#প্রেমসরনী,পর্ব ৫
#নাজমুন_বৃষ্টি
সন্ধ্যার দিকে নিহি রান্নাঘরের জিনিসপত্র ধোয়া-ফালা করছিল। রেহেনা খালা’কে চাচি তার রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছে পা টিপে দেওয়ার জন্য। আসলে এটা মূলত চাচির কারসাজি। যাতে করে রেহেনা খালা যেন নিহিকে কাজে সাহায্য করতে না পারে।
আর মাত্র কয়েকমাস পরেই নিহির ফাইনাল পরীক্ষা কিন্তু সে কোনোমতেই ভালোমতো প্রিপারেশন নিতে পারছে না। কলেজে যাওয়া তো দূরের কথা। চাচি নিহিকে কলেজ যাওয়ার সময় একেকটা কাজ এগিয়ে দেয়। নিহি কলেজের কথা বললে চাচি আজেবাজে বকে। তাই নিহি আর কথা বাড়ায় না।
নিহি এসব ভাবতে ভাবতে ধোয়া-ফালা শেষ করে রান্নাঘর মুছার জন্য উঠে পিছনে ঘুরতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। রান্নাঘরের দরজায় দু’হাত বুকে গুঁজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাহান নিহির দিকে।
নিহি ভয়ে ঢোক গিললো। রাহান বিকেলে বের হওয়ার সময় নিহিকে বারে বারে বলে দিয়েছে নিহি যাতে কোনো কাজ না করে, রুমেই রেস্ট করে কিন্তু এখানে নিহি’রই বা কী দোষ! চাচিই তো নিয়ে আসছে।
-‘ভ,,ভাইয়া আপনি? কিছু কী লাগবে?’
-‘আমার জন্য কফি নিয়ে আই।’ এই বলে রাহান দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
নিহি রাহানের যাওয়ার পানে থাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সে মনে করেছিল -রাহানের কথা না শোনার জন্য আজ বোধহয় গালিই খাবে কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। নিহি রাহানের গালি খাওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো কিন্তু তা হয়নি ভেবে নিহি খুশি খুশি মনে রাহানের জন্য কফি বানাতে লাগল।
কফি বানিয়ে নিহি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই চাচি সিঁড়ি দিয়ে নামার পথে রক্তচক্ষু দৃষ্টিতে নিহির দিকে তাকাতেই নিহির পা স্থির হয়ে গেল।
-‘কিরে! কফি নিয়ে কই যাচ্ছিস তুই?’
-‘চা চাচি রাহান ভাইয়া কফি নিয়ে যেতে বলেছে। তাই আর কী,,,,’ ভয়ে ভয়ে কাপা কাপা কণ্ঠে নিহি চাচির কথার প্রতিউত্তর করল।
-‘রেহেনায়ায়া’ চাচি রেহেনা খালার নাম ধরে জোরে ডেকে উঠল।
রেহেনা খালা চাচির রুম থেকে বের হতেই চাচি নিহির হাত থেকে কফির মগটা রাগী দৃষ্টিতে কেড়ে নিয়ে রেহেনা খালার হাতে তুলে দিল।
-‘রেহেনা এগুলো আমার ছেলে রাহানকে দিয়ে আই।’
রেহেনা ‘হ্যাঁ’ বোধক সম্মতি দিয়ে রাহানের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
নিহি রেহেনা খালা যাওয়ার পানে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝতে পেরেছে এখন তার কপালে শনি আছে।
পারভীন বেগম নিহির সামনে এসে নিহির চুলের মুঠি ধরে রাগীস্বরে বলে উঠলো,
-‘হতচ্চারি, তোকে যেটা করতে বারণ করি সেটাই বেশি করে করিস। আরেকবার এমন কিছু করলে-সেইদিন তোর একদিন কী আমার একদিন দেখিয়ে দিবো। আমার সামনে থেকে এখনই দূর হো।’ এই বলে নিহির চুল ছেড়ে ধাক্কা দিয়ে নিহিকে ফেলে দিল পারভীন বেগম।
নিহি ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে ছিটকে দূরে সরে গেল ফলে সিঁড়ির কোনায় নিহির ঠোঁট কেটে যাওয়ায় নিহি ব্যথায় ‘আহ’ করে শব্দ করে উঠল।
নিহি রুমে এসে ব্যালকনিতে গিয়ে মলিন দৃষ্টিতে সন্ধ্যার আকাশটার দিকে তাকিয়ে রইলো। সন্ধ্যার রক্তিম আকাশটা আস্তে আস্তে অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কয়েকটা তারা উঁকি দিচ্ছে। তারাগুলো কী সুন্দর জ্বলজ্বল করছে!
এখন কেন জানি চাচির এসবের কারণে নিহির আর খারাপ লাগা কাজ করে না। সবকিছু নিয়তি হিসেবে মানিয়ে নিতে শিখেছে নিহি।
~ যার মা’বাবা নেই – জীবন কী জিনিস -সেই বুঝে হায়!~
এরপর নিহি রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শরীরটা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে তাই বিছানায় শুতেই সব ঘুমরা এসে ধরা দিল। রাতে আর নিহি খেতে রুম থেকে বের হয়নি। অবশ্য কেউ নিহিকে ডাকতেও আসেনি। চাচা বিজনেসের কাজে ঢাকার বাইরে গিয়েছে। আর রেহেনা খালাকে নিশ্চই চাচি চোখে চোখে রেখেছে। যার ফলে তিনিও নিহিকে ডাকতে আসেনি। অবশ্য নিহি না খেলেই খুশি চাচি।
রাত ১২টা বাজে।
পুরো সন্ধ্যা সময়টা ঘুমানোর ফলে আর ঘুম আসছে না নিহির। এদিকে ক্ষুদায় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। নিহি আর না পারতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল কিছু খেতে পারে কী-না দেখতে।
নিহি রুম থেকে বের হতেই ওই কোনার রুমটাতে আলো জ্বলতে দেখা গেল। সেই রুমটা রাহান ভাইয়ার। উনি কী এখনো ঘুমাইনি! হয়ত কাজ করছে।
নিহি আবছা অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ফ্রিজের কাছে আসতেই কেউ একজনের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই সামনের মানুষটা নিহির কোমর জড়িয়ে ধরে ফেলে যার ফলে নিহি হুমড়ি খেয়ে সেই মানুষটার বুকে গিয়ে পড়ল। মানুষটার হার্টবিট খুব দ্রুতই চলাচল করছে। নিহি চোখ তুলে উপরে তাকাতেই আবছা অন্ধকারে রাহানের মুখায়ব দেখে দ্রুত সরে গেল।
রাহানকে দেখে নিহির চাচির কথা মনে পড়ে গেল। চাচির চোখে নিহি আর খারাপ হতে চায় না। নিহি দ্রুত পিছন ঘুরে চলে যেতে নিতেই রাহানের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেল।
-‘রাতে খাসনি কেন?’
নিহি নিশ্চুপভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
-‘সন্ধ্যায় তোকে কফি নিয়ে যেতে বলেছিলাম, রেহেনা খালাকে নয়। কী হয়েছিল তখন? মা কী বলেছিল?’ রাহান শান্ত-কণ্ঠে আবারো বলে উঠল।
নিহি রাহানের কোনো কথার প্রতিউত্তর না করে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
রাহান নিহির কোনো উত্তর না পেয়ে রাগ সামলাতে না পেরে পাশে থাকা কাঁচের ফুলদানিটা হাতে নিয়ে জোরে ছিটকে মারলো। মুহূর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ড্রয়ইং রুমটাতে ঝনঝন শব্দে চারপাশ ভারী হয়ে উঠল।
নিহি ভয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো। এতক্ষন ধরে কোনোমতে কান্নাটা ঠোঁট চেপে আটকে রেখেছিলো। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর নিহিকে কেউ এভাবে যত্ন সহকারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি যার ফলে আজ রাহান একটু জিজ্ঞেস করাতে ভেতর থেকে সব কান্নারা বেরিয়ে আসলো।
রাহান রাগী দৃষ্টিতে নিহির দিকে আরেক ফলক তাকিয়ে দফাদফ সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
রাহান যাওয়ার দিকে নিহি কান্নারত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাঙা ফুলদানির টুকরো গুলো কুড়াতে লাগলো। কারণ সকালে উঠে চাচি এগুলো দেখলে নিহির উপর আরো চিল্লাচিল্লি করবে।
রাহান উপরে উঠে রুমে না ঢুকে নিচে নিহিকে ফুলদানি’র ভাঙা অংশগুলো কুড়াতে দেখে তার খারাপ লাগলো। নিজের রাগ সংযত না করতে পারার জন্য নিজেকে নিজে গালি দিল।
নিহি ভাঙা অংশগুলো কুড়িয়ে রাখার সময় একটা হাতে ঢুকে যাওয়াতে ‘আহ’ করে শব্দ করল। সেটা কোনোমতে বের করে ভাঙা অংশগুলো ডাস্টবিনে ফেলে উপরে চলে এলো। এসবের মাঝে আর খাবারের কথা নিহির মনে রইল না।
নিহি কোনোমতে উঠে দৌড়ে রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল। তার জীবনটা কোথা থেকে কোথায় এসে দাঁড়ালো তা নিহি ভেবেই পাই না! কেন এমন হলো। নিহির কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেল। একসময় ক্রান্ত হয়ে ঐভাবেই ঘুমিয়ে পড়ল নিহি। হাতে কেটে যাওয়া স্থানটাই রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে গিয়েছে।
রাহান রুমে ঢুকে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। আজ কিছু কাজ আছে তাই না ঘুমিয়ে রাত জেগে কাজগুলো করছিল মাঝে পানির তৃষ্ণার ফলে নিচে পানির জন্য গিয়েছিল। রাতে নিহিকে খাবারের টেবিলে না দেখে সে মায়ের সামনে কোনোমতে কয়েক লোকমা খেয়ে খিদা নেই বলে চলে এসেছিল। সে মাঝে মাঝে ভেবে পাই না তার নিহু এতটাই সহ্যশীল কীভাবে হলো! যে মেয়ে সামান্য খেলনার জন্য কান্নায় পুরো বাড়ি মাথায় তুলতো সে-ই মেয়ে আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে!
রাহান লেপটপ বন্ধ করে কিছুক্ষন হাটাহাটি করল। তারপর কী ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে নিহির রুমের সামনে দাঁড়ালো। দরজা হাল্কা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। রাহান সাবধানে পা ফেলে ঘুমন্ত নিহির সামনে হাঁটুমুড়ে বসে নিহির কোমল হাতটা নিজের মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে কিছুসময় তার নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকিয়ে রইলো এরপর পরম যত্নে ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে উঠে পড়লো। রাহান বসা থেকে উঠে নিহির পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ‘সরি নিহুপাখি’ বলে নিহির হাতে একটা চুমু খেল এরপর নিহির গায়ে ভালোমতো লেপ টেনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
রাহানের এতক্ষনে শান্তি শান্তি লাগছে, কিছুক্ষন আগেও মনের ভেতর অস্তিরতা কাজ করছিলো। এখন আর তা লাগছে না। রাহান রুমে এসে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ল। এইবার একটু শান্তির ঘুম দিবে রাহান।
#চলবে ইন শা আল্লাহ।