#তুমিময়_বসন্তে❤
#অন্তিম_পর্ব
#কায়ানাত_আফরিন
বহু প্রতীক্ষার পর ঘনিয়ে এলো আজ বিয়ের দিন।গতরাতের তুমুল বেগের বৃষ্টি তান্ডব বিদায় নিয়ে আকাশ আজ স্বচ্ছ। যেন আকাশও হলফ করে বলতে পারছে , ‘আজ নিধি আর আয়মানের বিয়ে!’। ব্যাপারটা ভাবতেই শিউরে উঠলো নিধি। মনে হাজারো কথা কেমন যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলছে বারবার। নিচে সবাই বরযাত্রীদের অপেক্ষায় ব্যস্ত। নিধি আয়নায় একপলক দেখে নিলো নিজেকে। বধূবেশে তাকে এক অন্য নিধি মনে হচ্ছে। পরনে বিয়ের শাড়ি, গলায় গহনা আর নাকে সুন্দর একটি নথ। লালরাঙা মেহেদি হাতের সৌন্দর্যের থেকেও নিধির কাছে সুন্দর লাগছে আয়মানের দেওয়া সেই এনগেইজমেন্ট রিংটা। একমুহূর্তের জন্যও এটা খুলেনি নিধি। ভাবতেই মুচকি হাসলো সে। আচ্ছা আজ আয়মানকে দেখতে কেমন লাগবে? আগের মতোই সুন্দর নাকি বরবেশে অনন্য? যেমনই লাগুক না কেন, এই মানুষটাকেই মনে প্রাণে ধারন করে নিয়েছে সে।
নিচে হৈ চে এর আওয়াজ পেতেই নিধি বুঝে নিলো বরপক্ষের লোকজন এসে পড়েছে। তুলি আর বাকি কাজিনদের হালকা পাতলা শোরগোল শোনা যাচ্ছে। হয়তো গেট ধরার জন্য টাকা আদায় করতে ব্যস্ত। কিন্ত নিধির মনে এবার টানটান উত্তেজনা। এতক্ষণের জমানো আবেগ কেমন যেন কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। এই সময়গুলো স্বাভাবিক ভাবে অতিবাহিত হলেই ভালো , মনে মনে বিড়বিড়িয়ে নিলো নিধি।
হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে নিধি পেছনে ফিরে দেখে মা এসেছে। উনার পরনে হালকা রঙের শাড়ি। তাঁতের অপরূপ কাজের থেকেও ফুটে ওঠেছে মুখে প্রফুল্লের হাসি। তবে চোখজোড়া টলমল করছে। নিধি কাপা কাপা স্বরে বললো,
‘মা ওরা এসে পড়েছে?’
‘হ্যাঁ………’
নরম কন্ঠে বললেন তিনি। মেয়েটাকে আজ হুট করে কত বড় মনে হচ্ছে। এইতো কিছুদিন আগেই তো এই মেয়ে স্কুল থেকে বাসায় আসার সময় পা মচকে পড়ে গিয়েছিলো। সে কি কান্না! তারা দুই স্বামী স্ত্রী মিলে মেয়ের কান্না থামাতে পারেননা। আর আজ সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সময় কতটা অদ্ভুত তাই না? হুট করে চলে গিয়ে স্মৃতির পাতায় আটকে যায়। রাবেয়া বেগম কান্না চেপে বললেন,
‘নিচে চল মা……..সবাই অপেক্ষা করছে।’
_________________
নিচের বসার ঘরে লোকজন এবার কম। সোফার একপাশে আয়মান আর ওর বাবা-চাচারা বসে আছে। পরনে সোনালী রঙের কারুকাজ করা পান্জীবী। মাথার পাগড়ী খুলে সাদা টুপি পড়ে নিয়েছে সে। চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে আবদ্ধ।অপরপ্রান্তে নিধি আর বেশ কিছু মহিলা বসে আছে। ওদের বরাবর চেয়ার নিয়ে বসে আছে কাজি। নিধি কয়েকবার নিঃশ্বাস ফেললো। সময়টা ওর কাছে বড্ড অন্যরকম লাগছে। হয়তো প্রতিটি মেয়ের কাছেই এই সময়টি অন্যরকম। কাজি প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলার পর গুণে গুণে সুন্দরভাবে তিন কবুল বলে ফেললো আয়মান। তারপর সিগনেচার করলো কাবিননামায়।
নিধির দম যেন বন্ধ হয়ে এসেছিলো আয়মানের কবুল বলার ধরন দেখে। অবশেষে কিছুসময় যাওয়ার পর নিধিও বিনয়ের সাথে বললো, ‘,,,,,,কবুল। কবুল। কবুল।’
তিন কবুল বলার পর কাবিননামায় সাইন করলো নিধি। সবার মুখেই আনমনে ফুটে ওঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ!’ । নিধি আড়চোখে পরখ করে নিলো আয়মানকে । মুখে মানুষটার আত্নতৃপ্তির আমেজ। দেখেই শিউরে ওঠলো নিধি। এখন তারা অবশেষে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েই গেলো।
______________
রাতের উত্তাল হাওয়ায় ছেয়ে গিয়েছে প্রকৃতি। জানালাটি খুললেই হাসনাহেনা ফুলের অপরূপ একটা ঘ্রাণ নাকে এসে হানা দেয়। আহা! কি মিষ্টি একটি ঘ্রাণ। প্রাণভরে তা টেনে নিলো নিধি। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অপার্থিব চোখে দেখে যাচ্ছে আয়মানদের বাড়িটার সামনে সিক্ত পথের দিকে। ঘড়ির কাটা সাড়ে এগারোটায় ছুইঁ ছুইঁ। নিজেদের বাড়ি থেকে নিধি শ্বশুড়বাড়িতে পা দিয়ে পৌনে একঘন্টার মতো হলো। নিজের অশ্রু ভেজা চোখ দেখে নিজেই মর্মাহত হলো সে। বাবা-মায়ের জন্য কষ্ট হচ্ছ ওর। আজ বাড়িতে থাকলে হয়তো এতক্ষণে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিত। আর বাবা শোয়ার আগে অবশ্যই একনজর দেখে যেত নিধিকে। একসময় যা ছিলো নিত্যদিনের অভ্যাস তা আজ কেবল স্মৃতি। ভেবেই বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
আয়মানের ঘরটা খুব একটা বড় নয়। মাঝখানে একটি খাট , সাথে আলমারি-ড্রেসিংটেবিল-পড়ার টেবিল আর জানালার পাশে বিশাল বইয়ের একটি তাক। সবই ওর পড়ুয়া বই। খাটের কাছে দেয়ালে বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে আয়মান আর ওর পরিবারের সাথে। নিধি প্রাণভরে সেই হাস্যোজ্জল মানুষটার ছবি দেখে নিলো। ভাবতেই অবাক লাগছে এই মানুষটা এখন ওর স্বামী, নিতান্তই নিজের একটি সত্তা।
.
.
এর মাঝেই রুমে প্রবেশ করলো আয়মান।বাইরে ফুরফুরে বাতাস বইছে, ফুলের গন্ধে মৌ মৌ চারিপাশ।নিধিও পেছনে ঘুরলো তৎক্ষণাৎ। আয়মানের ঠোঁটে রয়েছে বরাবরের মতোই স্মিত একটি হাসি। সে নিজের পাগড়িটা খুলে সযত্নে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রেখে ড্রয়ারটি খুললো।সেখান থেকে একটি ছোট প্যাকেট নিয়ে এগোতে থাকলো নিধির দিকে। নিধির হাতে প্যাকেটটি দিয়ে বললো,
‘এই নাও। মোহরানার টাকা পরিশোধ করে নিলাম। এটা দিয়ে তুমি কি করবে তা আমার দেখার বিষয় না। তোমার অধিকার এটি ।তাই তোমার প্রাপ্য তোমায় বুঝিয়ে দিলাম।’
আয়মানের একনাগাড়ে বলা কথাগুলোর জালে হারিয়ে গেলো নিধি। অতঃপর মাথা নিচু করে রইলো। আয়মানকে আজ দেখতে অন্যরকম লাগছে। সাথে সময়ও এগিয়ে চলছে অন্যভাবে। নিধির এমন লাজরাঙা মুখ দেখে আচমকা ওর হাতজোড়া চেপে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো আয়মান।কালবিলম্ব না করেই নিজের ওষ্ঠ্যদ্বয় দিয়ে নিধির কপালে প্রগাঢ় চুমু একেঁ দিলো সে। শিউরে ওঠলো নিধি। ওর ঠোঁটজোড়া অস্বাভাবিকভাবে কাপছে। আয়মানের থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শ এটি। যেখানে কোনো জড়তা নেই, শুধুই অনুভব করা যায় এক আকাশ ভালোবাসা।নিধির চোখ বন্ধ। চোখের পাতা ঘনঘন নড়ছে। যা দেখে হেসে ওঠলো আয়মান।
মেয়েটাকে আজ বড্ড আদুরে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজের সমস্ত সত্তায় ওকে মিশিয়ে ফেলতে। আয়মান ঘোরতর কন্ঠে বললো,
‘যাও……….ফ্রেস হয়ে এসো।’
.
.
আয়মানের কথামতো নিধি ফ্রেস হয়ে এলো তাই। আয়মান ইতিমধ্যে জামাকাপড় পাল্টে নরমাল ট্রাউজার আর টিশার্ট পড়ে নিয়েছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আনমনে। নিধি এর মধ্যে একটা কাজ করে বসলো। আয়মানকে নিজের দিকে ফিরিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো ওর উষ্ণ বক্ষে। নিজের সমস্ত দেহ যেন আয়মান নামক মানুষটার প্রেমসিক্ত আলিঙ্গন করতে চাইছে। আয়মান কিছু না বলে ঠোঁটে স্মিত হাসির রেখা ফুটালো। জড়ানো কন্ঠে বললো,
‘নিধিপরী?’
‘হুম…………………..’
‘আমার সাথে একটি ছোট্ট সংসার করতে পারবে তো? যেখানে কোনো বাধ্যকতা থাকবে না , শুধুমাত্রই তোমার ভালোবাসা থাকবে? পারবে?’
‘পারবো কি-না জানিনা তবে নিজের সর্বোস্ব দিয়ে চেষ্টা করবো।’
আয়মানে চোখে-মুখে প্রশান্তির রেশ। আজ যেন এই মেয়েটাকে নিজের আলিঙ্গনে পেয়ে জীবনে সমস্ত প্রশান্তি নেমে এসেছে।নিধিকে হুট করে কোলে তুলে নিলো আয়মান। নিধির চোখে-মুখে বিস্ময়। তাই অবাকমিশ্রিত চাহিনী নিয়ে তাকিয়ে আছে সে আয়মানের দিকে। আয়মান প্রসন্ন গলায় বলে ওঠলো,
‘আমায় সারাদিন দেখতে পারবে নিধিপরী………….এভাবে তাকিয়ে থাকলে কি মন আর ভরবে? বরকে ভালোবাসতে হবে তো !’
লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো নিধি। মুখটা লাল আভা ধারন করছে। আয়মান নিধিকে বিছানায় শুয়ে দিলো। খাটের পাশে হাত বাড়িয়ে লাইট বন্ধ করে জ্বালিয়ে নিলো টিমটিমে ডিম লাইট। ঘরটা এখন অন্যরকম হয়ে ওঠেছে। আয়মানের চোখে নেশা।নিধি সে দিকে নিজের মায়াবী দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে। মানুষটা আজ নিতান্তই ওর। এতদিনের আড়ষ্টতাটি এখন আর নেই। আয়মান নামক মানুষটার প্রতিটা সাড়াজাগানো স্পর্শ অনুভব করতে পারবে সে। আয়মান হাত বাড়িয়ে রেডিওতে একটা গান ছাড়লো। তারপর নিধির কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘আজ এই গানের সাথে তোমার সর্বাঙ্গে মিশে যাবো গো নিধিপরী।’
নিধি সুখে চোখ বন্ধ করে ফেলে।এ কেমন অনুভূতি হচ্ছে ওর?আয়মানের মুগ্ধময় কথাবার্তায় ওর প্রগাঢ় নিঃশ্বাস যে বন্ধ হয়ে আসছে সেদিকে মানুষটার আদৌ খেয়াল আছে? পরিবেশটা মোহনীয় । আয়মানের স্পর্শে সর্বাঙ্গে উথাল পাতাল ঝড় হচ্ছে নিধির। বাইরে ঝড়ো হাওয়ার কবলে ক্ষণে ক্ষণে কেপে ওঠছে পর্দা। সেই সাথে রেডিওতে চলছে সুন্দর একটি গান,
‘হতে পারে না………..কোনো গল্প তোকে ছাড়া!
হতে পারে না…………….
কোনো ইচ্ছে তোকে ছাড়া❤’
_____সমাপ্ত______