অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_৫

#অনুভূতির_মায়াজাল,পর্ব_৫
#নাজমুন_বৃষ্টি

মৌ নীলাদ্রির এমন অবস্থায় এক পরিচিত আঙ্কেলের সাথে কথা বলে একটা অফিসে চাকরির ব্যবস্থা করলো।

নীলাদ্রিও বিনা বাক্য ব্যায়ে মাথা নেড়ে চাকরিটা সন্তোপর্নে গ্রহণ করে নিলো।

নীলাদ্রি চাকরির প্রথম দিন, একটা চাকরি পাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়ে রওনা দিল। তার বড়ো কোনো চাকরি লাগবে না, কোনোমতেই চলার মতো একটা ছোটোখাটো চাকরি হলেই চলবে। মৌ এর দেওয়া ঠিকানাই গিয়ে দেখলো, এটা অনেক বড়ো একটা কোম্পানি। অনেক কর্মচারী আছে। নীলাদ্রি বুঝতে পারলো না, এতো বড়ো অফিসে সে কীই-বা চাকরি পাবে! ভয়ে ভয়ে ঢুকতেই একজন কর্মচারী নীলাদ্রিকে একদম উপরে বসের ক্যাবিনের সামনে নিয়ে ঢুকতে বলে নিজে চলে গেল। নীলাদ্রি চারপাশে তাকিয়ে দেখল, সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তাই কেউ নীলাদ্রির দিকে তাকাচ্ছে না, এইটা নীলাদ্রির বেশ ভালো লাগলো। এখন আর অস্বস্তি লাগছে না। ভয়ে ভয়ে বসের ক্যাবিনে ঢুকতেই দেখল, একজন মধ্য-বয়স্ক লোক চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।

নীলাদ্রি কিছুক্ষন সেইদিকে তাকিয়ে রইল। লোকটাকে এখন ডাকা কী ভালো হবে! লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে উনি ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু নীলাদ্রি যে চাকরির আশায় এসেছে, এই চাকরি যে তার পেতেই হবে। নীলাদ্রি আশেপাশে তাকালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে এগিয়ে লোকটির উদ্দেশ্যে ডাক দিল।

-‘স্যার?’

লোকটির কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে সে আরেকটু এগিয়ে আবার ডাকল। এইবার লোকটি নীলাদ্রির ডাকে ধড়ফড় করে উঠে সোজা হয়ে বসল।

-‘তুমি কে?’ লোকটি ভ্রু কুঁচকে নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল।

নীলাদ্রি লোকটিকে মৌ’য়ের কথা বলতেই লোকটি হেসে নীলাদ্রিকে বসতে বলল। নীলাদ্রি বসতেই তিনি বলে উঠলেন,

-‘মৌ আমার মেয়ের সমবয়সী। ও আমাকে কাল সব বলেছে। এই দিনে তোমার এই অবস্থা দেখে আমার ভীষণ খারাপ লেগেছে। মনে হয়েছে, তোমার এই অসহায় সময়ে তোমার জন্য কিছু করতে না পারলে আমার এই জীবনে এতটুকু এগিয়ে আসাটা বৃথা।’

-‘আঙ্কেল, আপনি আমাকে যেকোনো একটা কাজ দিলেই হবে। যেটা দিয়ে আমি কোনোমতে চলতে পারবো।’

-‘জানো মা? তোমার মতো আমারও একটা মেয়ের শখ ছিল। তোমাকে দেখে আপন আপন লাগছে মনে হচ্ছে যেন তুমি আমার মেয়ের মতোই। তুমি আমাকে স্যার বলিও না। তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করো না। তোমার বেশি টাইম দিতে হবে না, তুমি তোমার পড়াশোনা ঠিকমত করিও। প্রিন্টারের কাজ দিচ্ছি। অবশ্য, সেটাতে অন্য একজন আছে কিন্তু আপাতত এটাই করো। আর বাকি সব কাজে তোমাকে অনেক সময় দিতে হবে তাই সেগুলো দিচ্ছি না। তোমার তো বড়ো হতে হবে, পড়াশোনার পাশাপাশি এই কাজটা করলে হবে।’ বলেই তিনি একজনকে ডাকলেন, উনি আসতেই তিনি নীলাদ্রিকে তার জায়গা দেখিয়ে দিতেই নীলাদ্রি চলে আসতে গিয়ে থেমে জিজ্ঞেস করলো,

-‘স্যার, একটা কথা বলি? আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে, আপনি কী কোনো কারণে ডিপ্রেসড!’

নীলাদ্রির কথায় লোকটি মলিন মুখে হাসলো।

-‘শুভকামনা মা তোমার জন্য!’
নীলাদ্রি বুঝতে পারলো উনি এই বিষয়ে কথা বলতে চাইছেন না। তাই সে হেসে মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল ক্যাবিন থেকে।

———–

এভাবেই কেটে গেল আরও কয়েকমাস। নীলাদ্রির অফিসের স্যারটা অনেক ভালো। তার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করলো ওই একজন মানুষই। উনি নীলাদ্রিকে অনেক স্নেহ করেন, আর মেয়ে সম্বোধন করে কথা বলেন । নীলাদ্রিও বাবার নজরে দেখে। নীলাদ্রিকে বেশি কাজ করতে দেয় না, নীলাদ্রির পাশাপাশি প্রিন্টারের জন্য আগের জনকে আর বিদায় করেনি। তাই নীলাদ্রির তেমন চাপ পড়ে না। সে সকালে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস করে অফিসে যায়। এটা তার অফিসের স্যারের আদেশ, নীলাদ্রি যাতে ক্লাস করে, ঠিকমত পড়াশোনা করে। নীলাদ্রিও বাধ্য মেয়ের মতো সব হাড়ে হাড়ে পালন করে। অফিসে যেহেতু বেশি কাজ থাকে না তাই নীলাদ্রি পাশাপাশি আরেকটা টিউশন নিল। মাস শেষে কিছু টাকা নিজে রেখে বাকি কিছু টাকা বাবা-মায়ের জন্য পাঠায়। উনারা তা দিয়ে ভালোই চলে যায়। অবশ্য প্রথম প্রথম নেহাল আহমেদ নীলাদ্রির উপর রেগে ছিলেন, কেন তার মেয়ে চাকরি করবে এরকম একটা অচেনা শহরে! কিন্তু পরবর্তীতে নীলাদ্রি যখন অফিসের স্যারটার সাথে বাবাকে কথা বলিয়ে দিল এবং বুঝিয়ে বলল তখন নেহাল আহমেদের রাগ পড়ে গেল। তবুও তিনি অভিমান করে থাকেন। সব মিলিয়ে নীলাদ্রির দিন এখন ভালোই কাটে। নীলাদ্রি মাস শেষে পাশাপাশি কিছু টাকা নিজের কাছে সঞ্চয় রাখে। তার যে অনেক বড়ো হতে হবে!

দেখতে দেখতে আরও কয়েকমাস কেটে গেল। এখন নীলাদ্রি এতদিনের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে কয়েকটা সেলাই মেশিন নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি খুঁজে খুঁজে আরও কয়েকজন অসহায় মেয়েকে তার সেলাইয়ের দোকানে কাজ দিয়েছে। সে মূলত শাড়ির ব্যবসাই শুরু করছে। আস্তে আস্তে বিভিন্ন দোকানে এসব ছড়িয়ে দিচ্ছে। দিন শেষে রাতে একটু পড়াশোনা করে রাত জেগে সে এসব শাড়ির কাজ করে, নিজেও করে পাশাপাশি অসহায় মেয়েগুলোকেও শিখাই। আস্তে আস্তে তারাও নীলাদ্রির মতো কাজে দক্ষতা অর্জন করছে। এসবের মাঝেও নীলাদ্রি অফিসের চাকরিটা ছাড়েনি কারণ তার অসহায় সময়ে যে মানুষটা তার বাবার মতো করে সাথে থেকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলো মেয়ের মতো করে, উনাকে কিভাবে ছেড়ে আসবে নীলাদ্রি! লোকমান সাহেব যে নীলাদ্রিকে মেয়ে ভেবে আসছে, তাকে নীলাদ্রি ছেড়ে আসতে পারবে না। অবশ্য উনি সবসময় বলেন, এতো কষ্ট করে আর চাকরিটা না করার জন্য কিন্তু নীলাদ্রি অবসর সময়ে একটু আধটু গিয়ে মানুষটার অফিসে গিয়ে সময় দেয়। নেহাল আহমেদও অনেক খুশি, তার মেয়ে অবশেষে সুখের পথ দেখছে! সবাই সাক্ষী, নীলাদ্রি কত কষ্ট করে এগোচ্ছে!

একদিন নীলাদ্রি অফিসে স্যারের ক্যাবিনে ফাইল দিতে গিয়ে দেখল, স্যার কার সাথে জানি কথা বলছে। হয়ত ছেলেই হবে।
নীলাদ্রিকে তার স্যার কথার ফাঁকে একদিন বলেছিলেন, তার একটা-মাত্র ছেলে। তবে ছেলেটা এখনো দেশে আসলো না। সেই যে চারবছর আগে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে গিয়েছে এখনো একবারও আসলো না। এখন পড়া শেষ। তিনি ছেলেকে বলেন, এসে যাতে তাদের এতো এতো কোম্পানিগুলো হাতে নেয় আর বিয়ে করে।আর কয়দিনই বা নিজে বাঁচবে কিন্তু ছেলেকে দেশে আসার কথা বললে কোনো এক কারণে বিষয়টা এড়িয়ে যায়। লোকমান সাহেব বুঝে উঠতে পারেন না। উনার ছেলে উনাকে অনেক ভালোবাসে, বাবার কথা হাড়ে হাড়ে মেনে চলার চেষ্টা করে কিন্তু দেশে আসে না। নীলাদ্রি যখনোই দেখতো তখনোই লোকমান সাহেবকে সবসময় ছেলের কথা বলতে শুনতো।

নীলাদ্রি ফাইল নিয়ে আবার ফেরত আসলো কারণ বুঝতে পারলো, স্যার বোধহয় উনার ছেলের সাথে কথা বলছে কারণ তিনি মোবাইলের অপর পাশে থাকা ব্যক্তিকে অনুরোধ করছিলেন। হয়ত ছেলেকে দেশে আসতে বলছিলেন! তাই নীলাদ্রি আর ডিসটার্ব করলো না। ব্যক্তিগত কথায় ডিসটার্ব না করা ভালো।

অনেক্ষন পর নীলাদ্রি ফাইল নিয়ে আবারও ক্যাবিনের দরজায় ঠোকা দিল কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ পেল না। দ্বিতীয়বার ঠোকা দিয়েও যখন কোনো সাড়া পেলো না তখন সে দরজা ঠেলে নিজেই ঢুকে পড়লো। দেখতে পেল, স্যার হাঁফাচ্ছে। নীলাদ্রি তাড়াতাড়ি দৌড়ে স্যারকে ধরতেই স্যার নীলাদ্রিকে নিজের হাতের ফোনের দিকে ইশারায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু বলার আগেই ঢলে পড়লো। নীলাদ্রি স্যারকে ধরে সবাইকে ডাক দিল। সবাই আসতেই স্যারকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও স্যারের হুশ ছিল। তিনি তার হাতের ফোনটা নীলাদ্রির দিকে বাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতে করতে চোখ বন্ধ করে ফেলল। নীলাদ্রি লোকমান সাহেবকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে নিজেও উনার হাত ধরে পাশের সিটে বসে পড়লো। পাশেই লোকমান সাহেবের অক্সিজেন লাগানো নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকাতেই চোখ দিয়ে অঝোরে ধারাই অশ্রু নির্গত হলো। এই স্যারটা তার দ্বিতীয় বাবার মতো এই অচেনা শহরে এই দুইবছর ধরে নীলাদ্রিকে আগলে রেখেছিল। ইনার কিছু হলে নীলাদ্রি কল্পনাও করতে পারবে না।

হাসপাতালে নেয়ার সাথে সাথেই ডাক্তাররা ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল লোকমান সাহেবকে। তারা জানাল, উনার শ্বাসকষ্টের সমস্যা ছিল আর কোনোকিছু নিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার ফলে হার্ট এট্যাক আসছে। আর বয়সের ভারে বিভিন্ন রোগ ছিল। উনার কাছের বলতে একমাত্র কয়েকজন কর্মচারী ছিল, তারাও অতটা কাছের নয়। উনি নীলাদ্রিকে সবসময় মেয়ের মতো আপন ভাবতেন। তাই নীলাদ্রি সায় জানাল অপারেশনের জন্য।

অপারেশন থিয়েটারে যখন লোকমান সাহেবকে ঢুকাচ্ছিল তখন উনার কোনো হুশ ছিল না। নীলাদ্রির মনটা আজ অনেক খারাপ। সে শুধু প্রার্থনা করছে , লোকমান সাহেবের যেন কিছু না হয়।

নীলাদ্রি অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে চেয়ারে মাথা উঁবু করে চোখ বন্ধ করে বসে রইল। হঠাৎ হাতের মোবাইলটার তীব্র শব্দে নীলাদ্রি ধড়ফড় করে চোখ খুলতেই দেখল, লোকমান সাহেবের মোবাইলে কেউ একজন কল করছে। নীলাদ্রি মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে চোখ যেতেই দেখল,’ছন’ লেখা। সে বুঝতে পারলো হয়ত স্যারের ছেলে।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here