নিরুদ্দেশ পর্ব ১৮

নিরুদ্দেশ
পর্ব ১৮

বড্ড খিদে পেয়েছে তোতার। কাল রাতে কিছু খায়নি। খিদের চোটে ছটপট করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না। মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি পেটের খিদের কথা। ভেবেছিলো, রাতে নিশ্চয়ই তাকে কেউ খেতে ডাকবে। নতুন বউ সব জায়গায় এখন যাওয়া আসা হয় না। তারাই তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। তাদের ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে সে বাড়িতে অনেকদিন ধরে আছে। সবকিছু নখদর্পণে। যাই হোক না কেন, তিন বেলা কেউ না কেউ তাকে খেতে নিয়ে গেছে। কিন্তু গতকাল রাতে কেউ আসেনি। হয়তো এসেছিল। তাকে বা সবুজকে অনেকবার ঠেকেছিল। পরে সাড়া না পেয়ে ফিরে গেছে। আবার পরে ভাবে, সে এতটা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেছিল যে মানুষের শব্দ শুনতে পেল না! না, এতটা ঘুমে আচ্ছন্ন হয়নি। কিছু একটা ব্যাপার রয়েছে। সকাল হতেই সবুজ জমি দেখতে বাইরে বেরিয়ে গেছে। কৃষকের নতুন ধান বাড়িতে উঠছে। প্রকৃতির আলাদা একটা ছোঁয়া রয়েছে। তার স্পর্শ পেতে শিশির ভেজা ঘাসকে তোয়াক্কা করে বেরিয়ে গেছে। সোনালী ধানের ক্ষেত তার ভালো লাগে। দিগন্তের পর দিগন্ত ধানের মোহ তার হৃদয়কে শীতল করে। এক সপ্তাহের মতো মাঠে যায়নি। তাকে আর বেঁধে রাখা সম্ভব নয়। সকালে উঠে দৌড় দিয়েছে। কথাটা ভাবতেই তোতার কেমন হাসি পায়। ধান কাটার সময় তাকে কত যন্ত্রনা সহ্য করতে হতো। কাস্তে ধরে ধরে তার নরম হাত বলিষ্ঠ হয়েছে। ধানে লেগে থাকা ধুলোবালিতে খুব হাঁচি হতো। সকালে মাঠের মধ্যে কখনো যেতে চাইতো না। বাধ্য হয়ে যেত। আর এই ছেলে নাকি ধানের গন্ধ না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। অদ্ভুত ছেলে বললেও কম হবে।
নিজের ঘরে প্রতিটি কোণোয় খুঁজতে রইল কিছু খাবার আছে কিনা! কিছু পেল না। বাড়িতে একটাই মানুষ থাকে। আবার যে মানুষটা থাকে তাকে খেতে না দিলে খেতেও চাইবে না। তাই কোনো খাবার না থাকাটাই স্বাভাবিক। নতুন বাড়িতে এসেছে। সবার সামনে একটু বেশি খাবারও খেতে পারে না। লজ্জায় পেট ভরে গেছে বলে উঠে আসতে হয়। তার উপর গতকাল রাতে কিছু খায়নি। খিয়েটা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এভাবে আর বাড়ির মধ্যে থাকলে চলবে না। মায়ের কাছে একবার যাওয়া যাক। বৌমা হিসেবে তার দায়িত্ব শাশুড়ি মায়ের কাছে যাওয়া। বাইরে বেরিয়ে আসলো ঠিকই তবে সাহস কুলালো না। তবুও একটু একটু করে এগোল। পৌঁছনোর আগেই দেখতে পেল মা বাড়ির বাইরে আসছেন। সামনের দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। হঠাৎ করে মুখোমুখি হওয়ায় তোতা ঘাবড়ে গেল। কি বলবে বুঝে উঠতে পারল না। কোনোরকম নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,’কোথাও বের হচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, আমি শহরে চলে যাচ্ছি। রিপন একটা কনফারেন্সের জন্য বাইরে কয়েক দিন থাকবে। তাই আমি শহরে কয়েকদিন থাকবো বাড়ি ফিরবো না। তোমরা সাবধানে থেকো।’ তোতার জবাবের অপেক্ষা না করে তরতর করে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। মুহূর্তের ঘটনায় হতভম্ব হলো সে। ব্যাপারটি একদমই বিচ্ছিরি ঠেকলো। সৌন্দর্য বলে কি কিছু নেই? কোথাও নিজের আত্মসম্মানে লাগলো। খুব রাগ হল। তবে বাড়িতে সবার অনুপস্থিতিতে নিজেকে একটু স্বাধীন মনে করলো। উৎফুল্লতায় পশ্চিম দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখল বিশাল মাঠ। বিঘার পর বিঘা চাষের জমি। তোতা বাড়ির একদম শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়ালো। তারপরে একটা পুকুর রয়েছে। সম্ভবত পুকুরটা তাদেরই হবে। তারপর চাষের জমি। সেখানে দাঁড়িয়ে সে সবুজকে লক্ষ করল। দূরে দাঁড়িয়ে আপন মনে চাষিদের সঙ্গে গল্প করছে সবুজ। ইচ্ছে করছিল ঘাড় ধরে টেনে আনতে নয়তো জোরে ডাক দিতে। কিন্তু পারল না। ভাই হলে অবশ্যই পারতো। সবুজ তো আর ভাই নয়।
রাগে গুম হয়ে চুপচাপ বসে রইল। সবুজ বাড়ি ফিরলেই ঝগড়া করবে। নতুন এসেছে তো কি হয়েছে ঝগড়া করতেই হবে। এভাবে পারা যায় না। তার উপস্থিতি যেন কেউ মানতে চাইছে না। সবাই অবজ্ঞা করছে। কিছুক্ষণ পর সবুজ ফিরে এলো। পা হাত ধুয়ে বেশ পরিপাটি হয়ে রুমে এলো। তোতা প্রতিজ্ঞা করে রেখেছে কিছুতেই কথা বলবে না। সবুজ নিজে থেকে কথা বললেও বলবে না। সে গামছা নিয়ে পা মুছতে মুছতে বলল,’জানেন তোতাপাখি , আজ সকালে কি হয়েছে? দাঁড়ান দাঁড়ান পরে বলছি। আগে আপনি বলুন তো, আপনি ধান চাষ করতে পারেন?’ তোতা জবাব দিল না। গুম মেরে বসে রইল। সবুজ হেসে বলল,’বোকার মতো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি। আপনি তো বলেছিলেন সব কিছুই পারেন। আমরা না এবার থেকে ধান চাষ করব। আমাদের বাড়িতে জমি রয়েছে। প্রত্যেক বছর ভাগে চাষ করতে দেওয়া হয়। এক বিঘা মতো নিজেদের জন্যে রেখে দেবো। আপনি আমায় একটু শিখিয়ে দেবেন দেখবে আমি ঠিক পারব। শিখিয়ে দেবেন তো?’
তোতার জবাব না পেয়েও তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এলো না। সবকিছু স্বাভাবিক নিল। আবার বলতে শুরু করল,’ জানেন তো, আজকে এক কৃষক কাকার সঙ্গে দেখা হলো। উনি খুব ভোরে উঠে মাঠে চলে এসেছেন ধান কাটতে। আর উনার স্ত্রী বাড়িতে সমস্ত কাজ শেষ করে আটটার সময় এলেন। সঙ্গে কি নিয়ে এসেছিলেন জানেন? চা আর বাসি রুটি। গতকাল রাতে তাঁদের বাড়িতে রুটি হয়েছিল কয়েকটা রেখে দেয় সকালের জন্য। চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে রুটি খেলেন দুজনে। কি সুন্দর বল। গৃহবধুটি চাইলে বাড়িতে নিজে খেয়ে নিয়ে স্বামীর জন্য শুধু নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি তেমনটা করেননি। দুজনের জন্য নিয়ে এসে একসঙ্গে খেলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাকেও দিল। আমিও তাদের সঙ্গে বসে খেলাম। আলাদা একটা স্বাদ আছে। তারপর তাঁরা কাজ করতে শুরু করলেন আর আমি চলে এলাম। ভাবতেই কেমন লাগছে। কত সুন্দর তাদের জীবন। আমিও জীবনের কিছুটা সময় এমন ভাবে কাটাতে চাই।’ তোতার সমস্ত রাগ মুহূর্তের মধ্যে কোথাও হাওয়া হয়ে গেল। সবুজের শিশুসুলভ ব্যবহার মনকে শান্ত করে দিল। মুগ্ধ না হয়ে পারল না। এই ছেলেটির মধ্যে কোনো হিংসা বিদ্বেষ ঘৃনা নেই। খুব সাধারণ। তবুও একটু গম্ভীর কণ্ঠে বলল,’আপনি তো খেয়ে নিয়েছেন। পেট ভরে গেছে না! কিন্তু আমি কিছু খাইনি। আমার খিদে পাচ্ছে।’
‘খিদে পেলে কিছু খেতে হয়। আমাকে বললে আপনার পেট ভরে যাবে না।’
‘কি খাবো সেটা বলুন?’
‘ওই বাড়িতে চলে যান অনেক কিছু খাবার পাবেন। না হলে মাকে বলবেন খাবার বানিয়ে দেবেন।’
‘আপনার মা সকালে উঠে শহরে চলে গেছেন।’
‘তাহলে একটু কষ্ট করতে হবে। চাবি নিশ্চয়ই দিয়ে গেছেন। গিয়ে কিছু খাবার বানিয়ে নিন।’
‘চাবিও দিয়ে যাননি।’
এবার সবুজের মুখ শুকিয়ে গেল। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলূ। সে জানে, সে তার বাবা-মা’র মতো সন্তান হতে পারেনি। বড় অবাধ্য। এত সাকসেসফুল হলেও এখনো বাবা-মার অপ্রিয় ছেলে সে। সবসময় ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে। এই ঠান্ডা লড়াই এর মধ্যে তাঁরা তোতাকে নিমজ্জিত করেছে। নিজের অপমান সয়ে এসেছে। কিন্তু তোতার অপমানটা মানতে পারল না। বিয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না তার। তাঁরাই জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। আর এখন বিয়ের কাজ শেষ হতে সরে পড়তে চাইছেন। ঠিক হচ্ছে না। তোতার মনে সন্দেহের বাসা বাঁধছে। তাদের পরিবারকে নিয়ে খারাপ ভাবছে। এগুলো কি ঠিক হচ্ছে? বাবা আর দাদা না হয় বরাবর এমন ছিল। কিন্তু মা তো তাকে ভালোবাসতো। চোখের আড়াল হতে দিত না। সবসময় তার কথা ভাবতো। কিন্তু হঠাৎ করে এত পরিবর্তন হলো কেন? সবুজ তোতার কাছ থেকে একটু সরে এসে ভাবতে লাগলো। মনে পড়ল বিয়ের কয়েক দিনের আগের কথা। যখন পাত্রী দেখা চলছিল তখন রিপন সবুজকে বলেছিল তার কোম্পানিতে চাকরি করতে। চাকরি না করলে তাকে কোনো মেয়ে বিয়ে করবে না। সবুজ সোজাসুজি না বলে দেয়। মুখের উপর এমন উত্তর কখনো প্রত্যাশা করেননি সে। ধীরেসুস্থে কারণ জানতে চায়। সবুজ স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়, সে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে। মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট নিয়ে অফিসে অফিসে ঘুরলে, তাকে কি কেউ চাকরি দেবে? দেবে না। এটা কোনো অস্বাভাবিক নয়। যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য জায়গায় রাখা হবে। দাদার অফিসে কাজ করার জন্য কত যোগ্য ছেলে-মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সে অযোগ্য হয়েও যোগ্য স্থানে থাকবে। তা হতে পারে না। তাহলে তো তার ভেতরের সততাকে হত্যা করা হবে। পারবে না কারোর দয়ায় বড়ো হতে। কারোর স্থান ক্ষমতার বলে জয় করতে। রিপন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঝাঁঝের সাথে বলে, সে তো বরাবরই দাদার এঁটো খেয়ে বড় হয়েছে। ছোটবেলা থেকে রিপন খুব ছটপটে ছিলো। বাড়িতে কোনো খাবার এলে প্রথম খেয়ে ফেলতো সে। যেটুকু অবশিষ্ট থাকতো সেটুকুই খেতো সবুজ। তাকে যা দিতো তাই খেতো। নিজে থেকে কখনো কিছু চাইতো না। শান্তশিষ্ট সবুজ কখনো কিছু আবদার করেনি। দাদার ছোট হয়ে যাওয়া জামাগুলো পরতে কখনো দ্বিধা করেনি। এখনো মাঝে মধ্যে পরে। পুরনো জিনিস তার খুব ভালো লাগে। তাছাড়া সে এখন দাদার ফেলে দেওয়া রুম ব্যবহার করছে। বারবার এঁটো খাচ্ছে, তাহলে এখন খেতে অসুবিধা কোথায়? সেদিন নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করে সবুজ। তবে বড়োদের মুখের উপর জবাব দেওয়ার অভ্যাসটা তার নেই। নিরবে চলে আসে। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। দাদার দেওয়া চাকরি নাচক করে। তারপর থেকেই সম্পর্কের বড় ধরনের ফাটল ধরে। সে-ই প্রথম দাদা তার নামে বদনাম রটাতে শুরু করে। যদিও তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। দুই ভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্যে দুশ্চিন্তায় পড়েন বাবা-মা। কে ঠিক,কি ভুল, বুঝে উঠতে সময় লাগে। পরে ঠিক করেন রিপন তাদের যোগ্য সন্তান। সে প্রতিষ্ঠিত। শেষ বয়সে নিশ্চিত আরামদায়ক জীবন যাপন করতে হলে রিপনের হাতে ধরতে হবে। তাই তার প্রতি আনুগত্য থাকাটাই সঠিক। সবুজের হাত ধরাটা ঠিক হবে না। কারণ তার কোনো লক্ষ্য নেই। সে ভবঘুরে। আজ আছে তো কাল নেই। তাকে বিশ্বাস করা শক্ত। তাই বাবা-মা রিপনকে বেছে নিয়েছে। অনিশ্চিতের দিকে পা বাড়াতে চায়নি। সবুজের বিয়ে দিয়ে নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছে। এবার তাদের ব্যাপার তাদেরকে বুঝে নিতে হবে। সবুজ আবার তোতার কাছে ফিরে আসলো। করুন কন্ঠে বলল,’আমি আপনার পরিস্থিতির কথা বুঝতে পারছি। আমি খুবই দুঃখিত। আপনার সঙ্গে খুব অন্যায় হচ্ছে। একটু মেনে নিন। কথা দিচ্ছি আর এমনটা হবে না। আপনি রান্না করতে পারেন না?’
তোতা জবাব দিল। সবুজ বলল,’আমি বাজার থেকে সবকিছু এনে দিচ্ছি। আপনি রান্না করে ফেলুন। এখন শহরে যেতে পারবো না। বিকালে গিয়ে সব কিছু কিনে আনব। বাড়িতে মাটির হাঁড়ি আর বাগানে কলাপাতা আছে। দুপুরের জন্য একটু ম্যানেজ করতে পারবেন না?’ তোতার সম্মতি পেয়ে খুব খুশি হলো। আজকাল মেয়েরা সবকিছু মানতে চায় না। এতক্ষণে হয়তো ঝগড়া লেগে যেত। কিন্তু তোতা ধীর-স্থিরভাবে সবকিছু মেনে নিল। তার দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে না তো? চাইলে তো এক্ষুণি শহর থেকে ঘুরে আসতে পারতো। কিন্তু গেল না কেন? মন সায় দিচ্ছে না। সঙ্গে একজনকে নিয়ে গেলে ভালো হবে। রায়বাবুদের বাড়িতে থাকাকালীন রান্নার সম্বন্ধে সবকিছু জেনে গেছে। বাড়িতে কেউ না থাকলে মাঝে মধ্যে নিজেও রান্না করেছে। রান্নাঘরের সরঞ্জাম সম্পর্কে একদম অজ্ঞ নয়। তবুও সঙ্গে কাউকে নিয়ে যেতে চাইলো। অনেক জিনিস কিনতে হবে। ছোট ছোট জিনিস কিনে একটা সুন্দর সংসার সাজাতে হবে। কারোর সাহায্যর দরকার। তোতাকে তো আর বাজারে নিয়ে যাওয়া যায় না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চাল,আলু,তেল,আর কিছু শুকনো খাবার কিনে আনলো। সকালে খাওয়া শেষ করে উনুনে রান্না চড়িয়ে দিল তোতা। এই বাড়িতে এসে এমন পরিস্থিতিতে যে পড়তে হবে স্বপ্নেও ভাবেনি। ভেবেছিলো, এই বাড়িতে কাজের লোক রয়েছে। তাকে কোনো কাজ করতে হবে না। হেলে দুলে জীবন কাটাবে। সময় কীভাবে শেষ করবে সেটাই ভাবছিল। কিন্তু বাড়িতে আসতে না আসতেই তার ভাবনা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল। কি ভেবেছিল আর কি হচ্ছে। যদিও এতে সে মোটেও অখুশি নয়। এত গভীর শূন্যতা আর আশাহীনতার মধ্যেও কোথাও সে সুখ খুঁজে পাচ্ছে। নতুন নতুন সংসার করতে কিংবা একদম গ্রাম্য ভাবে সাধারণ গৃহবধূ হতে মন্দ লাগছে না। সে যেন হঠাৎ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে গেছে। তখনকার দিনে মাটির হাঁড়িতে রান্না করা কিংবা কলাপাতা বা পদ্মপাতায় খাওয়ার ঝোঁক ছিল। এখন কি সে সব আর আছে? হয়তো আজও দু-একটা পল্লীগ্রামে আছে। আধুনিক জীবন যেমন অনেক ভালো কিছু দিয়েছে তেমনই অনেক ভালো কিছু কেড়েও নিয়েছে। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হবে ব্যাপারটা এমনই। রান্না শেষ হওয়ার পর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল। তারপর সবুজকে ডাক দিল। দুজনে একসঙ্গে আসন পাতিয়ে খেতে বসলো। সবুজের কষ্ট হলো। স্বামী হিসেবে নিজেকে ব্যর্থ মনে করলো। একজন স্বামীর যা দায়িত্ব কর্তব্য তা কি পালন করতে পারছে? মনে তো হচ্ছে না। প্রথম দিন থেকেই তোতাকে বিপদে ফেলে আসছে। অসম্মান করেছে। তিন বেলা ঠিকমতো খাবার দিতে পারেনি। তার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিয়ে তার সাথে ঠিকমত কথা বলেনি। নিজের বাড়িতে থাকলে কি কেমন হতো? সবকিছু ছেড়ে এসেছে একটু ভালো থাকার জন্য। বাপের বাড়িতে যে মন্দ ছিল তা নয়। তবুও ভালো থাকার জন্য এবং কাউকে ভালো রাখার জন্য এই বাড়িতে এসেছে। তাকে তো নিশ্চিন্তে ভালো রেখেছে, কিন্তু সে কি পারছে তাকে ভালো রাখতে? মনে হয় পারছে না। আবার একটু পর ভাবলো সে তো জেনে-বুঝে কিছুই করেনি। পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছে। সবুজের নুন ভাত হলেই হয়ে যায়। সেখানে আলু মাখা ভাত তার কাছে অনেক দামী। কিন্তু তোতা! তার এগুলো খেতে অসুবিধা হচ্ছে না? তার বাবা বারবার বলেছিলেন মেয়ে মাছ খেতে খুব ভালোবাসে। তারা রোজ আনে রোজ খায় তবে আলু মাখা ভাত খাওয়ায় অভ্যস্ত নয়। বাড়িতে পুকুর, মুরগি,গাভী আছে। খাওয়াতে কোনো রকম অসুবিধা হতো না। তোতার কাছে নিজেকে ছোট লাগলো। কথা বলতে কেমন একটা লাগলো। কলাপাতা খাবার অভ্যাস তার রয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে মিলে অনেকবার খেয়েছে। তোতাও কি কখনো কলাপাতায় খেয়েছে? এটা তো জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,’তোতাপাখি, পূর্বে কখনো কলাপাতায় খেয়েছেন?’
‘অনেকবার খেয়েছি, রাজামশাই।’
‘আমার নাম রাজামশাই নয়। আপনি বারবার আমায় রাজামশাই বলেছেন কেন?’
‘আপনিও তো বারবার আমায় তোতাপাখি বলছেন। আমার নাম কি তোতাপাখি?’
‘আমি বললাম বলে আপনিও বলবেন?’
‘অবশ্যই। আপনি যেদিন বলা বন্ধ করবেন আমিও সেদিন বলা বন্ধ করব। বুঝেছেন?’
‘বড় অসভ্য মেয়ে আপনি।’
‘বড় অসভ্য মেয়ে আপনি।’
‘আমার কথা নকল করছেন!’
‘আমার কথা নকল করছেন!’ সবুজ থেমে গেল। বুঝে গেছে মেয়েটি কিছুতেই থামবে না। বড় ফাজিল। তার ব্যবহারে স্নিগ্ধতা রয়েছে। খুব দ্রুত মানুষকে আপন করে নিতে পারে। মাত্র কয়েকদিন পরিচিত অথচ কত আপন হয়ে গেছে। হয়তো স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন এমনই। চেনা নেই জানা নেই দুটো মানুষ এক হয়ে যায়। থাকতে থাকতে একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। তারপর কোনো কিছুর বিনিময়ে ছাড়তে চায় না। পরে যদি জানতে পারে দুজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ সঠিক নয় তবুও কেউ কাউকে ছেড়ে যায় না। শুকনো ভাত খেতে তোতোর খুব অসুবিধা হচ্ছে। খেতে বেশ সময় নিল। কিছুক্ষণ পর বলল,’জানেন রাজামশাই, আপনি যখন প্রথম আমায় দেখতে গেলেন এবং আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল তখন আমি ভাবছিলাম আপনার হয়তো কোনো রোগ আছে।’
‘রোগ!’
‘হ্যাঁ, এমন অনেক ঘটনাই তো ঘটে। ছেলের কোনো রোগ থাকে আর তারা লুকিয়ে ঝুঁকিয়ে কোনো গরীব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করে আনে। তারপর সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় মাঝপথে ছেলেটা চলে যায়। বিধবার জ্বালা নিয়ে সারা জীবন শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকতে হয়। ফিরে আসতে পারে না। সমাজে কত মানুষের কত অপমান লাঞ্ছনা স্বীকার হতে হয়। কত মানুষের গঞ্জনা সহ্য করতে হয়। তাই ধনী ব্যক্তিরা সুযোগ বুঝে সব সময় গরীবদেরকে পাঁঠার বলি বানায়। আমি প্রথমে আপনাদেরকে তাই ভাবছিলাম।’
‘তাহলে আমায় বিয়ে করতে গেলেন কেন?’
‘পরে ভাবলাম আপনি তেমনটা হতে পারেন না। আপনার লেখা পড়েছি। যে মানুষটা উপন্যাসের মধ্যে কত মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। সাধারণ মানুষের কথা লিখেছেন। সে মানুষটা আর যাই হোক সাধারণ মানুষকে ঠকাবেন না। আপনি একটা কবিতা লিখে ছিলেন না, -আমার বন্ধু চাষি, আমি চাষ করতে ভালোবাসি….। আপনি আমায় ঠকালেও আমার বাবাকে কখনো ঠকাবেন না। কারণ আপনার বন্ধু তো চাষি। সন্দেহ তখনো পুরোপুরি যায়নি। ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। যা হওয়ার হবে। এখন বুঝতে পারছি আপনারা এত ধনী হওয়া সত্ত্বেও কেন গরীব ঘরের মেয়েকে বাড়িতে বউ বানাতে গিয়েছিলেন?’
‘কি ভাবছেন তাহলে এখন?’
‘আপনাদের পরিবার দুটো ভাগে বিভক্ত। একদিকে আপনি আর একদিকে পুরো পরিবার। আপনাদের মধ্যে সম্পর্ক মোটেও ভালো নয়। আপনি গ্রাম্য জীবন পছন্দ করেন। খুব উদাসীন। লোভ লালসা নেই। আপনি কখনো নিজের অধিকার চাইবেন না। কিন্তু আপনার স্ত্রী যদি চালাকচতুর হয়, তাহলে সে আপনাকে বাধ্য করবে অধিকার চাওয়ার জন্য। একটা সময় দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হবে। আপনাকে যা দেবে তাই মেনে নেবেন। কিন্তু আপনার স্ত্রী যদি চতুরচালাক হয় তাহলে সে কিছুতেই মানবে না। সে সমান ভাগ চাইবে। সে-ই জন্য আপনাদের পরিবার সুযোগ বুঝে একটা গ্রাম্য মেয়েকে বউ বানিয়ে এনেছেন। তাঁদের ধারণা গ্ৰামের মেয়েরা চালাকচতুর হয় না। আপনার মতোই কিছুটা বোকা না হয় পুরো সহজ-সরল হবে। কিন্তু তাঁরা ভুল করে ফেলেছেন। আমি মোটেও পল্লীগ্রামের সাদাসিদে মেয়ে নই। শহরের মেয়েদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমাকে ফাঁকি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সহজ নয়।’
সবুজ মনে মনে এমনটা ভেবে রেখেছিল। সে জানতো তার বাবা-মা কেন তাকে গ্রামের মেয়ের সাথে বিয়ে দিচ্ছে। সারা জীবন তাঁরা গরীবদের হীন চোখে দেখে এল আর বিয়ের সময় গরিব ঘরের মেয়েকে নিজেদের বউ বানাতে চায়। বিষয়টি মোটেও স্বাভাবিক লাগছিল না সবুজের কাছে। তখন থেকে ধারণাটি জন্মেছিল। আর সে-ই ধারণা পুরোপুরি পরিষ্কার করে দিলো তোতা। হাসিমুখে সবুজ বলল,’আপনার কি এত সম্পত্তির প্রতি লোভ ররেছে? আপনি টাকা-পয়সা কামনা করেন?’
‘মোটেও না। এসবের প্রতি আমার কোনো লোভ নেই। আমি চাইও না। আমার লোভ আপনার প্রতি। আপনি শুধু আমার কাছে থাকলেই হবে। তবে আমাকে যদি কখনো অসম্মান করার চেষ্টা করেন তাহলে ভুল করেবেন। জীবনের যত টুকু মাথা নিচু করার কথা ততটুকুই করবো তার বেশি কখনো করবো না।’ ভারাট কণ্ঠস্বরে কোনোরকম সংকীর্ণতা নেই। ব্যক্তিত্ব আর গাম্ভীর্য পরিপূর্ণ। এমন ব্যবহার সবুজকে মুগ্ধ করল। খুশি হলো। তার খাওয়া শেষ হয়েছে। তোতা এখনো খাওয়া শেষ করতে পারেনি। শুকনো খাবার গলায় আটকাচ্ছে। বারবার জল পান করছে। একটু পর সবুজের দিকে তাকিয়ে বলল,’আপনি তো কাল থেকে অফিস যাবেন। কখন অফিস যান? টিফিন নিয়ে যাবেন তো?’
‘আমি অফিসে যাই কে বলেছে? আমিতো অফিসে যাই না।’
‘মজা করছেন না!’
‘মজা করছি না। আমি লেখালেখি ছাড়া আর কোনো কাজ করি না। আর আপনি হয়তো জানেন আমি মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। কোন কোম্পানি আমায় কাজ দেবে? কিছু-ই তো জানি না।’
‘আপনার বাবা তো বলেছিলেন আপনি নাকি আপনার দাদার কোম্পানিতে চাকরি করেন।’ সবুজ হাসলো। সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। হাসিমুখে বলল,’আপনাদের পরিবারকে ভুল বলা হয়েছে। আমাদের সমাজের অনেকের মনে এখনো একটা ধারণা আছে। ছেলের দীর্ঘ একটা ইনকামের পথ না থাকলে মেয়ের বাবারা মেয়েকে ওই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চায় না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পাঠাতে চায় না। তাই আমার বাবা আপনার বাবাকে মিথ্যা বলেছেন।’ তোতা কিছু বলল না। সবুজ ঢোক গিলে বলল,’আপনি সবকিছু জেনে গেলেন। এবার কি আপনি আর আমার কাছে থাকবেন না?’
‘থাকবো না তো বলিনি। আমি শুধু জানতে চেয়েছি। আপনার যা পছন্দ তাই করুন। আমার তিন বেলা আলুমাখা ভাত হলেই হবে।’
‘আমি যা রোজগার করি তা একদমই কম নয়। কিন্তু আমার রোজগারের আশি শতাংশ কোনো ট্রাস্টে দান করে দিই। বাকি দশ শতাংশ নিজে খরচ করি তার দশ শতাংশ জমা করি।’
‘আপনি বড় উল্টাসিধা মানুষ। এখনকার বেশিরভাগ সেলিব্রেটি মানুষেরা নিজের রোজগার থেকে কুড়ি শতাংশ কোনো ট্রাস্টে দান করে বাকি আশি শতাংশ নিজের কাছে রাখে। আর আপনি এর ঠিক বিপরীত।’
‘আমি আলাদা কিনা জানি না। তবে আমি যখন জল পান করি তখন কৃষকের ক্ষেতের জমিতে জলের অভাবের কথা মনে পড়ে। আমি যখন খাবার খাই তখন রাস্তায় অনাহারে কাটানো শিশুদের কথা মনে পড়ে। আমি শান্তিতে থাকতে পারি না। বড়ো উতলা লাগে।’
‘সব বুঝতে পারছি। কিন্তু এবার তো আমি এসেছি। আমার জন্য কিছু রাখবেন না?’
‘না, আমি আরও বেশি পরিশ্রম করব। সে-ই জন্য তো সকালে বললাম ধান চাষ করব। আপনি শিখিয়ে দেবেন না? ওখান থেকে ভালো রোজগার হবে।’ তোতা হাসিমুখের মাথা নাড়ালো। মানুষটি ব্যাপকভাবে ভিন্ন। নিখুঁত সাধারণ। ধনী মানুষদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কত ধারণা। ধনী মানুষ মানে আলাদা একটা জগৎ। ওই জগৎ থেকে তারা মাটিতে নামতে চায় না। সবার সাথে মিশতে চায় না। তাদের একটা ক্লাস রয়েছে। কিন্তু মানুষ মানুষই হয়। মানুষ কখনও ধনী কিংবা গরিব হয় না। কেউ ডাল-ভাত খেয়ে জীবন অতিক্রম করে কেউ মাংস ভাত খেয়ে জীবন অতিক্রম করে। কিন্তু জীবন তো একটা সুতোই বাঁধা। ডাল ভাত খাওয়া মানুষটাও বেঁচে আছে আবার মাংস ভাত খাওয়া মানুষটাও বেঁচে আছে।
দরজায় বারবার টোকা পড়ায় দ্রুত দরজা খুলে দিল তোতা। সংকেতকে দেখে চমকানোর কথা নয় তবে কোনো কারণে চমকে উঠলো। হয়তো এই চমকে ওঠার কারণ সংকেতের অস্থিরতা। খুব অস্থির লাগছে তাকে। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করেই জিজ্ঞেস করলো,’নতুন বৌঠান, সবুজ কোথায়?’ সবুজ সেখানেই ছিল। কাছে এসে বলল,’আমি কি দুটো বিয়ে করেছি? নতুন বৌঠান কেন? পুরনো বৌঠানটা কে?’ সংকেত হাসলো। বলল,’ এখানে একটা সাইন্স আছে। ধরতে পারলেই হলো।’
‘কেমন সাইন্স শুনি?’
‘আমি সূর্যময়ের বউকে বৌঠান বলি। আর তোমার বউকেও বৌঠান বলা কি ঠিক হবে? ঠিক হবে না। তুমি সবার পরে বিয়ে করেছো। তাই স্বাভাবিকভাবে তোমার বউ নতুন বৌঠান হবে।’ তোতা সংকেতের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো। তার হাতে মিষ্টির ঠোঙ্গা রয়েছে এই প্রথম দেখতে পেল। এই ভর দুপুরে মিষ্টি আনতে গেল কেন? জানতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু বাড়িতে নতুন হওয়ায় বেশি আগ বাড়ালো না। খপ করে সবুজকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। ঘনঘন বন্ধুদের জড়িয়ে ধরার অভ্যাস নতুন নয় সংকেতের। এক সময় সংকেতের এমন আচরণে খুব বিরক্ত হতো সবুজ। এখন হয় না বরং ভালোই লাগে। আজকের জড়িয়ে ধরা কিছুটা হলেও আলাদা। সংকেতের চোখে স্নিগ্ধ জল রয়েছে। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় সবুজ সংকেতের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,’কিছু হয়েছে সংকেত? এত ঘেমে আছো কেন?’
‘বন্ধু আমি এখন আর শুধু সংকেত নই। আমার নামের আগে আরও তিনটি অক্ষর যোগ হয়েছে।’
‘মানে?’
‘মানেটা খুব সোজা বন্ধু। আমি এখন এ.সি.পি সংকেত। আমি এ.সি.পি হয়ে গেছি।’ সবুজ উত্তর দিল না। বুক থেকে সবুজকে সরিয়ে দেখলো তার চোখে জল। বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে সংকেত বলল,’তোমার চোখে জল কেন?’
‘তুমি ভুলে গেলে বুঝি! আমরা একজনের কষ্টের তিনজন কাঁদি। একজনের খুশিতে তিনজন হাসি।’
দুজন দুজনকে আবার একবার জড়িয়ে ধরলো। একসঙ্গে বলে উঠলো,
‘টাকা আছে, বাড়ি আছে,আধুনিক জীবন আছে।
না,না, ওসব পোষাকি জিনিস আমাদের চাই না।
আমরাতো কৃষকের ঘাম, মাটিতে পড়লেই অনেক দাম।
চিতার আগুনে শুয়েও বলতে পারি, বন্ধু তুমি কৃষকের ঘাম।’
তোতা এই খুশির মুহুর্তের সাক্ষী রইল। সংকেতের পথ নিশ্চিন্তে সবুজের অনেক উপরে। তবুও তার কোনোরকম ঈর্ষা কিংবা হিংসা হল না। এটাই হয়তো ভালো মানুষের লক্ষণ। নিজেকে কিংবা নিজের স্বীয়কে কেউ নিজেকে যোগ্য করে যোগ্যতা দিয়ে হারিয়ে দিলে তার প্রতি কোনো রকম ঈর্ষা মনোভাব না আসাই ভালো মানুষের লক্ষণ। তোতো সবুজের মতো অনেক খুশি। চোখ-মুখ আনন্দে কলরব করছে। তাদের দুজনকে ছাড়া বাড়িতে আর কাউকে দেখতে না পেয়ে অবাক হয় সংকেত। কারণ জানতে চায়। সবকিছু জানার পর সংকেতের রাগ হয়। রাগে গনগন করে ওঠে। সে জানে সবুজের বাবা মা কেমন। মুখ পেঁচিয়ে তাচ্ছিল্য করে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই সবুজ বাধা দিয়ে বলল,’ওঁরা আমাদের চেয়ে বড়ো। ওদেরকে সম্মান করাটা আমাদের ভেতরের সত্তা। তাছাড়া ওঁরা আমার বাবা-মা। ওদের সম্বন্ধে খারাপ কথা শুনতে চাই না।’ সংকেত চুপ করে গেল। বাবা-মার যোগ্য সন্তান হয়ে উঠতে পারেনি সবুজ। বাবা-মা তাকে বারবার ফিরিয়ে দিয়েছে। কখনো কখনো অস্বীকারও করেছে সবুজ তাদের ছেলে বলে। তাকে অপমান করার চেষ্টা করেছে। অবহেলা করেছে। তবুও সবুজের মন শক্ত হয়নি। বাবা-মার জন্য আজও সে নরম এবং আনুগত্য।
বিকাল বেলায় সবুজ আর সংকেত সংসার করার প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস শহর থেকে কিনে এনেছে। তারপর দু-একটি গল্প করে বাড়ি ফিরে গেছে সে। সারা বিকেল জুড়ে সংসার সাজালো সবুজ আর তোতা। তোতা বেশ খুশি। এভাবে সবকিছু গোছাতে ভালো লাগছে। বাড়িতে এমন কাজে অভ্যস্ত ছিল। তবুও এখানে সবকিছুই আনকোরা লাগছে তার কাছে। এমন সুন্দর মুহূর্তের ব্যাঘাত ঘটালো কারোর আগমন। দরজায় কেউ টোকা দিচ্ছে। এই অসময়ের আবার কে এলো? কিছুটা এলোমেলো হওয়া শাড়িটা ঠিক করে দরজার কাছে গেল। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে একেবারেই চেনে না সে। তোতা পরিচিত মানুষের সাথে বকবক করতে ওস্তাদ কিন্তু অপরিচিত মানুষের সামনে একদম ভেজা বিড়াল। কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে নিজেকে একটু স্থির করে বলল,’ভেতরে আসুন।’ লোকটি ভেতরে এল। বসার জায়গা দিল। সবুজ লোকটিকে দেখে হেসে ফেললো। তার মানে লোকটি অপরিচিত নয়। সবুজের চেনা কেউ হবে। সবুজ সৌজন্যে নিবেদন করে কথায় লিপ্ত হল। তোতা সেখানে রইল না। নিজের ঘরে ফিরে এলো। বেশ অনেকক্ষণ ধরে দুজনে কথা বলল। তারপর লোকটি বিদায় নিল। জানালার আড়াল থেকে তোতা সব কিছু দেখল এবং কান পেতে শুনলো। সব কিছু স্পষ্ট ভাবে শোনা গেল না। কিছু বার্তা অস্পষ্ট থেকে গেল। লোকটি যে ভাবে ফিরে গেল তাতে মনে হলো না হাসিমুখে ফিরে যাচ্ছে। সবুজের ব্যাপারে বা কোনো কথায় রাগ করেছে। মনোমালিন্য স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। সবুজ ঘরে আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করল। লোকটি রাগ করলো কেন? সবুজ শীতল মস্তিষ্কে সবকিছু তোতাকে বললো। উনি প্রকাশনীর লোক। তিনি এসেছিলেন সবুজের নতুন বইয়ের জন্য। অ্যাডভান্সও দিতে চাইছিলেন। সবুজ প্রস্তাবে রাজি হয়নি। নতুন বিয়ে করেছে। স্ত্রী আর পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাতে চায়। লোকটি আপত্তি করেনি। অবসর সময় কাটাতে চাইলে কাটাতে পারে। কিন্তু তা কতদিন? এক সপ্তাহ নয়তো বড়জোর দু-সপ্তাহ। কিন্তু সবুজ অবাক করে জানায় সে প্রায় তিন মাস ধরে কোনো কাজ করতে চায় না। লোকটি ভাবে সবুজ মজা করছে। কিন্তু না। সবুজ সঠিক কথাই বলেছে। সারা জীবন ধরে কাজ করে গেলে জীবন কি তা উপলব্ধি করা যায় না। বেঁচে থাকার জন্য অবসর দরকার। আজকের কাজ কালকে করব বলে যেমন ফেলে রাখি। কিন্তু পরে সে-ই কাজটা করা হয় না। কাল কাল বলে চলতে থাকে। অবসর সময়টাও তেমন। আজ নয় কাল বললে আর অবসর সময় আসবে না। সবুজের একটাও কথা বিশ্বাস করেনি লোকটি। ভাবে সবুজ আর তাদের প্রকাশনীতে কাজ করতে চায় না। তাই বাহানা দিচ্ছে। রেগে ওঠে। চায়ে চুমুক পর্যন্ত না দিয়ে বেরিয়ে যায়। সব শুনে তোতোও একটু অবাক হয়। বলে,’ আপনি সত্যি সত্যি তিন মাস কিছু করবেন না?’
‘না, এখন পুরো ছুটি।’
‘কিন্তু কেন?’
‘নতুন জীবনে পা দিয়েছে। সবকিছু গোছাতে হবে। তোমার সঙ্গে বসে গল্প করব। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাব। তোমায় নিয়ে বাইরে কোথাও যাব। এখন শুধু ছুটি ছুটি আর ছুটি। কোনো কাজ নেই। একটা তো জীবন পেয়েছি। নিজের মতো উপভোগ করব। কাজ নিয়ে সবসময় পড়ে থাকলে জীবনকে কি উপভোগ করতে পারব? আজ মরে গেলে কাল দু’দিন। জীবনে কিছুটা অলসতাও দরকার।’ তোতা অবাক চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইল। যত দেখছে ততই মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ছে। কত আলাদা একটা মানুষ। চিন্তাভাবনা কত গভীর। জীবনটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে। জীবনের মানে হয়তো এই মানুষটা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।
‘কী ব্যাপার তোতাপাখি, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?’
‘দেখছি আপনাকে।’
সবুজ তোতার সামনে গিয়ে বসলো। আলো জ্বালালো। তার হাত দুটো ধরে বলল,’নিন দেখুন। ভালো করে দেখুন।’ খিলখিল করে হেসে উঠল তোতা। বড় অসভ্য ছেলে। সহজে হাসি থামল না। চলতে রইল। স্ত্রীর হাসি তাকে মুগ্ধ করল। এই রমণী প্রতি একটু একটু করে মায়ায় আবদ্ধ হচ্ছে। নিজেকে হারিয়ে ফেলছে তাও বুঝতে পারছে। হাসির মুহূর্তটা কত সুন্দর। কত রূপবতী সে। হাসি থামিয়ে বললো,’দুপুরে বাবা ফোন করেছিল। আমরা কবে আসছি জানতে চাইছিল।’
‘কোথায় যাব?’
‘বিয়ের পর দ্বিরাগমনে যেতে হয় জানেন না?’ সবুজ উত্তর দিল না। মুখ কালো হয়ে গেল। দ্বিরাগমন ব্যাপারে অজ্ঞ নয় সে। কিন্তু বাড়িতে তো কেউ নেই। কীভাবে সব কিছু ঠিক হবে? তাছাড়া সে বাড়ির বাইরে থাকতে পছন্দ করে না। বিশেষ করে রাতে। দ্বিরাগমনে যাওয়া মানে এখন শ্বশুরবাড়িতে বেশ কয়েকটা দিন থাকতে হবে। যা তার কাছে অত্যন্ত দুষ্কর ব্যাপার। তোতার চোখের দিকে তাকালো। তার চোখে আনন্দের শিহরন বইছে। খুশির মাধুর্যতা রয়েছে। না বললে কষ্ট পাবে সে। সবুজ না বলতে পারলো না। সমস্ত নিয়ম যখন মেনে এসেছে তখন এই নিয়ম মানতে অসুবিধা কোথায়! আর বাকি রইল নিজের অস্বস্তি। এটুকু মেনে নিতে হবে। সংসার মানে মানিয়ে নেওয়া। মানিয়ে নেওয়া কখনো একতরফা না হয়। সমানভাবে দুজনকে মানিয়ে নিতে হয়।

গ্রীষ্মের দুপুরে মাটিকাটা বড্ড শক্ত কাজ। কাজ সেরে সদ্য বাড়ি ফিরেছে সূর্যময়। গা থেকে ঝর-ঝর করে ঘাম ঝরে পড়ছে। নিম্নাংশে কাদামাখা লুঙ্গি সম্পূর্ণ ভিজে গেছে ঘামে। হাঁটু পর্যন্ত কাদা লেগে রয়েছে। উর্ধাংশ সম্পূর্ণ নগ্ন। বড়ো ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। ঝিমিয়ে রয়েছে। বাড়ির উঠানে বসে পড়ে হাঁক ছাড়লো,’লতা,ও লতা,কোথায় গেল? তেল আনো স্নান করবো। বেলা তো গড়িয়ে গেলো।’ বার দু-এক-বার ডাকতে হলো না। লতা হাজির হল। কাছে বসলো। চতুর্দিকে ঘামের একটা অস্বস্তিকর গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। ঘামের বিরক্তকর ঘ্রাণ খারাপ লাগলো না লতার। সে বেজায় খুশি। আরও গা ঘেঁষে বসলো। সূর্যময়ের চোখের দিকে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যে চোখের ক্লান্তি কোথায় হারিয়ে গেছে। চোখ দুটো বড় উজ্জ্বল। স্বামীকে ঘামতে দেখে সে উঠে গিয়ে পাখার সুইচ অন করল। পাখা ঘুরলো না। বিদ্যুৎ নেই। একটা বিরক্ত নিঃশ্বাস ছাড়লো। ভেতর থেকে হাতপাখা এনে বাতাস করল। শীতল বাতাস পেয়ে একটু স্বস্তি অনুভব করল সূর্যময়। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা রইল। কেউ কোনো বাক্য ব্যয় করল না। একটু পর সূর্যময় গলা খাঁকরে শান্ত কন্ঠে বলল,’মাথায় তেল মাখিয়ে দাও। আমার হাত তো কাদায় ভর্তি।’ লতা হাতে কিছু পরিমাণ সরিষার তেল নিয়ে হাতের তালু দুটো জড়ো করে বারবার ঘষলো তারপর স্বামীর মাথায় ভালো করে মাখিয়ে দিল। মাখাতে মাখাতে বলল,’জানো, কি হয়েছে?’ সূর্যময় মাথা নাড়িয়ে বলতে বলল।
‘আমার দু’মাস ধরে হচ্ছে না।’
‘কি হচ্ছে না?’
‘তুমি কি বাচ্চা ছেলে? কিছু বুঝতে পারছো না? আমি তো মেয়ে মানুষ সব কিছু খুলে বলবো নাকি!’ সূর্যময় মুখ ঘুরিয়ে লতাকে দেখলো। তার চোখ-মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে গেছে। উষ্ণ লজ্জিত মুখখানা নিচু করে ফেলল। সূর্যময় বেজায় খুশি। হয়তো শীঘ্রই তৃপ্তির খবর পেতে চলেছে। হাসি মুখে বলল,’তুমি সত্যি কথা বলছো?’ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো লতা।
‘তাহলে কাল একবার ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসি চলো।’ লতা কিছু বলল না। সে আরও ঘেঁসে বসলো। স্বামীর ঘর্মাক্ত কাঁধে মাথা রাখল।

পর্ব ১৯ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here