নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৯
খেয়া পুর গ্রামে এক সন্তান সম্পত্তির লোভে মাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে সংকেতের দায়িত্ব সঠিক তদন্ত করা। বীভৎস মৃতদেহ দেখে তার হাত-পা কেঁপে ওঠে। বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি সেখানে। তারপর আর সারাটা দিন কাজে মন দেওয়া হয়নি। বেশ অনেক আগেই বাড়ি ফিরে এসেছে। রাতের খাবার খেয়েছে নিঃশব্দে। ঘুম কিছুতে না আশায় বাইরে বেরিয়ে এলো। খেয়াল করল তৃধা ঘুমায়নি। উঠে আসার সময় জানতে চাইলো, সে কোথায় যাচ্ছে? যথাযথ উত্তর দিয়ে খোলা আকাশের নিচে আসলো। বেশ রাত হয়েছে। থমথমে পরিবেশ। চতুর্দিকে নির্জনতা আর ছেঁড়া ছেঁড়া অন্ধকারে আবদ্ধ। আকাশের দিকে তাকালো। অসংখ্য তারা রাতের অন্ধকারের সৌন্দর্য বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখ দুটো জলে ভোরে গেল। চোখে জল কেন? বুঝতে পারল না। মা কে? মা কী? মা কেমন হয়? সে জানে না। এতগুলো বছর মায়ের কথা মনে পড়েনি। আজ হঠাৎ মায়ের কথা কেন মনে পড়ছে? যখন একটু বড় হয়েছিল, একটু বুঝতে শিখে ছিল, তখন সে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল -তার মা কোথায়? বাবা সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়েছিলেন। তার মা নেই। কখনো আসবেও না। তিনি তার মা তিনি-ই তার বাবা। ছোট সংকেত তখন কিছুই বোঝেনি। বড়ো হওয়ার পর মাকে দেখার ইচ্ছা জেগে ওঠে। তখনকার দিনে এত আধুনিক ক্যামেরা ছিল না। মায়ের কোনো ছবি নেই। ভোটার কার্ডে সাদাকালো ছবিতে মাকে প্রথম বারের মতো দেখেছিল। তার আগে খুব ছোটবেলায় মাকে দেখেছিল ঠিকই তবে মুখের আদল কিংবা কোনো স্মৃতি মনে নেই। আজ সন্তানের হাতে মায়ের বীভৎস মৃত্যু তার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। সংকেত নির্জনতা ভয় পায়। রাতের অন্ধকার তাকে কাঁপিয়ে তোলে। আজ ভয় করছে না। বেশ রাত হয়েছে অথচ বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিছুক্ষণ পর তার কানে গুনগুন শব্দ ভেসে আসে। কেউ যেন দূরে দাঁড়িয়ে গান গাইছে। এত রাতে এখানে কে গান গাইছে? মা! বাবা সবসময় বলে মা খুব ভালো গান গায়। কিন্তু তিনি এখানে কী করে আসবে? ভয় করলো। মনে হলো সামনের বড়ো শিরিষ গাছের মোটা ডালে বসে কেউ পা দোলাচ্ছে। ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। ঝড়ের মত কাঁপছে সে। অদ্ভুত ভাবে ওই রমনীর প্রতি মায়ায় আবদ্ধ হলো। কলের পুতুলের মত সে দিকে এগিয়ে গেল। সে যেন নিজের মধ্যে নেই। চুম্বকের মতো তাকে কেউ আকর্ষন করছে। হঠাৎ-ই তার সামনে বেশ মোটা একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পরল। সঙ্গে সঙ্গে হুশ ফিরল। দেখার চেষ্টা করল না গাছের ডালটি শুকনো না কাঁচা। ভয়ে চিৎকার করে উঠল। সদ্য চোখ দুটো বুজে এসেছিল তৃধার। স্বামীর ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনে ঘুম ছুটে যায়। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে বাইরে আসার জন্য উদ্যত হয়। তার আগেই সংকেত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। ঘোলাটে অন্ধকারে সংকেতকে বড্ড ভয়ার্ত দেখাল। কালবৈশাখী ঝড়ের সময় লম্বা সরু গাছ যেভাবে কাঁপে ওইভাবে কাঁপছে সে। কোনোরকম বাক্য ব্যয় না করে বিছানায় উঠে গিয়ে বসল। তৃধাও এগিয়ে বসলো। আলো জ্বালালো না। চাঁদের মিহি আলোয় আলোকিত হল ঘর।
‘তুমি ভয় পেয়েছো? হঠাৎ ভয় পেলে কেন? কিছুক্ষণ আগে তো ঠিক ছিলে।’ সংকেত করুন চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। এখনো শিরিষ গাছে বসে থাকা রমণীর কথা ভুলতে পারেনি। না ভুল দেখেনি সে। কলের পুতুলের মত সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল না। কে ছিল? তার মা! এত বছর পর ফিরে এসেছেন। কেন আসবেন? সে তো ভূতে ভয় পায়। ভূত হয়ে আসবেন কেন? নাকি ক্লান্ত শরীরে মনের ভুল! কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সংকেতের এমন অবস্থা দেখে তৃধা ঘাবড়ে গেল। সেও খুব বেশি সাহসী নয়। ভূতে ভয় পায়। কিন্তু এমন সময় নিজের ভয় ব্যাখ্যা করল না। অন্তরে চেপে রেখে বাহাদুরি দেখালো। বলল,’তুমি না পুলিশ অফিসার,এত ভয় পেলে হবে? তোমায় দেখে কোথায় চোর ডাকাত ভয় পাবে তা না হয়ে তুমি নিজেই ভয় পাচ্ছো।’
‘আমি চোর-ডাকাতকে ভয় পাই না। আমি অলৌকিক বিষয়কে খুব ভয় পাই।’
‘অলৌকিক বলে কিছু হয় না। একটু স্বাভাবিক হও।’ সংকেত উত্তর করলো না। তৃধা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,’এত বড় বাড়িতে আর কতদিন দুজনে থাকবো? বাবাকে বল এখানে চলে আসতে। বয়স হয়েছে আর কাজ করার দরকার নেই। একজন এ.সি.পি অফিসারের বাবা হোটেলে রান্না করেন। ব্যাপারটা কি শোভনীয়?’
‘শোভনীয় নয় কেন? হোটেলে রান্না করে বাবা আমাকে বড়ো করেছে। আর আজ আমি বড়ো হয়ে যারা হোটেলে রান্না করে তাদেরকে ছোট চোখে দেখবো? আমি এতটা নিষ্ঠুর নই।’
‘ছোট চোখে কিংবা তাচ্ছিল্য করতে বলছি না। আর তুমি যে কখনো তা করবে না আমি জানি। বাবার বয়স হয়েছে। এতদিন তোমায় দেখে এসেছেন। এবার তুমি বাবাকে দেখো। কাজ করতে বারণ করো।’
‘আমি বাবাকে অনেকবার বলেছি। না শুনলে কি করব,বল? বাবা সবসময় বলে কখনো কারোর উপর নির্ভর হতে চায় না। রক্তের তেজ যতদিন আছে ততদিন দিন পরিশ্রম করে যাবে।’
‘রক্তের তেজ চলে গেলে কি করবেন? ছোটবেলায় বাবা-মা সন্তানের দেখাশোনা করে আর বাবা-মা বৃদ্ধ হলে সন্তান মা-বাবার দেখাশোনা করে। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম।’
‘বাবা বলে তাঁর রক্তের তেজ কমে গেলে তিনি আর এই জগতে থাকবে না। মার কাছে চলে যাবে। কারোর উপর নির্ভর হতে চান না। আমার বাবা বড়ো নিঃস্বার্থ মানুষ। বাবা আরও বলে যেখানে স্বার্থ শেষ হয় সেখান থেকেই শুরু হয় মানুষ হওয়া।’ সংকেতের কণ্ঠস্বর ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসলো। তৃধা আর কিছু বলল না। স্বামীর চোখে পানে তাকিয়ে রইল। শুয়ে পড়তে বললো। ঘুম সহজে এল না। ঘুমহীন চোখে ওই রমনীর কথা আবার মনে পড়লো। যত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করলো ততোই চোখের সামনে ভেসে উঠলো। চোখ দুটো কেঁপে উঠল। ভয়ার্ত কন্ঠে ডাক দিল,’তৃধা।’
‘বল!’
‘আমার খুব ভয় করছে।’
‘ভয় পাবে না। আমি আছি তো। কিছু হবে না। কাছে আসো।’ সংকেত তৃধার দিকে মুখ করলো। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মুখশ্রী মায়ায় ভরা। তাকে খুব কাছে পেতে চাইছে। ভাঁজ করা কবুতরী বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিলো। সংকেতেকে নিজের বুকের মধ্যে আগলে নিয়ে মাথায় আলতো করে হাত বোলালো। তার শরীর ভয়ে শীতল হয়ে গেছে। ভরসাযোগ্য বুক পেয়ে তার কাঁপুনি বন্ধ হল। তৃধা মিষ্টি কন্ঠে বলল,’ভয় পাবে না। আমি আছি। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও।’ সংকেত উত্তর করলো না। তৃধা কিছু একটা আশা করছিল। সেই আশায় জল ঢালল সংকেত। সেও ভয় পেয়েছে। তা ধরতে পারল না সংকেত। বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রেখেছে। ফিসফিস করে যদি একবার বলতো তোমায় ভালোবাসি তৃধা। খুব ভালোবাসি। তেমন কিছুই হলো না। সংকেতের গতানুগতিক একঘেঁয়েমি ব্যবহার কিংবা ভয়ের কারণে কোনো বাক্য ব্যয় করল না। ভয়ে কাতর হয়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ঘুমিয়ে পরল। তৃধার চোখ দুটো জলে ভিজে গেল। খুব অভিমান হল। বুঝলো রাতে আর ঘুম আসবে না। স্বামী একদিন তাকে বুঝবে।সে-ই অপেক্ষায় রইল। কিন্তু সে জানে না,কিছুটা অপেক্ষা নিয়ে হয়তো বেলা ফুরিয়ে যাবে।
আবারও লেখালেখির জগতে ফিরে এসেছে সবুজ। বিয়ের পর এটা নয় ওটা,আজ নয় কাল, দূরে নয় কাছে,-এমন অনেকগুলো দিন পার করেছে। হাসিখুশিতে দিব্যি সংসার করছে তারা। পার্বতীর পুত্র সন্তান হয়েছে। তবে সে এখনো এখানে আসেনি। বাপের বাড়িতে রয়েছে। মেয়েটি খুব অভিমান করেছে। অন্তিমের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বাবা অসুস্থ। তাই মা খুব কমই বাড়িতে আসে। দাদা তো একদমই আসে না। নতুন বাড়ি প্রায় সময় বন্ধ থাকে। সবুজের মতো তোতারও নতুন বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না। পুরনো বাড়িতে স্বামীর সঙ্গে থাকে। সবুজ বাইরে যাওয়া আসা খুব বেশি করে না। প্রায় সময় বাড়িতে থাকে। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের বাড়িতে যায় আবার কখনো বন্ধুদের নিজেদের বাড়িতে ডেকে আনে। তোতাকে বন্দী করে রাখেনি। সে যেখানে যায় সেখানেই নিয়ে যায়। বন্ধুদের বাড়িতে গেলেও সঙ্গে নিয়ে যায়। তোতা বারণ করে না। ঘুরতে পছন্দ করে। তবে সবুজের কর্মক্ষেত্রে যেতে চায় না। সবুজ প্রকাশনীর কোনো কাজে কিংবা বইতে অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য প্রকাশনীতে গেলে তোতাকে নিয়ে যেতে চায়। কোনো নতুন লেখককের বই উদ্বোধন হলে সবুজের অনেক সময় ডাক পড়ে। আবার কোনো সাহিত্য সভা কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান সভায় সবুজের সাথে সাথে স্ত্রী হিসেবে তোতার আমন্ত্রণও থাকে। কিন্তু তোতা সেখানে যেতে চায় না। কেন যেতে চায় না, তার কারণ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করেনি। এক কথায় বলতে গেলে তোতা স্বামীর ব্যক্তিগত জীবনে পুরোপুরি আবদ্ধ হলেও স্বামী যে একজন শিল্পী এক বড়ো জনপ্রিয় এবং প্রতিভাবান মানুষ সেটার আড়ালে থাকতে চায়। সে চায় না সবাই জানুক তোতা সবুজের স্ত্রী। সে নিজে জানলেই হলো। আর কাউকে জানাতে চায় না। সবুজ বাংলা পাঠকের কাছে অমূল্য রত্ন। আর সবুজের অর্ধাঙ্গিনী তোতা। সে চায় না সবুজের মাধ্যমে নিজের খ্যাতি পরিচয় সবার সামনে তুলে ধরতে। সে সাধারণ হয়ে থাকতে চায়। কত ইন্টারভিউতে সবুজকে তার স্ত্রীর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে। তার স্ত্রী তোতা সেনগুপ্ত। খুব ভালো মেয়ে। তারা সুখে শান্তিতে সংসার করছে। এর বাইরে আর কিছু জানায়নি সবুজ। তোতাকে দেখার ইচ্ছা অনেকেরই রয়েছে। কিন্তু সে-ই আশা কারোর পূরণ হয়নি। তোতা সবার সামনে আসতে চায় না। সবুজ একবার জানতে চাইছিল,সে কেন এমনটা করে? কেন তাঁর কর্মজীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে? তোতা হাসি মুখে বলেছিল, সে তার সম্মান খ্যাতি পরিচয়কে সম্মান এবং শ্রদ্ধা করে কিন্তু ভালোবাসে সবুজকে। সে শুধু সবুজকে চায় আর কিছু চায় না। সবুজ হলেই হলো। সে সবুজের অর্ধাঙ্গিনী। সবুজ সবসময় তাকে দেখবে। দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ … কোনো মানুষের দেখার প্রয়োজন নেই। তবে তার যদি কোনোদিন মন চায় তবে অবশ্যই স্বামীর সঙ্গে যাবে। তোতার এখানে থাকতে বেশ ভালো লাগছে। এ বাড়িতে আসার আগে ভেবেছিল সবুজ হয়তো কাজে সবসময় ব্যস্ত থাকবে। বেশিরভাগ সময় একা কাটাতে হবে। একাকীত্ব বোধ করবে। ভালো লাগবে না। কিন্তু এখানে এসে উল্টোটা হচ্ছে। সবুজ সবসময় তার কাছে থাকে। দূরে যেতেই চায় না।
খুব শীঘ্রই সবুজের নতুন একটা উপন্যাস প্রকাশ পাবে। বইয়ের ব্যস্ততায় ঘেমে রয়েছে সে। সকালে বাসি মুখেই লিখতে বসেছে উপরের ঘরটায়।। বেলা বাড়িতেই তোতা গিয়ে খাবারের কথা বলে। বারন করে দেয়। তার খিদে নেই। একদম দুপুরে ভাত খাবে। তোতা ফিক করে হেসে পালিয়ে আসে। এই কয়েকটা মাসে স্বামীর পাগলামো গুলোর সম্পর্কে অবগত হয়েছে। তাই বিরক্ত করেনি। নিঃশব্দে নীচে এসে স্নান সেরে পুজো সম্পন্ন করে। তারপর রান্নার তোড়জোড় শুরু করে। সে জানে দুপুর হওয়ার অনেক আগে সবুজ লেখা ছেড়ে উঠে পড়বে। খেতে চাইবে। রান্না সেরে ফেলা উত্তম কাজ হবে। যেমন ভেবেছিল ঠিক এমনটা হল। কিছুক্ষণ পর সবুজ হাঁক ছেড়ে বলল, তার খিদে পাচ্ছে। আজ যেন একটু তাড়াতাড়ি রান্না সেরে ফেলে। তোতা যথাযথ উত্তর দিয়ে রান্না বসিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর কিছু একটা নিতে নিজের ঘরের মধ্যে যায়। টিভি চালু করে। দারুন একটা টেলিকাস্ট হচ্ছে। সেদিকে মনোযোগী হয়ে পড়ে। ভুলে যায় রান্নার কথা। বেশ অনেকক্ষণ পর যখন হুশ ফিরল তখন পোড়া গন্ধ তার নাকে ভেসে আসছে। আঁতকে ওঠে। টিভি বন্ধ করে রান্না ঘরে এসে মুহূর্তের ঘটনায় হতভম্ব হয়ে পড়ে। ভাত তরকারি তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে কড়াই আর হাঁড়ির অবস্থাও খুব খারাপ। তাড়াতাড়ি গ্যাস বন্ধ করে দিল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। সবুজকে এখন কি বলবে? কি খেতে দেবে? সে এখন-ই নিচে নেমে এসে খেতে চাইবে। সকাল থেকে কিছু খায়নি। রাগ করবে। বকুনি দেবে। ভয় করল। ভয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। থর থর করে কেঁপে উঠলো। কি করবে বুঝতে পারল না। সবুজের নাকেও পোড়া গন্ধ ভেসে গেছে। লেখায় আর মনোযোগ দিতে পারল না। তরতর করে সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে রইল। পায়ের শব্দ শুনে আর স্থির থাকতে পারলো না তোতা। দৌড়ে ঘরে মধ্যে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। দরজা বন্ধ দেখে অবাক হলো সবুজ। ধাক্কা দিল। স্ত্রীকে ডাকলো,’তোতোপাখি,ও তোতাপাখি, দরজা বন্ধ করে রেখেছেন কেন?’ কোনো উত্তর করলা না।
‘কি হয়েছে আপনার? আমার চিন্তা হচ্ছে। পোড়া গন্ধ কোথা থেকে আসছে?’ তথাপি জবাব দিল না। সবুজ আবার বলল,’আপনি ঠিক আছেন তো তোতাপাখি? দরজা খুলুন। বন্ধ করে রেখেছেন কেন?’ সবুজকে দুশ্চিন্তা করতে দেখে ঘাবড়ে গেল তোতা। কি করবে বুঝে উঠতে পারল না।
‘দরজা খুলুন। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে?’ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে তোতা এবার জবাব দিল,’আপনি আমায় মারবেন না তো?’ সবুজের কানে বাক্যটি বড় বিদঘুঁটে শোনালো। আজ পর্যন্ত সে কারোর সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেনি। কারোর উপর রাগ করেনি।আর সে কারোর গায়ে হাত তুলবে! এ যে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। মুহুর্তের মধ্যে তার চোখ-মুখ ঘৃণায় ভরে গেল। নিশ্চয়ই তোতার প্রতি কোনো অন্যায় করেছে। যার জন্য তার প্রতি এমন খারাপ ভাবনা জেগেছে মনে। খুব খারাপ লাগলো নিজেকে। মন বিষাদে ভরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,’মারবো কেন? আপনাকে আমি মারবো না। দরজা খুলুন।’
‘মিথ্যা বলছেন না তো? সত্যি করে বলুন।’
‘আমি মারবো না। তিন সত্যি।’
কিছুক্ষণ পর তোতা দরজা খুলে দিল। খুব ঘেমে রয়েছে। তাল পাতার মতো থর থর করে কাঁপছে। ঘরে ঢুকে স্ত্রীকে কাছে নিয়ে বসলো। একটা হালকা কালারের শাড়ি, ফুলহাতা লাল ব্লাউজ পরে আছে। হাতের বাহুতে যেখানে ব্লাউজ শেষ হয়েছে সেখানে শক্ত করে ধরল। তোতা কেঁপে উঠল। সবুজ বলল,’কি হয়েছে? এত ভয় পেয়ে আছেন কেন?’
‘আপনার খুব খিদে পেয়েছে না?’
‘খুব মানে খুব।’
‘আপনি আমায় মারবেন না তো?’
‘আপনাকে মারতে যাব কেন? কেন একই কথা বারবার বলছেন?’
‘একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম আর ওই সময়ের মধ্যে সমস্ত রান্না পুড়ে গেছে।’
‘ঠিক আছে। তাতে এত ভয় পাওয়ার কি আছে? মুড়ি খেয়ে নেবো। এত অস্থির দেখাচ্ছে কেন আপনাকে?’ সবুজ যে বিষয়টি এত সহজ ভাবে নেবে তা কখনো কল্পনাও করেনি তোতা। বোকার মতো তাকিয়ে রইল। একটু শান্ত হয়ে বলল,’আপনার রাগ হচ্ছে না?’
‘না, আপনি কি জেনেশুনে করেছেন? করেননি। ভুলবশত হয়ে গেছে। এখন আর কি করা যায়! ভয় পেলে কি রান্না আবার হয়ে যাবে?’
তোতা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। সবুজ শান্ত কন্ঠে বলল,’সামান্য কারণে আমি আপনাকে মারবো! কেমন করে ভাবলেন?’
‘আসলে, আমার বাপের বাড়ির পাশের বাড়িতে যে দাদা বৌদি থাকে; ওদের বাড়ির বৌদি কিছু ভুল করলে দাদা তো সবসময় মারে। তাই ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমি মার খেতে খুব ভয় পাই। একবার স্যার আমাকে মেরেছিলেন। এমন কেঁদেছিলাম বাবা পরের দিন স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়েছিল। আমাকে কেউ কখনো মারেনি। খুব ভয় হয় তো।’ সবুজকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো তোতা। হু হু করে কেঁদে গেল। কিছুতেই সান্ত্বনা দেওয়া গেল না। এই কান্নার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সবুজের প্রতি মুহূর্তের অবজ্ঞার ফলে নিজের মনের বিষাদের ঝড়। লুকিয়ে আছে মুহূর্তের ভয়। তার মুখের বিগলিত অবস্থা দেখে খারাপ লাগল সবুজের। তোতাকে বুকে আগলে নিল। ভরসাযোগ্য বুক পেয়ে একটু স্বাভাবিক হলো। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। বড় উত্তেজিত হয়ে আছে। সবুজ আদুরে কন্ঠে বলল,’কাঁদছেন কেন তোতাপাখি?’
‘এমনি এমনি, খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।’
‘আচ্ছা তোতাপাখি, আপনি কি করে ভাবতে পারলেন আমি আপনাকে মারবো?’
‘আর এমনটা কখনো হবে না। আমিও রেগে গেলে মাকে খুব খারাপ ভাবে বোকে দিই। ভাবছিলাম আপনিও বকুনি দেবেন বা মারবেন।’
সবুজ মুখ অন্ধকার করে স্ত্রীকে আগলে রেখেছে। তার মুখের মূর্ছা ভাব তোতাকে ভাবিয়ে তুললো। সবুজ কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট দূর করতে হবে।
‘রাজামশাই, আপনি কষ্ট পেয়েছেন?’
‘না।’
‘কেন কষ্ট পাবেন না? আপনাকে আমি এত বড় কথা শোনালাম আর আপনার কষ্ট হলো না!’
‘না, হলো না।’
‘আপনি আমায় ভালবাসেন?’
‘খুব।’
‘শুধু আমাকে ভালোবাসেন তো?’
‘খুব হিংসুটে মেয়ে আপনি।’
‘এই হিংসুটে মেয়েকে ভয়ঙ্করভাবে ভালোবাসুন না। ঠকবেন না কখনো। আপনার জীবন রঙিন করে তুলবো।’
‘ভালোবাসা ভিক্ষার জিনিস নয় তোতাপাখি।’
‘আমি না হয় ভিক্ষা চাইলাম। ভিক্ষা দেবেন আমায়?’
‘আমি সত্যি সত্যি আপনাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি তোতাপাখি।’
‘আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। কিন্তু আমি চাই আপনি শুধু আমায় ভালোবাসুন। শুধু আমায়। আপনি ঠিকই বলেছেন রাজামশাই, আমি হিংসুটে মেয়ে। খুব হিংসুটে।’ সবুজ উত্তর করলো না। সে ধীরে ধীরে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালোবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু তোতাকে কি করে বোঝাবে সে তাকে খুব ভালোবাসে। মুখে বললে কি ভালোবাসা হয়ে যায়? ভালোবাসার কোনো দলিল হয় না। ভালোবাসা তো অনুভব করতে হয়। তোতা অনুভব করতে চাইছে না। এক অদ্ভুত টানাপোড়েনের মধ্যে পরলো সবুজ। নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসতে শুরু করেছে কিন্তু কোথাও মনের মধ্যে আজও সাথী রয়েছে। মাঝেমধ্যে গভীর রাতে তার কথা মনে পড়ে। চোখ থেকে জল ঝরে পড়ে। স্ত্রীর কাছে বড় একটা মিথ্যা লুকিয়ে রেখেছে। এ যে ঘোর অন্যায়। তোতা এই অন্যায় যেন ধরে ফেলেছে। তাই তার চোখে-মুখে অভিমান। তার রাজামশাইকে হারানোর ভয় রয়েছে। তাইতো বারবার বলছে শুধু তাকে ভালোবাসতে। সবুজ কি পারবে শুধু তাকে ভালোবাসতে? সে অনেকবার সাথীকে বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ব্যর্থ হয়েছে। ওই কিশোরীকে এখনো ভুলে যায়নি। সে নিজের অতীত মনে করে স্ত্রীকে কষ্ট দিতে চায় না। সব ভুলে স্ত্রীকে ভালোবাসতে চায়। কিন্তু মন সায় দেয় না। চঞ্চল মন দৌড়ে বেড়ায়। বিদ্যুৎ খুঁজে বেড়ায়। আর সে-ই বিদ্যুৎ কেবল সাথী চোখে খুঁজে পায়। কী অদ্ভুত অনুভূতি! কতগুলো বছর কেটে গেছে কোনো যোগাযোগ নেই কথা নেই তবুও অনুভূতি শূন্য হয়নি।
‘কী এত ভাবছেন রাজামশাই?’
‘কিছু না। মনে হচ্ছে আপনি একটু বেশি ভাবছেন।এত ভাববেন না। বেশি ভাবলে সুখে থাকতে পারবেন না।’
‘আচ্ছা তোতাপাখি, আপনি তো পড়াশোনা করেছেন। চাকরি করবেন?’
‘দূরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন?’
‘আপনি আমার স্ত্রী। দূরে কেন সরিয়ে দেবো? এখন মেয়েরা পিছিয়ে নেই। আপনি আপনার অধিকার চাইবেন। প্রতিষ্ঠিত হবেন।’
‘মেয়েদের অধিকার বলতে কি শুধু প্রতিষ্ঠিত হওয়া বোঝায়? স্বামীর কাছে থাকতে চাওয়া কি মেয়েদের অধিকার নয়?’
‘স্ত্রী স্বামীর কাছে থাকতে চাইবে এটা যেমন স্ত্রীর অধিকার তেমনি স্বামীও স্ত্রীর কাছে থাকতে চাইবে এটাও স্বামীর অধিকার।’
‘বেশ তাই হোক। আমি আপনার কাছে থাকতে চাই।’
‘আমি তো বারন করিনি।’
তোতা জবাব দিল না। হাসিমুখে সবুজের চোখের দিকে তাকাল। সবুজের চোখ দুটো ছলছল করছে। কিসের একটা বেদনা চোখের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে। কিছুটা ভয়ও রয়েছে। কিছুটা ভয়ার্ত কন্ঠে সবুজ বলল,’আপনি আমার কাছ থেকে কি চান, তোতাপাখি?’
‘আমি বেশি কিছু চাই না। আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু করবেন না। খারাপ করুন ভালো করুন মঙ্গলের জন্য করুন কিংবা অমঙ্গলের জন্য করুন আমাকে সবার প্রথম বলবেন। আপনি যেখানে যাবেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন।’
‘আপনি নিজে তো অনেক জায়গায় যেতে চান না।’
‘তবুও আমায় ডাকবেন। আপনার পাশে আমি সব সময় থাকতে চাই। আমায় দূরে সরিয়ে দেবেন না। আপনি যখন ঘন্টার পর ঘন্টা একা বসে ভাবেন। ওই সময়টাও আমি আপনার কাছে থাকতে চাই। আপনি যখন গল্প লেখেন তখন আপনার কাছে কেউ থাকুক আপনি চান না। কিন্তু আমি থাকতে চাই। আপনি যখন একা বসে কিছু ভাবেন কিংবা লেখেন তখন তো অনেক সময় আপনার পাশে পাখি থাকে। গাছপালা,নীল কিংবা কালো আকাশ, নক্ষত্র, চাঁদ, সূর্য থাকে। তারা কি আপনাকে বিরক্ত করে? আমিও না হয় পাখি হয়ে আপনার পাশে বসে থাকবো। বিরক্ত করব না। শুধু আপনাকে দেখবো।’
‘আমি বাথরুমে গেলেও কি আপনি আমার সঙ্গে যাবেন?’
‘ফাজিল ছেলে।’ তোতা খিলখিল করে হেসে উঠলো।
একটু পর সবুজ বলল,’আপনি কি আমায় সন্দেহ করেন?’
‘কখনো করব না। আপনার প্রতি আমার চরম বিশ্বাস রয়েছে। আমি শুধু আপনার সঙ্গে থাকতে চাই। আপনার পাশে অনেকক্ষণ অনেকক্ষণ অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেও আমার ভালো লাগে।’ সবুজ হাসি মুখে জবাব দিল,’ঠিক আছে। আপনি যা চান তাই হবে।’ একটু থেমে আবার বলল,’আপনাকে প্রথমদিন দেখে মনে হয়েছিল আপনি শক্ত মানুষ। আত্মসম্মানবোধ প্রখর। সহজে মাথা নোয়াবেন না। এখন ভিন্ন লাগছে। আপনি বড় অদ্ভুত! কখনো কিশোরীর মতো আগ্নেয়গিরির ধারা তো কখনো বালিকার মতো নদীর চাঞ্চল্য আবার কখনো শক্ত পাথরের মতো বিংশ শতাব্দীর প্রতিবাদী নারী। জানেন না, জোর করে কিছু চাইতে নেই।’
‘আমিতো আমার স্বামীকে জোর করছি। আপনার কাছে আমি শুধু আপনার আদুরে তোতাপাখি। আমি আপনার কাছে শ্রীমতি তোতা সেনগুপ্ত নই।’ সবুজ আলতো করে তোতার কপালে চুম্বন করল। তোতা হেসে ফেললো। অনেকক্ষণ ঠোঁটদুটো কপালে বসিয়ে রাখলো। বলল, ‘আপনি আমায় এত ভালোবাসে কেন?’
‘জানি না। সত্যিই জানি না রাজামশাই।’
‘আমার বড়ো ভয় করছে। আপনি আমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে দিচ্ছেন। আমি পারবো তো আপনাকে এমন ভাবে ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে?’
‘পারবেন, অবশ্যই পারবেন।’
‘দেখবেন রাজামশাই, আপনি একদিন কলম ছাড়তে রাজি হয়ে যাবেন আমার জন্য।’ বড়ো বেসুরো ভাবে কথাটি সবুজের কানে শোনালো। তোতা যেন একটু বেশি বাড়াবাড়ি করল। তার জীবনে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ সংকেত আর সূর্যময়। আর লেখার জন্য অনেক সময় বন্ধুদের ফিরিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। দূরে সরে আসে। যদিও তোতা তার জীবনে সংকেত কিংবা সূর্যময় থেকে কোনো অংশে কম নয়। তবুও লেখা সত্তাকে কিছুতে হারাতে দেব না। এর জন্য কোনো সেক্রিফাইস চলবে না। মৃদু কণ্ঠে সবুজ বলল,’আপনি কি চান আমি লেখালেখি ছেড়ে দিই?’
‘এমনটা কেমন চাইবো? আপনি লেখালেখি করেন বলে আমি আপনাকে ভালোবাসতে পেরেছি। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। আপনার খুব কাছে আসতে পেরেছি। আপনার ভালোলাগাতে কখনো আঘাত করব না। আমি কি বলতে চাইছি আপনি বুঝতে পারছেন না।’
‘বুঝিয়ে বলুন?’
‘কিছু কথা বুঝিয়ে বললেও বুঝবেন না। আপনি যখন আমায় ভয়ংকরভাবে ভালোবাসবেন। শুধু আমায় ভালোবাসবেন। তখন বুঝতে পারবেন।’
এই প্রথমবার সবুজ লিখছে আর তার পাশে কেউ বসে আছে। তোতা একদমই সবুজের মনোযোগ নষ্ট করল না। ধীর-স্থিরভাবে বসে রইলো। লেখা শেষ হতেই সবুজ বলল,’আপনার ধৈর্য শক্তি কে প্রণাম। এতক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে আছেন! সারাদিন তো পাখির মতো ছটফট করেন। এই সময়ে ছটপট করতে ইচ্ছে করছিল না?’
‘আমি এই শীতল পুরুষ মানুষটাকে দেখলে শান্ত হয়ে যাই। আমার আর ছটফট করতে ইচ্ছে করে না। আপনার দিকে তাকিয়ে আমি অনেকগুলো বছর পার করতে রাজি।’
‘আমি শীতল?’
‘হ্যাঁ, আর আমি এই শীতল বিব্রত লাজুক সুন্দর দয়ালু পুরুষ মানুষটাকে ভালোবাসি। এই মানুষটা শুধু আমার। আমার রাজামশাই।’
‘লজ্জা করছে না আপনার?’
‘না।’
‘কিন্তু আমার লজ্জা করছে।’
হেসে ফেললো তোতা। সবুজ তোতার চোখের দিকে তাকাতে পারলো না। কত মায়ায় ভরপুর! মেয়ে মানুষ যে লজ্জাহীনভাবে পুরুষের কাছে বারবার ভালোবাসি ভালোবাসি বলতে পারে তা ধারণার মধ্যে ছিল না সবুজের। সবুজ মৃন্ময়ী মুখশ্রীর দিকে তাকালো। চোখ কিছুতে ফেরালো না। সুঠাম মুখশ্রী। চোখ দুটো মিটিমিটি করছে। কপালে লাল টিপ। কানের গোড়া কাছে ঘামের জন্য চুল গুলো ভিজে গেছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। লাবণ্যময়ী নারী।পুরুষ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে নারী লজ্জা পাবে না, তা কি হয়? এবার তোতা লজ্জা পেল।
‘এ ভাবে তাকাবেন রাজামশাই। আমি কেঁদে ফেলবো।’
‘কাঁদবেন কেন?’
‘ভয়ে।’
‘কিসের ভয়?’
‘জানি না।’
‘আপনি যে কখন কি বলেন আমার এই ছোটো মাথাটায় কিছু ঢুকে না।’ তোতা বালিকার মত হেসে উঠলো। এমন ভাবে হাসলো যেন সবুজ কিছু একটা হাসির কথা বলেছে। হাসতে হাসতে বলল,’এখন তো আধুনিক যুগ। আপনি তাও খাতা কলমে কেন লেখেন? ল্যাপটপে লিখতে পারেন না?’
‘খাতা কলমে লিখে আমি সুখ পাই।’
‘তারপর আবার টাইপিং করেন?’
‘না, আমার লেখা হয়ে গেলে আমি সূর্যময় আর সংকেতকে পাঠিয়ে দি। তারা টাইপিং করে দেয়। পরে আমি আবার একবার দেখেনি বানানগুলো।’
‘আপনার বন্ধু গুলো খুব সুন্দর। আপনার জন্য কত কি করে।’
‘অনেক সুন্দর আর ভালো।’
‘তাদেরকে আর টাইপিং করতে হবে না। এবার থেকে আমি টাইপিং করে দেবো।’
‘আমার বন্ধুদের থেকে আমাকে আলাদা করতে চাইছেন?’
‘রাজামশাই, আপনি সবসময় খারাপটা ভাবছেন, কেন বলুন তো? তারা সবাই বিয়ে করেছে। কর্মজীবনে ব্যস্ত। আমি সারাদিন বাড়িতে থাকি। কোনো কাজ নেই। আমি কি করতে পারি না? আচ্ছা এসব বাদ দিন। ধরে নিলাম আমি আপনার বন্ধুদের থেকে আপনাকে আলাদা করতে চাইছি। তাহলে কি আলাদা হয়ে যাবেন? যদি আলাদা হয়ে যান তাহলে আপনাদের বন্ধুত্ব তো খুব সস্তা। আশা করি আপনাদের বন্ধুত্ব সস্তা নয়।’
সূর্যময়ের পুত্র সন্তান হয়েছে। শহরের এক হাসপাতালে লতা এখন চিকিৎসাধীন। সূর্যময় বাড়ি ফেরে না। বাবা হওয়ার আহ্লাদ মাটি ছেড়ে যেন উড়তে শিখিয়েছে। সবকিছু ভুলে গেছে। বাবা হওয়ার তৃপ্তি যে এত মিষ্টি কখনো কল্পনা করেনি। বারবার লতার কাছে চলে যায়। চুপচাপ বসে পুত্র সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে তার সাথে। কিন্তু সে তো কিছুই বলতে পারে না। শুধু কাঁদে। তাতেও আপত্তি নেই সূর্যময়ের। তবুও সব সময় সন্তানকে দেখতে চায়। কি যে অপূর্ব সুখ কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না সে। লতা সন্তানের পিতার এমন ছেলেমানুষি দেখে শুধু হাসে। লতার পরিবারের সাথে এখনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পুত্র হওয়ার সংবাদ সবাইকে জানিয়েছে। সূর্যময় লতার বাপের বাড়িতে সুখবর জানাতে উদ্যত হয়। লতা বাধা দেয়। যারা আদুরে মেয়েকে ভুলে গেছে। একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি। তাদের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে চায় না। সূর্যময় লতাকে বুঝিয়েছে। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এভাবে ঝামেলা ঝুলিয়ে রাখা সঠিক নয়। দুটো পরিবার এক হলে সবাই খুশি হবে। কাউকে একটা মাথা নোয়াতে হবে। তার বাবা-মা মাথা নোয়াতে চাইছে না কিন্তু লতা তো মাথা নোয়াতে পারে। লতা রাজি হলো না। নিজের জেদ বজায় রাখল। কিছুতেই ফিরতে চাইলো না। সূর্যময় খুশি হতে পারল না। সে জানে লতা পরিবারের কথা ভেবে খুব কষ্ট পায়। এই সময়ে সে নিজের বাবা-মাকে কাছে পেতে চাইছে। শুধু উপরের শক্ত আবরণ দিয়ে নিজের দুঃখ গুলোকে আড়াল করছে। বেশি দেরি করলো না। নিজে থেকে শ্বশুর বাড়িতে যায়। তাদের সুখবর জানায়। কেউ সামান্য আগ্রহ পর্যন্ত প্রকাশ করেনি। লতা তাদের মেয়ে সেটা তারা ভুলে গেছে। তার সাথে কেউ ঠিকমতো কথা বলেনি। বড় অপমানিত বোধ করে সূর্যময়। লজ্জায় অপমানে মাথা নীচু করে চলে আসে। তবুও শ্বশুরবাড়ির কারোর উপর রাগ দেখাতে পারেনি। লতার কাছে ঘটনাটি লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু সম্ভব হয়নি। সবকিছু বুঝতে পেরে যায়। দুদিন স্বামীর উপর রাগ করেছিল। শরীর ঠিক হয়েছে। এই সময়ে যখন বাবা-মা সবকিছু জানার পরও একবারের জন্য দেখতে এলো না। সাহস জোগানোর মতো কাউকে পেলে না। কিছুটা ভয় করলো। তখন তার সঙ্গী রইল শুধুমাত্র নিজের স্বামী আর শ্বশুর-শাশুড়ি। এর চেয়েও লতাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে সংকেত আর সবুজ। এত কাজের ফাঁকেও তারা দিনে দুবার দেখা করে যায়। বাড়ি থেকে তাদের জন্য রান্না করে নিয়ে আসে। ভাবতে অবাক লাগে লতার। বন্ধুত্ব এমন হয়! তৃধা এসেছে, তোতা এসেছে, জ্যোতির্ময় বাবুও এসেছেন। সবাই সন্তানের আর সন্তানের মাকে দেখেছে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছে তাদের দীর্ঘ আয়ু জন্য। লতার আনন্দে তৃপ্তি সৌন্দর্যে চোখ থেকে জল ঝরে পড়ে। যারা জন্ম দিয়েছিল, যারা সঠিক ভুল শিখিয়েছিল তারা আজ পর হয়ে গেছে। অথচ যাদের সঙ্গে কোনো পরিচয় ছিল না তারা আজ কত আপন। কত ভাবে তাদের নিয়ে।
সাত দিনের পর লতা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেল। বাড়ি ফিরে এলো। গ্রামে কত কুসংস্কার। কোনো কিছুর তোয়াক্কা করলো না সূর্যময়। সে স্ত্রী আর ছেলের কাছে সারাদিন রইল। স্ত্রীর সেবা সুস্থতায় কোনো খামতি রাখলো না। লতা অনুভব করল, সে ভুল মানুষের হাত ধরেনি। তার চারিদিকে সঠিক মানুষে ভরপুর। সবাই কত আপন। কত সুন্দর। এত সুখ পেয়ে বাবা-মার অনুপস্থিতি বেশি নাড়া দিল না। নিজে থেকে খুশি হওয়ার চেষ্টা করল। যা পেয়েছে তা অনেক। আর কি চাই? লতা একটু সুস্থ হতে ফোন নিয়ে কাউকে বারবার ফোন করলো। বিপরীত মানুষটা ফোন ধরল না। সূর্যময় কিছুটা অবাক হল। লতাকে কেমন বিচলিত লাগছে। কাকে এত ফোন করছে? কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করার আগে ফোন বেজে উঠল। লতা ফোন ধরে বেশ হাসি খুশিতে কন্নড় ভাষায় কথা বলল। সূর্যময় অবাক হলো না এবং সবকিছু বুঝে গেল। প্রশ্ন করার প্রয়োজন হলো না। লতা বাঙালি মেয়ে নয় সে আগে থেকে জানতো। লতার আদিবাড়ি দক্ষিণ ভারতে কর্নাটকে। বাবা ব্যবসা সূত্রে বাংলায় এসে থাকতে শুরু করে। তারপর বাবা-মা সন্তান-সন্ততি এবং স্ত্রীকে নিয়ে আর কর্নাটকে ফেরেনি। এখানে থেকে যান। এখানকার নাগরিকত্ব অর্জন করে। লতা প্রাথমিক শিক্ষা কর্নাটকে সম্পন্ন করে। কন্নড় ভাষা তার হাতের মুঠোয়। অনবরত ওই ভাষায় কথা বলতে পারে। যখন কোনো যুক্তিতে হেরে যায় কিংবা স্বামীর সাথে ঝগড়ায় পেরে ওঠে না তখন সে কন্নড় ভাষায় কথা বলে। সূর্যময় কিছু বুঝতে পারে না। ঝগড়া আর এগোয় না। স্ত্রীর এমন চালাকি বুদ্ধি দেখে সূর্যময় হেসে ফেলে। মান অভিমান সবকিছু ভুলে যায়। আর ওখানে লতার এক বান্ধবী রয়েছে। তার সাথে মাঝে মধ্যে কথা হয়। তাকেই সুখবর জানালো। তাদের বাড়িতে আসতে বলল। সে রাজী হল আসার জন্য। আরও কয়েকটা দিন কেটে গেল। পুত্রের নাম কি দেওয়া হবে, ওই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হল। শেষমেষ সূর্যময়ের দেওয়া নাম-ই চূড়ান্ত হলো। লতা আর সূর্যময়ের ছেলের নাম হলো ময়ূর। ধীরে ধীরে ময়ূর বড়ো হতে শুরু করল। বাবার বড়ো আদুরে হয়ে উঠল।
পর্ব ২০ আসছে।।