নিরুদ্দেশ
পর্ব ০৭
____________________
সপ্তাহখানেক হলো সবুজের বসন্ত হয়েছে। যতই একঘেঁয়েমি থাকুক না কেন, দীর্ঘ সময় একা থাকতে পছন্দ করে না সে। কারোর না কারোর সাথে গল্পে মত্ত থাকে। কিশোর বয়সে শান্ত মন বেশিক্ষণ শান্ত থাকতে চায় না। চঞ্চল হয়ে পড়ে। এই একাকিত্বের সময়ে বারবার মনে পড়েছে অতীতের কথা। বাবা-মার মুখ বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। বন্ধুদের সাথে স্বর্ণ মুহূর্তগুলো হারিয়েছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকে প্রত্যেকে কত স্বীয় হয়ে উঠেছে। রুপা দিদি তেমন একটা কথা না বললেও কখনও হীন চোখে তাকে দেখেনি। কিংবা কখনও খারাপ ব্যবহারও করেনি। প্রায় সময় তাকে এড়িয়ে গেছে। বাড়ির সকলের চাইতে সাথী আর কাজলের সাথে একটু বেশি স্বীয় হয়ে পড়েছে। কি করে তিনটা বছর কাটিয়ে ফেলেছে বুঝে উঠতে পারেনি। খুব সহজ-সরল স্বাভাবিকভাবে দিনগুলো বয়ে গেছে। শুধু রেখে গেছে কিছু স্মৃতি। একাকিত্বের সময় স্মৃতিগুলো বার বার মাথায় এসেছে। ক্লান্ত রোগাক্রান্ত শরীরকে স্মৃতিগুলোই সুখ খুঁজে দিয়েছে। বসন্ত যাতে বাড়িতে আর কারোর মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে তাই তাকে একটা ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে। এ-ভাবে বন্দী থাকতে ভালো লাগছে না। প্রকৃতি তাকে ডাকছে। কিন্তু উপায় নেই। বাড়িতে বৌদিমণির ছোট্ট মেয়ে লীলা রয়েছে। বের হলেই তার কাছে ছুটে আসবে। কিশোর বয়স পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে সবুজ। এই বয়সে এমন কঠিন যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না। বাচ্চা মেয়ে কি করে সহ্য করবে? পরিবার এবং নিজের কথা ভেবে কঠিন সময়টাকে মেনে নিয়েছে।সারা শরীরে অসংখ্য প্যাপিউলস বেরিয়েছে। ঘুমোতে পারে না। শরীর ব্যথা করে। চুলকায়। বড্ড অসহ্য লাগে। মাঝেমধ্যে পীড়া সহ্য না করতে পেরে কেঁদে ফেলে বালকের মত। এই অসময়ে রায় পরিবারের সকলেই তার পাশে রয়েছে। তবে তার সেবা সুস্থতা ভালো রাখার দায়িত্বটা কাজল নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নিয়েছে। সে সবুজকে বুঝতে পারে। তার কখন কি দরকার জানে। প্রায় সময় তার কাছে এসে বসে। গল্প করে। এমন অসুখের সময় মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি কাজল। সবুজের খুব মনে পড়ে,কথা বলা শেখার পর প্রথম অসুখের কথা। দীর্ঘদিন ধরে অসুখে ভুগে ছিল। সে-ই সময় মা একেবারে জন্যও তাকে ছেড়ে যাননি। সারাদিন পাশে বসে সেবা করেছিলেন। তারপর থেকে মাকে আর কখনও তেমন আদর যত্ন করতে দেখা যায়নি। হঠাৎ করে বদলে যান। কিন্তু মায়েরা কি আদৌ বদলায়? যদিও তারপর ঈশ্বরের কৃপায় সবুজের তেমন কোনো বড় অসুখ হয়নি। সেজন্য হয়তো তেমন আদর-যত্ন আর পায়নি কিংবা সে বড়ো হয়েছে মা নিজের মতো থাকতে দিয়েছে তাকে। আজ এত বছর পর যখন আবার একবার বড় অসুখে আক্রান্ত হলো, মায়ের সে-ই আদর যত্ন খুব মনে পড়লো। অথচ কাজল যে ভাবে তাকে সেবা সুস্থতা করেছে তা মায়ের আদর যত্নকেও হার মানায়। বড়দিদির মত যা করার কথা তার চেয়ে অনেক বেশি করেছে। তবুও মায়ের অভাব পূরণ করতে পারেনি। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। সবুজ বইয়ের পাতায় পড়েছে, কেউ কখনও মায়ের অভাব পূরণ করতে পারে না। আজ তা অক্ষরে অক্ষরে টের করতে পারছে। এই অবসরে তার চোখ দুটো নোনা জলে ভেজে গেল।
কিছু সময়ের পর দরজা খোলার শব্দ সবুজের কানে পৌঁছালো। কাজল জামবাটিতে নিম পাতা আর হলুদ নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে এসেছে। দিদিকে কিছুতেই নিজের চোখের জল বুঝতে দিল না। মুছে ফেললো। সবুজকে দেখে বড্ড করুণা হল। এই কয়দিনে তার শরীর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। নবীন মসৃণ মুখে এখন পিম্পলে ভর্তি। দীর্ঘদিন কোনো রোগব্যাধিতে ভুগলে মানুষ যেভাবে মুষড়ে পড়ে সবুজ ঐ ভাবে মুষড়ে পড়েছে। শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। ক্লান্ত অসাড় শরীরটা কোনো রকম বিছানায় পড়ে আছে। কাজল পাশে বসল। তারপর সবুজকেও বিছানা থেকে তুলে বসালো। ঝিমিয়ে পড়ছে বারবার।
‘শরীর কেমন আছে?’ সবুজ কন্ঠ প্রসন্নতা লুকিয়ে বললো,’ভালো।’ কাজল গলায় হাত দিয়ে দেখল তাপমাত্রা বেড়েছে কিনা! তাপমাত্রা খুব বেশি বাড়েনি। হালকা জ্বর রয়েছে। বিছানার বেডশীট চাদর বালিশের ওয়াড় বদলে দিল। ঘর ভালো করে পরিষ্কার করল। জানালা দরজা খুলে দিল। এর মধ্যেই সবুজ আবার একবার শুয়ে পরলো। তাকে জোর করে তুলে বসালো। সব সময় শুয়ে থাকলে শরীর আরও বেশি খারাপ করবে। কিন্তু সবুজ বেশিক্ষণ বসতে পারে না। শরীর অসাড় হয়ে আসে। কষ্ট হয়। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কাল থেকে আবার সর্দি কাশি এসেছে। তবুও কষ্ট করে কিছুক্ষণ বসলো। ঘর ভালো করে পরিষ্কার করার পর সে আবার সবুজের পাশে এসে বসল।
‘জামা খোলো।’ সবুজের জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল কাজল। সবুজ এখন আর কাজলের সামনে জামা খুলতে লজ্জা পায় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। এই কদিনে কাজলের আদর-যত্ন পেয়ে মুগ্ধ হয়েছে। কাজল যে এত আদুরে কখনও জানতো না। শুধু আদুরে নয়,সে খুব সৎ আর ভালো মানুষ। মনের মধ্যে কোনো হিংসা কিংবা পাপ নেই। বড্ড উদার। হলুদ আর নিমপাতা লাগালে শরীরে আরাম বোধ হয়। চুলকানি কমে যায়। সবুজ জামা খুলে ফেলতেই চমকে উঠল কাজল। তবে কোনোভাবেই তার উৎকণ্ঠা বুঝতে দিল না। গতকালের তুলনায় আজকে আরও অনেক বেশি প্যাপিউলস বের হয়েছে। লাল হয়ে আছে। কি করে যে সহ্য করছে কে জানে? অস্বাভাবিক দৃশ্যটাকে স্বাভাবিক নিল। রোগী যদি অসুখকে ভয় পায় তাহলে অসুখ আরও বেশি রোগীকে চেপে ধরবে। ব্যাপারটি ঠিক তেমন; সে সেবা সুস্থতা করতে এসে যদি রোগীকে দেখে ভয় পায়,তাহলে রোগীর অবস্থা কেমন হবে? কাজলের মনটা ব্যাথায় টনটন করে উঠল। ছোট ভাইয়ের যন্ত্রণা সহ্য করতে পারলো না। আলতো করে শরীরের নিমপাতা আর হলুদ মাখিয়ে দিল। আরাম বোধ করলো। হলুদ আর নিমপাতা মত কাজলের হাতেও যেন ভেষজ গুণ রয়েছে। ঠিক মায়ের হাতের রান্নার মতো। রান্না যতই খারাপ হোক না কেন মা যদি নিজের হাতে খাইয়ে দেন তাহলে রান্নার স্বাদ আপনাআপনি বদলে যায়। তার হাতের মালিশ শরীরকে বেশ আরাম দিল। তার শরীর আর মন জুড়ে রয়েছে শিল্পের সুষমা। নিস্পলক চোখে তাকিয়ে রইল। উপকরণ মাখানো শেষ হতে বলল,’এ ভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকো। শুয়ে পড়বে না আবার।’ সবুজ মাথা নাড়ালো। তবে বুঝতে পারলো না কাজল ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। তাকে বের হতে দেখে সবুজ চটপট করে বলল,’তুমি চলে যাবে?’ কাজল মুখ ঘুরিয়ে হাসলো। বলল,’হ্যাঁ,কেন? কিছু দরকার?’
‘তেমন কিছু নয়। আসলে একা থাকতে ভালো লাগছে না। একটু কাছে বস। গল্প করবো।’
‘ইস! আজ তো হবে না মনে হচ্ছে। কত কাজ পড়ে রয়েছে।’
‘তোমার আবার কি কাজ? তুমি তো তেমন কোনো কাজ কর না।’
‘জানো না, আজ সাথী কলকাতা চলে যাচ্ছে। সবকিছু গুছিয়ে দিতে হবে। তাকে তৈরি করতে হবে।’ সবুজের বুক ধড়পড় করে উঠলো। সাথী কলকাতা চলে যাচ্ছে! অথচ সে জানে না। এ বাড়ির কেউ তাকে না জানালো… কিন্তু সাথী! সে একবারও তাকে জানালো না। তার অসুখ হয়েছে বলে কাছে আসছে না। একবারের জন্যও কি আসা যায় না? নিশ্চয়ই যাওয়ার আগে দেখা করে যাবে। অতটা আনমনা হবে না। সবুজকে অবাক হতে দেখে বিস্মৃত কন্ঠে কাজল বলল,’কি হলো? আঁতকে উঠলে কেন?’ সবুজ জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল,’কলকাতায় কি করতে যাবে? সঙ্গে কেউ যাবে না?’
‘মা আর দাদা যাবেন। হোস্টেলে সবকিছু ঠিক করে তারা আবার ফিরে আসবে।’
‘হোস্টেল!’ কোনো কথাই মাথায় ঢুকলো না সবুজের। সবকিছু এলোমেলো লাগছে। বলল,’ও মা! এত বড়ো বাড়ি থাকতে হোস্টেলে থাকতে যাবে কেন?’
‘কলকাতা থেকে পড়াশোনা করবে। এখান থেকে নিশ্চয়ই রোজ কলকাতায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাই হোস্টেলে থাকতে হবে।’
‘এই বয়সে হোস্টেলে থাকবে! এ তোমাদের কেমন সিদ্ধান্ত? তুমিও তাতে রাজি হয়েছো? দেখবে দুদিনে উচ্ছন্নে চলে যাবে।’
‘কত ছেলে মেয়ে তো হোস্টেলে থাকে। সবাই কি উচ্ছন্নে চলে গেছে?’
‘অন্যের সঙ্গে তুলনা করে সমস্ত সমস্যার সমাধান হয় না। এই বয়সে বাড়িতে থাকাটাই শ্রেয়। বাবা-মার দেওয়া শিক্ষাটাই আসল শিক্ষা। কোনো বাবা-মাই চায় না তার সন্তানকে কু-শিক্ষা দিতে।’
‘তাহলে একই ভুল তুমিও করেছো। নিজের ভুলটাও দেখো।’ শুকনো হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কাজল। সবুজের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। কাজল কি বোঝাতে চাইছিল বুঝতে অসুবিধা হলো না। সত্যি কি সেও বাড়ি ছেড়ে ভুল করেছে। সে জীবনে ভুল কিংবা অন্যায় করতে চায় না। তবুও কেন অনেকের চোখে নিজের কাজগুলো ভুল হিসেবে প্রমাণিত হচ্ছে! যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে তা অজ্ঞাত কারণে হয়েছে। জেনে শুনে ভুল করেনি। তবুও ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইলো।
দুপুর এক’টা পেরিয়ে গেলেও আজ আর খাবার কেউ আনলো না। এমনটা কোনোদিন হয় না। কাজলদিদি না হয় বৌদিমণি সঠিক সময়ে খাবার নিয়ে আসে। খুব খিদে পেয়েছে। উঠে যেতে পারছে না। সেটুকু শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে। বাড়িতে একটা চাপা আর্তনাদের ভাব রয়েছে বোঝা যাচ্ছে। বারবার দরজার দিকে চোখ রাখলো। আজ কেউ না আসুক তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু একবার সাথী আসুক। তার সঙ্গে দেখা করে অল্প গল্প করুক। একটু ভালোবাসা দিক। তিন-বছরেরও অধিক সময় ধরে তার সঙ্গে থেকেছে খেলেছে মিশেছে কত আবদার পূরণ করেছে কত জায়গায় ঘুরেছে। অন্তত এই খাতিরে সে একবার হলেও আসবে। কিন্তু কিশোর বয়সে কিশোরীর চঞ্চলা মন বোঝা কি এত সহজ? সে আশাহত হলো। সাথী এলো না। কয়েক মিনিটের পর জানালায় চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল। বাড়ির সকলেই সাথীকে বিদায় দিতে ব্যস্ত। সাথী গোলাপি কালারের একটা চুরিদার পরেছে। চুল খোঁপা করে বাঁধা। দুপুরের সূর্যের গরম রশ্মি তার মুখের উপর পড়ে চকচক করছে। বেশ সুন্দর করে সেজেছে। কাঁধে সাদা রঙের ব্যাগ দুপাশে দুটো জলের বোতল। গরমে রোদে না দাঁড়িয়ে সবাই কিছুটা দূরে এগিয়ে গিয়ে গাছের তলায় দাঁড়ালো। কমলা বড়ো বড়ো তিনটে লাগেজ নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিল। আরও একটা লাগেজ অন্তিম দাদা গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে গেল। রায়বাবুর বাদে বাড়ির সকলকেই দেখা গেল সেখানে।কোথা থেকে লীলা দৌড়ে এসে সাথীকে জড়িয়ে ধরল। কিছু সময়ের পর অন্তিম সাথী আর বর্ণালী দেবী গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি আস্তে আস্তে করে চলতে শুরু করলো। সকলের চোখ থেকে দু-ফোঁটা চোখের জল ঝরে পরলো। গাড়ি অদৃশ্য হওয়ার পরও কেউ ফিরলো না। একটু অপেক্ষা করলো। সবুজের চোখও মিটমিট করে উঠলো। চোখের জল কানের গোড়ার দিকে গড়িয়ে গেল। সে আগে থেকেই জানতো, -এ বাড়ির সকলেই মাধ্যমিকের পর কলকাতায় গিয়ে পড়াশোনা করেছে। কাজলই একমাত্র গ্রামের স্কুল এবং কলেজ পড়াশোনা করেছে। এ ছাড়া কেউ গ্রামে পড়াশোনা করেনি। জানে না সাথী পরিবারের চাপে বাইরে গেল না নিজের ইচ্ছায় বাইরে গেল। তবে তার সাথে একবারের জন্যও দেখা না করার খুব অভিমান হয়েছে। কষ্ট পেলো।শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা মিলিত হয়ে এক অদ্ভুত কাঁপুনি হলো সারা শরীর জুড়ে। চোখ বেশিক্ষণ খোলা রইল না। একরাশ দুঃখ-কষ্ট অভিমান নিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। কাজলের ডাকে আবার ঘুম ভাঙলো। বুঝতে পারল বেশিক্ষণ ঘুমায়নি সে। খাবার এনেছে কাজল। পাশে খাবারের থালা রেখে বলল,’আজ অনেক দেরি হয়ে গেল খাবার আনতে। শরীর কেমন আছে?’ সবুজ উত্তর না দিয়ে বলল,’সাথী আবার কবে আসবে?’
‘হঠাৎ বোনের জন্য মন এত উতলা যে!’
‘এমনি এমনি। তেমন জরুরী কিছু নয়।’
‘বোন যাওয়ার সময় দেখা করে যায়নি,তাই অভিমান হয়েছে?’ জবাব দিল না সবুজ। খাবার থালার সামনে নিয়ে গেল। তার মুখ ধুয়ে দিল। নিজে হাতে সবুজকে খাওয়ালো। খাওয়াতে খাওয়াতে বলল,’আসলে তোমার অসুখ হয়েছে তো তাই আসেনি। অনেক বার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। দেখা করতে চাইছিল। কিন্তু বাড়ির সবাই আসতে বারণ করে।’ তথাপি সবুজের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হলো না। চুপচাপ খেয়ে নিল। জিভের স্বাদ নষ্ট হয়েছে। খাবার মুখে লাগালো না। একটুখানি খাবার খেতেই খাবারের প্রতি অনীহা চলে আসলো। সবুজ না খেতে চাইলেও তাকে জোর করে অনেকটাই খাওয়ালো। এইসময় শরীরকে ভেঙে পড়তে দেওয়া যাবে না। পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার চাই। খাওয়ানো শেষ হতেই কাজল তাকে আবার ঘুমিয়ে পড়তে বলল।
‘বিশ্রাম করো। আমি থালা বাসনগুলো রেখে আসছি।’
‘চলে যাবে?’
‘যাব আর আসব। বেশিক্ষণ বাইরে থাকবো না।’
কাজলের কথায় সামান্য হলেও স্বস্তি পেল সে। নিজের কথা রাখলো কাজল। দ্রুত ফিরে আসলো। সবুজ ঘুমায়নি। তার মাথার কাছে বসলো। এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
‘শরীর কেমন আছে?’ একই প্রশ্ন বারবার শুনতে বিরক্ত বোধ করলো। উত্তর দিল না। কাজল অকারনেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।
‘তখন তো কথা বলার জন্য জোর করছিলে..। এখন কি কথা হারিয়ে গেছে? না ঘুম পাচ্ছে? তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো।’ সে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো ঘুম পায়নি। বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। শরীরের ব্যাথাটা সমস্ত ইচ্ছাকে দমিয়ে রেখেছে। করুন কন্ঠে বলল,’এখানে গ্রামের স্কুল গুলো কি ভালো নয়?’
‘কে বলেছে ভালো নয়?’
‘তুমি তো একবার বলেছিলে তোমাদের বাড়িতে কেউ -ই মাধ্যমিকের পর গ্রামের স্কুলে পড়েনি।’
‘কাউকে সম্পূর্ণ না জেনে তার সম্বন্ধে মন্দ বলার অভ্যাসটা আমার নেই। আশেপাশে হায়ার-এডুকেশনের স্কুল নেই। অনেকটা দূরে যেতে হয়। কিন্তু স্কুলগুলো মন্দ নয়। আমাদের পরিবারের ভাবনা চিন্তা গুলো আলাদা। তাঁরা মনে করে ছোট জায়গায় পড়ে বড় জায়গায় যাওয়া যায় না। বড় স্কুলে পড়বে নতুন মানুষদের সঙ্গে মিশবে। নিজেদের ছোট জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। তাই ছুটে বেড়ায়।’
‘তাহলে তুমি বাইরে যাওনি কেন?’
‘আমার মনে হয় না শুধুমাত্র বড় জায়গায় থাকলে বড় মানুষদের সাথে মিশলে বড় জায়গায় যাওয়া যায়। ছোট জায়গা থেকেও বড় জায়গায় যাওয়া যায়। এই দেখো না আমার দাদাও প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু এখন কি করছে? মদ জুয়ার নেশা ছাড়া তেমন কোনো ভালো নেশা তো আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বড় কলেজে পড়েলে কি জীবন বদলে যায়? বদলায় না।’
কাজলের মুখে দামি দামি কথাগুলো শুনতে বেশ ভালো লাগলো। মুগ্ধ হলো। জীবন সম্পর্কে আরও অনেক বেশি অবগত হলো। কতটুকুই বা জানে সে? যতটুকু জানে তার মধ্যে কতটুকুই বা সঠিক? সবুজ কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো কাজল দিদি বসতে বসতে কখন তার পাশে শুয়ে পড়েছে। দ্বিতীয় কোনো বালিস নেই। কনুই বিছানায় ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথার ভর দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু লজ্জা পেল সে। অসুখের সময় সবাই যখন পর হয়ে গেছে সেখানে আপন মানুষটা শুধু কাজল রয়ে গেছে। অসুখ তার কাছে গুরুত্ব পায়নি। ও হয়তো বুঝতে পেরেছে,ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাইয়ে মানুষকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করা যায় না। অসুখ থেকে আরোগ্য লাভ করতে হলে রোগীকে খুশিতে রাখতে হবে। একা ছেড়ে দিলে তার ভয় করবে। ভেঙ্গে পড়বে। শরীরের অসুখ সহজে মুক্ত হতে চাইবে না। অসুখ করলে শুধু ওষুধ নয় রোগীর পাশে থাকতে হবে। তাকে ভরসা জোগাতে হবে। কোনোভাবেই যেন ভেঙে না পড়ে। খুশিতে থাকে যেন সবসময়। অবসাদ যেন না আসে। মাথায় আলতো করে হাত বুলালো। আদর পেয়ে চোখ বন্ধ হয়ে এল। তবুও না ঘুমিয়ে তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাইলো। কাজলদিদির প্রতি এই প্রথম কৌতূহল জন্মালো।,’তোমার জীবনে স্বপ্ন কি? বড়ো হয়ে কি হতে চাও?’
‘কিছু না।’
‘এটা কোনো উত্তর হল?’
‘তোমার পছন্দ না হলে আমার তো কিছু করার নেই। সত্য কথা তো বললাম। আমার কিছু প্রয়োজন নেই। যেটুকু আছে সেটাই অনেক। এর বেশি কিছু চাই না।’
‘বিয়েও করবে না!’ কাজল হাসলো। হাসির ছন্দে বলল,’না, তাতেও আমার আপত্তি আছে। প্রত্যেকের মধ্যে যৌবন আসে যৌবনের উথালপাথাল ঢেউয়ে সবাই হারিয়ে যেতে চায়। সবাই নতুন কিছু চায়। বিপরীত মানুষটার সঙ্গে পরিচিত হয় আগলে রাখে অধিকার ফলায় আর আমরা এর নাম দিয়েছি ভালোবাসো। ভালোবাসা তোমার মধ্যে রয়েছে আমার মধ্যেও রয়েছে পৃথিবীর সকলের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু আমি তেমন স্রোতে পা দিতে চাই না। আমি মা হতে চাই না। প্রতিষ্ঠিত হতে চাই না। কোনো পুরুষের দায়িত্ব নিতে চাই না। কারোর উপরে অধিকার ফলাতে চাই না। সন্তানের জন্য আমি আমার ভালোলাগাটাও বিসর্জন দিতে চাই না। কোনো কিছুর বিনিময়ে আমি আমার আমিটাকে হারাতে চাই না। আমার কাছে আগে আমি তারপর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি। আমি স্বার্থপর। বড়ো স্বার্থপর। আমি পাহাড়ের চূড়ায় থাকতে চাই। নদীর কোলে ঘুমোতে চাই। খোলা মাঠে বাতাসকে জড়িয়ে ধরতে চাই। অন্ধকার ঘরে একা একা বসে চাঁদ দেখতে চাই। আমি গভীর রাতের নির্জনতাকে ভালোবাসি।কালবৈশাখী ঝড়ের পর পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়া লাল টুকটুকে সূর্যটাকে চুমু দিতে চাই। ওই সময় আকাশে উড়তে থাকা ছোট ছোট পতঙ্গকে আঁকড়ে ধরতে চাই। আমার স্বপ্ন এ-গুলোই।’
‘তুমি সত্যি অদ্ভুত মেয়ে। অদ্ভুত রকমের কি সব বলছো।’
‘আজকে জানলে আমি অদ্ভুত!’ দুজনই হেসে উঠলো। বেশিক্ষণ হাতে ভর দিয়ে মাথা রাখতে পারলো না। অবশেষে সবুজের বালিশের কিছু অংশটা নিয়ে নিজের মাথা রাখলো। তারপর বলল,’আচ্ছা আমার কথা বাদ দাও। তোমার কোনো স্বপ্ন নেই?’
‘আমার তো একটাই স্বপ্ন। আমি লেখক হবো। প্রচুর উপন্যাস লিখবো। মানুষের হৃদয়ে নতুন কিছু দিয়ে রঙিন করার চেষ্টা করবো। তারপর বিয়ে করবো। স্ত্রী সন্তান নিয়ে প্রকৃতির মাঝখানে সুখে থাকবো। প্রচুর অবসর সময় চাই। আর এই অবসর সময়ে স্ত্রী,সন্তানের,আর প্রকৃতির সাথে থাকতে চাই।’
‘তুমি খুব জেদী। মাথা নাড়ালে হবে না আমি খেয়াল করেছি। চেষ্টা করো আর এমনভাবে সৎ থেকো ঠিক সফল হবে।’
নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হলো সবুজ। কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে বলল,’আচ্ছা, কেউ তো এখানে আসছে না। কিন্তু তুমি বারবার আসছো,পাশে বসছো,আদর করছো, আমার বিছানায় শুয়ে পড়ছো। তোমার যদি বসন্ত হয়!’
‘হলে হবে। কি আর করার আছে? অসুখ হলে তো মানুষকে ফেলে দেওয়া যায় না। অসুখের সময় যদি রোগীকে ঘৃণার চোখে দেখি তাহলে রোগী আপনাআপনিই ভেঙ্গে পড়বে। ও মানসিক অবসাদে ভুগবে। ওর পীড়া আরও বাড়বে। রোগী শারীরিকভাবে অসুস্থ তাই মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ রাখার দায়িত্বটা পরিবারের সদস্যদের।’
‘ কিন্তু তোমার মাধ্যমে তো অন্যকারোর রোগ ছড়াতে পারে?’
‘তা অবশ্য পারে। তবে আমি সবসময় চেষ্টা করি সাবধানতা অবলম্বন করা। এখান থেকে বেরোলেই স্নান করেনি।’
‘কি লাভ হচ্ছে এত সেবা সুস্থতা করে?কি পাচ্ছ তুমি?’
কাজল তার নাক টিপে দিয়ে বলল,’তোমার মা যদি এখানে থাকতেন তাহলে কি তিনি তোমায় ছেড়ে চলে যেতেন? যেতেন না। সব সময় তোমাকে আগলে রাখতেন। আমি না হয় দিদি হয়ে একটু দেখাশোনা করলাম। তাতে কি তোমার অসুবিধা আছে?’ সবুজ মাথা নাড়িয়ে হাসিমুখে ‘না’ বলল।সময় বয়ে গেল। গল্প করতে করতে এক বালিশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো দুজনে।
সন্ধ্যার সময় সবুজের সাথে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। এ বাড়িতে আসা থেকে রুপা কখনও তার সাথে কথা বলেনি। তাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। তার ভেতরের ভালো-মন্দ কোনোটাই আকর্ষণ করতে পারেনি রুপাকে। অথচ তার অসুখের সময় তার কাছে আসায় একটু আশ্চর্য হল। তেমন কোনো উদ্দেশ্যে যে নেই -তা তার চোখ মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়। সে সোজা সবুজের কাছে গিয়ে বসলো। সবুজ জেগেই ছিল। রুপা হাসি বিনিময় করল। তার দেখাদেখি সবুজও হাসি বিনিময় করল। গায়ের তাপমাত্রা দেখে বলল,’কেমন আছো?’ যথাযথ জবাব দিয়ে থেমে গেল।
‘এই অসুখকে আমরা যতটা সাধারন ভাবি অতটা সাধারণ নয়। অসুবিধা হলে বলবে। বাড়ির কাউকে বলতে না পারলেও অন্তত কাজলকে বল। ও তো তোমার কাছে সব সময় থাকে। তাকে বলতে নিশ্চয়ই ভাববে না। নিজের জন্য কখনও লজ্জা পেতে নেই। প্রয়োজন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ঠিকঠাক খাবার খাচ্ছ তো?’ সবুজ কোনো উত্তর দিল না। সে মুগ্ধ চোখে রুপাকে দেখলো। এর আগে কখনও এত কাছ থেকে দেখেনি। বোনেদের গায়ের রঙের আর দেহের সাথে নিজের অনেকটাই মিল রয়েছে। বয়স হয়েছে তাও বোঝা যাচ্ছে। তবে খুব বেশি শৌখিন নয় রুপা। সাথীর মত অগোছালো। হঠাৎ করে রুপার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মালো। এতদিন কোনো আগ্রহ ছিল না। আজ তার সম্বন্ধে জানতে আগ্রহ হলো। কেউ একটু ভালো ব্যবহার করলে তার প্রতি দ্রুত গলে যায় সবুজ। দয়া হয়। তার মায়ায় ডুবে যায়। যাচাই না করে তাকে ভালো মনে হয়। স্কুলের মাস্টারমশাইয়ের কথা মনে পরল, অনেক সাধারণ সৎ মানুষের মধ্যে ছল লুকিয়ে থাকে। তা ধরতে পারা যায় না। নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য অন্যের কাছে কয়েকদিনের জন্য ভালো সাজতে চায়। রুপা তেমনটা করছে না তো? পরে আবার জিভ কাটল। কি সব ভাবছে? রুপা খারাপ, কি করে জানলো? সে কি তার সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করেছে? কখনও তার খারাপ কাজ চোখে পড়েছে? কোনোটাই হয়নি। শুধুমাত্র কয়জন মানুষের মুখ থেকে শুনেছে রুপা অতটা ভালো নয়। তা থেকে তার প্রতি খারাপ ভাবনা চলে এসেছে। কিন্তু কখনও তাকে নাড়িয়া দেখেনি,সে আদৌ খারাপ কিনা! অন্যের কথায় বিচলিত হওয়ায় তো উচিত নয়। তাকে এত ভাবতে দেখে রুপা বলল,’কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? কি এত ভাবছো?’
‘কিছু না।’
‘সত্যি!’ খুব সুন্দর করে হাসলো। রুপা উঠে গেল না। কিছুক্ষণ তার কাছে রইল। গল্প করলো। প্রথম প্রথম অকারণেই রুপাকে ভয় পেলো। ধীরে ধীরে ভয় দূর হলো। রুপা বড্ড মিশুক মেয়ে। তার যেমন কঠিন মন রয়েছে তেমন সেই মন নরম হতে বেশি সময় লাগে না। কোনো কারণে কিংবা কারোর ব্যবহারে সে একটু বেশি বিরক্ত। তবে তার মধ্যে অহংকার বোধ খুব বেশি রয়েছে -তা তার কথার মধ্যে বারবার ধরা পরল। অস্বস্তি বোধ করলো সবুজ। অহংকার জিনিস খুব খারাপ -আজকাল বাচ্চারও তা বোঝে। অথচ রুপা কেন বুঝছে না কে জানে। তার এই আচরন নিশ্চয়ই আত্মসম্মান কিংবা গর্ব করা বোঝায় না, ওটা অহংকারই।
পরের দিন বিকালে বর্ণালী দেবী এবং অন্তিম ফিরে আসলেন। সাথীর অনুপস্থিতিতে সকলে মনমরা হয়ে থাকলেও তারা ফিরে আসায় একটু স্বস্তি ফিরে পেলো। কৌতুহলী হয়ে পরলো। আগ্রহ প্রকাশ করল সাথীর হোস্টেল, স্কুল এবং কলকাতা শহর সম্পর্কে জানার জন্য। তাদেরকে বিশ্রাম নিতে দিল না। তাঁরাও এই বিষয়ে সবাইকে জানাতে বেশ আগ্রহী। পরিবারের সকলে একসাথে জড় হতেই বর্ণালী দেবী সবকিছু বললেন। শহরের জীবন-যাপন পল্লীগ্রামের থেকে অনেক আলাদা। সেখানে মাটির বাড়ি নেই, মাটির রাস্তা নেই। পিঁপড়ের সারির মতো গাড়িগুলো বিরামহীন ভাবে এগিয়ে যায়। তাদের গ্রামের মতো শহরেও গাছপালা সংখ্যা খুবই অল্প। তবে নির্জনতা নেই। ফাঁকা মাঠ নেই। কংক্রিটের সভ্য সভ্যতা রয়েছে। ওই সভ্যতার এক কোণে রয়েছে সাথীদের স্কুল আর হোস্টেল। তাঁরা সব কিছুই ঠিক করে এসেছেন। একটা রুমে দুজন করে থাকে। রান্না বাদে প্রায় সমস্ত কাজ নিজেকেই করতে হবে। তাতে সাথীর একটু অসুবিধা হবে। হোস্টেল থেকে বাইরে তেমন একটা বের হতে দেওয়া হয় না। ক্যাম্পাসের মধ্যেই সবকিছু সীমাবদ্ধ। বেশ গাইডের মধ্যে থাকবে। হোস্টেলে কোনো ছাত্রীর ফোন রাখার নিয়ম নেই। পরিবারের কারোর সাথে কিংবা অন্য কারোর সাথে কথা বলতে হলে হোস্টেলের ফোন ব্যবহার করতে হবে। এই নিয়মটা একদমই পছন্দ করেনিন বর্ণালী দেবী। এর ফলে তিনি যখন চাইবেন তখন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। অসুবিধায় পড়বেন। তাই তিনি মেয়েকে লুকিয়ে ফোন এনে দিয়ে এসেছেন। মায়ের এমন খামখেয়ালী ব্যবহার সকলে পছন্দ করলেও অর্চনা করলো না। সে বলে উঠলো, এটা তিনি অন্যায় করেছেন। এই বয়সে মেয়ের হাতে মোবাইল দেওয়া উচিত নয়। যেখানে হোস্টেলে ফোন রাখার নিয়ম নেই সেখানে মেয়ের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে তিনি চরম অন্যায় করেছেন। মেয়েকে অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছেন। মেয়েকে ভরসা যুগিয়েছেন আইন ফাঁকি দেওয়ার জন্য। এতেই মনোক্ষুন্ন হলেন বর্নালি দেবী। তিনি আর কিছু বলতে চাইলেন না। রাগ করলেন। বললেন,’আমার মেয়ে, মা হয়ে কি মেয়েকে কিছু কিনে দিতে পারি না! সব কিছুতে তোমার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে?’
‘এখানে অনুমতির প্রশ্ন আসাটা বৃদ্ধা। আমি তেমন ভাবে কিছু বলিনি। তুমি মা তোমার কাছে মেয়ে অনেক কিছুই আবদার করবে। তাহলে কি তুমি সবকিছু পূরণ করবে? ফোনের জন্য তো আবদার করেনি। তুমি নিজে থেকে কিনে দিয়েছো। ভালো। বাড়ির সকলে তাকে ভালোবাসে। মিস করবে। তাই একটু সুবিধার জন্য তুমি কিনে দিয়েছো। কিন্তু তুমি এর বিপরীতটা ভাবোনি। যদি কখনও ধরা পড়ে যায় তখন তুমি কি জবাব দেবে? যখন স্কুলের প্রিন্সিপাল জানতে পারবেন এই অন্যায়ের পেছনে তাদের পরিবারের সাপোর্ট ছিল। তখন আমাদের পরিবারের সম্মান থাকবে তো? এ না হয় বাদ দিলাম। আমরা সাথীর সমস্ত চাহিদা পূরণ করে দিয়ে তার চাহিদার পথ প্রসারিত করছি।আজ মোবাইল দিয়েছি কাল অন্য কিছু চাইবে সেটা পূরণ করব পরশু আবার কিছু চাইবে তা পূরণ করবো কিন্তু তার পরের দিন যা চাইবে তা পূরণ করতে পারবে তো? তখন কিন্তু বাধা দিলেও সে শুনবে না। আর সে-ই সময় তাকে দোষ দেওয়াটা হবে শুধুমাত্র বোকামি। ভালোবাসা মানে সবকিছু পূরণ করে দেওয়া নয়। কিছু অভাব বুঝতে দেওয়াও ভালোবাসা। সন্তানের প্রতি কঠিন হওয়াটাও ভালোবাসা।’
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে সদ্য কলেজে পা দিয়েছে সংকেত। শুধু মানসিক নয় শারীরিক ভাবে দুর্দান্ত পরিবর্তন এসেছে। টগবগ করে ফুটে উঠেছে যৌবন। যৌবনের নববারুদ সুপ্ত থাকা অনেক উচ্ছ্বসিত ইচ্ছাকে প্রাণ দিয়েছে। আগে বাবাকে লুকিয়ে দু-একটা বিড়ি কিংবা সিগারেট টান দিতো। এখন সে-ই ছোট সীমাবদ্ধে আবদ্ধ নেই সে। কয়েকদিন আগে বন্ধুদের সাথে মিলে অ্যালকোহলে হাত দিয়েছে। শহরের জীবনকে মেনে নিতে খুব বেশী দেরি করেনি। চার দেওয়ালে বন্দী হয়ে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকতে ভালো লাগে না তার। বাড়ি থেকে বাইরেই বেশিরভাগ সময় থাকে। তাই বন্ধুত্বের অভাব হয় না। যত বন্ধু বাড়ছে দিনের পর দিন তত উচ্ছন্নে যাচ্ছে। বাবা আগের মত ছেলেকে সময় দিতে পারেন না। কাজে ব্যস্ত থাকেন সবসময়। ছেলে বড় হয়েছে তাই একটু বেশি স্বাধীনতা দিতে কার্পণ্য করেননি। এই স্বাধীনতাকে সংকেত সৎ ভাবে ব্যবহার করছে না। আগে বাবাকে মিথ্যা কথা বললে নিজের মনের মধ্যে অপরাধবোধ জন্ম নিত। নিজেকে ধিক্কার জানাতো। এখন যে নিজের মধ্যে অপরাধবোধ জন্মায় না তা নয়। কিন্তু সে ভাবে মিথ্যা তো একবার বলেছে পরে ঠিক করে নেবে। কিন্তু ঠিক করা আর হয় না। একের পর এক মিথ্যা বলে যায়। আবার ভাবে কত মানুষ তো কত মিথ্যা বলছে তা বলে কি তারা সবাই অসুখী? অসুখী নয় বরং সুখেই আছে।আর সে দু-একটা মিথ্যা বললে কি এমন হয়ে যাবে?এতকিছুর মধ্যেও তার মন বারবার গ্রামকে খুঁজে বেড়ায়। সপ্তাহের শেষে বাবা না ফিরলেও সে গ্রামে ফিরে। গ্রামের খোলা বাতাস গায়ে মাখে। সূর্যময়ের বাড়িতে যায়। তার সাথে ঘুরে ফিরে। সারাটা দিন কাটিয়ে ফেলে। রাতে এক বিছানায় ঘুমোয়। সেও নেশায় আসক্ত। উচ্চমাধ্যমিকের পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। বাবা পড়াতে চাইছিলেন কিন্তু সে নিজে থেকে ছেড়েছে।পড়ার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। এখন বাবাকে কাজে সাহায্য করে। মাছ ধরতে যাওয়া,জাল বোনা, চাষের জমিতে যাওয়া নিত্যদিনের রুটিন হয়েছে তার।
পর্ব ০৮ আসছে।