তোমাকে,পর্ব 15.1,16.1

তোমাকে,পর্ব 15.1,16.1
অনিমা হাসান
পর্ব 15.1

অনিমাদের যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে I মুনিরের সাথে আজকাল তেমন কথা হয় না I খুব একটা আসে ও না I ফোন করে অথবা টেক্সট করে দেয় প্রয়োজন হলে I টিকেট ও ইমেইল করে দিয়েছে অনিমার ইমেইল এড্রেসে I অনিমার একটু চিন্তা হয় কি খেয়ে আছে I মাঝেমাঝেই খাবার পাঠিয়ে দেয় সেঁজুতির হাত দিয়ে I নিজে আর ডাকে না উপরে I

ফ্লাইটে ও খুব একটা কথা হল না দুজনের I পুরোটা সময় অনিমা চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল অথবা ঘুমিয়ে ছিল I মুনির অবশ্য দিব্যি সেঁজুতির সঙ্গে গল্প করে সময় কাটিয়েছে I মুনির সারাটাক্ষন অনেক যত্ন করেছে ওদের দুজনের I অনেক খেয়াল রেখেছে যেটা আরো মন খারাপ করিয়ে দিয়েছে অনিমার I অনিমা ঠিক করে ফেলেছে দেশে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফিরে আসবে I মুনিরের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না I আবরার কে ও জানিয়ে দেবে I আবরারের অবশ্য ওকে নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই সেটা ও জানে I মুনিরের ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে চায় না ও I তাছাড়া সেঁজুতির জন্য ওকে ফিরে আসতেই হবে I আর মুনিরের পক্ষেও সম্ভব না সবকিছু ছেড়েছুড়ে ওর কাছে চলে আসা I কাজেই এভাবে বিয়ে করার কোন মানেই হয়না I মুনিরের জীবনটাকে আর জটিল করতে চায়না অনিমা I

এয়ারপোর্টে যখন ওরা পৌঁছলো তখন রাত হয়ে গেছে I আবরার এসেছে অনিমাদের নিতে I একাই এসেছে সোহানা সঙ্গে আসিনি I অনিমা অবশ্য আশা ও করিনি I ফ্লাইট থেকে নেমে মুনির বলল

– তোমাদের জন্য একটু খাবার আর পানি কিনে দেই
– দরকার নেই
– এখানকার পানি খেলে সমস্যা হতে পারে I দাঁড়াও আমি এনে দিচ্ছি

মনির পানি আর ও কি সব যেন সেঁজুতির ব্যাগে ভরে দিল I আবরারের সঙ্গে দেখা হলে কুশল বিনিময়ের পর মনির বলল

– আমি তাহলে যাই ?
– তোমাকে নামিয়ে দেই আমরা I আবরার ভদ্রতা করে বলল
– না আমি ট্যাক্সি নিয়ে নেব I ওরা টায়ার্ড আপনারা বাসায় চলে যান I

মনির বিদায় নিয়ে চলে গেল I আবরারের ফ্ল্যাটে পৌঁছতে প্রায় দশটা বেজে গেল I বাড়ি যেয়ে অনিমা একটু অবাক হল I সোহানা ঘুমিয়ে পড়েছে I আবরার বলল

– তোরা টায়ার্ড ঘুমিয়ে পড় I নিচে গেস্টরুমে তোদের থাকার ব্যবস্থা করেছি I ইয়ে , আমরা তো রাতে কিছু খাইনা তাই কিছু করা হয়নি I তোরা কিছু খেলে বল অর্ডার দিয়ে দিচ্ছি I

-না কিছু লাগবেনা I

অনিমা সেজুতিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল I মুনির কি কিছু বুঝতে পেরেছিল I আশ্চর্য তো I সেজুতিকে ফ্রেশ হতে বলে অনিমা সেজুতির ব্যাগ খুলল I ব্যাগের ভেতর পানির বোতল চিকেন স্যান্ডউইচ আর দুটো কাপ কেক পাওয়া গেল I অনিমার চোখে পানি এসে গেল I হঠাৎ করেই মুনিরের খুব মিস করতে লাগলো I কি অদ্ভুত আগে তো কখনো এমন হয়নি I কি জানি হয়তো একই বাসায় থাকত তাই I কাল সকালেই হোটেলে উঠে যাবে ঠিক করল অনিমা I আর হয়তো দেখা হবে না মুনিরের সাথে I একবার ওকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে I অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I হঠাৎ করেই মনটা কেমন দুর্বল হয়ে গেছে I খুব ইচ্ছা করছে একবার কথা বলতে I দেখা না হোক একবার ওর কন্ঠস্বরটা শুনতে I

রাত অনেক হয়ে গেছে I অনিমার ঘুম আসছে না I পাশেই সেঁজুতি ঘুমিয়ে আছে I অনিমা ফোন বের করে ফেসবুক চেক করছিল আর তখনই ফোনটা এলো

– ঘুমাওনি এখনও ?
– না কি করে বুঝলে ?
– তোমাকে অনলাইনে দেখে I খেয়েছো কিছু ?
– হু I তুমি ঘুমাচ্ছো না যে
– আমার এত সহজে ঘুম আসেনা
– কেন?
– আমার ক্রনিক ইনসম্নিয়া
– কবে থেকে ?
মনিরের খুব বলতে ইচ্ছে হল যখন থেকে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছো তখন থেকে সেটা আর বলা হল না মুখে বলল
– অনেক বছর ধরে
– গান শুনো ঘুম এসে যাবে
– তুমি শোনাবে ?
– না I আমার গান শুনলে তুমি আবার পালিয়ে যাবে I কথাটা বলে অনিমা নিজেই চমকে উঠলো I
-এবার তুমি পালাতে দিওনা
– আমি কাউকে জোর করে ধরে রাখি না
– মাঝে মাঝে জোর করতে হয় অনিমা
– হয়তো হয় I আমি চাইনা
– অনিমা
– কি বলো
– অন্য সময় বলবো
অনিমা হেসে ফেললো I অনেক বছর আগে ওরা এভাবে কথা বলতো

-ঘুমিয়ে পড়ো মুনির I
-আচ্ছা গুড নাইট I

অনিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল I মনে মনে বলল তুমি ভালো থেকো মুনির I অনেক অনেক ভালো I

অনিমার চোখটা মাত্র লেগে এসেছিল কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল I অনিমা পাশ ফিরে ঘড়ি দেখল I সাড়ে সাতটা বাজে I এত সকালে নিশ্চয়ই পেপারওয়ালা দুধওয়ালা কিছু একটা হবে I উঠতে ইচ্ছা করছে না I যে এসেছে সে বেল বাজিয়েই যাচ্ছে I বিরক্ত হয়ে ওঠে অনিমা গেট খুলল I হঠাৎ মনে হল ও বোধ হয় ঘুমিয়ে ই আছে I আর স্বপ্ন দেখছে এটা সত্যি নয় I

মনির হাসতে হাসতে বলল

-কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে ?
– তুমি এখানে কি করছ ?
– তোমাদের নিতে এসেছি I

পর্ব 15.2

– তুমি এখানে কি করছো অনিমা ?
অনিমা মুনীরকে দেখে একটু অবাক হল I প্রথমে কিছু বলল না I মুনীর আবার জিজ্ঞেস করল
– কোথায় যাচ্ছ তুমি ?
– এখানে কেউ কিছু করছে না I সবাই দাঁড়িয়ে দেখছে I বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলে হয়তো বাঁচানো যাবে I
– কোথায় নিয়ে যাবে ?
– ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে I তুমি কি কষ্ট করে আমাকে একটা রিকশা ডেকে দিতে পারবে ?

অনিমা খুব ফর্মালি কথা বলছে I আগে কখনো তো এভাবে বলেনি I মুনিরের খুব গায়ে লাগলো I ও কিছু বললো না তবে একটা রিক্সা থামাল I অনিমা বাচ্চাটাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসে বলল

– থ্যাঙ্ক ইউ I অনেক কষ্ট করলে

মুনিরের প্রচন্ড রাগ হল I অনিমা ওর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছে কেন ?

-সরে বসো আমি রিক্সায় উঠবো
– তোমাকে যেতে হবে না
– অনিমা আমি সরে বসতে বলেছি I তোমাকে আমি এভাবে একা ছাড়বো না I

অনিমা কিছু বলছে না I সরেও বসছে না I রিক্সাওয়ালা তাড়া দিচ্ছে I ব্যস্ত রাস্তায় এভাবে রিক্সা দাঁড় করিয়ে রাখা যায়না I মুনির অন্যদিক থেকে ঘুরে এসে রিক্সায় উঠল I অনিমা কিছু বলল না I কোনমতে বাচ্চাটাকে ধরে বসে রইল অন্যদিকে চেয়ে I

– হুড তুলে দেবো ?
– না লাগবেনা

মুনিরের মনে হল অনিমার বসতে কষ্ট হচ্ছে I ও বলল

– বাচ্চাটাকে আমার কাছে দাও I তুমি ঠিক হয়ে বস I ধাক্কা লাগলে পড়ে যাবে

– সমস্যা নেই I তুমি নিশ্চয়ই কোন জরুরী কাজে যাচ্ছিলে I সামনে নেমে যেতে পারো I

মুনিরের মাথায় আগুন ধরে গেল I মেয়েটা এতো অভিমানী I সেদিন জরুরী কাজের কথা বলে ওর বাসা থেকে বেরিয়ে ছিল বলে আজকে সেটা শোনাচ্ছে I আশ্চর্য I সামনে স্পিডব্রেকার I মুনির অনিমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে শক্ত করে ধরে বসলো I অনিমা কিছু বলল না I মুনির তাকিয়ে দেখল অনিমা বাইরের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে I মনিরের হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল I নরম গলায় বলল

– তোমাকে আমার কিছু বলার ছিল অনিমা I

মুনিরের কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল অনিমা হঠাৎ ফিরে তাকাল I ওর চোখ ভেজা I তখন বিকেলের আলো ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে I অনিমার গভীর কালো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মুনির দিশেহারা বোধ করল I ওর মনে হলো এই জীবনে এই মেয়েটাকে ছাড়া ওর চলবে না I

চলবে…..
লেখনীতে
অনিমা হাসান

তোমাকে
পর্ব 16.1

অনিমা নিজের চোখে কে বিশ্বাস করতে পারছে না I মুনির কি সত্যিই এসেছে না কি ও স্বপ্ন দেখছে I একবার একটু ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে I মুনির হাসছে I অনিমা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল I খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করল ওর সেই পুরনো হাসিটা আবার ফিরে এসেছে I

-তুমি চলে এসেছো আঙ্কেল I আমি এখনই রেডি হচ্ছি

সেজুতির কথায় অনিমা সম্বিত ফিরে পেল I তার মানে কি ওর আগে থেকেই আসার কথা ছিল I অনিমা ই কিছু জানতো না ? ততক্ষণে উপর থেকে আবরার আর সোহানা ও নেমে এসেছে I মনিরকে দেখে ওরা দুজন বেশ অবাক হল I সোহানা অনিমার দিকে তাকিয়ে বলল

– আরে অনিমা তুমিতো একেবারে আগের মতই আছো I

মুনির একটু অবাক হলো I তার মানে কি এখনই ওদের প্রথম দেখা হল I তাহলে হয়তো রাতের বেলা ওদের ঠিকমতো আদর যত্ন করা হয়নি I মুনির দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল I তারপর আবরারের দিকে তাকিয়ে বলল

– ভাইয়া আমি ওদের নিয়ে যেতে এসেছি I মা ওদের জন্য অপেক্ষা করছে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করবে বলে I আপনারা নিশ্চয় অনেক রকম আয়োজন করেছেন কিন্তু আজকে ওদের ছেড়ে দিতে হবে I আরেকদিন না হয় আপনাদের এখানে এসে খেয়ে যাব I

সোহানা সুযোগটা লুফে নিল I বলল

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই I কেন নয়

মুনির একটু ভ্রু কুচকে তাকালো I ওর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই I এরকম জায়গায় ওদের এক সপ্তাহ ফেলে রাখার কোনো মানেই হয় না I মুনির আবরারের দিকে ফিরে বলল

– ভাইয়া আর একটা জরুরী কথা ছিল I আমি জানি আপনারা ব্যস্ত I আমি বেশি সময় নেবো না I
– না না বল

– আমাদের তো একদিন পরে আসার কথা ছিল I তাই আমরা প্রোগ্রামটা নেক্সট ফ্রাইডেতে করব ঠিক করেছিলাম I এখন যেহেতু একদিন আগেই চলে এসেছি আর আজকে শুক্রবার কাজেই আমি চাইছি বিয়ের আজকেই হোক I

অনিমা চমকে উঠলো I এসব কি বলছে ও I মুনির তখনো কথা চালিয়ে যাচ্ছে

– আর আমরা চাই অনুষ্ঠান টা আমাদের বাড়িতেই হোক I আঙ্কেল বেঁচে থাকলে অন্যরকম কথা ছিল I এখন আমার মা চাইছিলেন বিয়েটা আমাদের বাড়িতেই হোক I আপনারা শুধু একটু কষ্ট করে সন্ধ্যার পরে চলে আসলেই হবে I আপনাদের পক্ষ থেকে যদি আরো কাউকে বলতে চান তাহলে টোটাল কত জন আসবে সেটা আমাকে জানালে হবে I

আবরার একটু গাইগুই করছিল I মিন মিন করে বলল

– তা কেন ? সবটা তো এখান থেকেই হওয়া উচিত

সোহানা ওর পাশে এসে দাড়ালো I এই সুযোগ ও কিছুতেই হাতছাড়া করবে না I এভাবে যদি ঘাড় থেকে ঝামেলা নামানো যায় তাহলে ক্ষতি কি ? ও হাসতে হাসতে বললো

– তাকে কি হয়েছে ? ওখানে ও তো ওরা দুজন একসাথেই থাকতো তাই এখানে বিয়ের আগে থাকলে অসুবিধা কোথায় ?

অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I ওর নিজের বাড়ির মানুষজন যদি এই ধারণা করে তা হলে বাইরের লোক কি কিভাবে ?

মুনির সোহানাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো

-ভাইয়া , এ ধরনের কথার জন্য কিন্তু আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে I বাইরের লোকেরা এ ধরনের কথা বলবেই I আপনি জানেন অনিমা কেমন ওর সীমারেখা কতটুকু I তাছাড়া লোকজনতো নিজের রুচি অনুযায়ী মন্তব্য করবেই তাই না ? এন্ড অফ দা ডে সবাই নিজেকে দিয়েই অন্যকে বিচার করে I

অনিমা মনে মনে একটু হাসলো I মুনির একদম আগের মতই আছে I কখন ও রেগে যাবে না আবার কেউ ওকে অপমান করলে তাকে ছেড়ে ও দেয়না I অনিমা ঠিক করে ফেলল এখানে আর এক মুহূর্তও নয় I বের হয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিতে হবে I তারপর কোন হোটেলে গিয়ে উঠতে হবে I মুনির কে কি করে বুঝাবে সেটাই বুঝতে পারছে না অনিমা I

সোহানা খোঁচাটা গায়ে মাখলো না I বলল

– আমাদের কোন সমস্যা নেই I আমরা সন্ধার সময় ঠিক পৌঁছে যাব I

– ভাইয়া আপনার ও একেই মত তো ?

আবরার স্ত্রীর দিকে তাকালো I সোহানা চোখের ইশারা করায় বলল

– হ্যাঁ ঠিক আছে I নিয়ে যাও I ইয়ে তোমার জন্য কিছু কেনাকাটা করতে চেয়েছিলাম ..

– সেসবের কোন দরকার নেই I ওইভাবে ফর্মালি তো কিছু হচ্ছে না I আপনারা আসবেন ওটাই যথেষ্ট I

মুনির তাকিয়ে দেখল অনিমা আর সেঁজুতি দুজনেই তৈরি হয়ে গেছে I ও দ্রুত ওদের লাগেজগুলো তুলে নিয়ে বলল

– ঠিক আছে ভাইয়া আসছি তাহলে I সন্ধ্যায় দেখা হবে I
নিচে নেমে অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I মুনির নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে I ঝটপট লাগেজ গুলো তুলে দিয়ে ও বলল
– তোমরা উঠে পড়ো দেরি করো না

অনিমা মহা ঝামেলায় পড়ে গেল I এখন ও মুনির এর কাছ থেকে কি করে পালাবে ?

তোমাকে
পর্ব 16.2

অনিমার কোলে বাচ্চাটা একটু কেঁপে উঠল I মুনির দেখল ওর কান বেয়ে রক্তের ধারা নেমেছে I অনিমা বাচ্চাটাকে আরো শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল I ওর গালে ঠোট কপালে রক্ত লেগে যাচ্ছে I খেয়াল করলো না অনিমা I বাচ্চাটার একটা হাত নিস্তেজ হয়ে মনিরের কাঁধের উপর পরল I ও টের পেল সেই হাতের উত্তাপ ধীরে ধীরে কমে আসছে I মুনির মনে মনে প্রার্থনা করল আল্লাহ অনিমা যেন কিছু বুঝতে না পারে I

ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সির সামনে প্রচন্ড ভিড় I অনিমা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে অসহায়ের মত এদিক ওদিক তাকালো I কি করবে বুঝতে পারল না I সাবের চাচা বার্ন ইউনিটের সিনিয়র সার্জেন I অনিমার বাবার বন্ধু I অনিমা কে খুব স্নেহ করেন I অনিমা বুঝতে পারছে না তাকে কিভাবে খুজে বের করবে I কিংবা খুঁজে বের করলেও আদৌ কোনো লাভ হবে কিনা I মুনির বলল

– তুমি একটু দাঁড়াও আমি দেখছি

মুনিরদের গ্রামে কোন হাসপাতাল নেই I ওদের সবসময় সদর হাসপাতালে যেতে হয় I মুনির প্রায়ই বিভিন্ন জনকে নিয়ে গেছে সদর হাসপাতালে I তাই এই জায়গাগুলোর চরিত্র ওর জানা I কিছুক্ষণের মধ্যেই ও একজন ইন্টার্ন ডাক্তার যোগাড় করে ফেলল I অনিমা দেয়ালে হেলান দিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল I ডাক্তার সহ মুনির কে আসতে দেখে দৌড়ে গেল I ডাক্তার ছেলেটা এসে বাচ্চাটার হাত তুলে দেখল I ওর চোখ মুখ কেমন যেন শুকিয়ে গেল I ছেলেটা চকিতে একবার মুনীরের দিকে তাকালো I মুনির দুদিকে মাথা নেড়ে কিছু বলতে নিষেধ করল I অনিমা বলল

– কি হয়েছে ওর ? ঠিক হয়ে যাবে তো ? আপনি কিছু বলছেন না কেন ?

– আমাদেরকে একটু দেখতে দিন I

ডাক্তার ছেলেটা বাচ্চাটাকে নিয়ে চলে গেল I মুনির বলল

– চলো এখানে থেকে আর লাভ নেই
– কিছু না জেনেই চলে যাব ?
– আমরা আবার পরে এসে খোঁজ নেব I চলো তোমাকে বাসায় পৌছে দেই
– তুমি চলে যাও I আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো

মুনির কিছু বলল না I স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে রইল I অনিমা ওর দিকে তাকাচ্ছে না I অন্যদিকে তাকিয়ে আছে

– আচ্ছা ঠিক আছে I তুমি একটু থাকো আমি আসছি

মুনির গেছে কিছুক্ষণ হবে কিন্তু অনিমার মনে হচ্ছে অনন্ত কাল I খুব অস্থির লাগছে I কান্না পাচ্ছে খুব I কেন যে এমন হচ্ছে বুঝতে পারছে না অনিমা I মুনির এল আরও কিছুক্ষণ পরে I অনিমা তখন দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে ছিল I মুনির এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়ালো I

– অনিমা তুমি ঠিক আছো ?

অনিমা চোখ খুলে মাথা নাড়ল অর্থাৎ ও ঠিক আছে I মুনির ওর হাতের ভেজা রুমালটা দিয়ে পরম যত্নে ওর গাল ,কপাল আর ঠোট থেকে রক্তের দাগ গুলো মুছে দিতে লাগলো I অনিমার চোখ ভিজে আসছে I প্রাণপণ চেষ্টা করেও কান্নাটা আটকাতে পারছেনা I মুনির চোখের জলটাও খুব যত্ন করে মুছে দিল I তারপর আস্তে আস্তে বলল

– তোমাকে বাসায় এভাবে দেখলে সবাই ভয় পাবে Iএকটু ঠিক হয়ে নাও I

অনিমা নিজেকে একটু গুছিয়ে নিল I

মুনির বলল

– চলো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমি যাব

অনিমা এবার আর আপত্তি করল না I মনিরের পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো I তখন রাত হয়ে গেছে I চারিদিকে বেশ অন্ধকার নেমেছে I দূরে কোথাও বোধহয় বৃষ্টি হয়েছে I বাতাসে ঠান্ডা ভাব I অনিমার একটু শীত শীত লাগছে I মুনির বলল

-শীত লাগছে ?

– হুম

– দাঁড়াও রিক্সা নিয়ে নিচ্ছে

রিক্সায় উঠে মুনির ওর ব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে অনিমা কে দিয়ে বলল

– এটা গায়ে দিয়ে নাও

অনিমা একটু অবাক হল তবে কিছু বলল না চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নিল

– রিক্সার হুড তুলে দেই ?

– দাও

অনিমার খুব ক্লান্ত লাগছে I এত ধকল ও আর নিতে পারছে না I মুনির দেখল অনিমা একটু একটু কাঁপছে I মুনির অনিমার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল

– খারাপ লাগছে অনিমা ?

-হুম

– ঘুম আসছে ?

– হ্যাঁ

– ঠিক আছে তুমি চোখ বন্ধ করে থাকো I বাসার কাছে আসলে আমি ডেকে দেবে

– আচ্ছা

অনিমা চোখ বন্ধ করলো I তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই মনিরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরল I মুনিরএকবার পাশ ফিরে অনিমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকালো I তারপর আস্তে আস্তে বলল

-তুমি কি জানো আমি তোমাকে কতখানি ভালবাসি ?

চলবে….
লেখনীতে
অনিমা হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here