বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_১৭
#পলি_আনান
মনের আকাশে জমে আছে এক গভীর মেঘ।দুজনের মাঝেই চলছে নীরবতার একটি পাহাড়।সেই দিন রাতে বাড়ি ফিরে এসে ওজিহাকে ধরে কাদতে কাদতে সেই অপ্রত্যাশিত মনিরার ঘটনাটি খুলে বলে নাহিয়ান।ওজিহা তখন নাহিয়ানকে সামনে থেকে প্রেরণা যোগালেও আড়ালে নিজের অশ্রু বির্সজন করে গেছে।সেই জমির দলিল গুলো পাগলের মতো আবার সারা ঘর নিয়ে খুজেছে কিন্তু ফলাফল শূন্য।হঠাৎ মাথায় আসে তার মামি আমেনার কথা। তিনি কাগজ গুলো সরিয়ে দেয় নি তো?সন্দেহ আর লজ্জা দুটো মিলিয়ে তার মামা ফিরোজকে ফোন করে। সেইদিনের কথাগুলো মনে পড়লে এখনো কলিজায় ছিদ্র হয়ে যায়।
“হ্যালো মামা তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে”
“হ্যা বল মা.
” মামা আসলে কথাটা কিভাবে বলবো ভেবে পাচ্ছি না।তুমি মনে কিছু নিয়োনা প্লিজ।আমার সেই জমির দলিল গুলো কয়েক মাস থেকে গায়েব আমি কোথাও খুজে পাচ্ছিনা।সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুজেছি কিন্তু কোথাও নেই।!
“সেকি কথা মা কাগজ গুলো নেই মানে?তুই কোথায় রেখেছিস।
“আমি তো আমার রুমের আলমারিতেই রেখেছিলাম।কিন্তু কাগজ গুলো এখন কোথাও নেই.
” জামাই যানে কাগজ গুলো যে পাওয়া যাচ্ছে না!
“যানে মামা।আমার স্পষ্ট মনে আছে কাগজ গুলো আমি আমার কাছেই রেখেছি তাহলে এখন কোথায়। মামা আমার এই মূহুর্তে কাগজ গুলো বেশী প্রয়োজন।!
” কি করবি তাহলে পাওয়া যাচ্ছে না কেন কেউ সরিয়ে দেন নি তো?
“মামা একটা কথা বলবো তুমি কিছু মনে নিওনা প্লিজ।আমার মনে হচ্ছে মামি কাগজ গুলো সরিয়ে দিয়েছে কারন এই কাগজ গুলো পেতে মামি আগে থেকেই ফাঁদ পেতে ছিল”
“তোর কাগজ তোর বাড়িতে ছিল তবে তোর মামি তোর পারমিশন ছাড়া তোর রুমে ডুকবে কেন তোর আলমারি খুলবে কেন।তুই কি তোর মামিকে চোর বলতে চাচ্ছিস।দেখ ওজিহা আর যাই করুক তোর মামি অন্যর বাড়িতে গিয়ে চুরি অন্তত করবেনা।আমি তোর থেকে এই কথা কখনো আশা করিনি।আর আমি কখনো তোর বাড়িতে যাবোনা তোর মামিকে অপমান করা মানে আমাকে অপমান করা।
” মামা শুন……..”কথাটি শেষ করতে পারলোনা ওজিহা তার আগেই ফিরোজ খট করে ফোনটা কেটে দেয়।
সেইদিন রাগে দুঃখে নিজের চুল ছিড়তে মন চাইছিলো ওজিহার।কাকে বলবে সে এই নৃশংস ঘটনা। এই সুখী পরিবারটাকে সে আর দুঃখী দেখতে চায় না।নিজের প্রান দিয়ে হলেও এই পরিবারকে বাচাবে সে।সেদিন সকালটা পার করলো হাজারো আত্ননাদ বুকে জমিয়ে।বিকেলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরের পরিবেশটা দেখছিলো আর হাজার কথা ভাবছিলো এমন সময় ফোন আসে একটি আননোন নাম্বার থেকে।সাত পাচ না ভেবেই ফোনটি রিসিভ করলো সে।
“হ্যা কে বলছেন?
” তোমার চাচাজান।”কথাটি শুনা মাত্রই ওজিহার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে।
“আপনি কেন ফোন করেছেন আমায়?
” শুন তোর জমির দলিল না পাওয়া গেলে সমস্যা নেই। কিন্তু তোর অন্যএকটা কাজ করতে হবে!
“ক.কি কাজ(ভীত কন্ঠে)
” তোর হাতে একমাস সময় তার মধ্যে তুই নাহিয়ান কে ছেড়ে যাবি। আর আমার মেয়ে সেই সুযোগে নাহিয়ানের মনে জায়গা করে নেবে।কাল থেকে মেয়েটা বায়না ধরেছে নাহিয়ানকে সে চায় যেকোন মূল্যে।
“কখনো না আমি কখনো নাহিয়ানকে ছাড়বোনা।”
আমি ছাড়লেও নাহিয়ান আমাকে ছাড়বেনা। সে ঠিকি আমায় আগলে রাখবে”
“আরে ধূর ছাড়বে ছাড়বে খুব সহজেই ছাড়বে।তুই ছেড়ে যা আগে।
” আমি কখই ছাড়বো না। মৃত্যু আগে পর্যন্ত তো না। ”
“হা হা হা আচ্ছা তোর চোখের সামনে যখন তোর মামা- মামি আর সরকার বাড়ির সবাইকে খুন করবো তখন তুই কি করবি বল কি করবি দায়ী কিন্তু তুই থাকবি আরেকটা কথা তুই যানিস মানুষ মারতে আমার হাত পা কাপে না বলতে পারিস মানুষ মারা আমার নেশা। তো এবার ভেবে কথা বল!
ওজিহা ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে সবার জীবনের ত্যাগের পরিবর্তে যদি নিজের একটা জীবন যায় তাতে ক্ষতি কি?
” আমি রাজি।”বুকে পাথর চাপা দিয়ে বললো কথাটি।
“এই তো ভালো মেয়ে যদি কাউকে এইসব বলো তবে তোমার মামা মানির লাশ পাঠিয়ে দেব।
কথাটি বলেই।ফোন কেটে দেয় লুকমান আর ওজিহা দেয়ালের সাথে ঘেসে বসে পরে।কান্নায় চোখ ভেসে যাচ্ছে।পাজরের সব হাড় যেন আলাদা হয়ে যাচ্ছে কি করে ছাড়বে সে এই মায়ার বাধনে বাধা ছেলেটাকে!।কি করে ভুলবে সে সারাজিন ওহিজান ওহিজান বলা ছেলেটাকে।কি করে ভুলবে সে যে বাবা ডাক শুনার জন্য অস্থির হয়ে ছিল পাগলের মতো নিজের বউয়ের দেখাশুনা করে গেছে আর শেষ মূহুর্তে কি না বাবা ডাকটাই আর শুনতে পাবে না ওজিহাকে দূরে সরে যেতে হবে।।
….
সেই পাচঁদিন আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো আবারো ভেবে কেদেঁ দেয় ওজিহা।এই কয়দিন নাহিয়ানকে বার বার দূরে সরাতে চেয়েছে সে কিন্তু পারছেনা যতটা দূরে সরাতে চায় নাহিয়ান যেনো আরো কাছে চলে আসে।তার হাতে সময় আছে মাত্র বিশ দিন এই কয়েকদিনের মাঝেই তাকে সব ছেড়ে চলে যেতে হবে।বারান্দায় দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সে গত কয়েকদিন থেকেই এভাবে রাত দিন পার হচ্ছে তার।তাসলিমা রুমে ডুকে ওজিহাকে না পেয়ে বারান্দার দিকে পা চালায়।ওজিহা মেঝেতে বসে আছে তা দেখে রেগে যান তিনি।
” ওজিহা পাগল হয়ে গেছো তুমি।নিচে বসে আছো কেন।উঠো আমার হাত ধরে উঠো”ওজিহা চুপচাপ বাধ্য মেয়ের মতো দাঁড়ায়।
“কিছু বলবেন মা? “৷ ” হু কি খাবে বলো আমি তৈরি করে দিচ্ছি!” ” কিছু খাবো না মা”
ওজিহা হঠাৎ করেই হু হু করে কেদে উঠে।ঝাপিয়ে পড়ে তাসলিমার বুকে।তার এমন আচরনে অবাক হয়ে যায় তিনি।”এই মেয়ে কাদছো কেন কি হয়েছে বলো?”কিছুনা মা আমাকে একা ছেড়ে দিন একটু।”
সে মনে মনে বলতে থাকে “আমি কি করে আপনাদের ছাড়বো মা।আপনাদের ভালোবাসায় আমি জড়িয়ে গেছি চাইলেও চাড়তে পারবোনা।
……
রাতে নাহিয়ান অফিস থেকে ফিরেছে। কিন্তু ওজিহার কোন ভাব আবেগ নেই সে চুপ চাপ অন্য দিকে পাশ কাটিয়ে শুয়ে আছে আর নিরবে চোখের জল ফেলছে।নাহিয়ান খেয়াল করছে ইদানিং তার ওহিজান তাকে ইগ্নোর করছে এর কারনটা সে এখন পর্যন্ত খুজে পাচ্ছেনা।ওজিহার পাশে শুয়ে বলে,”ওহিজান আমি কি কোন ভুল করেছি বলো যদি ভুল করে থাকি প্লিজ আমায় ক্ষমা করো তবুও তোমার এই ইগ্নোর আমি নিতে পারছিনা।”ওজিহা নিরবে কেদেই যাচ্ছে।নাহিয়ান আবারো বলে,”তুমি যানো আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি তবুও কেন এমন করছো তোমার এই নিরবতা আমার বুকের ভেতর রক্ত ক্ষরন করে তা কি তুমি বুঝোনা। “ওজিহাকে চুপ থাকতে দেখে পেছন থেকে জড়ি ধরে নাহিয়ান তাতেও কোন ভাব আবেগ নেই তার।হঠাৎ সে অনুভব করে তার ঘাড়ে গরম তরল কিছু পরছে।তার বুঝতে আর বাকি নেই নাহিয়ান কাদছে। ওজিহা পাশ ফিরে নাহিয়ানের উত্তপ্ত ঠোটের সাথে নিজের ঠোট মিলিয়ে দেয়।দুজনের উত্তপ্ত দহন হৃদয়ে এখন যেন একপাশলা বৃষ্টি হচ্ছে।প্রিয়তমার একটু ছোঁয়ায় বাচ্চাদের মতো কান্না যেন আরো বেড়ে গেছে তার।ওজিহাও কাদছে। দুজনের চোখের পানি এক হয়ে মিশে যাচ্ছে, দুঃখ গুলোকে কিছু সময়ের জন্য ছুটি দিয়ে শুধু প্রিয়তমকে আপন করে চাইছে সে।
……….
আরো ১৫টি দিন কেটে গেছে এই কয়দিনে অনেক চেষ্ঠা করেছে সে নাহিয়ানকে দূরে সরিয়ে দিতে কিন্তু পারেনি। সহ্যর সীমানা অতিক্রম করে লুকমান কে সে ফোন করে এবং জানিয়ে দেয় সে কিছুতেই নাহিয়ানকে ছাড়তে পারবেনা।এদিকে লুকমানের মেয়ে নাহিয়ানকে না পেলে আত্নহত্যা করবে বলে জানিয়ে দেয়।লুকমান শেষ পর্যন্ত উপায় না পেয়ে আবারো যাদু বিদ্যার সাহায্য নেয়।
ভোর হতে চললো হঠাৎ কিছু ভাঙ্গার শব্দে ওজিহার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নাহিয়ান তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে তাকে দেখতে একদম বাচ্চা রুপে লাগছে।তারদিকে কিছু ক্ষন তাকিয়ে থেকে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়।ফ্রেশ হবে বলে পানির কল চালু করে হাতে পানি নিলে সে খেয়াল করে পানির পরিবর্তে তার হাতে কল থেকে রক্ত পড়ছে ভয়ে তার গা শিউরে উঠে চিৎকার দিয়ে নাহিয়ানকে ডাকতে থাকে কিন্তু তার গলা থেকে কোন শব্দই আসছেনা।হঠাৎ করেই একটি কালো আলখাল্লার মতো পোশাক পরাহিত একটি অবয়ের আবির্ভাব ঘটে।ভয়ে ওজিহার গলা শুকিয়ে গেছে নিজেকে বাচাতে দরজা খুলতে নিলেই পেছন থেকে তার চুল টেনে ধরে। আর দেয়ালের সাথে মাথা বারি দিতে থাকে মাথা ফেটে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।নিজেকে বাচাঁতে ধস্তা ধস্তি করছে তবুও তার রক্ষে নেই।
ঘুমের ভেতরে হাতড়ে হাতড়ে নাহিয়ান তার ওহিজানকে খুজচ্ছে ওজিহাকে না পেয়ে লাফিয়ে উঠে সে।ওয়াশরুমের সামনে কিছুক্ষন ডাকাডাকি করলেও কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। এক পর্যায়ে নাহিয়ান দরর্জা ভেঙ্গে ভেতরে ডুকে।ভেতরে ডুকে যা দেখলো তাতে নিজের পায়ে দাড়ানোর মতো ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সে। ধপ করে ফ্লোরে বসে পরে মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেরিয়ে আসে,
“আমার ওহিজান!!!
#চলবে……