#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি,১২,১৩
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#দ্বাদশ_পর্ব
১৮.
আজ রাশেদ খুব সকালে বেরিয়ে গেছে। ইমারজেন্সি থাকায় না খেয়ে বেরিয়ে গেছে। চন্দ্রা খুব তাড়াতাড়ি রান্না করে নিলো। যদিও রাশেদ বলেছে কেন্টিনে খেয়ে নিবে তারপরও চন্দ্রার খারাপ লাগছে। তাই ঠিক করলো রাশেদের হাসপাতালে যাবে। চন্দ্রা চট করে তৈরি হয়ে নিল। তারপর লাঞ্চবক্স নিয়ে বেরিয়ে গেল। হাসপাতালে ডুকে সে কনফিউজড হয়ে গেল। রাশেদের কেবিনটা যেন কোথায়? ভুলে গেল নাকি? কোন ফ্লোরে জানি? সব ফ্লোর তো দেখতে একই রকম। চন্দ্রা রিসেপশনিস্টের কাছে গেল। গিয়ে দেখলো অত্যাধুনিক এক রমনী বসে আছে। তার মুখে চড়া মেকআপ এবং ঠোঁটে মেরুন রংয়ের লিপষ্টিক। চন্দ্রা অবাক হলো। হাসপাতালে কেউ এভাবে সেজে আসতে পারে। রমনীকে একনজর দেখে চন্দ্রা নিজের দিকে তাকালো। এতো সাধারণভাবে এসেছে তো ওর নিজেরই লজ্জা লাগছে। ভার্সিটি লাইফের পারফেক্ট মেয়েটি যে যেকোন কারো সাথে প্রফেশনালি কথা বলতে পারতো, সবথেকে ভালো প্রেজেন্টেশন দিতো আজকে তাকে কিছুটা…না না কিছুটা না বেশ কনফিউজড দেখা যাচ্ছে। চন্দ্রার কাছে মনে হচ্ছে সে কথা বলতে ভুলে গেছে। রিসেপশনের কাছে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। রমনী অনেকক্ষণ চন্দ্রাকে খেয়াল করেছে।
এবার সে চমৎকার ইংরেজি অ্যাকসেন্টে উচ্চারণ করে চন্দ্রাকে বললো, ম্যাম হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?
চন্দ্রাী ঘোর ভাঙলো। সে ইতস্তত করে বললো, রাশেদ আছে?
কোন রাশেদের কথা বলছেন জানতে পারি?
ডক্টর রাশেদ।
রাশেদ নামে আমাদের এখানে তিনজন ডাক্তার আছেন।
রাশেদ আহমেদ, চাইল্ড স্পেশালিষ্ট।
ম্যাম তিনতলায় আছেন।
থ্যাংক ইউ।
ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মেম।
চন্দ্রা তরতর করে ওপরে চলে গেল। রাশেদের কেবিনের সামন এসে নক করলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ এলো না তাই সে নিজেই ডোর ঠেলে ঢুকে পড়লো। ভেতরে গিয়ে দেখে কেবিন ফাঁকা কেউ নেই। চন্দ্রা সোফায় বসে রাশেদের অপেক্ষা করছে। হাসপাতাল জায়গা বিশেষ পছন্দ নয় তার। তারপরও এখানে আসতে হলো। হয়তো এখন থেকে প্রায়ই আসতে হবে। না হলে দেখা যাবে সে না খেয়েই থাকবে। রাশেদ কেন্টিনের খাবার পছন্দ করে না। তাই না খেয়েই থাকে যেদিন খাবার না আনে। কথাটা চন্দ্রা জানতো না রাশেদের মা সেদিন কথায় কথায় বলেছিল তাই জানলো। কিছুক্ষণের মধ্যে রাশেদ ভেতরে এলো। চন্দ্রা রাশেদের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
রাশেদ অবাক হয়ে বললো, তুমি কখন এলে?
এইতো কিছুক্ষণ হলো।
হঠাৎ? কোন দরকার ছিল?
দরকার ছাড়া কেউ আসতে পারে না?
না কারন হাসপাতালে কেউ দরকার ছাড়া আসে না।
দরকারেই এসেছি।
সেটা কী?
দুপুরে খেয়েছেন?
না খাবো না। ক্ষিদে নেই। বাসায় গিয়ে খাবো একবারে।
খাবার নিয়ে এসেছি। খেয়ে নিন।
রাশেদ হা করে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, সত্যি?
মিথ্যে বলার মতো কী কিছু বলেছি?
সিরিয়াসলি?
হ্যাঁ।
রিয়েলি?
হ্যাঁ।
আসলেই?
এখন কিন্তু আমি চলে যাবো।
বলেই চন্দ্রা রাগ করে উঠে চলে যেতে রাশেদ হাত ধরে টেনে কাছে আনলো, তারপর ফিসফিস করে কানের কাছে বললো, আরে বোকা মজা করছিলাম।
চন্দ্রা ফিক করে হেসে বললো, আমিও।
বলেই হাত ছাড়তে চাইলো। রাশেদ ছাড়লো না উল্টো আরো শক্ত করে ধরলো। তারপর বললো, চন্দ্রাবতী আপনি কী প্রেমেটেমে পড়েছেন নাকি?
আপনার কী মনে হয়?
মনে তো হচ্ছে আমি ঠিকই ধরেছি।
তা আপনি কী খুশি নন?
খুব। এখন চলো খাবো। ক্ষিদে পেয়েছে।
এতোক্ষণ বকবক করলেন কেন?
আচ্ছা আর করবো না। আসো।
খুব তো বলছিলেন ক্ষিদে পায়নি।
আরে ওইটা ফর্মালিটির জন্য বলেছিলাম।
আচ্ছা চলুন। আমি বেড়ে দিচ্ছি। গ্লাস, প্লেট কোথায় আছে?
তুমি সোফায় বসো আমি নিয়ে আসছি চট করে।
আচ্ছা।
রাশেদ সবকিছু এনে চন্দ্রাকে দিলো। চন্দ্রা সুন্দর করে খাবার বাড়লো। এই মেয়ে খুবই অর্গানাইজ থাকতে পছন্দ করে। সব কাজ গুছিয়ে করে। এতো গুন তার বউটার! কিন্তু বউটার কপাল খারাপ। কারন তার বর নিজেও গুছিয়ে কাজ করে। তাই তার কাজ করার সুযোগ খুব কম। কিন্তু যতটুকু করে সুন্দর করে করতে চেষ্টা করে।
চন্দ্রা রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো, বসুন।
চন্দ্রা তুমি খেয়েছো? রাশেদ ভাত মাখাতে মাখাতে বললো।
না। গিয়ে খাবো।
হাঁ করো।
আমি খেয়ে নিবো বাসায় গিয়ে। আপনি খান।
এখান থেকে তুমি খেলে আমার ভাগে কম পড়বে না।
অবশ্যই পড়বে। এখানে একজনের খাবার।
কিছু হবে না। নাও।
রাশেদের জোরাজুরিতে চন্দ্রা খাবার মুখে নিল। তারপর রাশেদ নিজে খেলো। খাওয়া শেষে চন্দ্রা আবার সব গুছিয়ে নিল রাশেদের কাছে গিয়ে বললো, এবার যাই।
এখনই চলে যাবে? একটু বসো আমি নিয়ে দিয়ে আসবো।
আপনি এখন চেম্বারে বসবেন না?
না এখনো সময় হয়নি। আরো পরে। চলো তোমাকে দিয়ে আসি।
না না লাগবে না। আমি যেতে পারবো আপনি রেষ্ট নিন।
রেষ্ট নেওয়ার কী হলো? রেষ্ট নিতে হবে না।
আমি কিন্তু একা চলাচল করতে পারি। এই শহরে চার বছর ছিলাম।
সেটা অন্য ব্যাপার ছিল। তখন আমি ছিলাম না। এখন আমি আছি।
কেন জেদ করছেন?
জেদের কী হলো? আচ্ছা ঠিক আছে। সিএনজিতে অন্তত তুলে দেই। সেই পর্যন্ত যাই? নাকি সেটাও করা যাবে না?
চন্দ্রা ফিক করে হাসলো রাশেদের কথার ধরনে।
সেটা করা যাবে।
তাহলে চলো।
রাশেদ ইচ্ছে করলো চন্দ্রাকে আরো কিছুক্ষণ থাকতে বলতে। কিন্তু বললো না কারন সে খেয়াল করে দেখেছে চন্দ্রা হাসপাতালে ঢোকার পর থেকে নাক কুঁচকে রেখেছে। কড়া ফিনাইলের গন্ধ হয়তো সে সহ্য করতে পারে না। যদিও কেবিনের ভেতর এতোটা ফিনাইলের গন্ধ নেই তারপরও রাশেদ বেশ কয়েকবার ঘরে এয়ার ফ্রেশনার স্প্রে করলো। কিছুক্ষণ সে স্বাভাবিক থাকছে কিন্তু তারপরই আবার নাক কুঁচকে ফেলছে। তাই জোর করলো না।
চন্দ্রাকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে রাশেদ চন্দ্রাকে বললো, সাবধানে যাবে। ঠিক আছে?
চন্দ্রা মিষ্টি করে হাসলো। যার অর্থ আচ্ছা।
তারপর বললো, আপনিও সাবধানে যাবেন।
তারপর রাশেদ বয়ষ্ক সিএনজির ড্রাইভারকে বললো, চাচা ওকে সাবধানে নিয়ে যাবেন।
বয়স্ক ড্রাইভার পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসলো। রাশেদ ভাড়া দিয়ে দিল। তারপর পাশে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো চন্দ্রার উদ্দেশ্যে। চন্দ্রা চলে গেল।
১৯.
দুইদিন পরের কথা। রাশেদদের নাইট ডিউটি ছিল।সকাল বেরিয়েছিল তারপর রাত হয়ে গেল ফিরে নি। চন্দ্রার ঘুম আসছিল না বলে বারান্দার দাঁড়িয়ে ছিল। রাত দুইটা নাগাদ চন্দ্রার ফোনে ছোট্ট একটা মিসকল এলো। মিসকলের শব্দ শুনে ফোন নিয়ে আবার বারান্দায় এলো। রাশেদের ফোন থেকে মিসকল দেখে অবাক হলো। কেন জানি ভয় লাগছে? সে কাঁপা কাঁপা হাতে রাশেদের ফোনে কল করলো। পরপর তিনবারের মাথায় কেউ একজন ফোন ধরলো। অচেনা কন্ঠটি থেকে হ্যালো শুনে তার বুকের রক্ত জমে গেল। ঘোর ভাঙলো অচেনা কন্ঠটির কথায়।
হ্যালো আপনি নিশ্চয় মিসেস আহমেদ? তাই না?
চন্দ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, হ্যাঁ। আপনি কে? রাশেদ কোথায়?
উনি একটু অসুস্থ। আপনি কী একবার হাসপাতালে আসতে পারবেন?
চন্দ্রার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কী হয়েছে তার? কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কী হয়ে গেল?
কী হয়েছে উনার?
তেমন কিছু না মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল। আপনি চলে আসুন।
বলেই ফোন কেটে দিলো। চন্দ্রা কথা বলতে ভুলে গেল। মনে পড়ে গেল চৌদ্দ মাস আগের সেই কালো রাতের সূচনা পর্বের কথা। সেই একই ঘটনা, একটা ফোনকল আর তারপর? তারপর সব শেষ হয়ে গেছিলো। চিরদিনের মতো কেউ একজন চলে গেছিলো। তবে কী এবারও সবকিছু শেষ? কেন বারবার তার সাথেই এমন হয়? চন্দ্রা অনুভূতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আঁধারে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে যেন এখনো বুঝতে পারছে না কী হয়েছে? সে বারান্দায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো এতটুকুও নড়তে পারলো না। পা দুটো যেন অসাড় হয়ে আছে। পৃথিবী সমান ভার হয়ে রইলো তার বুক। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে চেতনা হারানোর পূর্বে সে সম্মতি ফিরে পেলো। না তাকে এভাবে থাকলে চলবে না। একজনকে সে হারিয়েছে। কিন্তু এই মানুষটাকে হারিয়ে ফেললে পৃথিবীতে যে সে নিজেই হারিয়ে যাবে। তার ভালো থাকার মানুষকে সে কিছুতেই যেতে দিবে না। পরর্বতী কিছু সময় চন্দ্রা ঘোরের মধ্যে ছিল কীভাবে হাসপাতালে আসলো তার কিছুই তার মনে নেই। শুধু এতটুকু মনে আছে বাড়ির মালিক শাহাবুদ্দিন সাহেবের দরজার একাধারে কলিংবেল বাজানোর পর যখন শাহাবুদ্দিন সাহেব দরজা খুললেন চন্দ্রা কান্নাভেজা কন্ঠে বলছিল, আমার খুব বিপদ একবার হাসপাতালে নিয়ে যাবেন? রাশেদের কাছে। তারপর আর তাকে কিচ্ছু করতে হয়নি নি। শাহাবুদ্দিন সাহেব নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছিলেন। চন্দ্রার একবারও মনে রইলো না রাশেদের পরিবারকে একটা কল দিয়ে রাশেদের কথা জানাতে।
রিসেপশনে গিয়ে জানলো কোথায় আছে রাশেদ। তারপর এক প্রকার ছুটে চলে গেল সেখানে। ছোট্ট একটা কেবিনে রাশেদ শুয়ে আছে। তার চোখ বন্ধ। মাথায় ব্যান্জেজ। হাতে স্যালাইন চলছে। সে ভেতরে যেতে চাইলো। কিন্তু নার্স ভেতরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বের করে দিলো আর বললো, ডাক্তার এখন দেখছেন। একটু পরে আসুন। বলেই এক প্রকার ঠেলে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। চন্দ্রা বাইরে এসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কেবিনের ভেতরে। চন্দ্রা দিশেহারা হয়ে দরজার পাশে মাটিতে বসে পড়লো। পা দুটো অসাড় হয়ে গেছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। ফুপিয়ে উঠলো সে। একটা বিশ্বস্ত কাঁধ যে এই মুহূর্তে তার খুবই দরকার।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বের হয়ে এলো। চন্দ্রা চোখ ভর্তি পানি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
ডাক্তার বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রার দিকে। রাশেদের কিছুই হয়নি সামান্য একটা ঘটনায় চন্দ্রা এভাবে কাঁদছে।
ডক্টর, রাশেদ কেমন আছে? কী হয়েছে ওর?
রিলাক্স। সিরিয়াস কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে।
তাহলে ওর মাথায় ব্যান্ডেজ কেন?
ও সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল।
কেন পড়েছে? অস্থির কন্ঠে চন্দ্রা বললো।
ডক্টর চন্দ্রার অবস্থা বুঝতো পারলো। উনি বললেন, রাশেদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছিল। আর ঠিক তখনি সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায়। তাই কিছুটা চোট পেয়েছে।
কিন্তু উনার তো ডায়াবেটিস নেই।
মিসেস আহমেদ, এটা ঠিক রাশেদের ডায়াবেটিস নেই কিন্তু হাইপোগ্লাইসেমিয়া ওর হয়েছে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে ছিল। তাই এমনটা হয়েছে। চিন্তার কারন নেই ঠিক হয়ে যাবে। গ্লুকোজ দেয়া হয়েছে। আর এখন আপনি ভেতরে যেতে পারেন। যান ভেতরে গিয়ে দেখা করে আসুন। চাইলে থাকতেও পারেন।
চলবে……
#আমি_তোমাকে_ভালোবাসি
#লেখনীতে_সুরঞ্জীতা_সুর
#ত্রয়োদশ_পর্ব
২০.
রাশেদের ঘুম ভাঙ্গলো পরের দিন ভোরে। চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করলো কোথায় আছে সে। তারপরই সব ঘটনা মনে পড়লো আর তার সাথে সাথেই মনে পড়লো চন্দ্রা কী জানে তার কথা? সে কী এসেছে? বাম পাশে তাকাতেই চোখে পড়লো চন্দ্রা এলোমেলো হয়ে টুলে বসে রাশেদের বেডে হাতের উপর হাত রেখে চন্দ্রা ঘুমাচ্ছে। চোখ মুখে ফুটে রয়েছে শুকিয়ে যাওয়া জলের ছাপ। পরিপাটি হয়ে থাকা মেয়েটা তার জন্য এলোমেলো হয়ে গেছে ভাবতেই রাশেদের বুকটা কেমন করে উঠলো। তাকে কী কেউ কল করেছিল? না হলে তো জানার কথা না। সে দুর্বল হাতে চন্দ্রার মাথায় হাত বুলালো। পাতলা ঘুমের অধিকারী মেয়েটি চট করে জেগে উঠলো সেই আলতো স্পর্শে। চোখে মেলে ধরফরিয়ে উঠলো। রাশেদ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
চন্দ্রা কাঁদছে মাথা নিচু করে। রাশেদ আদুরে স্বরে ডাকলো, চন্দ্রাবতী?
চন্দ্রা মাথা তুলে তাকাতেই রাশেদ শুয়ে থেকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলো চন্দ্রার দিকে। চন্দ্রা কোন দিকে না তাকিয়ে রাশেদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সে ভুলে গেল রাশেদ অসুস্থ। রাশেদ দুই হাতে আগলে ধরলো চন্দ্রাকে। এক পৃথিবী সমান ভার বুক ক্রমান্বয়ে হালকা হচ্ছে।
রাশেদ চন্দ্রাকে বললো, এতোটা ভালবাসা কোথায় রেখেছিলে চন্দ্রা? কই আমি তো বুঝতেই পারলাম না?
চন্দ্রা নিঃশব্দে কাঁদছে। রাতের অসম্পূর্ণ কাজটা সে সম্পন্ন করলো। ধীরে ধীরে চন্দ্রা শরীর ছেড়ে দিলো। সমস্ত ভার রাশেদের উপর ছেড়ে দিয়ে সে ঘুমিয়ে গেল। রাশেদ বুঝতে পারলো চন্দ্রা অজ্ঞান হয়ে গেছে। একই রকমভাবে ঘটা দুটো ঘটনা ওর মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে সেই স্ট্রেস সে নিতে পারে নি।
চন্দ্রা বেডে ঘুমাচ্ছে। রাশেদ পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কী নিস্পাপ মুখ! কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে চোখমুখের কী অবস্থা করেছে! চুল এলোমেলো, ফ্যাকাসে মুখে শুকনো জলের ছাপ। নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো রাশেদ। কিছুক্ষন পর চন্দ্রা চোখ পিটপিট করে তাকালো। কোথায় আছে বুঝতে একটু সময় লাগলো। মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে পাশে তাকালো। পাশে তাকাতেই দেখলো রাশেদ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চন্দ্রার চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে গেল। গড়িয়ে পড়ার আগেই রাশেদ সযত্নে মুছিয়ে দিল। তারপর বললো, কেমন লাগছে এখন?
চন্দ্রার চোখ আবার ভরে এলো জলে।
আবার কাঁদছো কেন?
আমাকে একটু ধরে উঠে বসাবেন?
রাশেদ চন্দ্রাকে উঠে বসালো তারপর চন্দ্রার থেকে সরে যাওয়ার আগেই চন্দ্রা আরেকবার জড়িয়ে ধরলো রাশেদকে। রাশেদও আগলে নিলো। চন্দ্র কাঁদতে কাঁদতে বললো,
রাশেদ আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। খুব। মনে হচ্ছিল সব শেষ। এমন করাটা কী খুব জরুরি ছিল? কেন না খেয়ে ছিলেন? আপনার কিছু হয়ে গেলে আমার কী হতো একবারও ভেবেছিলেন?
কিছুই তো হয়নি আমার দেখো তাকিয়ে।
সেদিকে কান না দিয়ে চন্দ্রা নিজের মতো বললো, আপনি যখন জ্ঞান ছিলো না জানেন কেমন লাগছিলো আমার? মনে হচ্ছিল আপনি আর উঠবেন না চিরদিনের মতো চলে……..
চন্দ্রার অসম্পূর্ণ কথা রাশেদ শেষ করতে দিলো না।
চন্দ্রা আমার কোন মেজর অ্যাকসিডেন্ট হয়নি। মাথায় চোট পেয়েছি শুধু। বেকায়দায় পড়েছিলাম তাই কেটে গিয়েছে। শুধু এতোটুকু। আর কোন গবেট তোমাকে কল করেছে বলো তো?
জানি না।
একমিনিট তুমি এতো রাতে কীভাবে এসেছো?
মনে নেই।
মনে নেই মানে কী?
দোতলার চাচার সাথে।
তাই বলো। ছিঃ উনি কী ভাববে বলো তো?
কী ভাববে?
ভাববে তুমি এতো ছুটোছুটি করে উনাকে নিয়ে এলে কিন্তু এসে দেখলেন আমি সুস্থ। ছোট্ট একটা চোট পেলাম। আর এই চোট দেখে আমার বউ অজ্ঞান হয়ে গেল।
আপনার কাছে এগুলো মজা লাগছে?
আরে তুমি রাগ করলে নাকি?
রাগের মতো কী কিছু বলছেন না?
না আমি রাগের মতো কিছু বলছি না।
আপনার কোন ধারনা আছে আপনার ফোন থেকে কল যাওয়ার পর আমার কী অবস্থা হয়েছিল?
কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। তার মানে এই না যে সব ঘটনা শুরু এবং শেষ একই রকমভাবে হবে। এইযে এতোটা স্ট্রেস নিলে এতে ক্ষতিটা কার হলো?
তার মানে আপনি বলছেন আপনার খবর পাওয়ার পর আমার উচিত ছিল বাসায় বসে থাকা।
না আমি সেটা বলিনি। আমার কথার অর্থ হচ্ছে থাক বাদ দাও।
অভিমানী গলায় চন্দ্রা বললো, ছাড়ুন আমাকে।
রাশেদ মৃদু হাসলো তারপর বললো, চন্দ্রাবতী আপনি চেয়ে দেখুন আপনিই আমাকে জরিয়ে রেখেছেন আমি না।
চন্দ্রার হুস ফিরলো। সে ছিটকে সরে গেল। রাশেদ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো। চন্দ্রাকে স্বাভাবিক করতে তার এতো গুলো কথা বলা।
চন্দ্রা?
হুম।
বেশি ভয় পেয়েছিলে?
হুম।
সরি এবার থেকে সবকিছু সময় মতো করবো। ঠিক আছে?
আচ্ছা।
তুমি কী বাসায় বলেছিলে আমার কথা?
চন্দ্রা মিনমিন করে বললো, সরি ভুলে গেছিলাম। এক্ষুনি ফোন করছি।
এই না না। বলার দরকার নেই। ভালো হয়েছে বলো নি। আমি বুঝেছি তুমি ভুলে গিয়েছো না হলে এতোক্ষণে চলে আসতো।
কেন বলবো না?
কারন আমার কিছুই হয়নি। এখন তুমি যদি বলো শুধু শুধু টেনশন করবে ওরা। কান্নাকাটি করবে। তবে মজার ব্যাপার হলো মা আমাকে ফোন করেছিল। আমি ঘুমে থাকায় ধরতে পারি নি। পরে অবশ্য কল ব্যাক করে বলেছি চার্জ ছিল না।
মায়ের মন।
হ্যাঁ সেটাই। তাহলে চলো বাসায় যাই। ছুটি পেয়েছি বুঝলে। বাসায় গিয়ে ঘুম দিব একটা। বেড থেকে উঠতে পারবে নিজে?
হ্যাঁ।
তাহলে উঠো।
চন্দ্রা উঠে দাঁড়ালো। একপা সামনে দিতেই পড়ে যেতে নিলো আর সাথে সাথেই রাশেদ ধরলো।
পারবে না তাহলে বললে কেন পারবে?
বুঝতে পারি নি।
আচ্ছা চলো।
বাসায় এসে কিছুক্ষণ পর চন্দ্রা বিশ্রাম নিয়ে উঠেপড়ে লাগলো খাবার বানাতে। রাশেদ বড়সড় একটা ধমক দিলো। কিন্তু চন্দ্রা ধমক খেয়েও রান্নাঘরে চলে গেল। তার ভাষ্যমতে সে সুস্থ। কিছুই হয়নি তার। রাশেদ অনেকক্ষণ না খেয়ে কিছু একটা করে দিতে হবে। সে চট করে চা করলো। কাপে ঢালার সময় ফুরফুরে মেজাজে টুকুকে বললো, এই টুকু চা খাবি? দুধ চা করেছি।
টুকু অবাক হয়ে গেল। আপা তাকে চা খেতে বলছে তাও দুধ চা। টুকুর খুবই প্রিয় দুধ চা। কিন্তু আপা সব সময় দেয় না মাঝেমধ্যে। বলে, টুকু এতটুকু বয়সে দুধ চা বেশি খেতে নেই।
আপার কথা টুকু খুব মানে। তাই আপাও টুকুকে আদর করে। এই তো কাল রাতে এত ঝামেলার মধ্যেও টুকুকে ঘুম থেকে তুলে হাত ধরে দোতলায় দিয়ে এলো। তাদেরকে বলে এসেছে যতক্ষণ না সে আসবে তাকে যেন ওদের ঘরে রাখে। যদি এতো রাতে টুকু ভয় পায় ঘুম থেকে উঠে। তাই তো সে তাকে ওদের ঘরে দিয়ে এলো। যদিও টুকু ওসবে ভয়টয় পায় না। চন্দ্রা ছোট্ট একটা মগে টুকুকে চা দিল। সাথে বিস্কিট দিলো তারপর বললো, টুকু বেশি ক্ষিদে পেয়েছে? এটা খেয়ে একটু অপেক্ষা কর আপা এক্ষুনি কিছু একটা বানিয়ে দিচ্ছি।
টুকু মাথা নাড়লো। যদিও তার ক্ষিদে তেমন একটা পায়নি। চন্দ্রা হেসে টুকুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল।
রাশেদকে চা দেওয়ার সময় রাশেদ আবার বললো, চন্দ্রা বাইরে থেকে নিয়ে আসি কিছু। তুমি অসুস্থ।
না আমি সুস্থ।
ডক্টর আমি না তুমি?
যেই হোক কিন্তু তো শরীরটা আমার। আমি জানি আমি সুস্থ।
রাশেদ আর কিছু বললো না। এই মেয়ে যে সময় বিশেষে খুবই ত্যাড়া তা সে খুব ভালো করে বুঝতে পারছে। হঠাৎ করে ঘরের কলিং বেল বাজলো। চন্দ্রা ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলো শাহাবুদ্দিন সাহেব দাঁড়িয়ে তারপাশে উনাদের বাসার কাজের মেয়ে। হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে। চন্দ্রা উনাদের ভেতরে আসতে বললো।
শাহাবুদ্দিন সাহেব ঘরে ঢুকেই বললো, দেখলাম একটু আগে হাসপাতাল থেকে এসেছো। রাশেদ কেমন আছে এখন?
জ্বি ভালো।
তোমার অবস্থা দেখে তো আমি ভয় পেয়েছিলাম।
চন্দ্রা কিছুটা লজ্জা পেল। ও কী সত্যিই বেশি বেশি করছিল? কী জানি কী রকম রিয়েক্ট করেছিল তার কিছুই তো মনে পড়ছে না। চন্দ্রা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। শাহাবুদ্দিন সাহেব বকবক করতে লাগলো। রাশেদ বাইরে কথা শুনে বের হয়ে এলো। শাহাবুদ্দিন সাহেব তাকে দেখে বললো, কেমন আছো রাশেদ?
জ্বি চাচা ভালো।
রেষ্টে থাকো কয়েকদিন তাহলে আরো ভালো হয়ে যাবে।
জ্বি আচ্ছা।
আমার একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাই হাসপাতাল থেকে চলে এসেছিলাম তোমার জ্ঞান এসেছে জেনে। রাগ করো না।
না না রাগ করবো কেন? আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ এতো রাতে চন্দ্রাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আরেহ তেমন কিছুই করিনি। ওর অবস্থা দেখলে যে কেউ এমনটা করতো। কান্নাকাটি করে বিধস্ত দেখাচ্ছিলো।
রাশেদ আড়চোখে চন্দ্রার দিকে তাকালো। সে যে লজ্জা পাচ্ছে তার চোখমুখ দেখলে যে কেউ বলে দিবে।
হটাৎ কিছু পরলো এই ভঙ্গিতে শাহাবুদ্দিন সাহেব বললো, রাশেদ কথায় কথায় ভুলে গিয়েছিলাম। তোমাদের জন্য খাবার এনেছি। খেয়ে নিও। দুপুরে আর রাতেও পাঠাবো।
চাচা এসবের কোন দরকার ছিলো না। আমরা বাইরে থেকেই আনতে পারতাম।
তা পারতে কিন্তু এখন যখন এনেছি খেয়ে নাও। দুপুরে আর রাতেও পাঠাবো। এটা নিয়ে আর কোন কথা আমি শুনতে চাইছি না।
তারপর আর কিছু বলার থাকে না। শাহাবুদ্দিন সাহেব বিদায় নিলো আর টেবিলে রেখে গেল ঝালঝাল মুরগীর মাংস আর পরোটা। দেখেই ক্ষিদে পেয়ে যাচ্ছে। চন্দ্রা কিছুটা স্বস্তি পেল। তার শরীর খুবই দুর্বল লাগছিলো। কীভাবে খাবার বানাবে তা নিয়ে চিন্তায় ছিল। রাশেদ বাইরের খাবার পছন্দ করে না। হয়তো চন্দ্রার কথা ভেবে বাইরে থেকে খাবার আনাতো কিন্তু সেটা সে তৃপ্তিতে খেতে পারতো না। কিন্তু এখন নিশ্চিন্ত লাগছে।
চন্দ্রা কিছুটা আনমনে রাশেদকে বললো, রাশেদ বসে পড়ো৷ ক্ষিদে পেয়েছে বোধহয়। টুকু তুইও আয়।
বলে সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। একটু আগে কী রাশেদকে তুমি করে বলেছে ও? রাশেদ চন্দ্রার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ছিলো। চন্দ্রা আমতা আমতা করে বললো, মানে বসে পড়ুন। ক্ষিদে পেয়েছে না?
রাশেদ হেসে বললো, তুমিটাই ভালো লাগছিল। বউ বউ লাগছিল।
চন্দ্রা চট করে উত্তর দিলো, বউকে বউ লাগবে না তো কী লাগবে বোন?
ছিঃ কী বলো এইসব। পাপ হবে পাপ।
হয়েছে বসুন।
তারপর টুকুকে উদ্দেশ্য করে বললো, টুকু কী হচ্ছে? আপা ডাকছি না।
আইতাছি আফা।
ঝড়ের বেগে দৌড়ে এলো টুকু। সে টেবিলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, আফা আফনে কী ম্যাজিক জানেন?
কেন?
ওত তাড়াতাড়ি রানলেন কীভাবে?
টুকুর কথায় চন্দ্রা ফিক করে হাসলো। টুকু এখন অল্পস্বল্প শুদ্ধ বলে। তবে তা সে তার কথার মাঝখানে ঢুকিয়ে দেয়। পুরো বাক্য শুদ্ধভাবে বলতে পারে না। মাঝে মাঝে এতো হাসি উঠে।
হ্যাঁ ম্যাজিক জানি। তুই শিখবি?
জ্বে আফা।
টুকুকে খাবার দিতে দিতে চন্দ্রা বললো, আফা কী? আপা বল।
আপা।
এইতো ঠিক হয়েছে। গুড।
রাশেদ পাশে বসে তাকিয়ে রইলো চন্দ্রা আর টুকুর দিকে। দুইজনের কথোপকথনের খুবই ইন্টারেস্টিং। চন্দ্রাকে আজ কোন অজানা কারণে খুবই খুশি দেখাচ্ছে। কিন্তু কেন তা ঠিক সে বুঝতে পারছে না।
চলবে…..