নিরুদ্দেশ
পর্ব ০৮
___________________
সকাল থেকেই সূর্যরশ্মিতে বেশ তেজ রয়েছে। খাতা কলম অনুযায়ী বর্তমানে ঋতু পরিবর্তনের সময় হলেও গ্রীষ্ম ঠিক বিদায় নিতে চাইছে না। বেশ ঝাঁজালো রোদ বেরিয়েছে। প্রায় মাসখানেকের পর সবুজ নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরোলো। গায়ে চাদর জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারল না। ক্লান্ত শরীর শক্তি জোগাতে ব্যর্থ। ভেতর থেকে চেয়ার এনে উঠোনে হালকা রোদ পড়েছে এমন জায়গায় বসল। অনেক দিনের পর খুব কাছ থেকে গাছপালা নীল আকাশ সূর্যি মামাকে দেখতে পেয়ে মনটা পুলকে ভরে গেল। কতদিন হল পায়ে ভর দিয়ে হাঁটেনি। সারাদিন শুয়ে থাকতে হয়েছে। এই ক’দিন সে যে কিভাবে কাটিয়েছে তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। অস্বস্তিকর জীবন থেকে মুক্ত পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ রোদে বসার পর গরম অনুভব করল। গা থেকে চাদর সরিয়ে নিজেকে উন্মুক্ত করল। শরীরে এখনও অনেক জায়গায় পিম্পাল শুকায়নি। সেগুলোতে রোদ লাগতে বেশ আরাম বোধ হলো। গরমের মধ্যেও অস্বস্তি বোধ করল না। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ল। নিজেকে খুব হালকা মনে করলো। এতদিন যেন শরীর জুড়ে কেউ একটা জড়িয়ে ছিল। আজ সে নিজে থেকে শরীরকে মুক্তি দিয়েছে। স্বাধীন চেতনা রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। সারা শরীর ঘেমে যাওয়ায় রোদে আর বসে রইল না। ছায়া জায়গায় সরে পড়লো। তবে নিজের কক্ষে গেল না। ওই বদ্ধ ঘরে থাকতে মন চায় না। সে পারবে না থাকতে। একা একা জীবনে অনেক বছর কাটিয়েছে। তবে প্রকৃতি ছাড়া সৃজনশীলতা ছাড়া শূন্য অনুভূতি নিয়ে একা থাকতে পারবে না। চার দেওয়ালে বন্দী থাকার ছেলে নয় সে।
একা একা বসে প্রকৃতির নির্জনতা অনুভব করছিল। এ বাড়ির কাউকে সকাল থেকে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো সবাই কাজে ব্যস্ত। খিদে পাচ্ছে। মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর লীলা কোথা থেকে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। শরীর পুনরায় ব্যাথায় টনটন করে উঠল। সে তার কোলে উঠতে চাইলো। বাধা দিতে পারলো না। ছোট মেয়ে তার উপরে এক মাস তাকে আটকে রাখা হয়েছে আর সম্ভব নয়। যদিও গতকাল ডাক্তারবাবু নিশ্চিত করেছেন সে এখন সবার সাথে স্বাভাবিক ভাবে মিশতে পারে। সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর কোনো অসুবিধা নেই। তাকে কোলে তুলে নিতেই নিজের ছোট নরম হাত দিয়ে মুখের পিম্পল গুলো টেপার চেষ্টা করল। বাঁধা দিলো। বাঁধা পেতেই তার কৌতুহল যেন আরও বেড়ে গেল। খিলখিল করে হাসলো। যে কোনোভাবে সবুজকে পাকড়াও করতে চাইলো। সবুজ এমনিতে কারোর উপর রাগ দেখাতে পারে না, এই ছোট মেয়ের উপর তো একদমই না। সেও বাচ্চা মতো হেসে ফেললো। আর এই হাসি লীলার মন জয় করে নিল। শান্ত হলো। অদুরে কণ্ঠে বলল,’তুমি এত দিন বাইরে আসোনি কেন? আমি অনেক বার তোমার কাছে আসতে চাইছিলাম মা আসতে দেননি।’
‘আমার অসুখ হয়েছিল তো তাই।’
‘অসুখ হলে কি মানুষ মারা যায়?’ দ্রুত জবাব দিতে পারলো না সবুজ। লীলার এমন প্রশ্নে একটু কুন্ঠা বোধ করল। তাকে আরও কাছে নিয়ে থুতনি ধরে বলল,’অসুখ হলে মানুষ মরে না। ডাক্তার রয়েছে তো। চিকিৎসা করলে সুস্থ হয়ে উঠে।’
‘ওওও, আচ্ছা।’ লীলা খুশি হলো কিন্তু সবুজ খুসি হতে পারলো না। এইটুকু মেয়ের মধ্যে মৃত্যুর ভয় দেখে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না। শিশুদের কাছে এই শব্দের অর্থ যদি গোপন রাখতে পারা যায় তাহলে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বহীন শৈশব কাটাতে পারবে।
ও-দিকে বৌদিমণি লীলার নাম ধরে বারবার ডেকে চলেছে। সবুজ তাকে সাড়া দিতে বলল কিন্তু সে দিল না। চুপটি করে কোলে বসে রইল। মজা পেলো। এমন মজা সবুজের ভালো লাগলো না। বারবার বলার সত্বেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। চুপচাপ রইল। খুব মজা পাচ্ছে লীলা। এমন পরিস্থিতিতে সে কি করে মজা অনুভব করছে বুঝতে পারল না। অন্যদিকে বৌদিমণি খুঁজেই অস্থির। লীলাকে আবার একবার বলল সাড়া দিতে। দিল না। শেষ পর্যন্ত সবুজ জোরে একটা হাঁক ছেড়ে বলল তার কাছে রয়েছে। সে তখনই তাদের কাছে দৌড়ে আসলো। হাঁপিয়ে পড়েছে। চটপট সবুজের কোল থেকে লীলাকে তুলে নিলো। লীলা তখনও হাসছে। তার পিঠে হাত চাপড়ে বলল,’এখনে চুপটি করে বসে আছো অথচ আমার ডাকে সাড়া দিতে পারছো না।এমন কেন তুমি? সবসময় এমন বদমাইশ না করলে হয় না? কত চিন্তা হচ্ছিল বল তো?’ লীলা উওর দিলো না। ফিরে যাওয়ার সময় সবুজকে লক্ষ্য করে বলল,’তুমিও কেমন ছেলে? ততক্ষণ থেকে ডেকে যাচ্ছি আর সাড়া দিচ্ছ এতক্ষণ!’ সবুজ মাথা নীচু করে রইল। বেশ ঘেমে গেছে বৌদিমনি। কিছু একটা হারানোর ভয়ে ঝড়ের মত কাঁপতে কাঁপতে সেখান থেকে চলে গেল।
ক্ষণিকের মধ্যে অনুশোচনায় ডুবে গেল সবুজ। তার উচিত হয়নি চুপ করে বসে থাকা। মায়ের মন বড় ব্যাকুল। সন্তানকে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে ফেলেছিল। নিজের মায়ের কথা মনে পড়লো। মা কি তাকে হারিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে ফেলেছেন? ভালো আছেন তো? তার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটাল কাজল। সে কাছে পড়ে থাকা একটা চেয়ার টেনে এনে পাশে বসলো। হাতে খাবারের থালা রয়েছে। থালাটা চেয়ারের উপর রেখে চলে গেল। আবার দ্রুত জলের মগ নিয়ে ফিরে আসলো। খাবারের থালা তুলে চেয়ারের উপর বসলো। তার দিকে তাকিয়ে বলল,’এত কী ভাবছো? কোনো নতুন কবিতা না গান?’ সবুজ জবাব দিল না। কাজল বলল,’খাবার খাও। অনেকক্ষণ না খেয়ে আছো। বড় হয়েছো কেউ খেতে দিলে খাবে না হলে খাবে না? খিদে পেলে খাবার খেতে হয়, এতে লজ্জা কিসের?’ সবুজ হাসলো। চাদর আবার গায়ে দিল। হালকা শীত করছে।আজ আর কাজল খাইয়ে দিল না। নিজের হাতে খেতে হলো। তাতেই হালকা অভিমান হলো। মৃদু হেসে কাজলকে জিজ্ঞেস করল,’তোমার কোনো বন্ধু বান্ধবী নেই?’
‘আছে তো।’
‘কোনো দিন দেখলাম না তো। তুমি কি বারণ করেছো তাদেরকে তোমাদের বাড়িতে আসতে?’
‘আসলে নিজের মতো করে কোনো মানুষ খুঁজে পাইনি।তাই আমার পরিচিত সংখ্যা বেশি হলেও বন্ধুর সংখ্যা খুব কম।’ সবুজ এক বিজ্ঞ ব্যক্তির মত মাথা নাড়ালো। বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলল,’জানো, আমারও তাই। আমার মাত্র দুটো বন্ধু কিন্তু তাদের ভাবনার সাথে আমার ভাবনার একটাতেও মিল নেই। কি করে যে বন্ধু হলাম বলতে পারবো না। তবে খুব মিশ করি। সূর্যময় খুব বদমাইশি করে। মারপিট আর ঝগড়া করায় ওস্তাদ। আমাকে আর সংকেতকে কেউ কিছু বললে তার রক্ষে নেই। আর সংকেত! ও খুব কাঁদুনি ছেলে। সামান্য কিছুতেই কষ্ট পায়। কেঁদে ফেলে। আমাদের তিনজনের মধ্যে তিনজনের পৃথক পৃথক নিজস্বতা রয়েছে আর আমারা নিজেদের নিজস্বতাকে আঁকড়ে ধরে বন্ধুত্বটা টিকে রেখেছি।’
‘এক সঙ্গে থাকবে তো সারাজীবন?’
‘থাকবো না কেন?’
‘ওই যে বললে ‘বন্ধুত্বটাকে টিকে রেখেছি’ কথাটির মধ্যে কেমন একটা চটচটে ব্যাপার রয়েছে। তাই বললাম।’ সবুজ পুনরায় নিজের পূর্ববর্তী বাক্যটি মনে করলো। অনেকবার উচ্চারণ করলো। কিন্তু তেমন কোনো অমূলক শব্দ খুঁজে পেল না। তবে কাজলদির কেন এমন মনে হল? মনের সংকোচন দূর করতে পারল না। একটু নিরাশ হয়ে সামান্য প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’আমার এই তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকেতকে ভালো লাগে। ওর ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ আলাদা। ওর মধ্যে ওর বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়। খুব সুন্দর সহজ সরল একজন মানুষ। উনি আমাকে খুব ভালোবাসেন। কত সময় আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি। তিনি আমাকে কিংবা সূর্যময়কে উভয়কেই নিজের ছেলে ভাবনেন। নিজের ছেলের মতো আদর যত্ন করেছেন। আমি ওদের বাড়িতে গেলে না খেয়ে কখনও ছাড়েননি। অথচ তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তাঁদের বাড়িতে মাংস হলে দুজনকে নেমন্তন্ন করতে ভুলে না। সূর্যময়ের বাড়িতেও তাই। কিন্তু আমার বাড়িতে তেমন নয়। মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় আমি যেন মরুভূমির মধ্যে থাকি। চারিদিকে শুধু বালি আর বালি। মাঝেমধ্যে মরুদ্দ্যান দেখা যায় কিন্তু পরে হতাশ হতে হয়।’ কাজল প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। তার মনোযোগ হারিয়ে গেছে। আরও অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও বলল না। থেমে গেলো। কাজলকে দেখে বোঝা গেল সে তার কথা শুনতে আগ্রহী নয়। তার খাওয়া শেষ হতেই কাজল উঠে পরল। একটা হাসি বিনিময় করে বলল,’নিজের ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। পরে আসবো।’ সবুজ মাথা নাড়ালো। কাজল তরতর করে নিজের গন্তব্য চলে গেল।
সদ্য দাড়ি-গোঁফ সেভ করতে শুরু করেছে সবুজ। জীবনে প্রথমবার সেভ করে আয়নার সামনে নিজের মুখ দেখে হেসে ফেললো। বসন্তের পর মুখের কালো কালো দাগগুলো বর্তমানে সম্পূর্ণ উবে গেছে। পুরনো রূপ যৌবন ফিরে পেয়েছে। গালে হাত রেখে হেসে উঠলো। খুব মসৃন আর নরম। তাকে বাচ্চার মতো দেখাচ্ছে। কি অপূর্ব লাগছে! তরুণের লাবণ্য সারা শরীর জুড়ে ঝরে পড়ছে। এই রূপ কত কিশোরীকে মুগ্ধ করেছে। এখনও মুগ্ধ করে। নিজেকে দেখে ভেতর থেকে সুখ অনুভব করল। এমন সুখের সাথে পরিচিত নয় সে। নিজেকে নিয়ে গর্ব হল। ঈশ্বরের দেওয়া রূপে সে নিজেকে আলোকিত করে তুলেছে। সবার সামনে প্রশংসায় ভাসে। সবুজ হঠাৎ খেয়াল করল দরজায় কাছে কেউ উঁকি মেরে তাকে দেখছে। কে হতে পারে? নিজের ধারালো বুদ্ধি কাজে লাগালো। আয়নাটা একটু উল্টো করে দেখতেই স্পষ্ট বোঝা গেল। এ যে সাথী। তবুও বিশ্বাস হলো না। চোখে যেন ঝাপসা দেখছে। ভালো করে দেখলো। ভুল কিছু দেখেনি। ফুটফুটে কিশোরী সাথীই রয়েছে। সে মিটিমিটি করে হাসছে। কিন্তু এখানে কি করে এলো? তার তো এখানে থাকার কথা নয়। দু’মাস আগে হোস্টেলে চলে গেছে। এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা নয়। তাছাড়া সে যে বাড়িতে আসছে তাও কেউ জানায়নি। সবুজ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলো না। নিজেকে নিয়ে মত্ত রইল। সামান্য অসুখের জন্য সে তাকে ত্যাগ করেছিল। একবারের জন্যও তাকে দেখতে আসেনি। শহরে চলে যায়। আজ আবার আদিখ্যেতা দেখাতে এসেছে। যদিও মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়েছে। সবার সামনে কথা বলায় তেমন কিছু বলতে পারেনি। ভালোমন্দ কয়েকটা কথা বলে রেখে দিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর সাথী নিজে থেকে কথা বললো।
‘এই যে বোকা ছেলে, শুনতে পাচ্ছো? এদিকে তাকাও। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’ সবুজ নিয়ম রক্ষার স্বার্থে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল। তবে কোনো মন্তব্য করলো না। সাথী এবার নিজে থেকেই ভেতরে চলে এলো। কাছে এসে ঠোঁট টিপে হেসে বললো,’আমায় চিনতে পারছো না?’
‘কেমন আছো?’ সবুজের পাল্টা প্রশ্নে বিব্রতবোধ করল সাথী।
‘এ কেমন কথা? তোমাকে ততক্ষণ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করছি উত্তর দিচ্ছ না। উল্টে আমায় প্রশ্ন করছো?’ সবুজ জবাব না দিয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে বসল। সাথী পেছনে পেছনে গেল তবে বিছানায় উঠলো না। রাগ করে বললো,’কথা বলতে যদি ইচ্ছে নেই তাহলে বল আমি চলে যাচ্ছি।’ সবুজ এবার নড়েচড়ে বসলো। হাসলো। সে মানুষ। স্বাভাবিকভাবে তার রাগ হয়। কিন্তু নিজের রাগ কাউকে দেখাতে পারে না। সে কোনো কিছু হারাতে চায় না। সামান্য কিছু পেয়ে হারিয়ে গেলে সে-ই কষ্টে রাতে ঘুমোতে পারে না। তাই খুব সহজেই সকলের প্রতি নরম হয়ে যায়। সাথীর মুখেও এবার হাসি ফুটে উঠল। সে এক লাফে বিছানায় উঠে গিয়ে বসলো। তার নাক টিপে দিয়ে বলল,’আমায় মনে পড়তো?’
‘খুব।’
‘কেন মনে পড়তো?’
‘তা তো জানি না।’
‘তাহলে কি জানো?’
‘এই যে তোমায় মনে পড়তো। খুব দেখতে ইচ্ছে করতো।’
‘সত্যি!’ মুহুর্তের মধ্যে আবেগপ্রবণ হয়ে পরলো সাথী। লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে সবুজ। তার থুতনি তুলে ধরে বললো,’দেখো,আমায় ভালো করে দেখো। যতখুশি দেখো কেউ বারন করবে না।’ সবুজ হালকা মুখ উঁচু করে দেখতে রইল। একটু একটু করে লজ্জা কোথায় হারিয়ে গেল। বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকলো। কি মায়াবী তার রূপ! চোখ গুলো কত সুন্দর! পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য যেন তার মুখে আটকে রয়েছে। নরম মুখশ্রীতে কৌতুহল মাখা স্নেহ আবেগ ছুঁয়ে গেছে। কি মৃন্ময়ী রূপ! চোখ ফেরাতেই ইচ্ছা করছে না। সে আর আগের মতো অগোছালো নয়। বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। পোশাকেও পরিবর্তন এসেছে। এ ভাবে কিশোরীর দিকে তাকাতে তাকাতে তার কিছু লাইন মনে পড়লো। মনের মধ্যে লাইনগুলো উচ্চারণ করলো। সে মূহুর্তের মধ্যে ভুলে গেল তার পাশে কেউ বসে আছে। তার সাথে সময় কাটাতে চায়। হঠাৎ করে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ায় সাথী বিরক্ত হলো। তাকে নাড়িয়ে বলল,’কি হলো? এমন উত্তেজিত হয়ে পড়লে কেন?’ সবুজ কোনো কারন ছাড়াই তার উপর বিরক্ত হল। বলল,’এখান থেকে যাও। আমার কাজ আছে।’
‘ও মা! কি এমন কাজ যা আমার সামনে করা যাবে না।’
‘যাও না। একটু তো। পরে আবার চলে আসবে।’ সাথী হাসিমুখে ঘর থেকে বেরিয়ে আসলো ঠিকই তবে খুশি হতে পারলো না। কত কথা ছিল কিন্তু বলা হলো না। সে তো মাত্র একদিনের জন্য বাড়িতে এসেছে। পৌঁছে প্রথমে বাবা-মার কাছে না গিয়ে তার কাছে এসেছিল। আর সে তাকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে দিল। এদিকে সবুজ ভীষণ খুশি। সে সাথীর রুপ দেখে কিছু নতুন শব্দ খুঁজে পেয়েছে। শব্দ গুলো জড়ো করে একটা কবিতা লিখে ফেলল।
কে তুমি, এসেছো মোর দোয়ারে?
পূর্ণিমার চাঁদ কপালে কালো টিপ লাগিয়েছে,
তাই ভীষণ অন্ধকার।
কে তুমি, অঙ্গে জড়িয়েছো শাড়ি?
শালিকেরা ভেঙ্গেছে আড়ি,
তাই অসময়ে এসেছে বসন্তের রাত্রি।
কে তুমি, ঝিঙ্গে ফুলের স্বপ্ন?
কোকিল ডাকছে বনে,
শোনোনি,পাতার ঝরার শব্দ।
কবিতাটি বারবার পড়লো। মনঃপূত হতে পারলো না। কোথাও যেন খামতি রয়েছে। আবার পড়লো।দু-একটা শব্দ বাদ দিল। পাগল পাগল অবস্থা। কারোর উপস্থিতি অনুপস্থিতি টের করতে পারল না। স্বাভাবিক জগতের বাইরে পৌঁছে গেছে সে। যে জগতে কারোর স্থান নেই। শুধুমাত্র সে আর কতগুলো কাল্পনিক চরিত্র বিদ্যমান।
অভিমানী সাথী সারাটা দুপুর অপেক্ষা করে কাটাল। ভেবেছিল সবুজ নিজে থেকে এসে দেখা করবে। অপেক্ষা বৃথা গেছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যায়। তবুও তার আগমনের কোনো বার্তা নেই। দুপুরে খাওয়ার সময় তার দেখা পায়নি। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। অনেকটা পথ এসেছে শরীর ক্লান্তিতে ভরপুর তবুও ঘুমোতে পারলো না। ছটফট করল। সবুজের কাছে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু সে তার সুখচরকে ধ্বংস করতে চাইল না। জানে, সবুজ গল্প লেখায় বদ্ধ পাগল। ওই সময়ে কাউকে সহ্য করতে পারে না। সে সত্যিই পাগল। তীব্র পাগল। সৃষ্টি করার সময় উন্মাদ হয়ে ওঠে। নিজে থেকে শান্ত হলে ফিরে আসবে -এই আশায় তখন ফিরে এসেছিল। কিন্তু সময়টা যে এতটা দীর্ঘ হবে তা ভাবতে পারেনি। চোখ দুটো অভিমানে ঝিমিয়ে পড়লো। এমনটা কেন করছে সে? সে যে শুধুমাত্র তার সঙ্গে কথা বলার জন্য বাড়িতে এসেছিল। আর ও তাকেই সরিয়ে দিল? কেন বুঝে না সে? তার অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটলো দীর্ঘসময়ের পর। সবুজ তার ঘরে আসলো রাতের খাবার খাওয়ার কিছু মুহূর্তের আগে। এতক্ষণে নিজের রাগ অভিমান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। শূন্য অনুভূতি নিয়ে বসে আছে। দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। সবুজের উপস্থিতি টের করতে পারেনি। সবুজ চুপিচুপি তার কাছে গিয়ে বসলো। ঠেলা দিয়ে তুলল। চোখে ঘুম নেই হাসিও নেই। নির্বোধের মতো সবুজের দিকে তাকিয়ে রইল। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। দু-একটা চুল মুখে এসে পড়েছে। কৌতুহলী হয়ে কথা বলার মত আগ্রহ নেই। এ যেন পূর্বের সাথী নয়। তার চঞ্চলা মন যন্ত্রণায় পূর্ণ হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে।
‘এত করুন লাগছে কেন?’
‘কই? আমি তো ঠিক আছি।’
‘তোমার মুখের ভাষা তো বড্ড শুষ্ক। কি করে বলছো ঠিক আছো?’
‘আচ্ছা সবুজ, জীবন মানে কি শুধুই লক্ষ পূরণ? আর কিছু নেই?’
‘কি হয়েছে তোমার? এমন কথা বলছো কেন?’
‘মনে হলো তাই বললাম। উত্তর দাও?’
‘না, জীবন মানে শুধু লক্ষ্যপূরণ নয়। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্ব নেওয়াও জীবন।’
‘আর অন্যকে ভালো রাখা….?’
‘আমার কাছে জীবনের সংজ্ঞা এটুকুই, -নিজের লক্ষ্য পূরণ আর নিজেকে ভালো রাখা।’
‘তোমার এই কথার সঙ্গে আমি একমত হতে পারলাম না। আমার কাছে জীবন মানে তো সবকিছু। শুধুমাত্র লক্ষ্যপূরণ কিংবা নিজেকে ভালো রাখার মধ্যে জীবন সীমাবদ্ধ নয়।’ সাথী ধীরে ধীরে তার কাছে সরে আসলো। চঞ্চলা মেয়েকে এত শান্ত হয়ে ধীরে সুস্থে কথা বলতে দেখে একটু অবাক হলো সবুজ। কিশোরী বয়সটা হঠাৎ করে যেন পার করে ফেলেছে। কি হয়েছে তার? ক’দিন আগেই তো তার অনেক কিছুতে ধারণা ছিল না। মাত্র কয়েকদিনে সে যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক কিছু জেনে গেছে। সাথী আস্তে করে সবুজের কোলে মাথা রেখে হাঁটু দুটো গুটিয়ে শুয়ে পরলো। হাঁটু দুটো এতটা গুছিয়েছে যে থুতনিতে লেগে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর সাথী নিশ্চুপ কন্ঠে বলল,’জানতে চাইলে না তো আমি কেন এসেছি?’
‘নিশ্চয়ই কিছু দরকার ছিল।’
‘না, আমি শুধুমাত্র তোমার সঙ্গে দেখা করবো বলে এসেছি। কাল সকালেই ফিরে যাবো। ভালো লাগছিল না কিছু। জানো তো শহরের মানুষের সাথে তুমি সম্পূর্ণ পৃথক। আমি বুঝতে পারি না কারা সঠিক, তুমি না তারা? এতগুলো মানুষ কি ভুল হতে পারে? তাদের ভাবনা চিন্তা হাবভাব কত আলাদা। কতটা এগিয়ে গেছে তারা।’ সাথীর কথাগুলো শুনল। তবে উত্তরটা খুব সংক্ষিপ্ত দিল।
‘কিছুদিন থাকলে হবে না? কালকে চলে যেতে হবে?’
‘তুমি যদি বলো তাহলে বিকেল পর্যন্ত থেকে যেতে পারি।’
‘তাহলে থেকে যাও।’
‘আচ্ছা।’
‘আবার কবে আসবে?’
‘যবে তোমায় দেখতে ইচ্ছে করবে।’
‘আর যদি না করে?’
‘এমনটা কোনদিন হবে না।’
আবার নিস্তব্ধতা। নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে সাথী বলল,’একটা চুমু দেই তোমায়?’
‘না।’
‘কেন?’ সবুজের উত্তর পাওয়ার আগেই সে আবার বলে ফেলল,’ও বুঝেছি। এতে তো পাপ হয়। তুমি জানো, আমার যে রুমমেটরা রয়েছে তারা তাদের বয়ফ্রেন্ডের সাথে কত গোপনীয় কথা বলে। দেহের গোপনীয় অংশ দেখাতে সংকোচন করে না। প্রথম প্রথম ভাবতাম তারা ভুল করছে। কিন্তু পরে আরও অনেক বান্ধবীর মুখে আরও অনেক গল্প শুনলাম। তারা তো আমার রুমমেটের চেয়ে আরও এগিয়ে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী যে সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ হয় তারা বিয়ে না করেও সে-ই সম্পর্কে চলে গেছে। আচ্ছা তারা এমনটা কেন করে? শুধু কি আবেগ? না কি পারিবারিক সঠিক শিক্ষার অভাব? না অন্য কিছু?’ একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে থেমে গেল। বিপরীত মানুষটার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে উঠে বসলো। সবুজকে দেখে অবাক হলো। কানে হাত গুজে বসে আছে। বেশ আশ্চর্য হয়ে বলল,’ও মা, তুমি এই এইভাবে কানে হাত গুজে বসে আছো কেন?’ সে ঠিক শুনতে পেলো না। সাথী হাত টেনে আনলো।
‘কি হচ্ছে কি? আমি যে এতগুলো কথা বললাম তার কোনো গুরুত্ব নেই বুঝি?’
‘তুমি তো কি সব খারাপ কথা বলছিলে।’
‘খারাপ কথা! যা সত্যি তাই বলছিলাম।’
‘সত্যি হোক বা মিথ্যা ওই সব কথা গুলো ভালো না। আমি শুনতে চাই না।’ সাথী সবুজের মাথায় চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,’তুমি সত্যি বোকা ছেলে। সমাজ এগোচ্ছে আমাদেরও এগোতে হবে। বোকা হলে চলবে না।’
‘আমি বোকা কি জানি না। তবে সমাজের সমস্ত কিছুকে মেনে নিতে পারবো না। যদি সমাজের সমস্ত কিছুকে মেনেনি তাহলে তো আমি অন্ধ হয়ে যাব।’
‘বুঝতে পারছো না সবুজ। তুমি বেশি মানুষের সাথে মেশ না তাই অভিজ্ঞতা কম। বাস্তব পৃথিবীটা জানার চেষ্টা করো। বুঝবে পৃথিবীত আসলে কি?’
‘আমি ঈশ্বরের আনুগত্য হতে চাই। আমি ঈশ্বরের দেখানো পথে যেতে চাই। সৎ পথে জীবন অতিক্রম করতে চাই।’
‘বাস্তবে ঈশ্বর বলে কি কিছু রয়েছে?’
‘কি সব প্রশ্ন করছো?’ সবুজ এবার উত্তেজিত হয়ে পড়লো। সে ভুত-প্রেত, অন্ধ-বিশ্বাস, কুসংস্কার বিশ্বাস করে না ঠিকই তবে ঈশ্বরের বড় ভক্ত। সব সময় ঈশ্বরের আনুগত্য থাকে। তাইতো প্রতিটি কাজের পূর্বে পাপ-পূর্ণের কথা ভাবে। যে কাজ করলে মনে হয় পাপ করবে সেটা কখনোই করে না। মিথ্যা কথা, খারাপ কাজ, অন্যায়,অসহিষ্ণুতা,হিংসা এগুলো ঈশ্বরের প্রকৃত ভক্ত কখনও করতে পারে না। তাই সে সবসময় এগুলো এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজ যখন ঈশ্বরের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তখন সে নড়েচড়ে বসল। এত দূর পড়াশোনা করলেও এমনটা সে কখনও ভাবেনি। তার বিশ্বাসে কেউ আঘাত করুক তা চায় না সে। তাকে নিশ্চুপ দেখে সাথী বলল,’বল? ঈশ্বর রয়েছে কিনা?’
‘অবশ্যই রয়েছে।’
‘আমি বলবো নেই। আমরা হিন্দুরা ভাবি এই পৃথিবীতে সব কিছুই ভগবান সৃষ্টি করেছেন, মুসলমানরা ভাবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন, খ্রিস্টানরা ভাবে গড সৃষ্টি করেছেন, বৌদ্ধরা ভাবে গৌতম বুদ্ধ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ইতিহাস আর ভূগোল ঘাটলে জানতে পারবে পৃথিবীতে সমস্ত ধর্ম গ্রন্থ সৃষ্টির পূর্বেও পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল। এবার বল, সে সমস্ত প্রাণ সর্বপ্রথম কে সৃষ্টি করেছেন?’ সবুজ কিছুক্ষণ চুপ করে গেল। নিজের যুক্তিগুলোকে সুসজ্জিত করলো। তারপর বলল,’তাহলে তুমিই বল কে সৃষ্টি করেছে?’
‘প্রকৃতি। চার্লস ডারউইনের মতবাদই সঠিক। এ পৃথিবীতে ঈশ্বর কিংবা মহাশক্তি বলে কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষকে সৃষ্টি করেছে আর একদিন প্রকৃতিই মানুষকে শেষ করবে।’ সবুজ সাথীর তীক্ষ্ণ বিজ্ঞান সম্পন্ন জ্ঞান দেখে অবাক হলো। তার যে সাহিত্যের প্রতি আদৌ ভালোবাসা নেই আগে থেকে জানতে পেরেছিল। বিজ্ঞান পড়তে তার ভালো লাগে। বিজ্ঞান চর্চায় সবসময় মত্ত থাকে। নানা ধরনের বিজ্ঞান বই পড়ে। সেগুলো রপ্ত করে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছে। আর বিজ্ঞানের যুক্তি তর্কের কাছে ঈশ্বরকে অনেকবারই হারতে হয়েছে। সবুজ গলা খাঁকরে জবাব দিল, ‘তোমার কথায় যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। কিন্তু কখনও মন থেকে মানতে পারবে না। আর যখন মন থেকে মেনে নেবে তখন তোমার সমস্ত কিছুতে অনীহা চলে আসবে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য বিজ্ঞান আর ঈশ্বর দুটোই প্রয়োজন।’ সাথী কোনো জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নাড়ালো। তার মাথা নাড়ানো ইঙ্গিত করে সেও মনে মনে ঈশ্বর বিশ্বাস করে। শুধু বিজ্ঞানের যুক্তি তক্কো কাছে ঈশ্বরকে বড় করতে পারে না।
পরের দিন বিকেলে সাথী চলে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। চলে যাওয়ার পূর্বে সবুজ ঘরের সামনে এসে উঁকি দিল। তাকে দেখতে পেয়ে খুব হাসলো সবুজ। কাছে ডাকলো। গুটিগুটি পায়ে তার কাছে গিয়ে জড়ো হয়ে বসলো। লজ্জায় মুখ নীচু করে আছে। ফুটফুটে মেয়েটা বেশ সেজেছে। কপালে লাল টিপে দারুন দেখাচ্ছে তাকে। রূপে মোহিত না হয়ে পারল না সবুজ।
‘তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। তাকাও আমার দিকে?’ জবাব দিল না সাথী। মুচকি হাসলো।
‘এই মেয়ে, তাকাও আমার দিকে!’
‘বা রে,আমার বুঝি লজ্জা করে না?’
‘তাকাতে আবার লজ্জা করবে কেন?’
‘তুমি তো পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের দিকে তাকাতে মেয়েদের লজ্জা করে।’
‘সত্যি!’
‘তুমি কিছু জানো না! বোকা ছেলে একটি। আমি আসছি। মা খোঁজ করবেন আবার।’
‘আবার কবে আসে?’
‘কালকেই তো বললাম।’
‘ফোন করবে তো।’
‘আমাকে দেখার জন্যে এত উতলা কেন?’
‘তোমাকে না দেখলে মনে হয় আমার অসুখ হয়েছে।
ক্লান্ত শরীরে বিছানায় পড়ে আছি। ভালো লাগে না কিছু।’ সাথী খিলখিল করে হাসলো। হাসির শব্দ দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসলো বারবার। বলল,’আসবো। খুব তাড়াতাড়ি আসবো। ভালো থাকবে। তোমাকে না দেখলে আমারও ভালো লাগে না। কেমন একটা অস্বস্তির মধ্যে প্রহর গুনতে হয়।’ সাথী দৌড়ে চলে গেল। সবুজ মুগ্ধ হলো। এই কিশোরীর মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যা তাকে চুম্বকের মতো বারবার কাছে টেনে আনে। কোথায় হারিয়ে যায় সে। নিজের সমস্ত ভাবনাচিন্তার বিসর্জন দিয়ে দেয়। সবকিছু উল্টোপাল্টা লাগে।
সাথীর যাওয়ার গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পরও সবাই কিছুক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইল। মহিলাদের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগলো না সবুজের। সে ফিরে এল। ফেরার পথে পায়ে কিছু একটা আঘাত পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। মাটির দিকে তাকাতে দেখতে পেল একটি কালো রংয়ের রশ্মি তাতে ছোট একটা হাতির দাঁত আর একটা লকেট রয়েছে। চিনতে অসুবিধা হলো না। এটাতো লীলার গলায় সবসময় থাকে। এখানে পড়ে আছে কেন? নিশ্চয়ই মেয়েটা হারিয়ে ফেলেছে। মায়ের কাছে বকুনি খাবে। সেটা তুলে নিল। পাশ ঘুরে দেখল নীলা আশেপাশে কোথাও নেই। এইটুকু বাচ্চা মেয়ে কোথায় গেল? বাড়ির সবাই এখানে রয়েছে। সে কোথায় গেল? দাদুর কাছে রয়েছে? সেখানে এসেও হতাশ হলো সবুজ। এবার একটু ভয় করল। বাড়ির সকলেই ব্যস্ত রয়েছে,সবাই একটু মনমরা -লীলার উপস্থিতি অনুপস্থিতি অতটা গুরুত্ব পায়নি। এই ফাঁকে কোথাও চলে যায়নি তো? ‘লীলা’ ‘লীলা’ বলে ডাকলো। কোনো সাড়া পেল না। সে বড্ড দুষ্টু আছে। ডাক শুনলেও সাড়া দেয় না। ঘাপটি মেরে বসে থাকে। মজা পায়।এর আগে বহুবার এমন হয়েছে। সবুজ কাকুতি-মিনতি করে বলল সাড়া দিতে। কোনো সাড়া দিল না। বাড়ির আশেপাশের সব জায়গার খোঁজার পর কাজলকে গিয়ে বলল। মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির সকলের কাছে খবর পৌঁছে গেলে। একটা হুলুস্থূলুস ব্যাপার। বাড়ির চারপাশ ছেড়ে আশেপাশের গ্রামে তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো কিন্তু কোথাও লীলাকে পাওয়া গেল না। অর্চনা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনি। কান্নাকাটি করে মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। কেউ তাকে স্থির করতে পারছে না। এইটুকু মেয়ে কোথায় যাবে? সে হারিয়ে গেছে? না হারাতে পারে না। সন্ধ্যার সময় পুলিশকে খবর দেওয়া হল। পুলিশ এল। তদন্ত চলল। কিন্তু খুঁজে পেল না। একটা মাস পেরিয়ে গেলেও লীলার সন্ধান কেউ দিতে পারল না। বাড়ির পরিবেশ পুরোপুরি শান্ত। লীলার অনুপস্থিতিতে যেন বাড়ির সকলে কঠিন অসুখে ভুগছে। অর্চনা একদম ভেঙে পড়েছে। মেয়েকে হারিয়ে শূন্য সে। সন্তান হারানোর যন্ত্রণা তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে।
পর্ব ০৯ আসছে।।