নিরুদ্দেশ পর্ব ২২

নিরুদ্দেশ
পর্ব ২২

সূর্যময়ের দিনকাল মোটেও ভালো যাচ্ছে না। আজ একটা বিপদ তো কাল আরও একটা বিপদ এসে হাজির। আর্থিক অবস্থা একদম ভেঙে পড়ছে। ময়ূর বড়ো হতে শুরু করার সাথে সাথে রোগও বৃদ্ধি পেয়েছে। সব সময় কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। বাবার বয়স হয়েছে। আগের মতো কাজ করতে পারেন না। মা তো একদমই পারেন না। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব তার উপর পড়েছে। ছোটবেলা থেকে পরিশ্রমে অভ্যস্ত তাই একটু বয়স হতে সেও পূর্বের মতো কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না। অল্পতে ভেঙে পড়ে। বাজারে ধারদেনা বেড়েই চলেছে। সুদ গুনতে গুনতে দিন কাটছে। বাবা-মা আর ছেলের ওষুধ আনতে আনতে সারাদিনের রোজগারের টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন তিন বেলা খাবার জোগাড়ের জন্য মাথায় দুশ্চিন্তা হয়। একটা বেলা রান্না করার পর পরের বেলায় কি রান্না হবে তা নিয়ে গভীর ভাবতে হয়। নুন ভাত দিয়ে না হয় সে আর লতা খেয়ে নিল, কিন্তু ময়ূর! তাকে তো আর এসব খাবার দেওয়া যায় না। বাবা-মাও আর কদিন বাঁচবেন? এই বয়সে ভালো-মন্দ খাবার খেতে চাইবেন। ভালো জিনিস আনতে পারে না। নিজেকে মাঝেমধ্যে ব্যর্থ সন্তান ভাবে। ছোটবেলায় না চাইতে বাবা-মার কাছ থেকে কত কিছু পেয়েছে। অথচ বৃদ্ধ বয়সে সে বাবা-মাকে কিছু দিতে পাচ্ছে না। বাবা-মাও আশা করে শেষ বয়সে ভালো থাকবে। সুখে থাকবে। তাঁরা কি সুখে আছে? সুখে হয়তো নেই কিন্তু ভালো আছে। অভাব থাকলেও ছেলে বৌমার কাছে আছে। নিজের জন্য আজকাল ভাবে না সূর্যময়। নিজের জন্য কিছু কেনে না। দুটো লুঙ্গি আর দুটো গেঞ্জিতে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে। আজকাল জ্বর হলেও নিজের জন্য ঔষধ আনে না। শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়। শরীর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। মাথায় প্রায় চুল উঠে গেছে। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। গায়ের চামড়া তামাটে হয়েছে। গাল গলে গেছে। বড় ক্লান্ত আর অগোছালো সে। তার এমন দুর্দশার কথা শুনলে বন্ধুরা অবশ্যই পাশে থাকবে। কিন্তু সে কাউকে তার দারিদ্রতার কথা জানাতে চায় না। তার যা আছে সেটাই অনেক। সে না বললেও বন্ধুরা ঠিক বুঝতে পেরে যায়। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রকমে আড়ালে থেকে সাহায্য করেছে তারা। তাদের কাছ থেকে যেচে সাহায্য নিতে চায় না। তার ক্লান্ত পথিক জীবনের একমাত্র সঙ্গী লতা। ন্যাড়া হয়ে যাওয়া গাছের ভরসা সে। দীর্ঘ পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরলে কোলে মাথা রেখে আরামে ঘুমোতে পারে। তার মাথায় যখন হাত বুলিয়ে দেয় তখন পৃথিবীর সমস্ত শান্তি সেখানে এসে থমকে যায়। বুক ভরে শ্বাস নেয়। লতা কোনো অভিযোগ করে না। অনেক সময় রাগ হয়। নিশ্চুপ থাকে। ঝগড়া করতে চায় না। ঝগড়া কেন করবে? মানুষটা তো আর বসে নেই। সবসময় পরিশ্রম করছে। তাকে শান্তিতে থাকার সুযোগ যদি না করে দেয় তাহলে নিজে যে ব্যর্থ হয়ে যাবে। ময়ূর যখন বাবা বলে ডাকে তখন ভেতর থেকে পরিশ্রম করার শক্তি খুঁজে পায়। ওই মুহূর্তে বুক ভারী হয়ে ওঠে। সমস্ত কিছু করার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ে। লতাও বড় অদ্ভুত মেয়ে। অভাব-অনটন বুঝতে পারে সে। নিজের জন্য কখনো কিছু চায় না। স্বামী পরিশ্রম করবে আর সে বসে থাকবে -তা হতে দেয় না। বাড়ির কাজের সাথে সাথে আজকাল সেও লোকের বাড়িতে কাজ করতে যায়। সূর্যময় বাধা দেয় কিন্তু শোনে না। উল্টে স্বামীকে একটু কম কাজ করতে বলে।
এখন ধান কাটার সময়। সূর্যময় খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের বাড়িতে ধান কাটে তারপর একটু বেলা হলে লোকের বাড়িতে কাজ করতে চায়। সবাই যখন বাড়ি ফিরে আসে বিশ্রামের জন্য তখন সূর্যময়ও ফিরে আসে। কিন্তু সে বিশ্রাম করে না। বাড়ির কাজে লেগে পড়ে। তারপর দু-মুঠো ভাত মুখে তুলে আবার লোকের বাড়িতে কাজ করতে যায়। সন্ধ্যার সময় সবাই মাঠ থেকে আবার ফিরে আসে। বাড়িতে বিশ্রাম করে। সূর্যময় বিশ্রাম করে তবে প্রতিদিন নয়। কোনো কোনো দিন বাড়ির কাজে লেগে পড়তে হয়। নিজের বাড়িতে ধান চাষ হয়েছে। সেগুলো শ্রমিক দিয়ে তুললে অনেক খরচ হয়ে যাবে। আবার নিজে বাড়িতে থেকে গেল বাইরে থেকে ইনকাম হবে না। সময় বের করে নিজের বাড়িতে ধান তোলে। লতা আর অতুল বাবু বাড়িতে থাকতে পারে না। সূর্যময়ের সঙ্গে যায়। ময়ূরকে সামলায় তার দিদা। গ্রীষ্মের পড়ন্ত দুপুরে চারিদিকে শুনশান। মানুষের আনাগোনা কম। বাড়ির উঠোনে হালকা বাতাস বইছে। খালি গায়ে বসে অপেক্ষা করছে লতার। সে পান সজিয়ে নিয়ে এলে কাজে বেরিয়ে যাবে। এমন সময় বাড়ির সামনে এক ভদ্রমহিলা স্কুটার করে এলেন। মহিলাটিকে চেনে না সূর্যময়। এই অসময়ে আবার কে এলো? লতার কোনো আত্মীয় নয়তো! আত্মীয় হলে সমস্যা আছে। তারা তো শাকসবজি সংগ্রহ করে কোনোরকম কিছু খেয়ে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। আত্মীয়দের তো আর ওইসব খাবার দেওয়া যায় না। সূর্যময় উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটি বেশ কয়েকটা কাগজ বারবার উল্টে দেখলো। লতা ততক্ষণে চলে এসেছে। প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে স্বামীর মুখের পানে তাকালো। সূর্যময় ইশারা করে বললো সেও তার মতো কিছু বুঝতে পারছে না। অপরিচিত মেয়েটি কিছুটা এগিয়ে এসে শান্তকণ্ঠে বলল,’এটা সূর্যময় মাঝির বাড়ি?’
‘হ্যাঁ, কেন বলুন তো?’
‘আপনার জন্য একটা নোটিশ রয়েছে।’
‘নোটিস!’ বিস্ময় কন্ঠে বলল। এই সময় আবার কিসের নোটিস? কিছুই বুঝতে পারলো না। মেয়েটিও পরিষ্কার করে কিছুই বলল না। বেশ দেমাক দেখালো। তার যেটুকু কাজ ও-টুকুই করল। ওর বেশি কিছু করতে চাইল না। সূর্যময়ের হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে সাইন নিয়ে চলে গেল। সে তাড়াতাড়ি কাগজটা খুলে পড়ে নিল। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে গেল। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। এ আবার কোন বিপদ এলো? লতা ভেঙ্গে পরলো না। শান্ত হয়ে সবকিছু জানতে চাইল। সূর্যময়ের স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগলো। তারপর কিছুটা বলতে লতা বুঝে গেল। সে সবকিছুই জানে। কিছু বছর আগে তাদের পুরনো মাটির বাড়ি ভেঙে নতুন পাকা বাড়ি হয়। কিছু টাকা জমানো ছিল আর কিছু টাকা জমি ব্যাংকে বন্ধক রেখে নিয়েছিল। প্রতিবছর কিছু কিছু টাকা দিয়ে শোধ করার কথা ছিল। কিন্তু দুটো বছর পর আর টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। দারিদ্র চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। এখন দু-লাখ টাকা দরকার। এই টাকা দিতে না পারলে তাদের জমি সরকারের হস্তগতে চলে যাবে। তাদের একমাত্র অবলম্বন চাষের জমি। সে-ই জমি চলে গেলে তারা পথে বসবে। পূর্বে আনন্দে কৌতুকে যেখান থেকে পেরেছে ধারদেনা করে ফেলেছে। নিজেদের চাহিদার অপূর্ণতা রাখেনি। ধারদেনা করে খুশির মতো টাকা উঠিয়েছে। কিন্তু দিনের পর দিন সুদ যে এভাবে বাড়তে থাকবে তা তারা বুঝতে পারেনি। এখন আসল টাকা চাইতে সুদের টাকা অনেক বেশি হয়ে গেছে। এত ঋণ কি করে শোধ করবে? কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর লতা বলল,’তুমি একবার সবুজদা ফোন করে বলল। সে তোমায় সাহায্য করতে পারবে।’ সূর্যময় স্ত্রীর দিকে তাকালো। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। বড়ো ভয় পেয়ে গেছে। সে মাথা দোলাতে লতা ঘর থেকে ফোন এনে স্বামীকে দিল।
ফোন তুলে সবুজ বলল,’বল, শুনছি।’
‘আমি একটা দরকারের জন্য ফোন করেছি।’
‘ঠিক আছে বল। কি দরকার?’
‘আমার টাকা দরকার। খুব প্রয়োজন। আমায় দু-লাখ টাকা দিতে পারবে।’
‘দু-লাখ!’ খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল সবুজ।
‘হ্যাঁ।’
‘আমি এত টাকা কোথায় পাবো? আমার কাছে তো এত টাকা নেই।’
‘নেই না!’
‘না।’
‘ঠিক আছে। রাখছি, পরে কথা হবে।’ সূর্যময় ফোন কেটে দিতে লতা বলল,’কি বলল?’ সূর্যময় সত্যি কথা বলতে পারল না। মুখের উপর ‘না’ বলে দিয়েছে সবুজ। সে কথা কিছুতেই স্ত্রীর সামনে বলতে পারল না। সে হাসিমুখে বলল,’ওর কাছে এত টাকা নেই। ওর চেনা পরিচিত কারোর কাছে আছে কিনা দেখবে বলল।’
‘তাহলে ঠিক ম্যানেজ করে দিতে পারবে। তার তো অনেক পরিচিত মানুষ আছে।’
‘কি জানি! তুমি একবার সংকেতকে ফোন লাগাও তো।’
সংকেত ফোন ধরে বিস্ময়ে চমকে উঠলো। বন্ধুর গলা এত শুকনো লাগছে কেন? নিজেকে স্থির করতে পারল না। তাড়াতাড়ি বলল,’কি হয়েছে তোমার? তাড়াতাড়ি আমায় বল? আমি এক্ষুণি আসছি।’
‘এখন আসতে হবে না……।’ সূর্যময় সংক্ষেপে সমস্ত ঘটনা বলল। সব শুনে সংকেত বলল,’চিন্তা করবে না বন্ধু। আমি আছি তো। আমি রাতে তোমার বাড়িতে টাকা নিয়ে আসছি। বৌঠানকে বলো চা আর মসলা মুড়ি বানিয়ে রাখতে।’ সূর্যমায়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। লতাও হাসলো।
সবুজ ফোনে কথা বলার সময় সবকিছুই শুনেছে তোতা। মুখ গোমড়া করে রেখেছে। স্বামীর এমন ব্যবহারে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। এ ভাবে বন্ধুদের সাথে কেউ কথা বলে নাকি! ফোনটা রেখে দিতেই তোতা বলল,’এভাবে কেউ কথা বলে? ও আপনার ছোট বেলার বন্ধু না!’
‘আপনি তো সবকিছুই জানেন তোতাপাখি। আমার কাছে এত টাকা নেই। আমার জমানো টাকা মাত্র তিরিশ হাজার পড়ে আছে। আপনি জানেন না!’
‘আমি সবকিছুই জানি। কিন্তু আপনি চেষ্টা করলে টাকাটা জোগাড় করতে পারতেন। আপনার বাবা কিংবা দাদার কাছে টাকা চাইতে পারতেন। সে আপনার ছোটবেলার বন্ধু। খুব আশা নিয়ে আপনাকে ফোন করেছিল। অন্তত ভরসা তো দিতে পারতেন।’
‘আমি ভরসা দিলাম আর পরে পারলাম না। তখন কী হতো? একজন অপেক্ষায় বসে থাকতো। আমি সত্যি কথা বলতেই পছন্দ করি।’
‘কেউ তো বারন করেনি আপনাকে সত্যি কথা বলতে। আপনি দিন দিন কেমন খিটখিটে হয়ে যাচ্ছেন।’
‘আমি খিটখিটে হয়ে যাচ্ছি!’
‘ আপনি সত্যি কথা এবং ভালো মানুষ হতে হতে আপনি অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছেন। আপনি আগের সে-ই ধীর স্থির রাজামশাই নেই। আজকাল বড় অস্থির হয়ে পড়ছেন। আজকাল একটু ভয় বেশিই পাচ্ছেন। এত ভয় কিসের আপনার?’
‘কোথায় আমি ভয় পেলাম?’
‘আপনার চোখ দুটো ভয়ে জর্জরিত। এত ভয় পান কেন সমাজকে? স্বাভাবিক হতে পারেন না!’ সবুজ জবাব দিল না। স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে আদুরে কন্ঠে বলল,’আমি ভালো মানুষ হতে চাই। খুব ভালো মানুষ।’
‘আপনি তো ভালো মানুষ রাজামশাই।’
‘তাহলে কেন বললেন আমি খিটখিটে হয়ে যাচ্ছি। খিটখিটে মানুষগুলো ভালো নয়।’
‘সত্যি সত্যি আপনি খুব খিটখিটে হয়ে যাচ্ছেন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি খুব অস্থির এবং অশান্ত। কেন এমন করছেন? আপনি তো খারাপ কাজ করেন না তাহলে ভয় পাচ্ছেন কেন?’
‘আমার খুব ভয় করে। আমার একা থাকতে ভয় করে। সমাজকে আমি খুব ভয় পাই। কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে আমি খুব শীঘ্রই একা হয়ে যাব।’
‘ভালো মানুষদের ভয় পেতে নেই।’ সবুজের জবাব না পেয়ে তোতা আবার বলল,’ আপনি বন্ধুকে ফোন করে বলুন আপনি টাকাটা দিতে পারবেন। আপনি কথা দিলে কথা রাখেন। আমি জানি আপনি ঠিক পারবেন।’ সবুজের মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিলো না। সে কখনো কথার খেলাপ করে না। আজ বন্ধুকে কথা দিয়ে যদি কাল রাখতে না পারে! তাহলে কি হবে? দ্বিধা সংকোচনের মধ্যে পড়লো। তোতার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নিজের মনের কথা কিংবা মস্তিষ্কের কথা এখন আর শুনে না। তোতার কথায় পুরোপুরি প্রাধান্য দেয়। আজও তাই করলো।তবে তার আগেই সূর্যময় টাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। সবুজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো।

আকাশে অসংখ্য তারার সমাবেশ তার মাঝখানে আধখানা চাঁদ আকাশের সৌন্দর্য বজায় রেখেছে।ঘরের মধ্যে গুমোট ভাব থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য বাইরে এসে বসেছে সূর্যময়। আজকে তার সঙ্গী সংকেত। সে তার কথা রেখেছে। যথাসময়ে টাকা পৌঁছে দিয়েছে। তারপর বৌঠানের হাতে বানানো চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প করছে বন্ধুর সাথে। টাকা পাওয়ার পরও সূর্যময়ের মনের হতাশা দূর হয়নি। কোনো কিছুতে কষ্ট পেয়ে আছে। মনে অসংখ্য ভাবান্তর। এমন পরিবেশে বহু স্মৃতি জড়ো হলো অন্তঃকরণে। তাকে অতিরিক্ত ভাবতে দেখে সংকেত বলল,’কি এত ভাবছো?’ সূর্যময় তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। জবাব দিল,’আজ শুধু পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে। আমরা তিনজন কত আনন্দ দুঃখ কষ্টের দিন কাটিয়েছি। স্মৃতি মনে করতে শুরু করলে বছরের পর বছর পেরিয়ে যাবে কিন্তু স্মৃতি শেষ হবে না। কত উজ্জ্বল কত অন্ধকার স্মৃতি রয়েছে। কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে সবুজ আর আগের মতো নেই। পরিবর্তন হয়ে গেছে। বেমালুম পরিবর্তন হয়ে গেছে।’
‘কি যা তা বলছো! সবুজ বদলাতে যাবে কেন? সে ঠিক আছে।’
‘কিন্তু কিছু মুহূর্ত বলছে সে বদলে গেছে। আগে তার লেখাগুলো আমরা টাইপিং করে দিতাম। এখন আর লেখাগুলো আমাদের দেয় না। তোমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিতে কুন্ঠাবোধ করল না। আমাকে মুখের উপর না বলতে দ্বিধা বোধ করল না।’
‘এই সব কারণে তোমার মনে হচ্ছে সে বদলে গেছে। ভুল ভাবছো। সম্পূর্ণ ভুল। আমার অফিসে প্রতিদিন কত ফাইল জমা হয়। কত নতুন নতুন জটিল কেস আসে। সবদিক সামলাতে হিমসিম খেয়ে উঠি। আর ওই সময় যখন কেউ সাধারন একটা কেস নিয়ে হাজির হয় তখন মাথা গরম হয়ে যায়। বিরক্ত হয়ে যাই। একবার ভেবে দেখো ওই সাধারণ কেস নিয়ে আসা ব্যক্তিটির কাছে হয়তো তার জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। কিন্তু আমার কাছে নগণ্য বলে আমি দূরে ঠেলে দিচ্ছি। এত ব্যস্ততার মধ্যে ওটাকে নিতে চাইছি না। কর্মজীবনে সব সময় একাগ্রতা বজায় থাকে না। মাঝে মাঝে বিতৃষ্ণা আসে। আর ওই সময় আমরা কাউকে সহ্য করতে পারি না। বড় উত্তেজিত হয়ে পড়ি। উত্তেজনার বশে সবুজ সেদিন মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে ছুটে এসেছিল ক্ষমা চাইতে। আর তুমিও তোমার বন্ধুকে চেনো। রাস্তায় অনাহারে পড়ে থাকা শিশুদের দেখলে খেতে পারে না সে। ফুটপাতের উপরে পড়ে থাকা মানুষদের দেখলে ঘুমোতে পারে না সে। তাই নিজের রোজগারের প্রায় টাকা দান করে দেয়। সবুজ প্রচুর টাকা রোজগার করে কিন্তু নিজের জন্য কিচ্ছু রাখে না। সবটাই সাধারণ মানুষদের জন্য বিলিয়ে দেয়। সে এতগুলো টাকা কোথায় পাবে? এটা ঠিক তাঁর বাবার অনেক টাকা রয়েছে চাইলে দিতে পারতো। কিন্তু আমাদের বন্ধু কথা দিয়ে কখনো কথা খেলাপ করে না। আমায় একবার কথা দিয়ে কত না পাগলামি করেছিল। তাই সে নিশ্চিত না হয়ে তোমায় কথা দিতে পারেনি। তারপর কিন্তু বারবার তোমায় ফোন করেছে। খোঁজ নিয়েছে। আর বাকি থাকলো টাইপিং। আমরা কর্মজীবনে সবাই ব্যস্ত। প্রত্যেকের কাজ রয়েছে। আমাদের ব্যস্ত জীবনে আর কাজ বাড়িয়ে দিতে চায় না। বাড়িতে স্ত্রী রয়েছে। তাকে দিয়ে টাইপিং করে নিতে পারবে। নতুন বৌঠান বাংলায় মাস্টার ডিগ্রী করেছে। সবুজের বানান ভুল গুলো ধরিয়ে দিতে পারবে।’ সূর্যময়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে এতক্ষণে মিছামিছি বন্ধুকে ভুল বুঝে গেল। অথচ কত সুন্দর ভাবে সংকেত মনের সমস্ত সংকোচন দূর করে দিল। এই না হলে বন্ধু! সূর্যময় হাসিমুখে বলল,’আমাদের বন্ধুত্ব পোষাকি নয়।’
‘ঠিক, আমাদের বন্ধুত্ব এত সস্তা নয় যে এই সামান্য ভুল বোঝাবুঝির কারণে ভেঙে যাবে।’ দীর্ঘ সময় ধরে দুই বন্ধু গল্প করল। জীবনের চড়াই-উৎরাই কত কি নিয়ে গল্প। রাত বাড়লো। আর থাকতে চাইলো না সংকেত। বাড়ি ফিরতে হবে। স্ত্রী অপেক্ষায় আছে। লতা তাকে না খাইয়ে ছাড়লো না। যা রান্না হয়েছে তাই খেতে হবে। সংকেতের এমন খাবারের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। সে দরিদ্র পরিবারে বড়ো হয়েছে। নগ্ন দারিদ্রতা অচেনা নয়। সূর্যময়ের বাড়িতে ভাত খেয়ে বাড়ি ফিরল। তৃধা অপেক্ষায় ছিল। স্বামী ফিরলে একসঙ্গে খাবে। যখন শুনলো সংকেত বন্ধুর বাড়িতে খেয়ে এসেছে তখন হতাশ হলো। একা একা খেতে বসলো। খেতে পারলো না। সে অপেক্ষায় ছিল অথচ তার অপেক্ষাকে গুরুত্ব দিলো না সংকেত। সে খেয়ে নিল? না খেয়ে উপায় কি ছিল? বন্ধু কত করে খেতে বলল। না খেলে তাদের অসম্মানিত করা হতো। তাদের বাড়িতে দুমুঠো ভাত খেয়ে কোনো অন্যায় করেনি -তৃধা তা বোঝে। কিন্তু সংকেত তো সবকিছু জানতো। তার স্ত্রী তার জন্য অপেক্ষা করবে। একবার ফোন করে তো বলে দিতে পারতো সে বন্ধুর বাড়িতে খেয়ে নিচ্ছে লতা যেন অপেক্ষা না করে তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়। অপেক্ষা করতো না। ঠিক আচ্ছা, ওই মুহূর্তে স্ত্রীর কথা ভুলে গেছিল। বাড়ি ফিরে জেনেছে তৃধা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। পেট ভরে গেছে আর খাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্ত্রীর পাশে বসতে তো পারতো। তার খাওয়া শেষ হলে একসঙ্গে গিয়ে ঘুমোতো। সংকেত সে সব কিছু না করে শুয়ে পড়ল। তৃধা ভাত বেড়ে নিল ঠিকই তবে খেতে পারল না। ফেলে দিল।

কয়েকদিন ধরে বেশ মুষড়ে রয়েছে তোতা। তার মনখারাপ। মানুষ সবসময়ই খুশি থাকতে পারে না মাঝেমধ্যে অকারণে চোখ ভিজে যায়। মন খারাপ হয়। সবুজ ভেবেছিলো তোতার তাই হয়েছে। কারণ জানতে চায়নি। কিছুদিন থাকলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু তোতা দিনের-পর-দিন কেমন হয়ে গেল। মন খারাপের কারণ জানতে চাওয়াতে কিছু বলল না। প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেলে মানুষ যেভাবে অসুখে ভোগে সে ওইভাবে ভুগছে। তার কৌতুহল ব্যাকুলতা হাসি কৌতুক ছেলেমানুষী সব থমকে গেছে। হঠাৎ করে এমন পরিবর্তনের হেতু বুঝে উঠতে পারল না সবুজ। বারবার জানতে চাওয়ায় সে বিরক্ত হয়ে পড়ল। একটা সময় সবুজের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। সকালে সবুজ এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে গিয়ে স্ত্রীর কাছ থেকে জোর বকুনি খেয়েছে। সবুজ কিচ্ছু বলেনি ধীর-স্থির শান্ত ছিল। স্ত্রীর বকুনি শান্ত মাথায় সহ্য করেছে। তোতাকে কখনো এত উত্তেজিত হতে দেখেনি। ভীষণ মন খারাপ তার। রাতে বাড়ি ফিরে সবুজ অবাক হলো। তোতা আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছে। বিয়ের পর এমনটা কোনোদিন হয়নি। তোতা সবসময় জেগে থাকতো। তার জন্য অপেক্ষা করতো। সবুজ না হলে কখনো খাবার খেতো না। সে খুব পেটুক তবুও খালি পেটে থাকতো। তাইতো সবুজ আজকাল বেশি রাত করে না। কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল? নিশ্চয়ই তার উপর রাগ করে আছে। সকালে ঝগড়া হয়েছিল। ঝগড়া করার কথা ভেবে হেসে উঠলো। অবশ্যই ঝগড়াটা একতরফা ছিল। সবুজের সাথে ঝগড়া করা মানে একতরফাভাবে ঝগড়া করতে হবে। সে ঝগড়া করতে পারে না। ঘরে প্রবেশ করে আলো জ্বালালো। দেখলো তোতা দক্ষিণের জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ঘুমোয়নি। পোশাক বদলে স্ত্রীর মাথার কাছে গিয়ে বসলো। নাড়া দিয়ে বলল,’তোতাপাখি, আপনি খেয়ে নিয়েছেন?’ কোনো জবাব নেই। জড় বস্তুর মতো জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই কদিনে তার শরীর অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। নিজের যত্ন নেয়নি। চোখ দুটো কোটায় গলে গেছে। মুখে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট। এলোমেলো চুল। উত্তর না পেয়ে সবুজ আবার বলল,’আপনি খেয়েছেন?’ তোতা কিছু বলল না। আরও বেশ কয়েকবার নাড়ানোর পরও সাড়া দিল না। তাকিয়ে আছে অথচ কিছু বলছে না। সবুজও বড়ো অদ্ভুত ছেলে। স্ত্রী এমন ব্যবহারের মোটেও বিরক্ত হলো না। আবার নরম কন্ঠে বলল,’আপনি আমার উপর রাগ করেছেন? ঠিক আছে। রাগ করুন। কিন্তু খেয়েছেন কিনা বলুন?’ তোতার জবাব পেলে না। সে সবুজের সাথে কথা বলতে চায় না। খুব রাগ হয়েছে সবুজের উপর। সবুজ উঠে খাতা-কলম নিয়ে এলো। বলল,’আপনি আমার উপর রাগ করেছেন অসুবিধা নেই। আমার সঙ্গে এখন কথা বলতে চান না তাতেও অসুবিধা নেই। আপনি খেয়েছেন কিনা খাতায় লিখে দিন।’ তোতা এবার সবুজের দিকে তাকালো। হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। তার এই মুহূর্তে কিছু করতে ইচ্ছে করছে না। একা থাকতে ইচ্ছে করছে। সবুজের অবচেতন মনে শিশুসুলভ ব্যবহার খুশি করতে পারল না। সবুজ আবার একবার বলল। কথা গ্রাহ্য করল না। একসময় বিরক্ত হয়ে পড়লো তোতা। উঠে-পড়ে খাতা ছাড়িয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি লিখে ফেলল ‘খেতে ইচ্ছে করছে না।’
সবুজ লিখল,’কেন?’
‘এমনি এমনি ইচ্ছে করছে না।’
‘না খেলে শরীর খারাপ করবে। চলুন আমার সঙ্গে কিছু খেয়ে নেবেন।’ লেখালেখি ব্যাপারটা তোতা একদমই পছন্দ হলো না। অন্যদিন হলে হয়তো ভালো লাগতো। কিন্তু আজ তার কাছে সবকিছুতে বিরক্ত লাগছে। সবুজও না খাইয়ে ছাড়লো না। তাকে জোরজবস্তি করে নিয়ে গেল। আসনে বসালো। তোতার সবুজের ব্যবহার দেখে বড় অবাক হচ্ছে। পাশাপাশি দুজন বসলো। দুটো থালায় খাবার নিয়ে এলো। তোতা খেলো না। জড়ো বস্তুর মতো বসে রইল। সবুজ শান্তকণ্ঠে বলল,’আপনি আমার উপর রাগ করেছেন ঠিক আছে। খাবারের উপর রাগ করছেন কেন? খাবার কি করলো? খেয়ে নিন। তোতা ভাতের থালা দূরে কিছুটা ঠেলে দিয়ে গুম হয়ে বসে রইল। মুখ অন্ধকার করে রেখেছে। সহজে কিছু বলল না। এবার নিজে হাতে ঝোল মাখানো ভাত তুলে বললো,’আচ্ছা আপনাকে এঁটো হাত করতে হবে না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি আপনি খেয়ে নিন। আঁ করুন।’ তোতার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হলো না। যেমন ছিল তেমন রইল। বড় বৈরাগী দেখাচ্ছে তাকে। সবুজ খুব ধৈর্যশীল। এবার সে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,’খেয়ে নিন। খাবারের উপর রাগ করছেন কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে না করলে বলবেন না। যতদিন ইচ্ছে করবে না ততদিন বলবেন না। কিন্তু খাবার খেয়ে নিন। আপনি আমার উপর রাগ করেছেন আবার আমার জন্য খাবার বানিয়ে রেখেছেন। আপনি আমায় ভালবাসেন বলে আমার উপর রাগ করেও রান্না করে রেখেছেন। শুধু আপনি আমায় ভালবাসবেন? আমি ভালোবাসতে পারবো না আপনাকে? খেয়ে নিন।’ এবার একটু নরম হলো তোতা। আঁ করে খেয়ে নিল। সবুজের মুখে বিজয়ী হাসি ফুটে উঠল। তোতা কাতর কণ্ঠে বলল,’আপনি খুব ভালো রাজামশাই। আপনি সত্যিই খুব ভালো।’
‘জানি।’
‘কি জানেন।’
‘এই যে আমি ভালো।’
‘ওওও।’ তোতাকে বেশি খাওয়ানো গেলো না। সবুজও পেট ভর্তি করে খেতে পারল না। তোতা তা বুঝলো কিন্তু কিচ্ছু বলবো না। অন্যদিন হলে তাকে না খাইয়ে উঠতে দিতো না। সে এমন একটা কিছু হারিয়েছে যে আর কোনো কিছুকেই পরোয়া করছে না। কিছুতে কিছু যায় আসে না।
আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। দুজনের চোখে ঘুম এলো না। দুজনের মনে দু’রকমের ভাবনা জেগে উঠেছে। একজন মনে অপরজনকে হারিয়ে ফেলার ভয় আর একজনের মনে প্রিয় মানুষটার কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার তাগিদ। বড়ো অস্বস্তি সৃষ্টি হচ্ছে সবুজের মনের ভেতর। তোতা এমন ব্যবহার কেন করছে? খাওয়ার সময় তো দু-একটা কথা ছাড়া আর কোনো কথা বলনি। তার পাশে শুয়ে রয়েছে। অন্যদিন হলে কত কথা বলতো। অনবরত বকবক করে যেত। আজ ধীর স্থির গতিহীন শীতল ভাবে শুয়ে আছে। সে যেন সব কিছু হারিয়ে ফেলেছে। যা হারিয়েছে তা যেন আর কখনো ফিরে পাবে না। মুখের কোমলতা নষ্ট হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে সে তোতার মুখ দেখার চেষ্টা করল। পারলো না। কিছুক্ষণ পর তোতা তার গা ঘেঁষে তার দিকে মুখ করল। পেটের উপর হাত রেখে বলল,’রাজামশাই!’ সবুজ সাড়া দিতেই তোতা আবার বলে উঠলো,’আপনি খুব ভালো মানুষ!’
‘বারবার একই কথা বলছেন কেন?’
তোতা জবাব দিল না। ঘরের বাতাস থমথম করছে -যেন কিসের প্রতীক্ষা। তোতা হাত বাড়িয়ে স্বামীর মুখ খুঁজলো। দুটো গালে হাত বোলালো। অন্ধকারের মধ্যে কারোর মুখ কেউ দেখতে পেল না। তোতা অনুভব করলো স্বামীর গাল দুটো ভেজা। আজকে তিন বছর ধরে সংসার করছে। সবুজ অনেকবার ভেঙ্গে পড়েছে। অনেক যন্ত্রণা সহ্য করেছে। কিন্তু চোখ থেকে কখনো জল ঝরে পড়েনি। আজ তাকে প্রথম কাঁদতে দেখে অবাক হলো না তোতা। তাকে থামালোও না। সবুজকে কাঁদতে দিল। স্বামীর বুকে মাথা রাখার দুর্লভ সুযোগ পেয়েও করুন কন্ঠে কথা বলল,’আমি সবকিছু জানি রাজামশাই! আমি অনেক আগে থেকেই সব কিছু জানি।’
‘তাহলে আমায় আটকালেন না কেন? আপনি আমায় ছেড়ে চলে গেলেন না কেন?’ সবুজের ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপছে। চোখে কোণে কোনো ইঙ্গিত নেই। ভিতু ভিতু ভাব। আজ সে যেন নিজে থেকে ধরা দিতে এসেছে। তোতা স্বামীর আরও কাছে গেল। আরও গাঢ় কন্ঠে বলল,’আমি যে আপনাকে ভালোবাসি। আমি আপনাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।’

পর্ব ২৩ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here