গাতে নয়,এক কর্নারে গিয়ে বসলো৷ যাতে গন্ধটা তার কাছে পৌছুতে পৌছুতে দুর্বল হয়ে আসে। তবেইনা সে সাহসী হতে পারবে!
একে একে সকলের পরিচয় নিয়ে রিপ্তির দিকেই এগিয়ে আসছেন মাস্টারজী। রিপ্তি বেঞ্চের নিচে পড়ে থাকা পা’দুটোকে এমনভাবে মিশিয়ে রেখেছে যেন,ছুটলেই সে শেষ। এখানেই সে পরাস্ত! চাপা উত্তেজনা,কঠিন যন্ত্রণা,ব্যথার ব্যামোর মাঝেও নিজের তৈরী করা সাহসটাকে জাহির করতে চাচ্ছে রিপ্তি। ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করছে,আমি পারবো,আমাকে পারতেই হবে!
মাস্টারজী রিপ্তির সামনে এসে দাড়ালেন। রিপ্তি আড়ষ্ট ভাব ছেড়ে সোজা হয়ে দাড়ালো৷ কন্ঠ কাঁপছে,কোনো শব্দই সে উচ্চারণ করতে পারছেনা। তাহলে নামটা কি করে বলবে? কি নাম বলবে? তার নাম কি? ভুলে গিয়েছে। রিপ্তির এত পরিশ্রম সব মাটিতে ঝুরঝুর করে মিশে গেলো। নিজের নাম নিজে ভুলে গেলো? এই তার ব্রেনশক্তি? এই নিয়ে সে ইংলিশ বিভাগে ভর্তি হয়েছে?
মাস্টারজী সামনে দাড়িয়েই রইলেন। কোনো কথা বলছেননা। অপেক্ষা করছেন,রিপ্তির কন্ঠ ছেড়ে বের হয়ে আসা শব্দের। রিপ্তি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,,
“” ভুল….””
তারমধ্যে ঘন্টার শব্দ। ক্লাসটাইম শেষ। রিপ্তি পেটের কথা পেটেই ঢুকিয়ে দিলো। মাস্টারজী ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। তারমাঝেই রিপ্তি চিৎকার করে বললো,,
“” রিপ্তিসা। আমার নাম রিপ্তিসা। নরসিংদীবাসী!””
মাস্টারজী থমকে দাড়ালেন। পেছন ঘুরে কাউকে পেলেননা। দরজায় চোখ পড়তেই বুঝলেন,কেউ হাওয়াবেগে বেড়িয়ে গিয়েছে।
~~~
দম বন্ধ করে চল্লিশটা মিনিট পার করেছে রিপ্তি। বাইরে বেরিয়েই সে কতক্ষণ হাওয়া গিললো। ঘনঘন লম্বা শ্বাস টেনে সিড়ির ধাপ পেরুচ্ছে। মাটির সবুজ ঘাসে পা পড়তেই সে থমকে গেলো। অনুভব দাড়িয়ে আছে। সেই আগের জায়গাটিতেই। কিন্তু আগেরবারের মতো এবার হাতদুটো খালি নেই,সাদা কয়েকগুচ্ছ ফুল,রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধটা নাকে বারি লাগতেই,অনুভব সামনে এসে দাড়ালো। কাছাকাছি,খুব বেশি কাছাকাছি এসে ফুলগুলো ওর হাতে দিলো।
“” সাবাস মেয়ে,রজনীগন্ধা!””
রিপ্তি কৌতুহলী দৃষ্টি রাখলে,অনুভব বললো,,
“” আজ থেকে তোমার নাম রজনীগন্ধা। তবে সেটা আমার জন্য। শুধু আমিই তোমাকে এ নামে ডাকবো।””
রিপ্তি ঘোর আপত্তি নিয়ে বললো,,
“” না,এই নামে ডাকবেননা।””
“” ডাকবো। তোমার ইচ্ছে হলে উত্তর নিবে নাহলে নিবেনা। আমি নাহয় ডাকতে ডাকতে গলায় সর্দি বসাবো। তাতে নিশ্চয় তোমার কিছু যাবে-আসবেনা?””
“” না।””
“” গুড,তোমার ক্ষিধে পেয়েছে? চলো আজ তোমাকে খিচুড়ি খাওয়াবো।””
“” আমার ক্ষিধে পায়নি।””
“” রজনীগন্ধার সুবাসে পেট ভরে গিয়েছে?””
“” হুম।””
“” আমার তো পায়নি। আমি খাবো,তুমি দেখবে।””
“” আপনার খাওয়া দেখে,আমার কি লাভ?””
অনুভব কয়েক সেকেন্ড ভাবনার ভাব ধরে বললো,,
“” তোমাকে বেতন দিবো। আজ থেকে তুমি আমার কর্মচারী,খাওয়া দেখার কর্মচারী। মাস শেষে দু’টাকা দিলে চলবে তো?””
রিপ্তি কড়া চোখে তাকালে,অনুভব অসহায় গলায় বললো,,
“” আমার সত্যিই খুব ক্ষিধে পেয়েছে,রজনীগন্ধা!””
~~~
হাতে রজনীগন্দার তোড়াটা কাঠের টেবিলে রাখতে রাখতে চারপাশে সচেতন দৃষ্টি রাখছে রিপ্তি। খুব বড়,নামী-দামী রেস্তোরা নয়,তবে গোছানো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা খুব বেশি। চারপাশে বড় দেয়াল ছাড়া আর কোনো দেয়াল নেই। সকলে যার যার খানায় ব্যস্ত। দেখে মনে হচ্ছে,বাংলাদেশের সব চুড়ান্ত খাদকগুলো এখানে এসে জড়ো হয়েছে। গরম,ঠান্ডা মানছেনা। সামনে খাবার আসছে আর মুখে ঢুকাচ্ছে। রিপ্তি লক্ষ করলো,এখানে মেয়ে বলতে সেই একমাত্র। এটা ভয়েস রেস্তোরা নয় তো? লাল ব্যাঙ আবার কোনো লজ্জা দিতে আনেননি তো? রিপ্তি আড়চোখে অনুভবের দিকে তাকালো। উনি কেন আনবেন? আমি তো নিজেই এসেছি,নিজের ইচ্ছায়। উনি কি আমায় হাতে-পায়ে বাধ দিয়ে এনেছেন? না। আমি স্বেচ্ছায় এসেছি। কিন্তু কেন? যাকে একসময় সহ্যই করতে পারতাম না,এখন তার সাথেই ঘুরঘুর করছি। আর খিচুড়ি? আমার তো খিচুড়ি পছন্দ নয়,তাও খিচুড়ি খেতে চলে এলাম? রিপ্তির বিমুঢ়তা ভাঙলো অনুভবের চিৎকারে। চিল্লিয়ে কাকে যেন ডাকছে। ডাকার পর্ব শেষ করে রিপ্তির উদ্দেশ্যে বললো,,
“” খিচুড়ির সাথে কি নিবে? ফুলের ভর্তা,ফলের ভর্তা নাকি পশু-পাখির ভর্তা?””
অনুভবের কথায় রিপ্তি তাজ্জব বনে গেলো।
“” কি হলো বলো?””
“” এগুলো মানুষের খাবার?””
“” চোখের সামনে কি তুমি পোকামাকড় দেখছো? আমাকে কি পোকা মনে হচ্ছে?””
“” লাল চিকা,যার গায়ে মাছের আঁশটের গন্ধ!””
“” চিকার গায়ে মাছের গন্ধ? কি করে সম্ভব? দুজন তো দু জায়গার বাসিন্দা!””
রিপ্তি আর কিছু বললোনা। অনুভব নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলো,,
“” মনে হয়,দুজনের মধ্যে প্রেম চলছিলো তারপর সুযোগ বুঝে মাখোমাখো পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো!””
রিপ্তি নাক সিটকে বললো,,
“” আপনার মনে সবসময় এগুলো চলে? চলবে না,আপনার তো…””
রিপ্তির কথার মাঝপথে অন্যকারো কন্ঠ।
“” বাপজান,কহন আইছেন?””
অনুভব কন্ঠ অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরালো। দশ/এগার বছরের একটি ছেলে। অবাক নয়নে এদিকেই এগিয়ে আসছে। সাদা টি-শার্টে,তরকারীর ঝোল,কাধে গামছা, প্যান্টের পকেটে টিস্যু! ছেলেটি নিকটে এসে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। অভিমানি সুরে বললো,,
“”মেলাদিন পরে আইলেন।””
অনুভব হাসলো।
“” হ,তোরে দেখতে আইলাম। কেমন আছস?””
“” বেশি ভালা না। মালিক খালি কাম করায়। আমারে বড় হইতে দিতাছে না। বহুত কষ্টে আছি বাপজান।””
“” এগুলা তো ভালা কতা না। আমার পোলারে এতো কষ্ট দিতাছে? বড় হইতে দিতাছেনা? আমি আজই তোরে লইয়া যামু। চল আমার লগে।””
অনুভব সত্যি সত্যি উঠে দাড়ালো। ছেলেটি বসেই রইলো। অনুভবের হাত টেনে বসালো। ইশারায় অনুভবকে সামনে ঝুকতে বললো। অনুভব মাথা এগিয়ে নিলে,ছেলেটি ফিসফিসভঙ্গিমায় বললো,,
“” এহননা। আর কয়ডা দিন পর।””
অনুভবও ফিসফিস করেই বললো,,
“” ক্যান? এহন গেলে কি অইবো?””
“” মেলাকিছু। আমার বড়লোক হওয়া হইবোনা।””
“” ক্যান?””
ছেলেটি চারপাশে সতর্কদৃষ্টি বুলিয়ে আরো ঝুকে বললো,,
“” আমার মালিকের একটা ভাগ্নি আছে। ডেইলি আসে। তারসাথে আমার ভাব হইছে। আমারে মেলা ভালোবাসে। ভাবছি ওরে বিয়া করুম। আমার মালিকের তো আর কোনো পোলাপান নাই। ওরে বিয়া করলে এই রেস্তোরাডা আমার হইয়া যাবো। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। বাপজান,বড়লোক হওয়া কত কষ্ট!””
অনুভব ছেলেটির পিঠে শক্ত চাপড় মেরে বললো,,
“” একেই বলে,বাপ কা ব্যাটা। মাইয়া কি করে রে?””
“” এহনো পড়ে। শুনছি এবার এস.এস.সি দিবো।””
দুজনের চুড়ান্তপর্যায়ের কথপোকথন শুনছিলো,রিপ্তি। ছেলেটির শেষ কথায় সে দারুনভাবে ভিষম খেলো। ছেলেটি তাড়াতাড়ি গ্লাসে পানি ভরে,রিপ্তির হাতে পানি ধরিয়ে দিলো। চিন্তাশীল মনোভাব নিয়ে দাড়িয়ে আছে। বেশিক্ষণ থাকতে পারলোনা। পেছন থেকে ডাক পড়লো!
রিপ্তি তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির ন্যায় পানি পান করছে। এক গ্লাস শেষ হতে অনুভব আরেক গ্লাস ধরিয়ে দিলো। পানি খাচ্ছে,হেঁচকি তুলছে আর আড়চোখে অনুভবকে দেখছে। উনার বউ দেখার আগে,ছেলে দেখে ফেললাম? যেমন বাপ,তেমন ছেলে! পিচ্চি বাচ্চার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা! সব তো উনার কাছ থেকেই পেয়েছে। না জানি আরো কত কি দেখতে হবে!
রিপ্তি পরপর তিনগ্লাস পানি খেলো। কিন্তু হেঁচকি থামছেনা। এরমধ্যে খিচুড়ি আর বাহারীজাতের ভর্তাও হাজির। অনুভব মুখে খাবার তুলছে আর রিপ্তির হেঁচকি গুনছে। একশ বায়ান্ন,একশ তিপ্পান্ন,একশ চুয়ান্ন….
হেঁচকি নিয়েই রিপ্তি চামচ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। খিচুড়ির গরম ধোয়া মুখে পড়ছে। খেতে ইচ্ছে করছেনা। ইচ্ছে করলেই কি,এমন হেঁচকির ঝড় নিয়ে খাওয়া যায়? তবুও খাওয়ার চেষ্টায় ক্ষুদ্রাংশ মুখে পুড়লো। চামচটা মুখেই আটকে গেলো। পায়ে ঠান্ডা কিছুর স্পর্শ পাচ্ছে। রিপ্তি মুখে চামচ নিয়ে মূর্তি হয়ে রইলো। পা’টা সরিয়ে নিতে গেলে,অনুভব নিজের পা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো। নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসলো। অন্য পা দিয়ে হালকা সুড়সুড়ি দিতেই,রিপ্তির মুখের চামচ পড়ে গেলো। টেবিলের সাথে লেগে টুং করে শব্দ বাজলো!
সুড়সুড়ি বন্ধ করে সজোরে চিমটি কেটে,অনুভব হেঁসে উঠলো। হাসির শব্দ নিয়েই বললো,,
“” হেঁচকি বন্ধ হয়ে গিয়েছে,এবার খাওয়া শুরু করো,রজনীগন্ধা!””
~~~
রিকসা ছুটছে কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে। গুটিসুটি মেরে বসে আছে দুটিপ্রাণ। রেস্তোরার অমন লজ্জাজনক কান্ডের পর আর একটি কথাও বলেনি রিপ্তি। চুপচাপ অনুভবকে অনুসরণ করেছে। অনুভবও আগ বাড়িয়ে গল্পঝুড়ি ফাঁদেনি। মেয়েটা যে ভারী লজ্জা পেয়েছে,তা এখনো বুঝা যাচ্ছে। তবে আর নয়,নিরবতা! একটু পরই তো পাখি নিজের নীড়ে ফিরবে। অনুভব ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললো,,
“” তুমি কি ডেইলি গরম পানিতে পা ডোবাও?””
“” কেন?””
“” মনে হলো।””
“” এমন অদ্ভুত মনে হওয়ার কারণ কি?””
“” তোমার পা যখন ছুলাম,তখন তোমার পা’টাকে সেদ্ধনরম সাথে কুসুম গরম লেগেছে। দেখি তোমার হাতটা দাওতো! পরখ করে দেখবো,এটা কেমন নরম-গরম?””
অনুভব সত্যি সত্যি হাত পেতে আছে। পাতা হাতের দিকে রিপ্তির চোখ। হাত দেবে কি দেবেনা ভাবছে!
“” কবে শুরু করছো?””
“” কি?””
“” ঝড়!””
“” কিসের ঝড়?””
“” তোমার দ্বিতীয় প্রেমের ঝড়। আমি কিন্তু ব্যাকুল হয়ে আছি,তোমার ঝড়ের লন্ডভন্ড দেখবো বলে।””
রিপ্তি চুপ। অনুভব আবার বললো,,
“” রিপ্তি!””
“” হুম?””
“” আমি আবারও তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছি,শুরুটা তোমার-শেষটা আমার!””
“” মানে?””
“” লিনা!””
নামটা যেন রিপ্তির বুকের ভেতর ধারালো সুচের মতো বিধলো। অনুভবের দিকে তাকালো। আর কোনো কথা হওয়ার আগেই অনুভবের তাড়াকন্ঠ,,
“” রিকসা থামাও,মামা।””
অনুভব হাঁটছে। জোরে জোরে পা ফেলে একটি মেয়ের সামনে গিয়ে দাড়ালো। সাথে সাথে মেয়েটি অনুভবকে ঝাপটে ধরেছে। দুর থেকেও মেয়েটির চোখের অশ্রু দেখতে পাচ্ছে রিপ্তি,চোখ থেকে একফোটা পানি তারও যে পড়লো!
চলবে