#মেঘের_অন্তরালে,পর্বঃ ১৪
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
হাতের কাটা দাগটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইসরা। সাতটা বছর চলে গেছে, হাতের ক্ষতটা অনেক আগেই সেরে গিয়েছে। তবে দাগটা রয়ে গেছে এখনো।
ইসরা আনমনে বলে উঠলো, সাতটা বছর কম সময় নয় মিস্টার নিহান রেজওয়ান। হাতের ক্ষতটার মতো, আপনাদের দেওয়া মনের ক্ষতগুলো অনেক আগেই সেরে গেছে। তবে দাগগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই। সেই দাগগুলো কখনো মুছবে না। চইলেও ভুলতে পারি না, আপনাদের করা সেই অপমানগুলো। আপনাদের জন্য আমার জীবন থেকে যা হারিয়েছে তার জন্য কখনো মাফ করবো না আপনাদের। মাঝে মাঝে খুব জানতে ইচ্ছে করে। নিজের মনের মতো স্ত্রী নিয়ে কেমন চলছে আপনার জীবন ? কতটা সুখী করতে পেরেছে আপনার সুন্দরী স্ত্রী, জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজেকে সামলে নেই আবার, অতীতের কোনো জায়গা নেই আমার জীবনে। সেদিন সুইসাইডের চেষ্টা করে আমার মৃত্যু না, নতুন করে জন্ম হয়েছিলো। আগের সেই ইসরা মারা গিয়েছে সেদিন। জীবনে একদিন আপনার সামনে দাঁড়াবো, এটা বুঝাতে আপনি ছেড়ে গেছেন বলে আমি মেঘের অন্তরালে হারিয়ে যাইনি। মেঘের অন্তরাল থেকে সূর্যের আলোর মতো জ্বলজ্বল করছি। আমি ঠিক ততটা ভালো আছি, যতটা আপনার সাথে থাকলে কোনোদিন থাকতে পারতাম না। আমার সাথে যা করেছেন তার জন্য কোনো অভিযোগ নেই আপনার উপর, বরং আমি আপনার উপর কৃতজ্ঞ। জীবনের কঠিন সময়টুকু পারি দিতে আপনাদের করা অপমানগুলো আমাকে পাথরের মতো শক্ত হতে সাহায্য করেছে। কিন্তু আমার বাবার সাথে যা করেছেন তার জন্য কখনো মাফ করবো না।
আপু আজকে তো পেশেন্ট নেই তেমন, বিকেলে ঘুরতে যাবি ?
পেশেন্টের চাপ কম থাকায় মেডিসিন গোছাচ্ছিল, তখনই চোখ পরে হাতের কাটা দাগটার দিকে। গভীর ভাবে কেটেছিল বলে দাগটা এখনো স্পষ্ট, সেটা দেখে অতীত বিচরণ করছিলো ইসরা। এতো বছর পেরিয়ে গেছে তবু চোখ বন্ধ করলে প্রত্যেকটা অপমান এখনো কানে বাজে ইসরার। চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রেজওয়ান বাড়িতে কাটানো বিষাদময় সেই দুই মাস। ইসরার জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম দুই মাস ছিলো সেটা। ইমনের ডাকে ইসরা ঘোর কাটে।
তুই তো ইচ্ছে মতো ঘুরছিস, আমাকে টানছিস কেনো এর মধ্যে ?
ইমন পাশের চেয়ারে বসে বললো, ইশ আপু তুই না একটা নিরামিষ। এতো সুন্দর একটা জায়গায় এতোদিন থেকেও যদি কিছু না দেখিস, তাহলে আসাটাই বৃথা যাবে তোর।
আমি এখানে বেড়াতে নয় বরং চিকিৎসা করতে এসেছি।
সেটা তো করছিসই, আমি তোকে কাজ বাদ দিয়ে যেতে বলছি নাকি ?
ইসরা কাজ রেখে ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো, আমরা আর কতদিন আছি এখানে ?
ইমন হিসাব করে বললে, এই তো সাতদিনের মতো।
যাওয়া আগের দিন, যেখানে যেতে বলবি সেখানেই যাবো।
ইমন মুখ ফুলিয়ে চলে গেলো ইসরার সামনে থেকে। আয়মান লেকের দিকে তাকিয়ে বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মান এখানে আছে আজ পাঁচদিনের মতো হলো। এখন খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে পারে, তবে ক্ষতটা গভীর হওয়ায় ঠিক হয়নি এখনো। ছোট ছোট যা আঘাত পেয়েছিলো, সবই ঠিক হয়ে গেছে অনেকটা। আয়মান ভাবছে ইসরার কথা। এই পাঁচদিন ইসরাই আয়মানের দেখাশোনা করেছে। ইসরা যতটা সময় আয়মানের সামনে থাকে অদ্ভুত অনুভূতি হয় আয়মানের। আয়মান শত চেষ্টা করেও সেই অনুভূতির কোনো নাম দিতে পারছে না। ইমন মুখ ফুলিয়ে আয়মানের পাশে এসে দাঁড়ালো।
আয়মান ইমনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললো, গাল ফুলানো মেয়েদের অভ্যাস। ছেলেটা গাল ফুলিয়ে থাকলে দেখে হাসি পায়।
মজা করবেন না ভাইয়া। আমি একদমই মজা করার মুডে নেই এখন।
ইমন এখন আয়মানকে ভাইয়া বলেই ডাকে। ইমন বারবার আয়মানে স্যার বলছিলো, তাতে অস্বস্তি হতো আয়মানের। তাই বলেছে যেনো ভাইয়া বলেই ডাকে।
তা কী কারণে মুড অফ তোমার ?
আপুকে বললাম আজ পেশেন্টের চাপ কম। চল বিকেলে কোথায় ঘুরতে যাই। কিন্তু গোমড়ামুখোটা রাজি হলো না।
তোমার আপু কী সবসময় এমন ?
ইমনের মুখটায় হঠাৎই কালো মেঘ ভীড় করলো মলিন গলায় বললো , আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আপু এমন ছিলো না। আপুর হাসির আওয়াজে বাড়ি মুখরিত হয়ে থাকতো সবসময়। মা মাঝে মাঝে রাগ করে বলতো ইশু মেয়েদের এতো শব্দ করে হাঁসতে নেই, লোকে খারাপ বলবে। আপুর সেই হাসি আর দেখা যায় না কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। এখন আপুর যে হাসিটা দেখা যায় সে হাসিতে কোনো প্রাণ থাকে না। কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে মানুষের সামনে নিজেকে হ্যাপি প্রমাণ করতে চায়।
আয়মান খুব মনোযোগ দিয়ে ইমনের কথা শুনছে।
ইমন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তারপর হঠাৎ করেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। আপুকে মন খোলে হাসতে দেখি না আজ কতগুলো বছর।
আয়মান কৌতূহল নিয়ে বললো, এমন হয়ে যাওয়ার কারণ ?
ইমন রাগে চোখ মুখ লাল করে বললো, এমন কিছু মানুষ এর জন্য দায়ী, তাদের কখনো মাফ করবো না আমি।
ইমন আর কিছু না বলে চলে গেলো আয়মানের সামনে থেকে। আয়মান কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইমনের যাওয়ার পথের দিকে।
২৪.
তুই আমাদের সাথে খেলতে পারবি না, তুই দূরে যা।
নিশিতা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আমি কেনো খেলতে পারবো না ?
তুই যে কালো, আমাদের সাথে ছোঁয়া লাগলে আমরাও তোর মতো কালো হয়ে যাবো। তুই দূরে যা, এখানে আসবি না।
নিশিতা এবার শব্দ করে কাঁদতে লাগলো। নিহান এসব দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ মেয়ের সাথে সময় কাটাবে বলে অফিস থেকে আগেই চলে এসেছে। নিশিতা পাশের পার্কে খেলতে এসেছে শুনে নিহান ফ্রেশ হয়ে মেয়ের কাছে এসেছে। মনিরা সাথে এসেছে নিশিতার তবে সে অন্য মহিলাদের সাথে গল্প করতে ব্যস্ত।
নিশিতা,,,
নিজের পাপার আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকালো নিশিতা। নিহানকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।
কাঁদতে কাঁদতে বললো, পাপা আমাকে ওদের সাথে খেলায় নিবে না। আমি ছুঁয়ে দিলে ওরাও নাকি আমার মতো কালো হয়ে যাবে। পাপা আমি তো তোমাকে কত ছুঁই, দাদুকে ছুঁই তোমরা তো কালো হওনি।
মেয়ের কান্না শুনে নিহানের কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়ের চোখের এক ফোঁটা পানি তার বুকে তীরের মতো আঘাত করছে। ইচ্ছে করছে পুরো পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে।
নিহান ধরা গলায় বললো, কাঁদে না মা। কিছু হয়নি একদম কাঁদবে না।
নিহান নিশিতার দু গালে ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে চুমু খেলো। নিশিতাকে কোলে তুলে সেই বাচ্চাদের কাছে গেলো। যে মেয়েটা নিশিতাকে এসব বলছিলো তাকে কাছে ডাকলো।
তোমার নাম কী মামুনি ?
মেয়েটা মুখ কালো করে বললো, আনিকা।
তো আনিকা মামুনি তোমার মনে হচ্ছে নিশিতা তোমায় ছুঁয়ে দিলে তুমিও কালো হয়ে যাবে।
হ্যাঁ হয়ে যাবো তো আর আমি এমন বিশ্রি দেখতে হতে চাই না।
কথাটা নিহানের বুকে আঘাত করলো। চোখ বন্ধ করে নিজের কষ্টটা গিলে নিলো।
দেখো নিশিতাকে আমি কোলে তুলে আছি। আমি কী কালো হয়ে গেছি ? নিশিতা সবসময় তার দাদীর কোলে থাকে, সে কী কালো হয়ে গেছে ?
আনিকা একটু ভেবে বললো, না।
তাহলে তোমরা কেনো কালো হয়ে যাবে নিশিতা ছুঁয়ে দিলে ? আর তোমার গায়ের দিকে তাকিয়ে দেখো কী রঙের জামা পড়েছো ?
আনিকা নিজের দিকে তাকিয়ে বললো, কালো ।
কালো রঙের জামা পড়ে তুমি কালো হয়ে যাচ্ছো না, তাহলে নিশিতা ছুঁয়ে দিলে কালো হয়ে যাবে ?
আনিকা কিছু না বলে মাথা নিচু করে ফেললো। নিহান আনিকার মাথায় হাত রেখে মনে মনে বললো, তুই তো বাচ্চা মেয়ে, অবুঝ। আমি একজন শিক্ষিত আর বুঝদার মানুষ হয়ে অমানুষের মতো আচরণে করেছি তাদের সাথে। আজ ঠিক বুঝতে পারছি তাদের কষ্টগুলো।
নিহান মুচকি হেঁসে বললো, নিশিতা কী খেলতে পারে তোমাদের সাথে ?
আনিকা মুচকি হেঁসে নিশিতার হাত ধরে নিজের সাথে নিয়ে গেলো। বাকি সবাইও নিশিতাকে তাদের সাথে খেলতে দিতে রাজি হয়ে গেলো। নিশিতার মুখে আবার হাসি ফোটে উঠলো। নিহানের চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কেবল তো শুরু, তার মেয়েকেও হয়তো জীবনে আরো অনেক মানুষের কথা শুনতে হবে। আজ বুঝতে পারছে ইসরার বাবার অবস্থা। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে নিহান নিজেও আজ যে কোনো কিছু করতে রাজি। ইসরার বাবাও সেটাই তো করেছিলো, তবে তার পথটা ভুল ছিলো। নিহান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পাশের বেঞ্চে বসে মেয়ের খিলখিল হাসি দেখতে লাগলো।
সন্ধ্যার আগে নিহান মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো, মনিরাকে আগেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলো। নিশিতা বাড়ি ফিরে দৌড়ে দাদীর কাছে চলে গেলো। নিহান রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে মাগরিবের নামাজে চলে গেলো। মোনাজাতে নিজের করা সব অন্যায়ের জন্য মাফ চাইলো আল্লাহর কাছে। তার পাপের শাস্তি যেনো তার মেয়ে না পায় আল্লাহর কাছে হাত তুলে কাঁদতে লাগলো। বাড়ি ফিরে মেয়েকে পড়তে বসালো। পড়ানোর মাঝেই খাইয়ে দিলো নাহলে না খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে। নিশিতা টিভিতে কার্টুন দেখছে আর বাকি সবাই ডিনার করছে।
আকরাম রেজওয়ান থমথমে গলায় বললো, নিহান তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।
নিহান খাওয়া রেখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, কী কথা বাবা ?
এভাবে আর কতদিন চলবে ?
মানে ?
তোমার কী মনে হয় না, তোমার এবার নিজের জীবন নিয়ে আগানো উচিত। আর কতদিন এভাবে একা থাকবে ? আমি ভাবছি তোমার আবার বিয়ে করা উচিত।
নিহান থম মেরে গেলো আকরাম রেজওয়ানের কথা শুনে। বিয়ে নামক সম্পর্কে আর জাড়ানোর ইচ্ছে নেই নিহানের। তার পৃথিবী এখন শুধু নিজের মেয়েকে নিয়ে।
একবার নয় বাবা, দু’বার তো হলো আর কত। আমার জীবনে যদি সুখ থাকতো তবে দু দু’বার আমার সাথে এমন হতো না।
নিহান সবার জীবনেই কিছু অতীত থাকে। তোমার অতীতটা নাহয় একটু বিষাদময়। অতীত আঁকড়ে আর কতদিন পড়ে থাকবে। জীবনটা ছোট নয় নিহান, এখনো অনেকটা পথ সামনে পড়ে আছে।
আমি অতীত আঁকড়ে পরে নেই। আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ আমার মেয়েকে ঘিরে। নতুন করে আর কোন ঝামেলা আমি চাই না। আশা করি এ নিয়ে আর কোনো কথা হবে না।
নিহান খাওয়া শেষ না করেই উঠে গেলো।
নিশিতা অনেক রাত হয়েছে, চলো ঘুমাবে। সকালে তোমার স্কুল আছে কিন্তু।
পাপা আর একটু দেখি না।
নিহান ধমক দিয়ে বললো, নিশিতা বেশি কথা আমি পছন্দ করি না।
নিশিতা ভয়ে টিভি অফ করে নিহানের আগে আগে রুমে যেতে লাগলো। নিহানের বাবা মা দুজনেই তাদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। ছেলেটার জীবন এমন অগোছালো হয়ে যাবে কখনো ভাবেনি তারা।
ভাইয়া আমিরা কল দিয়েছিলো আজ।
থমথমে গলায় আমিরের কথা শুনে ঘুরে তাকালো আকরাম। আমিরের মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না, খুব একটা ভালো খবর আছে।
কী বললো আমিরা ?
ভাইয়া ও তো আর থাকতে পারছে না। বেয়াইন আর তুষারের বড় বোন আমিরাকে যেনো সহ্য করতে পারে না। সব কাজে দোষ ধরে, সামান্য বিষয়ে বকাঝকা করে আর তুষারও মা আর বোনকে কিছুই বলে না।
তাহলে কী করতে চাইছো এখন ?
মেয়েটার কথা শুনে তুষারকে মেনে নেওয়াটাই ভুল ছিলো আমাদের। ছেলেটা আগে যেমন ছিলো এখন আর তেমনটা নেই। কী করবো কিছু বুঝতে পারছি না।
আমিরা ভালোবেসে বিয়ে করেছে তুষারকে। আমিরার পরিবারও মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে মেনে নিয়েছে। তুষারের পরিবারের পছন্দ ছিলো না আমিরাকে। সেটা নিয়ে শুরু থেকেই ঝামেলা ছিলো, দিন দিন যেনো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রথম দিকে তুষার আমিরাকে সাপোর্ট করলেও সেও এখন তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। ভাইয়ের সংসারে বোনদের বাড়াবাড়ি করা কতটা খারাপ আমিরা ঠিক বুঝতে পারছে এখন। সে ইসরাকে যতটা জ্বালিয়েছে তার থেকে কয়েকগুণ তার ননদ তাকে জ্বালিয়ে মারছে। স্বামী বিদেশে আছে বলে সেও বাপের বাড়ি পরে আছে আর মায়ের সাথে মিলে আমিরাকে জ্বালিয়ে মারছে।
২৫.
কী করছেন মিস ডক্টর ?
আয়মানের কথায় ইসরা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাঁসলো। অনেকটা ফ্রী হয়ে গেছে তারা।
এই তো বসে আছি, তা আপনার পায়ের কী অবস্থা এখন ?
আয়মান ইসরার পাশে ঘাসের উপর বসে বললো, এই যে হাঁটতে পারছি খুড়িয়ে খুড়িয়ে।
আপনার বন্ধুরা তো খোঁজতেও এলো না একবার।
খোঁজছে না সেটাও বা বুঝি কী করে আর ওরা কী অবস্থায় আছে সেটাও তো বুঝতে পারছি না। আদৌও সবাই সুস্থ আছে কিনা কে জানে ? আর আমিও যাওয়ার মতো সুস্থ নই।
এখনো তো ঠিক মতো হাঁটতে পারছেন না। তবে আশা করি আর দু-তিন দিনের মধ্যে অনেকটা সেরে যাবে।
হুম সেটা হলেই ভালো।
ইসরা কিছু বললো না, দুজনেই চুপচাপ কিছু সময় বসে রইলো। আয়মান আড়চোখে বারবার ইসরার দিকে তাকাচ্ছে, তবে ইসরার দৃষ্টি দূরের পাহাড়ের দিকে।
আপনি সবসময় এমন চুপচাপ থাকেন ?
ইসরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, কোথায় চুপচাপ থাকি ? নিজের পেশার জন্য হলেও বকবক করতে হয়।
প্রয়োজন ছাড়া কথা খুব কম বলেন।
অপ্রয়োজনীয় কথা বলে লাভই বা কী ?
অপ্রয়োজনীয় কথায় মন হালকা থাকে।
আপনাকে দেখেও মন হচ্ছে না প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলেন। যেটা নিজে করেন না সেটা আমাকে করতে বলছেন ?
আয়মান মুচকি হাঁসলো ইসরার কথায়। কথাটা ইসরা কিছু ভুল বলেনি।
আপনারা এখানে আর কতদিন আছেন ?
সাতদিনের মতো আছি, তবে সিউর বলতে পারছি না। সময় বাড়ানো হতে পারে।
আয়মান ছোট করে বললো, ওহ্।
ইমনের থেকে যতটা জেনেছি আপনি ইউএস থাকেন, এখানে কেউ নেই আপনার ?
ইসরার প্রশ্নটা কাঁটার মতো বিঁধল আয়মানের গায়ে। এই প্রশ্নটা সে বারবার এড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু ভাগ্য এই প্রশ্নের কাছে দাড় করায়। উত্তর না পেয়ে ইসরা আয়মানের দিকে তাকালো। মুখটা কেমন থমথমে হয়ে গেছে তার।
আর ইউ ওকে মিস্টার ফটোগ্রাফার ?
রাগের মাঝেই ইসরার ফটোগ্রাফার ডাক শুনে অবাক চোখে তাকালো আয়মান।
মিস্টার ফটোগ্রাফার, এটা আবার কেমন নাম ?
কেনো আপনি তো ফটোগ্রাফারই ?
সেটা আমার পেশা, আমার নাম নয়।
ডক্টরও কিন্তু আমার পেশা নাম নয়। ওকে, নামটা মনে হচ্ছে পছন্দ হয়নি। ঠিক আছে মিস্টার আয়মান ?
আয়মান মুচকি হেঁসে বললো, আয়মান রেজওয়ান নিশান।
আয়মানের কথায় চমকে উঠলো ইসরা। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে তার, হাসিখুশি মুখটা মেঘের অন্তরালে ঢাকা পরে গেছে।
ইসরা কাঁপা গলায় বললো, আয়মান রেজওয়ান নিশান ?
আয়মান মুচকি হেঁসে বললো, ইয়েস ম্যাম, নিশান নামটা এমন একজনের সাথে মিলানো যাকে আমার একদমই পছন্দ নয়। তাই সবার কাছে আমি আয়মান নামেই পরিচিত ?
ইসরা চোখ বন্ধ একটা একটা ঢোক গিললো, চোখ বন্ধ রেখেই বললো, আমির রেজওয়ান ?
ইসরার মুখে নিজের বাবার নাম শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো আয়মান আর বললো, আমার বাবা, কিন্তু আপনি জানলেন কী করে ?
ইসরা ফট করে চোখ খোলে তাকালো আয়মানের দিকে আর ভেজা গলায় বললো, রেজওয়ান পরিবার আমার জীবনের এমন একটা অধ্যায় যা চাইলেও ভুলতে পারবো না আমি। আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে, এই পরিবার। আমার বাবাকে কেড়ে নিয়েছে আমার জীবন থেকে। জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত একরাশ ঘৃণা থাকবে রেজওয়ান পরিবারের উপর।
কথাগুলো শেষ করে ইসরা এক মুহূর্ত দেরি না করে উঠে গেলো আয়মানের পাশ থেকে। আজ বড্ড মনে পড়ছে বাবার কথা। একটা ভুলের শাস্তি কাউকে নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয় জানা ছিলো না ইসরার। আয়মান হতভম্ব হয়ে বসে নিজের জায়গায়। ইসরার যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে।
চলবে,,,