তোমাকে,পর্ব 6.1,7.1
পর্ব 6.1
অনিমার জীবনটা এক লহমায় বদলে গেল I আশিক চলে যাবার পর মৃত্যু শোকের চেয়ে যে জিনিসটা অনিমাকে কাপিয়ে দিলো সেটা হলো বাস্তবতা I আশিক খুব আমুদে স্বভাবের ছিল I বন্ধুবান্ধব নিয়ে হইচই করতে পছন্দ করত I প্রচুর বন্ধু-বান্ধব ছিল তার I অথচ তার মৃত্যুর পর সেই সব বন্ধুরাই পাশে দাঁড়ানোর বদলে কার কার কাছে কত ধারদেনা ছিল সেগুলোর হিসেব নিকেষ শুরু করে দিল I সেঁজুতির দেখাশোনায় যেন কোনো ঘাটতি না থাকে তাই অনিমা কখনো ফুলটাইম জব করেনি I একটা পার্টটাইম জব করতো তাতে যা আসত তা দিয়ে ওর সখ আহলাদ পূরণ হয়ে যেত I বাকিটা ও সঞ্চয় করত সেঁজুতির ভবিষ্যতের জন্য I
আশিক খুব খরুচে স্বভাবের ছিল I দুহাতে টাকা ওরাতো I মাস শেষে ওর হাতে প্রায় কিছুই থাকত না I অনিমা কখনো কিছু বলেনি এগুলি নিয়ে I হাউজ লোন সংসারের খরচ সব আশিকি দিতI অনিমাকে কখনো এগুলো নিয়ে ভাবতে হয়নি I অনিমা যে বাড়িটাতে থাকে এটা ওরা 5 বছর আগে কিনেছে I বাড়িটা ওদের দুজনের নামে I তাই আশিক চলে যাবার পর লোনের সমস্ত তার দায়ভার এখন অনিমার I মাসে মাসে একটা বড় অংকের টাকা ব্যাংকে দিতে হয় I সংসার খরচ যদি বা অনিমা চালিয়ে নিতে পারে কিন্তু এই ব্যাংকের টাকাটা মাসে মাসে পরিশোধ না করলে বাড়িতে থাকবে না I অনিমা দেশে ওর ভাইকে ফোন করেছিলI দেশে ওর সম্পত্তির অংশ আছে সেখান থেকে কিছু পাওয়া যায় কিনা I অনিমার ভাই আবরার পরিষ্কার মানা করে দিয়েছে I ঢাকায় ওদের যা জায়গা জমি ছিল সবি বিল্ডার্সের কাছে দিয়ে ফ্ল্যাট বানানো হয়েছেI গোটা বিশেক ফ্ল্যাট আছে ওদেরI আবরার জানালো সবি ভাড়া দেয়া I এখন কোনটা বিক্রি করা সম্ভব নয় I অনিমা চাইলে দেশে চলে আসতে পারেI একটা ফ্ল্যাটে থেকে আরেকটার ভাড়া তুলে চলতে পারে I অনিমা যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলI তাই আর যোগাযোগ করেনি I ক্যালিফোর্নিয়ায় আশিকের বড় ভাই থাকে I আশিকের বাবা-মাও ওনার সাথেই থাকেন I আশিক এর মৃত্যুর পর ওরা বলেছিল সেজুতিকে নিয়ে এখানে চলে আসতে I ওদের জন্য একটা রুম ছেড়ে দেবে I ওদের কোন সমস্যা হবে না I অনিমা হেসেছিল মনে মনে I কারো গলগ্রহ হয়ে ও কখনই থাকবেনা I নিজের মেয়েকে তো রাখবেই না I অনিমা আর কথা বাড়ায়নি মেয়ের স্পেশাল স্কুলের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে গেছে I তাতে অবশ্য তারা একটু খুশিই হয়েছে I এমনিতেও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অনিমাকে পছন্দ করেনা I ইনিয়ে বিনিয়ে সেঁজুতি অবস্থার জন্য ওকেই দায়ী করে I
অনিমার বাড়িটা দুতালা I নিচতলায় লিভিং ডাইনিং ওপরে শোবার ঘর I তাই ঠিক ভাড়া দেবার মতো অবস্থা নেইI বেজমেন্ট টাকে আশিক পার্টি হল বানিয়ে রেখেছিল I বন্ধুবান্ধব নিয়ে ওখানেই পার্টি করত I একটা ছোট শোবার ঘরের মতো আছে I বাকিটা পুরাই হল I একপাশে একটা বার ও আছে I এইরকম একটা জায়গা ভাড়া দেয়া মুশকিল I অনিমা ভেবে পাচ্ছে না কি করবে I মাস প্রায় শেষ হয়ে এসেছে I আগামী মাসের শুরুতেই ব্যাংক লোন শোধ করতে হবে I যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে I তা না হলে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে I অনিমা ঠিক করে ফেলল বেজমেন্টে ভাড়া দিয়ে দেবে I ছোট একটা বিজ্ঞাপন ও দিয়ে দিল অনলাইনে I সেদিন ডিপার্টমেন্টের জুনিয়ার একটা ছেলে যোগাযোগ করেছে I তার পরিচিত কেউ একজন ছয় মাসের জন্য ভাড়া নিতে চাইছে I খুবই আর্জেন্ট I অনিমা রাজি হয়ে গেল I রাজি হওয়ার আরেকটা কারণ হলো ওরা আজি 6 মাসের বাড়ি ভাড়া অগ্রিম ই-ট্রানস্ফার করে করে দেবে বলল I এমনটা হলে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে I এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা ঠিকই করে ফেলবে I যদিও বাড়িতে অচেনা কাউকে রাখার ওর ইচ্ছে না কিন্তু পরে ভেবে দেখল 6 মাসের তো ব্যাপার I এর মধ্যে একটা ফুলটাইম জব হয়ে যাবে I অনিমা টাকা তুলে ব্যাংকে দিয়ে মোটামুটি দুমাসের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে গেল I বেসমেন্টে টাও মোটামুটি গোছগাছ করে ফেলল ও I হলরুমে এমনিতেই একটা টেবিল ছিল ছোট, বেডরুম এও একটা বিছানা পাতাই ছিলI বার থেকে সব ড্রিংস গুলো সরিয়ে অনিমা কতগুলো বই এনে রাখলো I গোছগাছ শেষে মনে হল একেবারে মন্দ হয়নি I যে আসবে তার আজ বিকেলে আসার কথা I সেঁজুতি ড্রয়িং ক্লাসে গেছে I অনিমা অপেক্ষা করছিল যে আসবে তাকে বাড়িঘর দেখিয়ে দিয়ে সেজুতিকে আনতে যাবে I
মনির যখন ট্যাক্সি থেকে নেমে লাগেজটা নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকলো অনিমা একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল I
আরে অনিমা এটা তোমার বাসা নাকি ?
মনিরের অভিনয়টা তেমন জমলো না I অনিমা বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে কোনমতে বলল
সজল তো আমাকে একবারো বললো না যে তুমি ভাড়া নিচ্ছ
আসলে সজল জানতো না I আমি অন্য একজনের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছিলামI যাই হোক এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলব ? আমি 19 ঘণ্টা জার্নি করে এসেছিI
না এসো তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনিমা মনিরকে নিচতলায় নিয়ে গেল I অনিমা যদি ধারণাও করত যে মনির এখানে আসছে তাহলেও মানা করে দিত I এখন ওকে অন্য বাসা খুঁজে দিতে পারে কিন্তু টাকাটা তো ফেরত দিতে পারবে না I
অনিমা মনিরকে নিচতলা টা দেখিয়ে দিল I এখানে ঢোকার আলাদা এন্ট্রান্স I পেছনের দরজা দিয়ে বাগানে যাওয়া যায় I অনিমার বাগান টা বেশ সুন্দর I ও যত্নও করে খুব I বেসমেন্ট থেকে মূল বাড়িতে ঢোকার একটা দরজা আছে সেটা সব সময় ভেতর থেকে বন্ধ করে রাখে অনিমা I অনিমা মুনির কে সবটা দেখিয়ে দিল I চাবি ও দিয়ে দিলো একটা I কাজ শেষ করে উপরে চলে গেল I হঠাৎ করেই অনিমার মনে হল এমনিতেই ওর জীবনে সমস্যার শেষ নেই আবার একটা নতুন ঝামেলার কি খুব দরকার ছিল?
পর্ব 6.2
আজ কক্সবাজারে ওদের শেষ রাত I রাতের খাবার শেষ করে সবাই বিচে চলে গেছে I জলের ধারে সুন্দর একটা জায়গা দেখে সবাই গোল হয়ে বসলো I প্রথমে শুরু হল আবৃত্তি I মিজান স্যার একটা আবৃত্তি করে অনুষ্ঠান শুরু করলেন I নীলা দুইটা কবিতা আবৃত্তি করল I এরপর শুরু হলো গান I অনিমা ওর ইউকিলিলি সঙ্গে নিয়ে এসেছিল I সেটা বাজিয়েই গান করল I সবাই ওকে একটার পর একটা গানের অনুরোধ করতে লাগলো I অনিমার খুব ইচ্ছা ছিল একজনের জন্য একটা বিশেষ গান করার I কিন্তু সবার অনুরোধে কারণে সেটা আর হয়ে উঠছে না I অনিমা এদিক ওদিক তাকিয়ে মনির কে খুঁজতে লাগলো I মনির তখন সবাইকে স্নাক্স দিচ্ছিল I অনিমার কাছে এসে দিতে চাইলে অনিমা শুধু পানি নিল I তারপর বলল
তোমার কোন রিকুয়েস্ট নেই ?
না
অনিমার মনটা দপ করে নিভে গেল I মুহূর্তে ওর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল I
মনির আর কিছু বলল না I সামনে থেকে চলে গেল I একটু পরে গরম চা এনে অনিমার হাতে দিল I তারপর বললI
আজকে অনেক গান করলে তোমার গলা ভেঙে আসছে চা খাও I আমি আজকে তোমাকে কোন রিকোয়েস্ট করব না I আমি যেদিন রিকোয়েষ্ট করবো সেদিন কিন্তু না করতে পারবে না I
অনিমার মন খারাপ ভাবটা চলে গেল I
চায়ের পর আবার গানের আসর বসল I মিজান স্যার হঠাৎ বললেন
অনিমা তুমি নজরুল গীতি গাও ?
জি স্যার
মনে পড়ে আজ গানটা করবে
চেষ্টা করছি স্যার
অনিমা গান শুরু করলো
মনে পড়ে আজ সে কোন্ জনমে
বিদায় সন্ধ্যাবেলা-
আমি দাঁড়ায়ে রহিনু এপারে
তুমি ওপারে ভাসালে ভেলা।।
সেই সে বিদায় ক্ষণে
শপথ করিলে বন্ধু আমার
রাখিবে আমারে মনে,
ফিরিয়া আসিবে খেলিবে আবার
সেই পুরাতন খেলা।।
আজো আসিলে না হায়,
মোর অশ্রুর লিপি বনের বিহগী
দিকে দিকে লয়ে যায়,
তোমায়ে খুঁজে না পায়।
মোর গানের পাপিয়া ঝুরে
গহন কাননে তব নাম লয়ে
আজো পিয়া পিয়া সুরে;
গান থেমে যায়, হায় ফিরে আসে পাখী
বুকে বিঁধে অবহেলা।।
জ্যোৎস্নার মন কেমন করা আলো, সমুদ্রের বিশালতা আর অনিমার দরদী কন্ঠ সব মিলেমিশে একরকম বিষাদ ময় পরিবেশ তৈরী হলো I অনেককে ই চোখ মুছতে দেখা গেল I এরকম একটা গানের পর আর কারো কিছু বলার মত মনের অবস্থা থাকলো না I মিজান স্যার বললেন কাল খুব ভোরে রওনা দিতে হবে I সবাই এবার শুতে চলে যাও I
মনির এসে অনিমার পাশে বসলো I অনিমা পাশে তাকিয়ে একটু হাসলোI মনির বলল
তোমার আজকের গানটা এ পর্যন্ত সব গুলির মধ্যে বেস্ট
তুই কালকে ও এই কথা বলেছিলে
তুমি যদি এখন প্রতিদিন নিজেকে ছাড়িয়ে যাও তাহলে আমার কি করার আছে?
অনিমা মুগ্ধ হয়ে শুনলো I এত সুন্দর করে কেউ প্রশংসা করতে পারে ওর জানা ছিল না I
অনিমা মনে মনে বলল আজকে একটা গান শুধু তোমার জন্য গেয়েছি, তুমি কি বুঝতে পেরেছো ?
অনিমা
বল
না কিছুনা I
কি বল
অন্য একদিন বলব
অনিমা কিছু বলল না I একটু হাসলো I
মনিরের হঠাৎ মনে হল অনিমাকে বলে তুমি প্রতিদিন রাতে আমাকে একটা করে গান শোনাবে I নিজের চিন্তায় মনির নিজেই বিস্মিত হয়ে গেল I এটা কি করে সম্ভব I অনিমা কেমন করে ওকে প্রতিরাতে গান শোনাবে ? মনির পাশ ফিরে তাকালো I অনিমা সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে I ওর খোলা চুল গুলো বাতাসে উড়ছে I চাঁদের আলোয় কি অদ্ভুত মায়াবী লাগছে ওকে I এই এলোমেলো অভিমানী মেয়েটার জন্য হঠাৎ বুকের ভেতর তীব্র ব্যথা অনুভব করল মনির I এই অনুভুতির সাথে ও পরিচিত নয় I এরই নাম ই কি তবে ভালোবাসা ?
চলবে…..
লেখনীতে: অনিমা হাসান
তোমাকে
পর্ব 7.1
ওদের বাসটা যখন ডিপার্টমেন্টের সামনে এসে পৌঁছল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে I চারিদিকে নিয়নের আলো জ্বলে উঠেছে I ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক সবাই খুব ক্লান্ত বিধ্বস্ত ক্ষুধার্ত I অনিমা বাস থেকে নেমে গাড়ির জন্য ফোন দিল I জানা গেল গাড়ি হাসান সাহেবের সঙ্গে আছে তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অনিমা কে নিতে আসবে I অনিমা অপেক্ষা করতে লাগলো I বাকিরাও সবাই যে যার মত বাড়ি ফেরায় ব্যস্ত হয়ে গেল I নীলা অবশ্য একবার জানতে চাইল অনিমা ওর সঙ্গে যেতে চায় কিনা অনিমা জানালো ওর গাড়ি আসছে I নীলা সহ অন্যান্যরা বিদায় নিয়ে চলে গেল I অনিমা বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন দিয়ে মিঠু খালাকে খাবার তৈরি করে রাখতে বলল I
মনির তাড়াহুড়া করে সব কাজ গোছাচ্ছে I হলে পৌঁছে লাগেজ রেখে ওকে আবার বেরোতে হবে I কাল ওর স্টুডেন্ট এর পরীক্ষা I আজকে একবার না গেলেই নয় I
অনিমা দূর থেকে দেখলো সব ভলান্টিয়াররা বাস থেকে জিনিস পত্র নামাতে ব্যস্ত I সব নামানো হয়ে গেলে বাসটা ও চলে গেল I ভলান্টিয়াররা সব জিনিসপত্র গুছিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে I অনিমা ই শুধু একা একা দাড়িয়ে রইল I
হাসিব আর মনির হলে যাওয়ার জন্য রিকশা নিতে যাবে তখন লক্ষ করল অনিমা একা একা দাঁড়িয়ে আছে I হাসিব বলল
তোমার গাড়ি এখনো আসেনি অনিমা ?
না , বুঝতে পারছি না এত দেরি কেন হচ্ছে
একটা ফোন করে দেখো
অনিমা ফোন করলো I জানা গেল গাড়ি মহাখালীতে জ্যামে পড়েছে আসতে ঘন্টাখানেক লাগবে I হাসান সাহেব অনিমাকে বাড়ি চলে যেতে বললেন I হাসিব বলল
মনির তোর স্টুডেন্টের বাসা তো ওদিকেই তুই অনিমা কে নামিয়ে দিয়ে চলে যা I আমি তোর লাগেজ নিয়ে হলে যাচ্ছি I
আচ্ছা , চলো অনিমা
অনিমা লক্ষ্য করেছে কাল থেকে মুনির খুব আনমনা হয়ে আছে I কথা ও বলছে না বেশি I সারাদিন খাইওনি কিছু I বাসে যখন খাবার দিতে এসেছিল অনিমা একবার জিজ্ঞেস করল
তুমি সবাইকে খাবার দিচ্ছে নিজে খাচ্ছ না
আমি আসলে জার্নিতে খেতে পারিনা I হলে গিয়ে একবারে খাব
অনিমা আর কথা বাড়ায়নি I তবে ওর নিজেরও খাবার ইচ্ছেটা চলে গিয়েছিলো
তোমার কি হয়েছে মনির ? তুমি কি কোন কারনে আপসেট ?
রিকশা চলতে শুরু হলে অনিমা জানতে চাই
কিছু হয়নি এমনি একটু টায়ার্ড লাগছে
আমি কি তোমাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম?
কিসের ঝামেলা ? আমি তো এমনিতেও ওইদিকে যাচ্ছিলাম
অনিমা আর কিছু বলল না I বাকিটা পথ দুজন চুপচাপ বসে রইল I
মনির যখন অনিমাকে বাসায় নামিয়ে দিল অনিমা কিছুতেই ওকে ছাড়লো না I বলল উপরে গিয়ে একটু কিছু খেয়ে যেতে I মনির কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না I অনিমা বলল
তুমি না আসলে আমি উপরে যাব না এখানেই রাস্তায় বসে থাকবো
মনির হেসে ফেললো I বলল আচ্ছা চলো
অনিমা দের বাসায় ঢুকে মনির একটা বড়সড় ধাক্কা খেলো I অনিমাকের দেখে বোঝা যায় না ওদের আর্থিক অবস্থা এমন I অনিমা খুব সাধারণভাবে থাকে I ওর মধ্যে কোন অহংকার নেই I সবার সঙ্গে খুব সহজ ভাবে মিশে I মনির অনিমার বাবার নাম ও জানতো না I নেমপ্লেট দেখে বুঝতে পারল I অনিমার বাবা একজন বিশিষ্ট শিল্পপতি I
অনিমাদের বাসাটা একটা বহুতল ভবনের টপ ফ্লোরে I দুটো ফ্লোর নিয়ে করা I নিচতলায় বিশাল হল লিভিং ডাইনিং লাগোয়া বিশাল বারান্দা I প্যাচানো সিড়ি দিয়ে উপরে উঠলে লম্বা বারান্দা আর সারি সারি শোবার ঘর I
অনিমা মনিরকে ফ্রেশ হতে বলে তাড়াতাড়ি উপরে গিয়ে চেঞ্জ করে নিল I হাত মুখ ধুয়ে নিল চট করে I পাছে মনির চলে যায় তাই দেরি না করে নিচে চলে এল তাড়াতাড়ি I টেবিলে খাবার পরিবেশন করাই ছিল I পরোটা ,সবজি, গরুর মাংস ভুনা ,বুটের ডাল আর ডিম ভাজি I অনেকদিন পর মনির খুব তৃপ্তি করে খেলো I খাওয়া শেষ হলে অনিমা বলল
কফি দিতে বলি ?
না আজকে আর সময় হবে না I আমাকে এখনই বের হতে হবে তা নাহলে হলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে
অনিমা মনিরকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল I গেটের কাছাকাছি এসে অনিমা ডাকলো
মনির
কি বলো
না কিছুনা সাবধানে যেও
মনির কিছু বলল না একটু হাসলো
অনিমার মনে হল এর চেয়ে একটু কম সুন্দর করে হাসলে ও চলত I এখন আর সারা রাত ঘুম আসবে না I
পর্ব 7.1
এদেশে গ্রীষ্মের দিনগুলো বেশ দীর্ঘ I সন্ধ্যা হতে হতে প্রায় নটা বেজে যায় I অনিমা সাধারণত রাতের খাবার খায় সাড়ে সাতটায় I আজও তার ব্যতিক্রম নয়I সেজুতিকে ড্রয়িং ক্লাস থেকে এনে অনিমা রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিল I আশিক বেঁচে থাকতেও এ সময় কখনো বাসায় থাকত না I রাতের খাবারটা অনিমা আর সেঁজুতি খায় একসঙ্গে I অনিমার হঠাৎ করে মনে হল মনির তো জার্নিতে খেতে পারে না I আসার পর থেকে বাইরে ও যেতে দেখেনি ওকেI তারমানে এতটা সময় না খেয়ে আছে I অনিমার খুব খারাপ লাগলো I ভদ্রতা করে হলেও খেতে বলা উচিত I অনিমা মনিরের আগের ফোন নাম্বারে ফোন দিল I নট রিচেবল দেখাচ্ছে I হয়তো ওই নাম্বারটা আর নেই I বেসমেন্টে একটা ইন্টার কম আছে I আশিক লাগিয়েছিল I পার্টির সময় কিছু দরকার হলে ফোন করে জানিয়ে দিত I অনিমা একটু অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা করেই ফেললI
হ্যালো মনির
হ্যাঁ অনিমা বল
তুমি কি ঘুমাচ্ছিলে?
না আজকে মনে হয় আর ঘুম আসবে না
খেয়েছো কিছু ?
এখনো খাইনি I কি খাব ভাবছিলাম
তুমি চাইলে আমাদের সঙ্গে ডিনার করতে পারো
তোমাদের সমস্যা হবে না তো
সমস্যা কি, তোমার জন্য তো আলাদা করে কিছু করছি না I তবে আগেই বলে রাখছি আমরা কিন্তু একেবারেই দেশি খাবার খাই I তোমার সমস্যা হবে না তো?
আমিতো দেশ থেকে এলাম I
তাহলে চলে এসো I
অনিমা ভেবেছিল মনির হয়তো আসতে চাইবে না I কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে মনির সত্যি সত্যি চলে এলো I
অনিমা সেজুতির সঙ্গে মনিরের পরিচয় করিয়ে দিতে নিলে আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো মনির সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ সেঁজুতি সঙ্গে কথা বলছে I ওরা নিজেদের মতই পরিচয়পর্ব সেরে নিল I
অনিমা হতভম্ব হয়ে গেল I জিজ্ঞেস করল
তুমি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ জানো?
হ্যাঁ জানি তোI I সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ এমন কোন রকেট সাইন্স নয় I ইংরেজি খবর এর সময় ইনসেটে দেখবে I একটু চেষ্টা করলেই শিখে ফেলা যায় I
আমার কিন্তু অনেক সময় লেগেছিল
তুমি একটা স্ট্রেস এর মধ্যে ছিলে I শিখতে না পারলে মেয়ের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারবে না I তাই হয়তো তোমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে I আনন্দ নিয়ে শিখলে দেখতে কোন ব্যাপার না I
অনিমা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ওরা সঙ্গে কথা বলার সময় ও মনির সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করছে যাতে করে সেঁজুতি ও আলোচনার মধ্যে থাকতে পারে I মনির বলেই যাচ্ছে
সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ তো একটা ভাষা তাই না ? আমি যেমন আর সাতটা ভাষা শিখেছি তেমনি এটাও শিখলাম I
সেঁজুতি সাধারণত খাওয়ার সময় কথা বলে না I অনিমাকে অবাক করে দিয়ে আজকে বলল
ওয়াও আঙ্কেল তুমি সাতটা ভাষা জানো
তা জানি I নতুন ভাষা শেখা টা আমার একটা হবি
তুমি কটা ভাষা জানো সেঁজুতি?
তিনটা বাংলা ইংরেজি আর ফ্রেঞ্চ
এক্সেলেন্ট তুমি ফ্রেঞ্চ জানো I যাক ভাল হলো তোমার কাছ থেকে আমি ফ্রেঞ্চটা শিখে ফেলতে পারব
তুমি কি জার্মান ও জান আঙ্কেল ?
না জার্মান জানিনা তবে জাপানিস জানি I আমি জাপানে ছিলাম এক বছর
ওয়াও that’s ওয়ান্ডারফুল
তোমাদের ভাষা বিষয়ক আলোচনা শেষ হলে এবার খাওয়া শুরু করি ?
ওরা দুজনই হেসে ফেললো I অনিমা কখনো সেজুতিকে এত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কার সঙ্গে গল্প করতে দেখেনি I মজার ব্যাপার হচ্ছে মুনির সেঁজুতির সঙ্গে গল্প করছে একেবারে সমবয়সীদের মত I এদেশে ছেলেমেয়েরাও এটা বেশ পছন্দ করে I
খাবারের আয়োজন দেখে মনির অবাক হয়ে গেল I ভাত ,বেগুন ভর্তা , পালং শাক আর রুই মাছের ঝোল I এ দেশে এসেও এরকম খাবার খেতে পারবে মনির ভাবতে পারেনি I যেখানে দেশে এখন অনেকেই স্যান্ডউইচ পিজ্জা দিয়ে ডিনার করে I মনির খুব তৃপ্তি করে খেলো I অনিমার রান্না বেশ ভালো I নিশ্চয়ই খুব কষ্ট করে হাত পুড়িয়ে শিখেছে একা একা I
খাওয়া শেষে সেঁজুতি শুভরাত্রি বলে উপরে চলে গেল I অনিমা টেবিল গোছাতে গোছাতে বলল
কফি খাবে ?
খাওয়া যায়
খাবার টেবিলের একপাশে সোফা I মনির সোফায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে অনিমা কে লক্ষ্য করতে লাগলো I অনিমা একটা লেবু হলুদ রঙের কামিজ পরেছে সঙ্গে সাদা ঢোলা পাজামা I লেবু হলুদ রঙের ফুলকারি ওড়না I আচল তুলে দিয়েছে মাথায় I ওকে কেমন বউ বউ লাগছে I অনিমা কফির জল চাপিয়ে টেবিল পরিষ্কার করল , এঁটো বাসন ধুয়ে রাখল I কফি বানানো হলে একটা মগ মনিরের হাতে দিয়ে বলল
বাগানে যাবে আমি সাধারণত এসময় বাগানে বসে কফি খাই
চলো যাই
খাবার ঘরের পরেই একটা বারান্দা I সিঁড়ি নেমে গেছে উঠান পর্যন্ত I ওরা নিচে নেমে সিঁড়ির শেষ ধাপে বসলো I এখন গ্রীষ্মকাল তাই সাড়ে আটটার সময় ভালোই আলো চারদিকে I মনির লক্ষ করল অনিমার মাথা থেকে ওড়না পড়ে গেছে I অনিমা সিঁড়ির ধাপে কফির মগ রেখে আবার মাথায় আচল তুলে দিল I মনিরের একটু মন খারাপ হলো I অনিমা ওর থেকে অনেক দূরত্ব রাখছে I যেন মনির এখন অনেক দূরের কেউ I আগে তো এমন ছিলনা I আগেও তো ওরা শুধু বন্ধুই ছিল কিন্তু তখন তো এত দূরত্ব ছিল না I মনির অনিমার হাতের দিকে তাকালো I কতবার এই হাত ধরেছে মনির I মনে আছে একবার অনিমা ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিল I কিরকম স্বপ্নের মতো ছিল সেই দিনগুলো I অনিমা কি আর কখনো ওর এত কাছে আসবে না ?
চলবে
লেখনীতে : #অনিমা হাসান