বৃত্তের_অন্তরালে পর্ব_১২
#পলি_আনান
আজ সরকার বাড়ির আকাশে বাতাসে ছেয়ে যাচ্ছে খুশির আভাস।সন্ধ্যা থেকে বাড়ির প্রতিটি সদস্য বাচ্চা দের মতো ধেই ধেই করে নাচ্ছে।খুশিতে চোখে জল চলে এলো তাসলিমার।তিনি এখনি অনুভব করছে ওজিহার অনাগত শিশুটি এখনি বাড়ির চারপাশে হই হই করে বেড়াচ্ছে। মাতিয়ে রাখছে পুরো পরিবার।আধো আধো মুখের বুলি ছুটবে দিদিভাই, দিদিভাই বলে।ভবিষৎত জীবনের কাংক্ষীত খুশির কথা ভেবে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি তিনি।মনে পড়ে যায় নাহিয়ান জন্মের সময়টুকু কতটা যত্নে ভালোবাসায় আগলে রেখেছিল তার শশুড় -শাশুড়ী।তিনিও আজ শাশুড়ী হলেন তারো কত শত দায়ীত্ব আছে।বাচ্চাদের মতো হেসে যাচ্ছে ইশরাক প্রথম দাদু হওয়ার আনন্দে তিনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি।ওজিহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে তফুরা খাতুন।তার বংশের বাতি ওজিহার কাছে দেখা শুনা যত্নে যেন কোন ত্রুটি না হয় তিনি আগেই সবাইকে সর্তক করে দয়েছেন।প্রয়জনে বাড়িতে আরো দুইজন সার্ভেন্ট বেশি রাখবেন তিনি।তার কাছে মা বাচ্চা দুজনের সুস্থতাই বেশি দামি।মিষ্টি বিতরনের কাজে লেগে গেছে নাহিয়ান।প্রথম বাবা হবে এই খুশির সংবাদ কাউকে না জানিয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না।সংবাদ টা আসার পর থেকে ওজিহাকে একটি বার নিজের কাছে পায় নি, একটু ছুয়ে দেখতে পারেনি।মনটার ভেতর শুধু আসফাস করছে কখন ছুয়ে দেখবে তাকে।
সেই দিনের রাত মনে পড়লে আজো বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে ওজিহার।সেদিন যদি নাহিয়ান সেই সময় উপস্থিত না হতো তবে আজকের এমন দিনটি আর চোখে দেখতো না।সন্ধ্যার সূর্যটা ডুবন্ত লাল আভা চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে প্রায় সতের মাস আগে ঘটে যাওয়া সেই গা শিউরে উঠার ঘটনা।নাহিয়ান ওজিহাকে গাড়িতে বসিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষন পরেই ওজিহা সেন্সলেস হয়ে যায়।কি হয়েছে তার, শেষটা কি ইংগিত করেছে কিছুই বোধগাম্য হয় নি নাহিয়ানের।বাড়ি ফিরতে ফিরতে তাদের প্রায় রাত দেড়টা বেজে যায়।নাহিয়ানের পরিবারের সবাই সেদিন বসার ঘরে বসে ছিল ওজিহাকে যখন পাজা কোলে নিয়ে সে ঘরে ডুকলো সবার মাঝে তখন খুশির আগমনী বার্তা ফিরে এলো। কিন্তু ওজিহার হাতে পায়ে গালে গলায় আচড়ের দাগ দেখে সবাই আতৎকে উঠে।সবাই ভেবে পাচ্ছে না এইসব কিসের আচড় তবে দেখে মনে হচ্ছে অনেক দাড়ালো নখরে আচড়।
কিছুটা নেকড়ের মতো।
সেইদিন তার সেন্স ফিরে আসে যখন ভোর হতে চললো।ওজিহার অবস্থার কথা শুনে জারাও ভোর হতে না হতেই ছুটে আসে।জারা ওজিহার অতীতের সবটা জানিয়ে দেয় সবাইকে।
হোস্টেলের মেয়ে প্রিয়া মারা যাওয়ার পর থেকে সে প্রায় একা হয়ে গেছিলো।তাই তার মনের মাঝে সব সময় হ্যালুসিয়েশান কাজ করতো।মাঝে মাঝে তার মা – বাবার সাথে কথা বলে এবং সে এইগুলো বিশ্বাস ও করে নিয়েছিল তার বাবা মা তার কাছে আসে।তার এই মনের ভ্রম দিন দিন বেড়েই চলছিলো।প্রিয়ার মৃত্যুর পর ওই রুমে কেউ ভয়ে ও যেতো না কিন্তু ওজিহা দিনের পর দিন খুব সাচ্ছন্দ্য কাটাতে শুরু করে ওই রুমে। তার মাঝে যেন ভয় ডরের কোন আভাস নেই।সব কিছু তদন্ত করে যানা যায় প্রিয়া মেয়েটি কালা জাদুতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছিল।যার প্রভাব কিছুটা পড়ে ওজিহার উপর।দিনের পর দিন এক মিথ্যা জালে ফেসে ছিল ওজিহা।তার মৃত্যু কামনায় কারো বছরের পর বছর রাত কাটে।কিন্তু মৃত্যু যেন ওজিহার কাছে আসেনা।এক পবিত্রতা তাকে বেধে রেখেছে।তার মামু বলে তার মায়ের মাঝে যে পবিত্রতা ছিল তা যেন ওজিহার মাঝেও বৃদ্ধমান।কিন্তু ওজিহার মা শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর নিষ্ঠুর লোভের কাছে হেরে যায়।ওজিহা কি বেচে থাকবে নাকি হারিয়ে যাবে সেই বিষাক্ত পাপ লোভের কাছে?সেইদিনের পর থেকে তফুরা খাতুন বিভিন্ন হুজুরের কাছ থেকে ঝাড় ফু, তাবিজ ইত্যাদি ওজিহার জন্য ব্যবস্থা করে যদিও নাহিয়ান এইসবে একদম বিশ্বাস করে না তবুও ওজিহার জন্য সে কোন রিক্সস নিতে চায় না।তাই সবটা মেনে যাচ্ছে সে।মাঝে মাঝে অদ্ভুত ঘটনা এখনো থামছেনা তার সাথে।
“ওহিজান!
পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে নাহিয়ান। ওজিহার কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে,
” ও আমার সারাজীবনের সঙ্গীনি, অনন্ত কালের সঙ্গীনি কি চাই বলো আমার কাছে তোমার?
“আমি আবার কি চাইবো তোমার কাছে?(ভ্রু কুচকে ওজিহা)
” আজ বাবা হবো শুনেই এতো আনন্দ আর এতো খুশি লাগছে আর যখন আমার সন্তান আমার দিকে আধো আধো চোখ করে তাকাবে তখন আমার কেমন লাগবে অনুভূতিটা কি হবে বলোত আমি ভেবে পাচ্ছিনা উফফফ আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে।
কথাটি বলেই নাহিয়ান ওজিহাকে পাজা কোলে তুলে নেয়।
“আরে কি করছো কি! আমাকে সারাদিন কোলে নেওয়া ছাড়া কি তোমার আর কাজ নেই”
“না নেই এখন থেকে সবসময় আমার কোলে কোলেই থাকবে,বুঝলে ওহিজান!এবার বলো কি চাই তোমার আমার কাছে?
” চাই, চাই আমার একটু বেশি করে চাই!
“বলো বলো কি চাই আমার ওহিজানের আমার কাছ থেকে!
“এখন থেকে আমাকে আরো বেশি করে ভালোবাসতে হবে,বাচ্চা পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে চলবে না কিন্তু!
শেষ কথাটা ঠোঁট উলটে কান্নার সুরে বললো সে।
” ব্যস এইটুকুই। তোমাকে ভালোবাসাতে আমার কোন সময় লাগেনা মূহুর্ত লাগে না। সারাদিন ভালোবাসবো তোমায়।”
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে একটি মিষ্টি করে হাসি উপহার দেয়।
“একটা কথা বলি তোমায়?
” আজ তোমার সব কথা শুনবো ওহিজান! বলো কি চাই তোমার।
“মুহিব ভাইদের সাথে সর্ম্পটা ঠিক করে নাও।দেখো আমাকে নিয়ে রেষারেষিতে ফুফু আর ফুফাও তেমন আসে না এই বাড়িতে। তাদের খারাপ লাগে তাদের ছেলের সাথে তোমরা কথা বলোনা যোগাযোগ রাখনা।এটা সব বাবা মায়েরি কষ্ট লাগবে তাই বলি কি সর্ম্পকটা ঠিক করে নাও প্লিজ!
” দেখো ওহিজান তুমি যে সুযোগ বুঝে কোপ দিতে জানো তা আমি আগে থেকেই যানি।কিন্তু ও আমাদের সাথে কি করলো তোমার আর আমাদের সর্ম্পকের ফাটল ধরালো তুমি আমার উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে এইসব কথা কি আমি ভুলে যাবো।
“দেখো আমি কিন্তু আমার সাথে হওয়া এইসব অদ্ভুত কথা তোমায় কখনো বলিনি সেই দিনের বিষয়টার পর থেকেই তুমি যানতে পারলে তাই এক দিক দিয়ে ভালোই হলো প্লিজ সবটা ঠিক করে নাও।!
নাহিয়ান কিছুক্ষন ভেবে, মুচকি হেসে সম্মতি জানায়।
” ঠিক আছে তোমার চাওয়াটাই হবে।
“আমি জানতাম তুমি আমার কথা ফেলবেনা।
……
এদিকে একটি অন্ধকার রুমে বসে আছে একটি লোক যার পড়নে আলখাল্লা। রুমটি দেখতে কিছুটা ভয়ংকর চারিদিকে ধৌয়া উড়ছে, মাথার খুলি,মানুষের হাড় গোড় স্তুপ জমানো।সেই লোকটির চেলা এসে বলে,
” জনাব আপনার সাথে সেই ভদ্র লোকদেখা করতে এসেছে!
“পাঠিয়ে দে?(গম্ভীর কন্ঠে)
কোট প্যান্ট পড়া একটি মধ্য বয়স্ক লোক।লোকটি রুমে ডুকেই চিৎকার চেচামেচি শুরু করে দেয়,
” আমি আর কয় বছর অপেক্ষা করবো আপনি বলুন, প্রায় সাত আট বছর হতে চললো ওই মেয়েকে কিছুতেই যাদু করে মারা যাচ্ছে না। প্রপাটির উইল ও আমার হাতে আসছেনা। মেয়েটাকেও খুজে পাচ্ছি না।আপনার উপর আমার সর্ম্পূণ বিশ্বাস টাই মরে যাচ্ছে!
“আহহহ থাম, এতো উতলা হচ্ছিস কেন?
” আপনি কি বলছেন আমি উতলা হবো না আমি আর কয় বছর অপেক্ষা করবো ওই মেয়ের মাকে মারতে যেমন এক অবস্থা হয়েছে এই মেয়েকেও মারতে ঠিক একই অবস্থা কি হচ্ছে আমি কিছুই বুজতে পারছিনা।”
“ওই মা, মেয়ের মাঝে এক পবিত্রতা আছে সেই পবিত্রতা সব সময় তাদের ঘিরে রাখে তাই তাদের মাঝে এই যাদু সহযে কাজ করতে চায় না।আচ্ছা শোন!
” জ্বি বলুন,তোর সব চোরা কারবারি খবর আমি যানি তুই কি চাস তাও আমি যানি। তোর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দে!
“কি বলছেন আপনি বিয়ে দিয়ে দেব!
” হুম তোর পুরোন বন্ধুর ছেলের কাছেই বিয়েটা দে….তাদের সম্পত্তির ও কমতি নেই!
“বাহ আপনি তো ভালো বুদ্ধিটাই দিলেন। আগে তো আমি ভেবে দেখিনি!
” তুই আর কি ভাববি সারাদিন তো মেয়ে মানুষের মতো কাউ কাউ করিস।বিয়েটা শেষ হলেই ওই বংশটাকেও নিশ্বস করে তোর মেয়ে জামাইকে নিয়ে তুই একা থাকবি আর সব সম্পত্তি তুই ভোগ করবি।
দুজন দুজনের মাঝে কি যেন চোখ ইশারা করে তার পর দুজনে একসাথে বিশ্রী এক বিদঘুটে হাসি হাসে।
চলবে……