নিরুদ্দেশ পর্ব ২৩

নিরুদ্দেশ
পর্ব ২৩

আজ অমাবস্যার রাত নয়। তবে তোতার আর সবুজের কাছে রাতটা অমাবস্যার। ঘন অন্ধকার নেই তবুও তারা চোখে সবকিছু অন্ধকার দেখছে। বেশি রাত হয়নি। পাশের বাড়ি থেকে দুই গৃহবধূর কথোপকথনের মৃদু বার্তা ভেসে আসছে তবুও তাদের কাছে চতুর্দিকে তীব্র নির্জন লাগছে। কুঞ্জবনে স্তব্ধতা নেমেছে। গভীর রাতে তৃণভূমির মাঝখানে নিজেরা সঙ্গীহীনতায় ভুগছে। কেউ কথা বলছে না। নীরবে চোখের জল ফেলছে। সবুজ আজ ধরা দিতে এসেছে। তোতা ঠিকই বলেছে দিনদিন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে সে। খারাপ হয়ে যাচ্ছে। খারাপ হয়ে গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারছে না। অপরাধবোধ তাকে পুড়িয়ে মারছে। মনের মৃত্যু ঘটেছে। তাই নিজে থেকে এসেছে ধরা দিতে। দীর্ঘক্ষণ কোনো বার্তা বিনিময় হলো না। অনেকক্ষণ পর অন্ধকারের বুক চিরে সবুজের মিহি কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সে তোতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,’কিছুক্ষণ আগে আপনি বললেন সবকিছু জানেন। কী জানেন তোতাপাখি?’
‘সবকিছু! আপনি যে খুব ভালো মানুষ তাও জানি। আপনার বড়ো মন রয়েছে কিন্তু আপনার একটা খারাপ কাজ দিনের পর দিন আপনার সমস্ত ভালো কাজের উপর মোটা আস্তরণ হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে সবাই যদি তা জেনে যায় তাহলে কেউ-ই মোটা আস্তরণ সরিয়ে আপনার শান্ত শীতল মনকে খুঁজবে না।’ ভেজা গলায় তোতা আবার বলল,’আপনি কেন এমন করলেন, রাজামশাই!’
‘কী করেছি?’
‘আপনি তো সত্যি কথা বলতে পছন্দ করেন। তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে সত্যি কথা বলুন,-আপনি আপনার স্ত্রীর নগ্ন শরীর ছাড়া আর কোনো নারীর নগ্ন শরীরে ডুবে যাননি!’
‘ডুবেছি!’ একজন নারীর কাছে এই মুহূর্তটা ঠিক কতটা নোংরা কতটা বিষাক্ত তা কেবলমাত্র তোতা বুঝতে পারছে। সে এতটা অভাগা যে কথা গুলো শুনতে হলো।
‘কেন? কেন রাজামশাই? আমার মধ্যে কিসের অভাব রয়েছে?’ সবুজের গাল দুটো স্পর্শ করে কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তেজিত কণ্ঠে বলল।
‘জানি না।’
‘আপনি আমাকে সবসময় সঙ্গে নিয়ে যেতেন। আর আমি ভাবতাম আপনি আমাকে গভীর ভালোবাসেন তাই সঙ্গে নিয়ে যান। কিন্তু না। আপনি আপনার কাজ সুরক্ষার সঙ্গে করতে চাইতেন। যাতে আমি কখনো সন্দেহ না করি। কিন্তু আপনি ধরা পড়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে যেতেন না। ভাবতাম আপনার অনেক কাজ আছে। আমাকে নিয়ে গেলে অযথা ঝামেলা হবে। আমি নিজে থেকে সরে আসতাম। রাতে একা উঠনে বসে আপনার জন্য অপেক্ষা করতাম। খুব চিন্তা হতো। আর আমার অপেক্ষা ছিল বড়ো ক্ষত। পথিক ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে আছে। আর ট্রেন কোনো নির্জন স্থানে একাকী আটকে পড়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। তার আসার কোনো তাড়া নেই। তার তো কোনো পিছুটান নেই। কত পথিক তার কাছে আসে আবার চলে যায়। সে কোনো পথিককে মনে রাখে না। আপনি ট্রেন আর আমি পথিক। কি অদ্ভুত? আপনি বাড়ি ফিরলে প্রায় দিন বলতাম আমাকে আদর করতে। আপনি রাজি হতেন না। আমার কবুতরী বুকের নিচে আশ্রয় নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। স্ত্রীরা স্বামীর বুকে নিচে থাকতে সবসময় পছন্দ করে। আর আপনি সবসময় আমার বুকের নিচে থাকতেন। আমি জেগে থেকে আপনাকে ঘুম পাড়াতাম। গল্প শোনাতাম। ভাবতাম আপনি ক্লান্ত। আমি ভুল ছিলাম। আপনি তো আদর খেয়ে আসতেন। তাই ভোররাতে আদর করতেন।’ সবুজ কাঁদছে। খুব কাঁদছে। মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। তবুও কাঁদছে। সবুজ কি বলবে তাকে? কি বলার আছে? সে সত্যি সত্যি ভালোবেসে তোতাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। নিজের স্বার্থের জন্য নয়। সত্যি সত্যি স্ত্রীকে ভোর রাতে আদর করতে ভালোবাসতো। নিজের ক্লান্তির জন্য নয়। বাসি মুখে গল্প করতে ভালো বাসে। সে তোতাকে সত্যিই ভালোবাসে। কিন্তু তোতার চোখে বিদ্যুৎ খুঁজে পায় না। যে বিদ্যুৎ-তে ত্রিভুবন জয় করা যায়। সবাইকে ছেড়ে একজনকে আঁকড়ে ধরে বাঁচা যায়। কিন্তু সবুজের ভালোবাসা বড়ো শীতল গতিহীন শান্ত আর ধীর। আজ সমস্ত ভালোবাসা সমস্ত অনুভূতি অপ্রাসঙ্গিক এবং অর্থহীন। চুপ করে রইল। তোতাকে বলতে দিল।
‘আপনি আমায় ঠকিয়েছেন, রাজামশাই!’
‘আমি বিয়ে করতে চাই ছিলাম না। আমাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
‘তাহলে বিয়ের পর নাটক করেছিলেন কেন?’
‘নাটক নয়। আমি সত্যিই ভালোবাসি।’
‘কিন্তু একজনকে নয় অনেক জনকে। আমি আপনাকে বারবার জিজ্ঞেস করতাম আপনি শুধু আমায় একা ভালোবাসেন না! আপনি জবাব দিতেন না। আজ সমস্ত উত্তর পেয়ে গেছি। আপনি আবার একবার প্রমাণ করে দিলেন আপনি মিথ্যা কথা বলেন না। কিন্তু আপনার এক একটা সত্য কথা এক একটা সাম্রাজ্যের পতনের জন্য যথেষ্ট।’ সবুজ নিশ্চুপ। তোতা কাঁদছে। বাচ্চার মতো চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্নার জোর এতটা প্রকট যে মাঝেমধ্যে নিশ্বাস আটকে গিয়ে কেশে ফেলছে। তবুও কাঁদছে। কেউ আটকাছে না। নিজেকে বড়ো দুর্বল পরাধীন অসহায় লাগলো। নির্জন নিরালা একাকী কোনো দিকে কেউ নেই। সবুজের দিকে মুখ করলো। অন্ধকারের মধ্যে তার মুখ দেখতে পেল না। তার মুখ যে রাঙ্গা হয়ে আছে বুঝতে পারলো। সবুজকে ডাকলো। সাড়া দিল না। আবার একবার ডাকলো। সবুজ এবার তোতার দিকে মুখ করে সাড়া দিল। তোতা কিছুটা শান্ত হয়েছে। সবুজের কোমরে হাত রেখে মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,’আপনি না পাপ কাজকে ভয় পান? আপনি যে আমায় ঠকালেন এ বুঝি পাপ নয়! আপনার একটা পাপ কাজ আপনার সমস্ত পূর্ণকে ধুলোয় মুড়ে দিয়েছে। আপনি একটা পাপী রাজামশাই। আর আমি এই পাপীকে ভালোবেসে ফেলেছি। এতটা ভালোবেসেছি যে না পারছি থাকতে না পারছি চলে যেতে।’ স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। পাপী মানুষটাকে ঘৃণা করতে পারলো না। সবুজ আগলে নিল বাধা দিল না। তোতা কেঁদে গেল। তাকে সান্ত্বনা দিতে পারলো না। কী বলে সান্ত্বনা দেবে? তোতা আর কিছু বলল না। তার মাথা যন্ত্রণা করছে। যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না। প্রথম থেকে হারানোর ভয় ছিল মাঝপথে হারিয়ে ফেলেছে। একটু একটু করে তোতা চুপ হয়ে গেল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলল। গভীর রাত নেমে এলো। তোতা সবুজের বন্ধন থেকে বেরোলো না। একই ভাবে শুয়ে রইলো। দুজনেই জানে আজ রাতে কেউ ঘুমোবে না। চুপচাপ পড়ে রইলো। একটা সময়ের পর দুজনেই ঘুমিয়ে পরল। ভয়ঙ্কর এক রাত। এ রাত্রির বর্ণনা নেই ভাষা যোগায় না।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই -তবে অল্পক্ষণ। তোতা ঘুম থেকে উঠে অনুভব করলো তার শাড়ি ব্লাউজ ঘামে ভিজে গেছে। চটচট করছে শরীর।স্বামীর বুকে তখনো মুখ লুকানো। মুখ তুলে দেখলো ভোরের আলো ফুটতে অনেক দেরি আছে। সবুজের গায়ে হাত বোলালো। সেও ঘামে ভিজে আছে। তার পেটে মাথা রেখে শুয়ে হাঁটু দুটো মুখের কাছে নিল। অকারণে কেঁদে ফেললো। ধক ধক করে কেঁদে গেল। নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারলো না। স্বামীর পাশে ঘুমানোর মতো বিরল সুযোগ পেয়েও চোখে জলে ভর্তি। এত একা লাগছে কেন? কিসের এত কষ্ট? সে তো মন থেকে স্থির করে রেখেছিল তাকে পাওয়ার পর তার মানুষটা যদি অন্য কারোর কাছে যায় তাহলে সে সব ছেড়ে চলে যাবে। তবে আজ কেন পারছে না? কিসের মায়া তাকে আটকে রেখেছে? অনেক্ষণ পর নিজেকে শান্ত করলো। স্বাভাবিক কন্ঠে সবুজকে ডেকে তুললো। ভোরের আলো কিছুটা ফুটেছে। স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারছে না। ভয় করছে। নিজেকে ঘেন্না লাগছে। অন্য দিকে মুখ করে বসে রইল। তোতা শান্ত গলায় বলল,’রাজামশাই,ও রাজামশাই,তাকান আমার দিকে।’ সবুজ তাকালো না।
‘আমার দিকে তাকাবেন না?’ সবুজ তোতার দিকে তাকালো। তার চোখ ঝিমিয়ে আছে। মুখ বড়ো শুকিয়ে গেছে। সে অস্থির অস্বচ্ছন্দ্য বিক্ষুব্ধ। তোতা বললো,’কি করেছেন নিজের অবস্থা? খাবেন না? কিছু বানিয়ে দিচ্ছি চলুন খেয়ে নেবেন।’
‘আমার খিদে নেই।’
‘কাল রাতে আমি অল্প খেয়েছি বলে আপনিও তো অল্প খেয়ে উঠে এলেন। খাবেন চলুন। নাহলে শরীর খারাপ করবে।’
‘আপনিও সারাদিন খেতে থাকেন। পেটুক মানুষ। কতদিন হলো ঠিকঠাক খাচ্ছেন না। আপনার বুঝি খিদে পাচ্ছে না!’
‘খুব খিদে পাচ্ছে। চলুন দুজনে একসঙ্গে খাবার খাই।’ সবুজ আবার শুয়ে পড়লো। তোতার দিকে তাকালো। সে বিমর্ষ বিষন্ন তমসাচ্ছন্ন তবুও এমন ভাবে কথা বলছে যেন কিছুই ঘটেনি। তোতাও পাশে শুয়ে সবুজের দিকে মুখ করলো। সবুজ ক্লেশিত কণ্ঠস্বরে বলল,’আপনার কি কিছু মনে নেই? সবকিছু ভুলে গেলেন?’
‘কিচ্ছু ভুলিনি। সব মনে আছে।’
‘তাহলে এত আদর করছেন কেন?’
‘কি করবো? আমি যে আপনাকে ভালোবাসি।’ সবুজ চোখ ফিরিয়ে নিল। তোতা বলল,’আপনি তো ভালো মানুষ ছিলেন। কেন এমন হয়ে গেলেন?’ সবুজের কাছে জবাব নেই। আবার নিস্তব্ধতা। একটু পর তোতা বলল,’আপনি আমায় ভালবাসেন?’
‘ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোতাপাখি। কিন্তু আজও আমার হৃদয়ে সাথী আছে। মুছে দিতে পারিনি।’
‘আপনি কি মাঝে মাঝে তার কাছে ছুটে যান? আমি আপনার সবকিছু পূরণ করতে পারি না? আমি ব্যর্থ নারী?’
‘না, ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও জানি না। আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই কিন্তু তাকে আমি ভালোবাসি।’
‘ভালোবাসেন ঠিক আছে। কাউকে ভালোবাসলে তাকে তো আর ভোলা যায় না। কিন্তু একের পর এক নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া কি খুব জরুরী ছিল?’
‘এর সঠিক উত্তর আমার জানা নেই। আমি প্রথম সাথীর বিবস্ত্র দিগম্বরী শরীর দেখেছিলাম। তারপর থেকেই শুরু হয় আমার শরীরের অদ্ভুত ঔদ্ধত্য নির্লজ্জতা বেহায়াপনা। কিশোরীর পুষ্পবৃক্ষ আমাকে ধৈর্যচ্যুত করে তোলে। তাদের শরীর আমার কাছে হরিণের মাংস হয়ে ওঠে।’
‘মনের মধ্যে পাপ পুষে রেখে ভালো মানুষ হওয়া যায় না।’
‘অধর্মের ভয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়েছিলাম।একটা মানুষের মধ্যে সমস্ত কিছু ভালো থাকতে পারে না খারাপও থাকে। আমার জীবনে খারাপ গুলোকে বলি দিচ্ছিলাম। সম্পূর্ণ ভালো মানুষ হতে চাইছিলাম। কিন্তু শরীরের ঔদ্ধত্য বলি দিতে পারিনি। একটা সময়ের পর আরও বেড়ে যায়।’
‘কেন বাড়লো? তখন আপনার অধর্মের কথা মনে এলো না? মনে হলো না আপনি ভুল করছেন?’
‘এর উত্তরও জানা নেই।’ তোতা আবার কাঁদতে শুরু করল। চোখ থেকে জল ঝরে পড়ছে। তাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল মুছে দিতে ইচ্ছা করেলো। কিন্তু করল না। সে অধিকার হারিয়েছে। অস্পষ্ট কণ্ঠস্বরে বলল,’আপনি কী করে সবকিছু জানতে পারলেন?’
‘আমি আপনার স্ত্রী। তিন বছর ধরে সংসার করছি। আমি জানতে পারবো না? আমি প্রথম যখন আপনার বাড়িতে এসেছিলাম তখন আপনাকে বলেছিলাম আমি মোটেও সহজ-সরল নই। আমাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। তাছাড়া অধর্মের কাজ কখনো লুকানো থাকে না। আমাদের গ্রামে একটা প্রবাদ আছে জানেন,পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’ আবার চুপচাপ। ভোরের আলো সম্পূর্ণ ফুটে গেছে। পাখিরা কিচিরমিচির শুরু করেছে। কোলাহল হয়ে উঠছে দিগন্তের পর দিগন্ত। তোতা মিহি কন্ঠে বলল,’আপনি কি বিয়ের আগেও এমন ছিলেন?’
‘না, বিয়ের পরে….। বিয়ের পর কোনো কারণে আমার সাহস দ্বিগুণ বেড়ে যায়।’ তোতা হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,’আপনি তাহলে জেনে শুনে সব কিছু বুঝে আমায় আঘাত করেছেন। আপনার আঘাতের তীব্রতায় আমি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছি। আমি আর পারছি না রাজামশাই। আমি হেরে গেছি। আপনি আমার হারিয়ে দিয়েছেন।’
‘কিন্তু আপনার কি একবারও মনে হলো না; -আপনি কত মানুষের আদর্শ। তারা যদি সবকিছু জানতে পারে তাহলে আপনি সমাজের সামনে মুখ দেখাতে পারবেন তো? ওদের কথাও না হয় বাদ দিলাম। আপনি আমার কথা একবারও ভাবলেন না। আপনি তো আমায় চেনেন। আমি কেমন তা আপনার অজানা নয়। এই সহজ সরল ভিখারিনীকে ঠকাতে আপনার বিবেকে বাঁধলো না!’ নিজেই বলে নিজেই হা হা করে হেসে উঠলো। সবুজ বুঝতে পারল না তার হাসির কারণ! প্রশ্ন করতে হলো না। তোতা নিজে থেকে জবাব দিল,’আপনি তো রাইটার। কত চরিত্রকে বিপদে ফেলেন আবার সে-ই বিপদ থেকে অনায়াসে মুক্ত করে দেন। আপনার মস্তিষ্ক ধারালো বুদ্ধিতে ভর্তি। আপনি আপনার ধারালো বুদ্ধি কাজে লাগিয়েছেন। আপনি নিজে একটা চরিত্র। আপনার সুন্দর চেহারা রয়েছে। সুন্দর চেহারাকে কাজে লাগিয়ে কিছু নারীকে ফাঁসিয়েছেন। আর কিছু নারীর তো জন্মগত অভ্যাস আজ এর সঙ্গে তো কাল অন্যের সঙ্গে ঘুমানোর। অনেক উপন্যাসে লিভিং শব্দটি শুনেছিলাম। কিন্তু বাড়িতে বউ রেখে অন্য মেয়ের সঙ্গে লিভিং করা শব্দটি আজ প্রথম শুনলাম। শুধু শুনলাম নয় উপলব্ধিও করলাম।’
নিঃশব্দে আরও অনেকটা সময় কেটে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠার কারোর তাড়া নেই। খিদে মরে গেছে। ভোরের সুন্দর নির্মল বাতাস এমন বিষাক্ত মুহূর্তের কাছে হেরে গেছে। সারা ঘর জুড়ে বিষাক্ত বায়ু বইছে। এমন বায়ুতে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দুজনের। নিষ্প্রভ কন্ঠে সবুজ বলল,’আপনি তাহলে চলে যাবেন?’
‘কোথায়?’
‘বাপের বাড়ি। আপনি তো বলেছিলেন আপনার মানুষটা যদি আপনাকে পাওয়ার পর অন্য কাউকে চায় তাহলে তাকে ছেড়ে চলে যেতে এক মুহূর্তও ভাববেন না।’
‘বলেছিলাম। কিন্তু তখন আপনাকে ভালোবেসে ছিলাম না তাই বলতে পেরেছিলাম। এখন আপনাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি পারব না আপনাকে ছেড়ে যেতে। আপনি যদি আবার অন্য কোনো মেয়ের কাছে যান তবুও পারবো না আপনাকে ছেড়ে যেতে। তবে আমি চাইবো আপনি যেন আর না যান।’
‘আমি এভাবে মাথা নিচু করা নারী দেখতে চাই না। আপনি ফিরে যান। এভাবে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেবেন না।’
‘আপনি আমায় মাথা নিচু করতে বাধ্য করেছেন। আবার নিজেই বলছেন মাথা নিচু করা নারীদের পছন্দ করেন না।’ একটু চুপ থেকে আবার বলল,’আমি খুব অহংকারী আর আত্মবিশ্বাসী ্ ছিলাম। কিন্তু আপনার ভালোবাসা আমার আত্মবিশ্বাস অহংকার সবকিছু বলি দিয়েছে। আপনি আমায় ভিক্ষুক বানিয়ে দিয়েছেন। আমার সবকিছু শেষ। আমার আর কিছু শেষ হতে বাকি নেই।’ তোতা আর শুয়ে থাকতে পারল না। গা হাত ব্যাথা করছে। উঠে বিছানায় বসলো। সবুজের দিকে তাকালো। নিশ্চুপ গতিহীন ভাবে পড়ে রয়েছে। সবকিছু ঝরে পড়েছে। রামধনুর মতো উজ্জ্বল মুখমন্ডলে অন্ধকারের ঘন ছায়া নেমেছে।
‘আজ রাতে কি আপনার গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ রয়েছে?’ কথাটি পরিহাস করার জন্য বলল তা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল সবুজ। নিজের মধ্যে কোনোরকম অসন্তোষ পুষে না রেখে সবুজ জবাব দিল,’না,নেই।’
‘তাহলে কবে আছে?’
‘আর কোনো দিন নেই। আমি আর যাব না।’
‘সত্যি!’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আটকাতে চাই না। জোর করে আমি আর আপনাক নেবো না। আমি জানি আপনি প্রতিশ্রুতি দিলে প্রতিশ্রুতি রাখবেন। আপনি তো ভালো মানুষ। আপনি যদি নিজে থেকে সত্যি আর না যান তাহলে আমার চাইতে খুশি আর কেউ হবে না। আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। অন্ধের মতো বিশ্বাস করি।’
‘জানেন রাজামশাই, আপনি রাতে ঘুমিয়ে গেলেও আমার ঘুম সহজে আসতো না। আমি তখন লক্ষ্য করতাম আপনি ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠতেন। প্রথম রাত্রিতে ঘুমানোর সময় আপনার চোখের কোণে জল দেখেছিলাম। সেদিন জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি। কিন্তু বুঝেছিলাম আপনি বড়ো কিছু আশা করেছিলেন। আপনার সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা চুরমার হয়ে গেছিল। তাই আপনার চোখের জল। ভেবেছিলাম কোনোদিন জানতে চাইবো না। আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে। আমায় বলবেন?’ সবুজ উঠে বসলো। বলল,’আমার সাথীর কথা মনে পড়তো। তার কথা মনে পড়লে আমার চোখ দুটো ভিজে যায়।’ তোতার মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সহজে মেনে নিল। হাসিমুখে বলল,’অনেক বেলা হয়েছে। চলুন কিছু খেয়েনি।’

সারাদিন মনমরা হয়ে কেটে গেল। একে অপরের সাথে ঠিক মতো কথা বললো না। দুজনের মধ্যে একটা ভেদাভেদ সৃষ্টি হয়েছে। একটা অদৃশ্য প্রাচীর দাঁড়িয়ে গেছে। প্রাচীর সরিয়ে কেউ কাছাকাছি আসার চেষ্টা করছে না। একজন অন্যজনকে ঠকিয়ে নিজের প্রতি ঘেন্নাতে ভুগছে। আর একজন একজনের কাছে হেরে গিয়ে নিজেকে সরাতেও পারছে না কাছেও আসতে পারছে না। ঘটনা ঘটলো রাতের খাবারের সময়। খেতে বসলো একসঙ্গে। সবুজ অনেকটা খাওয়ার পর খেয়াল করলো তোতা খাচ্ছে না। বিমূঢ় কন্ঠে বলল,’খাচ্ছেন না কেন?’
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘খেয়ে নিন। নাহলে শরীর খারাপ করবে তো।’
‘ইচ্ছে না করলে আপনি খাইয়ে দেন। আজ খাইয়ে দেবেন না?’
‘সে অধিকার হারিয়েছে। আপনি আর কেন আমায় স্পর্শ করবেন?’
‘ভালোবাসি তাই স্পর্শ করবো।’
‘ভালোবাসার অজুহাত দেখিয়ে সবকিছু হয় না। আপনি ফিরে যান তোতাপাখি।’
‘আপনি না সকালে বললেন আর কখনো যাবেন না। তাহলে ছেড়ে যেতে বলছেন কেন?’
‘আমি যাব না ঠিকই। তবে আমি চাই না আপনি হেরে যান।’
‘আমি যদি না হেরে যাই তাহলে সারা জীবনের জন্য হেরে যাবো। আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যাবে। আমি অন্তঃসারশূন্য সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বো। আমি পারবো না।’
‘আমি একজন পাপী।’
‘আর আমি পাপী রাজামশাই এর রানী।’
‘আপনি ফিরে যান। আপনার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রয়েছে।’
‘আপনার কাছে থাকার জন্য আমাকে যদি অন্ধকার রাজ্যের রানী হতে হয় তাতেও আমি রাজি।’
‘ফিরে যান।’
‘যাবো না। আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।’ সবুজ আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। চোখ থেকে ঝরঝর করে ভাতের থালায় জল ঝরে পড়লো।
‘খেতে বসে কাঁদতে নেই রাজামশাই। ভাতের থালায় চোখের জল ফেললে অমঙ্গল হয়।’ সবুজ থামলো।
‘আর কত কাঁদবেন? আমায় খাইয়ে দিন। খুব খিদে পেয়েছে।’ সবুজ খাইয়ে দিল। দু’মুঠো ভাত খেয়ে মুখে তৃপ্তি আসতে না আসতে কেঁদে ফেললো তোতা। ঝাঁপিয়ে পড়লো সবুজের উপর। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,’আমি আপনাকে ভালোবাসি রাজামশাই। খুব ভালোবাসি। আর কি করলে বুঝবেন আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর কি করার বাকি আছে আমার? আর কত পরীক্ষা নেবেন? আমার চোখ দেখে কি বুঝতে পারছেন না আমি আপনাকে গভীর ভালোবাসি?’
‘আমি জানি আপনি আমায় ভালবাসেন। ভালোবাসেন বলে এতো বেহায়া হতে পেরেছেন। সব কিছু ফেলে আমার কাছে থাকতে চাইছেন।’
‘তাহলে কেন ঠকালেন?’
‘আমায় ক্ষমা করে দেবেন তোতাপাখি? একবার ক্ষমা করে দিন।’
‘আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনার কাছে থাকতে থাকতে আমি আপনার মতো হয়ে গেছি।’ তোতা কেমন একটা মেয়ে। নিজের মনের ভাবনা নিজের কাছে স্পষ্ট নয়। না পারছে মন থেকে ক্ষমা করে গ্রহণ করতে না পারছে দূরে সরে যেতে।
‘আপনি কবে থেকে জানেন আমি অন্য মেয়ের প্রতি আসক্ত?’
‘এক বছর আগে থেকে।’ সবুজ চমকে উঠলো। এক বছর আগে থেকে সবকিছু জানে। অথচ তাকে কিছু বুঝতে দেয়নি। নিরবে কত হাসি কৌতুক করে কাটিয়ে দিয়েছে। সবকিছু জেনেও মুখ বন্ধ করেছিল। এও তোতার পক্ষে সম্ভব? সাপের বিষ গলায় নিয়ে একটা বছর বেঁচে ছিল। কি করে সম্ভব?
‘তাহলে এত দিনের পর বললেন কেন?’
‘দেখতে চাইছিলাম আপনি নিজে থেকে কবে ধরা দেন। আমি আর পারছিলাম না তাই কয়েক দিন মনমরা হয়ে পড়েছিলাম। আমি সত্যিই পারছি না।’

যতই ক্ষমা করে দিক না কেন মনের মধ্যে যে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে সে-ই ক্ষত সহজে পূরণ হবে না। একটা মানুষকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে আর পরে যখন জানতে পারে মানুষটা ভুল তখন বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই মরে যায়। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না তার রাজামশাই তাকে ঠকিয়েছে। ওই মানুষটা কাউকে ঠকাতে পারে এ ভাবা যায় না। বিশ্বাসের অযোগ্য। কিন্তু সত্যি ঠকিয়েছে সে। বিশ্বাস করতেই হবে। এমন অনুভূতি মানুষকে বোবা বানিয়ে দেয়। রাতের অন্ধকারে একে অপরের কাছে রয়েছে কিন্তু মন পড়ে আছে অনেক দূরে। বহু দূরে। কেউ কাছে আশার চেষ্টা করছে না। তারা জানে আজও রাতে ঘুম হবে না। শুধু আজ নয় আরও অনেক গুলো ঘুমহীন রাত্রি কাটাতে হবে। দীর্ঘ সময় কেটে গেল। তারপর তোতা সরল কন্ঠে বলল,’আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
‘না, ঘুম আসছে না।’
‘কেন?’
‘আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না!’ উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল সবুজ।
‘কষ্ট দিয়েছেন কষ্ট পাবো না?’ সবুজের কাছে উওর নেই। তোতা আবার বলল,’আমার কাছে কিসের অভাব ছিল রাজামশাই? সে-ই সময় বলতে পারতেন আমি নিজে থেকে চলে যেতাম। এখন সবাই জানতে পারলে কি হবে জানেন। গ্রামের মহিলাদের আপনি চেনেন না? বেশিরভাগ মানুষ আপনার দোষ দেখবে না। সবাই আমার দোষটা দেখবে। সবাই আমাকে দোষী মানাবে। ওরা দাবি করবে, আমি স্বামীর চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি তাই স্বামী অন্য নারী বেছে নিয়েছে। কথাটি একজন নারীর কাছে কতটা অপমানজনক জানেন? আমি কোনো দোষ না করেও কেন দোষী হবো? উত্তর আছে আপনার কাছে?’ উওর দেওয়ার মতো কোনো শব্দ নেই। গ্রামে বড়ো হয়েছে সবুজ। গ্রামের মহিলাদের কূটনীতি অজানা নয়। গ্রামের সমাজকে ভীষণ ভয় পায়। এখানে কিছু হলে সর্বপ্রথম নারীকে দোষী বানানো হয়। দোষ না থাকলেও দোষী হয়। এমন কত ইতিহাস সবুজের কানে ভেসে এসেছে। ছোটবেলা থেকে সব শুনেছে। সবকিছু জেনেও……।’
অনেকটা সময়ের পর তোতা বললো,’আমার বুকে আসুন। আপনাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে।’ কথা গুলো যেন মন থেকে বলল না। জোর করে বলল।
‘ইচ্ছে করছে না।’
‘আমি তো আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। অসুবিধা কোথায়?’
‘কিন্তু আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না।’
আবার নিস্তব্ধতা। দুজনে অসাড় হয়ে পড়ে রইল। দুজনের মনে অসংখ্য ভাবান্তর। তোতা ভাবতে শুরু করলো…। সব দোষ কি সবুজের? নিজের কোনো দোষ নেই? সে সবকিছু আগে থেকে জানতো। তবুও কেন আটকালো না? আটকায়নি বরং তাকে ভুল কাজে উৎসাহিত করেছে। সে প্রথম যখন সবুজের কাছে আসে তখন সবুজ ছিল শান্ত ধীর উগ্রতা শূন্য শীতল পুরুষ মানুষ। যে কোনো কিছুর বিনিময়ে খারাপ কাজ করতো না। শুধু নিজের নয় তার সামনে কোনো খারাপ কাজ হতেও দিতো না। ভুল কাজ থেকে সবসময় দূরে থাকতো। আর তাকে দিয়ে প্রথম ভুল কাজ করিয়েছে তোতা নিজেই। সবুজের জীবনের সমস্ত নিয়মকানুন চুরমার করে দিয়েছে সে। তার অনেক কিছুই ভালো লাগতো না কিন্তু তোতার দিকে তাকিয়ে সেগুলো করেছে। করতে না চাইলেও সে জোর দিয়ে করিয়ে নিয়েছে। তোতার ভুল কাজ গুলোকে সমর্থন করেছে। তার প্রানের বন্ধু তাকে যে কাজ করতে বলতো সেটা ভুল হলে সরে এসেছে সাথীর বেলাও তাই হয়েছে কিন্তু তোতার বেলা হয়নি। আজ তার কালো জগতের জন্য সে কিছুটা হলেও তাই। তোতা নিজেই তাকে ভুল কাজে উৎসাহিত করেছে। ভুল কাজ করতে বলেছে। কিন্তু তোতার কখনো মনে হয়নি সেগুলো আসলে ভুল কাজ। সবুজ স্বাভাবিক জীবনে ছিল না। তাকে স্বাভাবিক জীবনে আনার চেষ্টা করেছে। আর সবুজের কাছে স্বাভাবিক জীবনটা ছিল ভুল। এতকিছুর মধ্যেও কিছুটা হলেও দোষ রয়েছে। কিন্তু সবুজ একবারের জন্য অভিযোগ করেনি, তোতাপাখি আমার এই কালো জগতের জন্য শুধু আমি নয় আপনিও দায়ী। আপনিই আমাকে দিয়ে ভুল কাজ করিয়েছেন। অন্যায় দেখেও নীরব থাকতে বলেছেন। তাহলে আজ কেন আমায় ভুল দেখে দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন? কোনো অভিযোগ করেনি। সে আবার প্রমাণ করে দিল সে সত্যিই ভালো মানুষ। তোতা সবুজকে জড়িয়ে ধরলো। উজ্জল কন্ঠে বলল,’আপনি ভালো মানুষ রাজামশাই। আপনি সত্যিই ভালো মানুষ।’ সবুজ জবাব দিল না। তোতা আবার বলল,’আমার সারাজীবন বড়ো একটা আফসোস থেকে যাবে।’
‘কীসের আফসোস?’
‘আপনি আমায় ভালোবাসলেন। কিন্তু শুধু আমায় ভালোবাসেন না।’

পর্ব ২৪ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here