সোনালী-০৯,১০

#সোনালী-০৯,১০
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার
০৯

রোজান হতভম্বের শেষ প্রান্তে পৌঁছালো যেন। এটা কোন সোনালীকে সে দেখছে?
সোনালীর চুল! সোনালীর মাথায় তো ঘন সোনালী রঙের চুল?
এটা মনে হতেই সে মেয়েটার চুলের দিকে নজর দিলো। নাহ মেয়েটার চুল কালো রঙের।
মেয়েটা অগোছালো বেশ, চুলগুলোও কাঁধ অব্দি ছোট আর উসকোখুসকো। হ্যাঁ মৌয়াল হাবিলের মেয়ে যে এমনই হতে পারে সেটা বিশ্বাসযোগ্য, এমনকি তার স্ত্রীও এমন এলোমেলো।

কিন্তু তাদের সন্তান বলে তার চেনা সোনালীকে বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর হবেই বা কেন? আসলেই তো সোনালী তাদের নিজ সন্তান নয়, দিয়ালীর সন্তান। কিন্তু এখানকার কথা শুনে মনে হচ্ছে সেই বৈশিষ্ট্যের মেয়ের বিষয়ে হাবিল সাহেব নিজেই জানেন না। কিন্তু রোজানের চোখ তো ভুল দেখেনি!
তাও কেন জানি রোজানের পা ভয়ংকরভাবে কাঁপছে! বুকেও চিনচিনে কাঁপন! সোনালীর অস্তিত্ব আদৌ আছে তো? কিংবা সোনালী কোনো মানুষ তো? না না কি ভাবছে, নিশ্চয়ই কোনো গন্ডগোল হয়েছে এখানে। সোনালী নিশ্চয়ই আছে।

ঠিক তখনি তার মা প্রবেশ করলো। ভেতরে দেখলো দিয়ালী মেয়েকে না পেয়ে একপাশে বসে বসে কাঁদতেছে, আর রোজানের মামা আর বাবার কপালে চিন্তার ভাঁজ,সাথে তীব্র বিরক্তি। আর বাকি লোকজনদের দুইজন হাত গুটিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
রোজানের মা আস্তে আস্তে বললো,
‘ সোনালী কোথায়?

রোজানের বাবা চোখ দিয়ে ইশারা করে বললো,
‘ এই যে তোমার পুত্রবধূ। দেখে নাও!

বলেই মুখ ঘুরালো। রোজানের মা সেই সোনালীর দিকে তাকিয়ে চমকালো। রোজানের বর্ণনার সাথে কোনো মিল নেই। তবুও এগিয়ে গেলো সোনালীর দিকে! তার মাথায় হাত রেখে বললো,
‘ মেয়েটা যথেষ্ট মায়াবতী, কিন্তু রোজান আমাকে যে ছবি দেখিয়েছিলো, কিংবা সে যাকে ভালোবেসেছিলো এই মেয়ে তো সে নয়।

রোজানের মামা আওয়াজ করে বললো,
‘ সেই মেয়ে হলে কি আমরা এতক্ষণ ধরে এখানে বসে থাকি?

তিনি কিছুটা অবাক হয়ে বললেন,
‘ কোথায় সে? ওই সোনালী কোথায়?

এবার হাবিল রাগান্বিত হয়ে বললো,
‘ দূর বা* আর কোন সোনালী? এইরম কান্ড দেইখা মেজাজটা আগুন হইয়া যাইতাছে আমার। অতগুলি মানুষ আনছেন বইল্লা ভাইব্বেন না আমি নরমই থাহুম। আপনেরা সারা বাড়িত তল্লাশি করতাছেন,কিছু কই কইতাছিনা। কিন্তু বারেবার আমার আর আমার মাইয়ারে নিয়ে আজগুবি কথা কইলে আমি খারাপ করুম কইয়া দিলাম। এরপর আবার আপনারার লোকদেররে জঙ্গলে খুঁজতেও পাঠাইছেন। কিরম ফাইজলামি এইগুলা?

রোজান আর কিছু না শুনে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে শামিমের নিকট দাঁড়ালো। শামিম ধির কণ্ঠে বললো,
‘ ভেতরে কি হচ্ছে স্যার?

রোজান ব্যস্ত স্বরে বললো,
‘ শামিম তুমি সোনালীকে দেখেছিলেনা?

শামিম মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ জ্বী দূর থেকে দেখেছিলাম তো।

রোজান তার থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে ইশারা করে বললো,
‘ ভেতরে গিয়ে দেখো আসো আরেক সোনালীকে,এরপর আমাকে জানাও!

রোজানের কথায় শামিম ভেতরে গেলো। রোজান আশেপাশে পায়চারী করছে। তার জানামতে এখানে শুধু সোনালী আর তার মা-বাবা থাকে। কিন্তু হাবিলের মতো দেখতে আরেকজন সোনালী নামে কি করে আসবে? আর যদি সে থাকেই তাহলে ওই সোনালী কোথায়? সোনালী কোথায় যাবে, আর হাবিলই বা কেন মিথ্যা বলবে?

সেসময়ই শামিম বের হলো। সে চিন্তিত চেহেরায় বললো,
‘ স্যার এটা অসম্ভব। আপনার দেখা আর আপনার ড্রোনে রেকর্ড হওয়া সোনালী সে হতেই পারেনা।

রোজান মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,
‘ হুম সোনালী প্রায় আমার সমান লম্বা । আর ঘরের মেয়েটা তো অনেক খাটো। আর এতো কাছ থেকে অনূভব করা আমার সোনালী কোনোক্রমেই মিথ্যে কিংবা ভ্রম হতে পারেনা।

শামিম হঠাৎ বলে উঠলো,
‘স্যার সোনালী কি পালিয়ে গেছে? সে কি কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলো আমাদের আসার ব্যপারে কিংবা দিয়ালী ম্যামের আসার ব্যপারে?

রোজান এটা শুনে অদ্ভুতভাবে চমকে উঠলো। তাইতো! সোনালী কি টের পেয়ে গিয়েছিল? হ্যাঁ এটা নিঃসন্দেহে ঠিক যে সোনালী বেশ রহস্যময়। এইতো সেদিন তাকে নাম ধরে ডেকে ফেলা, সবকিছু আগেই বলে দেওয়া, আবার হুট করে জড়িয়ে ধরা। কি আছে এসবের পেছনে? সোনালী এসব কীভাবে জানে?

রোজান একবার ভেতরের দিকে তাকাচ্ছে আবার বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে পায়চারী করছে। সোনালীর হাতের লেখাও নিখুঁত সুন্দর, এটা ঘরোয়া হাতেখড়িতে সম্ভব বলে মনে হচ্ছেনা, অবশ্যই সোনালী পড়ালেখা করেছে কিংবা করে।

হঠাৎ রোজান ভেতরে একটা মহিলা কণ্ঠে শুনতে পেলো,
‘ আপনি আসল কাহিনি কইতাছেন না ক্যান? এরারে কইয়া দেন, বিশ্বাস করলে করবো না করলে নাই।

রোজান এটা শুনতেই বড় বড় চার কদমে ভেতরে চলে এলো। ততক্ষণে হাবিল সাহেব বলতে শুরু করলো,
‘ আপনেরা শহুরে সাহেবরা বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু কথা হইতাছে এটাই সইত্য। এই এলাকা কোনো সময় নিষিদ্ধ আছিলো, আমি এইহানে যহন আইছিলাম তহন একটা কাক পক্কিও দেখতাম না। হুনছি এইহানে জ্বীন পরীর আবাস আছিলো। কিন্তু আমরা আইয়া যহন ঘর বানলাম, তহন চইলা গেছে, কিন্তু মাঝে মাঝে দেহা দেয়। হইতে পারে সোনালীর যেই কথা কইতাছেন সেইটাও এমন হইবো। আপনারার বর্ণনা অনুযায়ে এমন রূপবতী জঙ্গলে থাকার কথা ভাবনও অসম্ভব।

রোজান হা করে শুনছে। হাবিল এসব কি বলছে? সোনালী পরী হলে ক্যামেরায় আসবে কি করে? নাকি মানুষ রূপে থাকলে এটা সম্ভব?
সে দেখলো সবাই হাবিলের কথাকে বিশ্বাসের সাথে নিয়েছে। নিচু করে তারা যুক্তিকে সায় দিচ্ছে।
রোজান তীব্রভাবে ঘামতে লাগলো! তার মাথায় চলছে সেদিন সোনালী কি করে আগে আগে সবকিছু বলে দিচ্ছিলো। তাহলে কি হাবিলের কথা?
না না এটা কীভাবে মানবে রোজান?

রোজান মানতে না পারলেও হাবিল তাদেরকে তার বাড়িতে আর মানলোনা। সে সবাইকে ঠেলে বের করতে লাগলো। কিন্তু রোজান খেয়াল করছে দিয়ালী এখনো কাঁদছে, এই মানুষটা সেই কতো বছর থেকে সন্তানের জন্য হাহাকার করছে! কিন্তু এবারও পেলোনা।

এবার রোজানকে নিয়েই তার বাবা নৌকায় উঠলো। একবারও জিজ্ঞেস করেনি কীভাবে এইপাড়ে আসলো! দিয়ালী আর লোক হেলিকপ্টারে উঠে গেছে। মাঝ নদীতে রোজান বললো,
‘ মা বাবাকে নিয়ে চলে যেও তুমি। আমি আজকে যাবোনা। শামিমকে নিয়ে ওর বান্ধবীর বাড়ি যাবো।

রোজানের বাবা আড় চোখে তাকিয়েও চুপ থাকলো।
আর রোজানকে যাওয়ার জন্য রোজানের বাবা কোনো জোরও করলোনা।

রাতে রোজান শামিমকে নিয়ে সেই হোটেলেই রাত্রিযাপন করলো। তার বিশ্বাস পরেরদিন গেলে সে ঠিক সোনালীকে দেখতে পাবে।
সেই আশায় আর কিছু ভয়ে সারারাত ঘুমালোনা।
পরেরদিন রোজান জসিমকে দিয়ে আবার সেই কলাগাছের নৌকা বানিয়ে রওয়ানা দিলো। ভেতরে ভীষণ রকম ভয়। কিন্তু জসিম বারবার বলছে হাবিলের কথা সব মিথ্যে, সোনালী অবশ্যই আছে। সবাইকে দেখানো সেই কালো মেয়েটা নয়। সোনালী চুলের অধিকারীর অস্তিত্ব আছেই আছে।

পাড়ে গিয়ে খুব সতর্কতার সাথে রোজান চারদিকে সোনালীর আগমন খুঁজতে লাগলো। কিন্তু নাহ আজকে আর সোনালীকে দেখা যাচ্ছেনা। এভাবে রোজান কোন ভরসায় ওই পাড়ে যাবে?
সে এদিক ওদিক ঘুরছিলো আর বারবার দেখছিলো সোনালীকে দেখা যায় কিনা!
তারপর সিদ্ধান্ত নিলো আজকে ওইপাড়ে গিয়ে বিপদে পড়বেনা, বরং পারাপারের এই জিনিসটা এখানে কোথাও লুকিয়ে রাখবে, সোনালীর দেখা যখন মিলবে তখনই সে যাবে।


এরপরও রোজান অনেক সময় বসে ছিলো। বসে থাকতে থাকতে হঠাৎই ওই পাড়ের একটা জায়গায় তার চোখ আটকে গেলো। কোনো এক আশংকায় সে বলে উঠলো,
‘ আমি এখনি ওইপাড়ে যাবো।

জসিম কিছুটা অবাক হলেও কোনো প্রশ্ন না করে তাকে নদীতে ভাসতে সাহায্য করলো। রোজান খুব তাড়াহুড়ো করে পাড় পর্যন্ত পৌঁছেই একটা দৌঁড়ে সেই গাছটার কাছে গেলো যেখানে সোনালীকে প্রথম দেখছিলো তার চিঠি পুঁতে ফেলতে। সে সেখানে গিয়েই বালি সরাতে লাগলো। কিছু বালি সরিয়েই রোজান একটা সাদা কাগজের অস্তিত্ব পেলো। সে এটাকে তুলে আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত আবার উঠে এইপাড়ে আসতে লাগলো। কেউ দেখার আগেই সে নেমে কোনো রকম গাছের আড়ালে গিয়ে কাগজটা খুলে দেখলো সেখানে লেখা,

‘ তোমার মামা এবং বাবার লোকেরা এখনো আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তাদের বিশ্বাস তুমি যেহেতু যাচ্ছোনা, সেহেতু আমি নিশ্চয়ই আছি এবং বের হবো। হ্যাঁ রোজান আমি আছি, খুব নিরাপদে আছি। আর খুব শীগ্রই তোমার সাথে আমার দেখা হচ্ছে। ‘

রোজান চরম মাত্রায় চমকে উঠলো। সোনালী ওখানে চিঠি রাখলে যে রোজান খুঁজে পাবে সেটা কি করে ভাবলো?

চলবে…..

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

#সোনালী [১০]

রোজানের সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ! চিঠিটা হাতে নিয়ে সে কাঁপছে।
ভেতরে উত্তাপ তবুও হাতদুটো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। সোনালী? এই সোনালীর পেছনে ছুটতে ছুটতে কোনো বিপদে পড়তে যাচ্ছেনা তো? রোজান নিজেও এটা আঁচ করতে পারছিলো তার মামা আর বাবার লোকেরা চারপাশে থাকবে। কিন্তু সোনালী কোথায় থাকছে? তাকে তো পুরো জঙ্গলেও তন্নতন্ন করে খুঁজেছে। কি এমন জায়গায় সে এতো নিরাপদে অবস্থান করছে বললো?
রোজানের বিশ্বাস ভিন্ন মোড় নিচ্ছে!
সে এক পা দু পা করে শুধু পিছিয়ে যাচ্ছে।
শামিম বিষয়টা খেয়াল করে বললো,

‘ স্যার আপনি ঠিক আছেন? এমন করছেন কেন?

রোজান চোখ তুলে তাকিয়ে বললো,
‘ হাহ? তুমি কি কিছু বলছো?

শামিম আরেকটু এগিয়ে বললো,
‘ আপনি কাঁপছেন স্যার!

রোজান চোখ কচলে বললো,
‘ তুমি এটা পড়ো শামিম।

শামিম চিঠিটা পড়ে বললো,
‘ ওখানকার বালির নিচে পেয়েছেন?

রোজান মাথা নেড়ে বললো,
‘ হ্যাঁ! কিন্তু আমি সেই বালির নিচে কিছু আছে কিনা এমন সন্দেহে ওখানে গেলাম কেন শামিম? আর সোনালী আমার প্রথম চিরকুটটা যে ওখানে পুঁতেছিলো সেটাও আমি লুকিয়ে দেখেছিলাম, সে কি করে জানে যে আমি সেই জায়গা চেক করবো?

শামিম এবার ভয়ে ভয়ে জসিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আঙ্কেল! কিসব হচ্ছে? এখানে কি আসলেই অদ্ভুত কিছু রয়েছে?

জসিম একটু ভেবে বললো,
‘ অহন তো আমারই ডর লাগতাছে। আমি তো এমনডা জানতাম না। তয় অইডা জানতাম হাবিলের সুন্দর মাইয়া আছে, যার লাইজ্ঞা হে ওইপাড়ে কাউরে যাইতে দেয়না। বলছিলাম না নজর দেওনের অপরাধে ঘুরতে আওয়া এক ছেলের হাত অবশ কইরা ফালাইছিলো?

রোজান চোখ ঘুরিয়ে বললো,
‘ তাইতো! তাহলে তো নিশ্চয়ই আছে সুন্দরী মেয়ে।

এটা বলেই আবার থেমে গেলো। কান্না কান্না স্বরে বললো,
‘ আমার এমন লাগছে কেন ? শামিম আমার সবকিছু এলোমেলো লাগছে! প্লিজ হোটেলে ফিরে চলো। আমি আর আসবোনা এখানে। মনে হচ্ছে আমি সত্যিই কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছি। আমার চারপাশের সবকিছু আমার ভ্রম। প্লিজ শামিম আমাকে নিয়ে চলো! এসব মিথ্যে।

শামিম বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। জসিম রোজানের শরীর ছুঁয়ে বলছে,
‘ হঠাৎ তোমার কিতা হইলো বাপ?

রোজান একটু সরে গিয়ে মাথায় চেপে ধরে বললো,
‘ কিছু হয়নি, আমার কাছে সবকিছু অবাস্তব লাগছে। একদম সবকিছু। আপনাদেরকেও আমার বিশ্বাস হচ্ছনা, আসলেই আপনাদের সাথে স্বশরীরে আছি নাকি ভ্রমের মধ্যে দেখছি, বুঝতে পারছিনা। প্লিজ আমি ফিরে যেতে চাই, আমি ফিরে যেতে চাই। আমাকে সাহায্য করুন, আমি কালকেই আমার মা’র কাছে ফিরে যেতে চাই।

শামিম বোকার মতো কিছুক্ষণ রোজানের কথা শুনলো, তারপর আশেপাশে তাকিয়ে রোজানের হাত ধরে বললো,
‘ আসুন স্যার। আপনি প্লিজ শান্ত হোন। আসলে এতগুলো প্রশ্ন রেখে চলছে মেয়েটা যে আপনি কিছু বিশ্বাস করতে পারছেন না।

রোজান আড়চোখে শামিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ আরে মেয়ে থাকলে তো! কেউ নেই, এমন মেয়ে নেই। সব চোখের ধোকা, সব ধোকা শামিম।

শামিম আর কথা বাড়ালোনা। বুঝতেও পারলোনা রোজানের হঠাৎ কি হলো! সে রোজানের হাত ধরে জঙ্গল পেরুলো। হোটেলে গিয়ে রোজানের গায়ে কম্বল মুড়িয়ে দিয়ে সে বললো,
‘ আপনি শুয়ে থাকুন স্যার, আমি মায়াকে দেখতে যাবো। আপনার গাড়ীটা নিয়ে যাচ্ছি কেমন? ফিরে আসবো শীগ্রই।

রোজান চোখ পিটপিট করে খুলে বললো,
‘ মায়া আসলে আছে তো? নাকি সোনালীর মতো!

শামিম হাসলো। আর চাবি হাতে বেড়িয়ে গেলো। নির্ঘুম কাটিয়ে, এতো এতো চিন্তা আর ধাঁধার মধ্যে পড়ে তার বসের মাথা ঠিক নেই, আর কারই বা থাকবে? শুধু মনকে বারবার বুঝাচ্ছে বলে শামিমও সোনালীকে অদ্ভুত কিছু ভাবতে পারছেনা। সে এটা মনে হওয়ার আগেই নিজেকে বলে, না সে নিজে দেখেছে সোনালীকে, সোনালী জলজ্যান্ত মানুষ ছাড়া কিছু না।

শামিম ফিরলো সন্ধ্যায়। ফিরে দেখলো রোজান ঘুমিয়ে আছে। সে প্রথম ভাবলো খাবার জন্য শামিমকে ডাকবে। দুপুরেও খায়নি। তারপর আবার ভাবলো জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উচিত। এই অবস্থায় উনি খাবে কিনা কে জানে!
শামিম আস্তে আস্তে রোজানের কাছে গিয়ে কম্বলের উপরেই হাত রেখে বললো,
‘ স্যার কি খাবেন?

হাত রাখতেই শামিম চমকে উঠলো, কম্বল তীব্রতর গরম হয়ে আছে। সে দ্রুত কম্বল সরিয়ে কপালে হাত রাখতেই আরো আৎকে উঠলো। রোজানের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে! কোনো ভয়ংকর রকম ভয় থেকে জ্বর আসলো নাকি?
শামিম দৌঁড়ে হোটেল রুমের বাইরে গিয়ে একজনকে ডেকে বললো,
‘ প্লিজ আমাকে সাহায্য করুন, আমার বন্ধু ভীষণ অসুস্থ। তাকে এখনি হাসপাতাল নিতে হবে।

লোকটা এগিয়ে আসলো। রোজানকে ধরে গাড়ীতে তুলে দিলো। ডক্টরের কাছে যাওয়ার পরে ডক্টর অভয় দিয়ে বললো, আপাতত জ্বর ছাড়া সমস্যা নাই। একদুইদিন রিলাক্স থেকে ঔষধগুলো খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা ইনজেকশন পুশ করে বললো,
‘ উনি বাসায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। নিয়ে যেতে পারুন।

শামিম একজনের সহায়তায় রোজানকে আবার তুলে হোটেলে চললো। এখানকার কেবিনগুলো জরুরী অবস্থায় সব রোগী দিয়ে বুক হয়ে আছে, তাই এখানে ডক্টর রাখতে ইচ্ছুক নন। কোনো উপায়ন্তর না দেখে ভয়ে ভয়ে শামিম হোটেলে ফিরলো।
কিন্তু হঠাৎ জ্বর আসার কারণ হিসেবে ধরতে পারলো রোজানের ভেতরকার ভয়! সে সোনালীকে গভীর থেকে ভাবতে গিয়ে যেন কিছুই মিলাতে পারছেনা, সবশেষে সে তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে, আর এসবেই বেশ ভয় পাচ্ছে। আর তাই বোধহয় এমন ভয়ংকর জ্বর আসছে!

রাতে সবকিছু ঠিক ছিলো। রোজান বেশি কথা বলেনি, কিন্তু শামিম রোজানের সর্বোচ্চ দেখাশোনা এবং যত্নে বিভোর ছিল। সারারাত কপালে পানিপট্টি দিয়েছে। রোজানও বারবার চোখ খুলে শামিমের ভীত চেহেরা দেখছিলো। রোজানের এমন অবস্থা দেখেই হয়তো তার এই ভীতি। শামিম সারারাত ঘুমালোনা।

ফজরের আজান দিচ্ছে। শামিম তখন ঘুমে কাতর, রোজান দেখছিলো শামিম ঘুমে ঢুলছে! রোজান তাকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য ধমক দিলো। তারও এখন কিছুটা ভালো লাগছে। জ্বরটা কমেছে,কিন্তু মস্তিষ্ক অস্বাভাবিকরকম বিপর্যস্ত লাগছে।
আগেরদিন সারা বিকেল, আবার সারারাত ঘুমিয়ে তার আর ঘুম নেই। শামিম শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে!

সে শামিমের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো সারারাত পাগলের মতো ছুটাছুটি করে কতো সুন্দর করে এখন ঘুমাচ্ছে। আসলেই শামিমের তুলনা হয়না, এবার ফিরেই শামিমকে ম্যানাজার পদে নিয়োগ করবে বলে ভাবলো নিলো সে, আর তার বেতন তিনগুণ করে দিবে।

ভোরের আলো প্রায় ফুটতে চলেছে। রোজান তখনও ভেতরে ভেতরে সোনালীকে ভেবে ভয় পাচ্ছে। আর সেসময়ই হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হলো। রোজান শামিমকে না ডেকে নিজেই ধির পায়ে দরজার দিকে এগুলো। ভাবলো রুম চেকিং দিতে কেউ আসছে বোধহয়।
রোজানের চোখে ভীষণ ব্যথা, অদ্ভুত রকমের লালও হয়ে আছে। আর রাতের করুণ অবস্থায় এখন ঝাপসা দেখছে সবকিছু। তবুও সে দরজা খুলে না তাকিয়েই বললো,
‘ এতো সকালে কি?

তারপর সামনে সে একজনের ছায়া দেখে চিৎকার মেরে বললো,
‘ শামিম ভূত। দেখো দেখো ওর চোখ নীল।

শামিম লাফিয়ে ওঠে তাকালো। দেখলো বোরকা পরিহিত একজন দাঁড়িয়ে আছে। শামিমকে ওঠতে দেখেই মেয়েটা বললো,
‘ আমি সোনালী।

এটা বলা শেষ না হতেই রোজান জোরে দরজা বন্ধ করে বললো,
‘ এ মানুষ নয়, ও এখানেও চলে আসছে!

কিন্তু রোজান শুনতে পাচ্ছে বাইরে থেকে বলতেছে,
‘ আরে আমি সোনালী, দরজা খুলো রোজান। আমি তোমার অসুস্থতার সংবাদে ছুটে এসেছি।

রোজান বুকে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,
‘ শামিম আমাকে ধরো প্লিজ। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।

শামিমও অবাক চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, রোজানের অসুস্থতার কথা সোনালী কীভাবে জানতে পারলো?

চলবে…….

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here