বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_১৮
#পলি_আনান
হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।একের পর এক চোখের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে দুই পরিবার।চুপচাপ এক কোনায় গুটিয়ে বসে আছে নাহিয়ান।কোথা থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই মাথায় ডুকছেনা তার।তখন ওজিহার সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙ্গলে রক্তাক্ত ওজিহাকে পায় সে।মাথা ফেটে রক্তের ফোয়ারা ভেসে যাচ্ছে,ওজিহার অবস্থা দেখে সে ঘাবড়ে যায় । দ্রুত কোলে তুলে ছুটতে ছুটতে নিচে নেমে গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে আসে তাকে।তার কিছুক্ষন পরেই এসে উপস্থিত হয় তাসলিমা,ইশরাক,তফুরা খাতুন।ওজিহার মামা মামিও এসে উপস্থিত হয় কিছুক্ষন আগে।
মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে নাহিয়ান।অনুভূতিরা শূন্যর কোটায় পৌছে গেছে।বার বার মনের ভেতর একটাই ডাক ডাকছে, তার ওহিজানের কিছু যেন না হয়।সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে তার হৃদয় জমিনে ফিরে আসে।আগের মতো রঙিন হয়ে যাক দিনেরা মূহুর্তেরা।হঠাৎ একটি বাচ্চার কান্না ভেসে আসে। চোখ খুলে দ্রুত পা চালিয়ে ওটির সামনে বেকুল চোখে তাকিয়ে থাকে।পেছনে এসে দাড়ায় বাকিরা।ওটির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে একটি নার্স।তার কোলে তোয়ালে প্যাচানো ফুটফুটে একটি শিশু।তার চোখ মুখে শুভ্রতার আভাস ছড়িয়ে আছে। নার্সটি৷এগিয়ে এসে নাহিয়ানের কোলে বাচ্চাটি তুলে দেয় আর বলে,
“কংগ্রাচুলেশনস আপনার ছেলে হয়েছে!
কথাটি শুনেই এক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পরে তার। একপলক বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে ইশরাকের কোলে দিয়ে। নাহিয়ান ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,
” আমার ওহিজান কোথায়। সে কেমন আছে।?
তার মুখে কথাটি শুনেই চুপসে যায় নার্স।
“পেশেন্টের প্রচুর রক্তক্ষরন হয়েছে আমরা রক্ত জোগার করেছি কিন্তু তবুও কন্ডিশন ক্রিটিকেল।৭২ ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে পেশেন্ট কোমায় চলে যাবে।”
নার্সের কথাটি বলা শেষ হতেই নাহিয়ান দুইপা পিছিয়ে চোখ বন্ধ করে সেন্সলেস হয়ে যায়।তার প্রতিক্রিয়া দেখে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।নার্সটি মনে মনে বলে,
“বউয়ের কথা শুনে হাজবেন্ড সেন্সলেস হয়ে গেছে। সত্যি মেয়েটাকে একটু বেশি ভালোবাসে।
ছয় ঘন্টা পার হয়ে গেছে ওজিহার এখনো জ্ঞান ফিরেনি।কিছুক্ষন আগেই নাহিয়ানের জ্ঞান ফিরে। ওজিহার কেবিনের সামনে দেয়াল গেসে দাঁড়িয়ে আছে সে।কেননা কেবিনে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। ডাক্তারকে দেখেই নাহিয়ান দৌড়ে সামনে দাঁড়ায়।
” প্লিজ আমার এই রিকুয়েষ্ট টা রাখুন আমার ওহিজানকে একবার দেখতে দিন।আমাদের দীর্ঘ এতো বছরের সংসারে এক মূহুর্তের জন্যও চোখের আড়াল করি নি কিন্তু আজ তাকে আমি আট ঘন্টার মতো চোখে দেখিনা আমার কেমন লাগছে আপনি বুঝতে পারছেন প্লিজ আমাকে পারমিশন দিন”
“কিন্তু…..
“কোন কিন্তু নয় বিশ্বাস রাখতে পারেন আমি দশ যাস্ট দশ মিনিট তার পাশে থাকবো।প্লিজ আমার দম যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে আমার ওহিজানকে আমি দেখতে চাই।
” ঠিক আছে যান। তবে শর্ত গুলো মেনে চলবেন।
“ধন্যবাদ!অসংখ্যা ধন্যবাদ আপনাকে।
মাথায় ব্যান্ডেজ মোড়ানো,মুখে অক্সিজেন মাক্স একদম নিস্তেজ হয়ে পরে আছে ওজিহা।ছুটন্ত,প্রাণবন্ধ হাসিতে মাতানো মেয়েটি আজ এমন নিশ্চুপ তা দেখে বুকের ভেতর টা মোচর দিয়ে উঠে নাহিয়ানের। ওজিহার কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে,
‘তোমাকে ছাড়া আমার একটা মূহুর্তে জাহান্নাম ওহিজান।নিজেকে কেমন অসহায় মনে হয়। এভাবে কি বেচেঁ থাকা যায় ওহিজান তুমি বলো?তুমি সুস্থ হয়ে যাও তাড়াতাড়ি তোমার চাওয়াটাই পূর্ণ হয়েছে ওহিজান আমাদের ছেলে হয়েছে। তুমি দেখবেনা তাকে?তোমার কথা মতো নাম রাখবো কেমন!আমাদের ছেলে ওয়াফী কে নিয়ে আমাদের এখনো একটা সুখের সংসার করা বাকি।তুমি চোখ খুলবেনা উঠবেনা জেগে?হুট হাট আদর পাওয়ার বায়না করবেনা কিগো জান পাখি তুমি কি কথা শুনতে পাচ্ছো না।
ওজিহার কোন রেসপন্স না পেয়ে কিছুক্ষন চুপ হয়ে যায় নাহিয়ান।বাম হাতের উলটা পিঠ দিয়েদুই চোখের পানি মুছে বলে,
” লিসেন ওহিজান তুমি যদি না ফিরে আসো আমার হৃদয়জমিনে তবে এই নাহিয়ান আর নাহিয়ান থাকবেনা সে মৃত লাশ হয়ে যাবে।প্রয়োজন পরলে সুইসাইড করবে নিজেকে বিলিন করে দেবে।আমার ওহিজান ছাড়া আমি বাচঁতে চাই না থাকতেও চাইনা।আমি তোমায় ভালোবাসি ওহিজান ভালোবাসার মৃত্যু নেই।”
নাহিয়ান কেবিন থেকে বেরিয়ে যায়।বাইরে তার বন্ধুরাও উপস্থিত হয়ে গেছে মুহিব এবং তার ফুফা ফুফিও দাঁড়িয়ে আছে।সবার সান্ত্বনা আজ বড্ড বিরক্ত লাগছে তার এইসব সান্ত্বনা তার চাইনা শুধু তার ওহিজানটাকে তার কাছে সুস্থভাবে ফিরিয়ে দিলেই হয়।
মধ্যে রাত। সবাই ঘুমিয়ে আছে ঘুম নেই নাহিয়ানের চোখে।কিছুক্ষন আগেই ওয়াফীর কান্নায় বিরক্ত হয়ে পরে সে।এই মূহুর্তে তার ওহিজানকে ছাড়া তার কিচ্ছু ভাল্লাগছেনা।হঠাৎ কেভিনের ভেতর থেকে একটি বিকট শব্দ আসে আর সেই শব্দে কেপেঁ যায় হসপিটালের ফ্লোর।ওজিহার কেবিনের দরজার নিচ থেকে রক্ত গড়িয়ে আসে বাইরে।আর তা দেখে সবাই ছোটাছুটি করে এক পাশে গুটিয়ে যায় কিন্তু নাহিয়ান আগে দৌড়ে কেভিনের দরজা খুলে দেয়।দরজা খুলে যা দেখে তাতে সে স্তব্দ হয়ে যায়।ফ্লোরে ওজিহার থেতলানো লাশ পরে আছে। তার দুটো কেউ বিভৎস ভাবে গেলে দিয়েছে জিহ্বা বুক সমান বেরিয়ে এসেছে হাতে পায়ের চামড়া কেউ তুলে দিয়েছে আর চারিদিকে ছড়িয়ে আছে রক্তের গঙ্গা।নাহিয়ান নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে” আমার ওহিজান বলেই ঢোলে পরে সেই রক্তের মাঝে।নাহিয়ানকে সেন্স হারাতে দেখে সবাই দ্রুত ছুটে আসে।
🥀ব্যস এইটুকুই লেখা ছিল শেষ পর্যন্ত।তারপর সব ডাইরির সাদা খালি পাতা।চোখের পানি মুছে ডাইরিটা বুকের সাথে চেপে ধরে ওয়াফী।জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে যেনে এসেছে তার মা বেচেঁ আছে তবে তার বাবার আত্নার মাঝে।বার বার প্রতিবার এই কথা বলতো নাহিয়ান সত্যিটা কখনই ওয়াফীকে যানতে দেয়নি।আজ সত্যটা জেনে নিজের মাঝে বড্ড আফসোস লাগছে তার বাকি কাহিনীটা সে কি করে যানতে পারবে। তার বাবার কাছে যানতে চাইলে যদি রেগে যায়।এখনো অনেক প্রশ্নের উওর জানা বাকি তার।ডাইরিটা বুকের মাঝ থেকে নিয়ে আরেকবার চোখ বুলায়। চিকচিকে লাল মলাটের একটি ডাইরি যার উপরে সোনালি রঙের কাজ করে লেখা “আমার ওহিজান” ডাইরির শুরুতে ওজিহার একটি ছবি। বেশ মিষ্টি করে হেসে তাকিয়ে আছে সে।ছবিটি প্রথমে দেখেই চমকে যায় সে তার মা এতো সুন্দরী। কোন হুর পরীর থেকে ও কম নয় তারপরের পৃষ্ঠায় লেখা “বৃত্তের অন্তরালে” এই নামটি পড়েই ওয়াফী ডাইরিটা পড়তে আরো বেকুল হয়ে উঠে।তারপর থেকে ডাইরিটি পড়া শুরু করে সে।প্রায় মাঝ রাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতো তার বাবা এই ডাইরিটি লিখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।আবার কখনো চোখ মুখ কুচকে যেত, কখনো বা চোখে মুখে আষাঢ়ের মেঘ জমা হতো।তার বড্ড ইচ্ছে ছিল ডাইরিটি পড়ার কেননা তার বাবা একমাত্র মাঝে মাঝে তার সাথে হালকা করে হাসে কিন্তু ডাইরিটি লেখার সময় বেশ খুশি এবং আনন্দে থাকতো সবকিছু মিলিয়ে কৌতুহল জাগে ডাইরিটি পড়ার।অফিসের কাজে নাহিয়ান এলাকার বাইরে গেলে ওয়াফী সুযোগ বুঝে টানা দুইদিন ডাইরিটা পড়ে শেষ করে।তবে এই ডাইরির ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছু যানতে দেয় নি সে।লুকিয়ে লুকিয়ে সবটা পড়ে নিয়েছে সে।সবটা পড়ার পর সে এবার কিছুটা হলেও আচ করতে পেরেছে পাপা কেন বিডিতে যেতে চায় না।
“ওয়াফী বাবা কোথায় তুমি বাবা এসে গেছি!
নিচ থেকে নাহিয়ানের কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘাবড়ে যায় ওয়াফী।ডাইরির বিষয়টা কি বাবার কাছে যানতে চাইবে তারপর কি হয়েছে।মায়ের সাথে কে করেছে এমনটা আরো কয়েকজনের নাম এখানে উল্লেখ আছে যাদের চেনেনা ওয়াফী তারা কারা। নাহ আর লুকুচুরি নয় এখন সময় এসেছে সবটা জানার। বুকের মাঝে আবারো ডাইরিটা আবদ্ধ করে গুটি গুটি পা ফেলে নিচে নেমে আসে সে।
পকেটে হাত দিয়ে তাসলিমার সাথে কথা বলছে নাহিয়ান এমন সময় সিড়ির দিকে চোখ গেলে ওয়াফীকে দেখতে পেয়ে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে তার মুখে কিন্তু সেই হাসি আর দীর্ঘ হয় না। ওয়াফীর হাতে ডাইরিটা দেখের রেগে যায় সে।
দ্রুত ওয়াফীর হাত থেকে ডাইরিটা কেড়ে নেয়।
” তোমাকে এই ডাইরি ছোঁয়ার অনুমতি আমি দেয় নি তবে কেন ধরেছো এটা?(রেগে)
“সরি পাপা আমি এই ডাইরি অলরেডি পড়ে ফেলেছি।(মাথা নিচু করে)
” হোয়াট!!!
ওয়াফী আর নাহিয়ানের কথা বার্তা কিছুই বুঝতে পারেনি তাসলিমা আর ইশরাক তারা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।
“তোমাকে আমি শিখিয়ে ছিলাম ওয়াফী অন্যর জিনিস না বলে ধরতে নেই তবুও তুমি ধরলে কেন? এই কাজটা করলে তুমি?
” সরি পাপা।তবে তুমি যাই বলো না কেন আমার তোমার আমার মায়ের অতীত সম্পর্কে জানার অধিকার আছে পাপা।আমি সবটা যানতে চাই।
ওয়াফীর কথা শুনে নাহিয়ান থমকে যায়।আবারো সেই বিষাক্ত কথা গুলো নিয়ে ভাবতে হবে তাকে সেই বিষাক্ত দিনগুলো ভাবতে চায় না সে তাই ডাইরিতে সেই পরর্বতী দিন গুলোর কোন কথা উল্লেখ করেনি।এই বিষাক্ত সত্য গুলো এই বাচ্চাটা কিভাবে সহ্য করবে?। সে শুধু তার ওহিজানের স্মৃতি নিয়ে বাচতে চায়।
“প্লিজ পাপা আমায় জানতে দেও। তফুরা খাতুন কোথায় যিনি তোমায় এতো আদর করতো?আরো অনেকেই ছিল তখন কিন্তু এখন তো শুধু দাদু দিদা আর তুমি আর কোন আত্নীয়ের ভালোবাসা আমি পাইনি।আর আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ীটা কে। তুমি বিডিতেও যাওনা।জ্ঞান বুঝ হওয়ার পর থেকেই দেখছি এই ইউএসএ পরে আছো আমি যানতে চাই পাপা প্লিজ আমায় বলো(কাদতে কাদতে)
আচঁলে মুখ গুযে কাদছে তাসলিমা ইশরাক চোখের পানি আড়াল করে নেয় তারা যানতো আবারো একদিন এইসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাদের।নাহিয়ান স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে চোখের জল বির্সজন দিয়ে যাচ্ছে।
” বেশ!তবে সত্যটা তোমায় বলছি!……..
……….সেদিন ওজিহার অবস্থা এতোটাই খারাপ ছিল যে দ্রুত তাকে কবর দেওয়া হয়।নাহিয়ানের জ্ঞান ফিরলে সে যখন যানতে পারে ওজিহাকে সবাই কবর দিয়েছে সে ছুটে কবরের পাশটায় চলে যায়। বসে পরে কবরের পাশে আর পাগলের মতো আচরন করতে থাকে।
“এই এই আমাকে ছেড়ে কোথায় গেলে তুমি।তুমি আমার সাথে থাকবেনা রেগে আছো আমার উপর তুমি?কেন রেগে আছো বলো।(কবরের উপর শুয়ে)ওহিজান ফিরে আসো না ও ওহিজান আমাকে ছেড়ে কেন গেলে। তুমি ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে আমার আত্না টাই তোমার কাছে রয়ে গেছে ওহিজান কি হলো তুমি শুনছো না আমার কথা।তুমি আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোবে না ওহিজান। আমার বুকটা যে খালি পরে আছে কি হবে এখন। ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আমাদের উষ্ণ ছোয়ার ভালোবাসা কি আর হবেনা। বলোনা ওহিজান।হুটহাট আমাকে জড়িয়ে ধরবেনা বলো।আমি কি মরে যাবো বলো তুমি বলো আমি তো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। আমি বরং একটা কাজ করি আমিও তোমার কাছে চলে আসি”
কিছুটা দূরে একটি অর্ধভাঙ্গা কাচঁ পরে আছে নাহিয়ান দ্রুত গিয়ে সেই কাচঁটা হাতে তুলে নেয় আর বাম হাতের রগে একটি পোচ দেয়। সাথে সাথে ছিটকে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করে।দুর থেকে নাহিয়ানের এই অবস্থা দেখে ছুটে আসে রওনক, রাকিব আরো বাকিরা সবাই মিলে নাহিয়ানকে বাধা দেয় কিন্তু তাতেও কাজ হয় না। আবারো হুট করেই সেন্সলেস হয়ে যায় নাহিয়ান।
চলবে……..