প্রেমসরনী,পর্ব ৩,৪

#প্রেমসরনী,পর্ব ৩,৪
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৩

নিহি রুমে এসে বসে রইলো মেঝেতে। চাচির এই অত্যাচার’গুলো এতদিন সহ্য করলেও এখন যেন সব অসহ্য হয়ে উঠছে। আজ ভীষণ করে বাবা-মা’কে মনে পড়ছে।
নিহি ব্যলকনিতে গিয়ে সকালের ব্যস্ত শহরটা’র রাস্তার দিকে তাকাতেই এক জায়গায় চোখ আটকে গেল।
রাস্তা দিয়ে একটা বাইক যাচ্ছে। যেটাতে একটা ছোট-খাটো হাসি-খুশি পরিবার ফুটে উঠছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সব সুখ এই ছোট-খাটো একটা বাইকেই এসে ধরা দিয়েছে। বাইকের সামনে বাবা, বাবা-মা দুজনের মাঝখানে একটা হাসি খুশি পিচ্চি মেয়ে স্কুল ড্রেস পড়া, মেয়েটি’র হাতে একটা হাওয়ায় মিঠাই। মাঝে মাঝে মেয়েটির মা ঠোঁটের কোনায় হাসির রেখা টেনে তার স্বামীকে কিছু একটা বলছে আর মেয়েটি মাঝখানে গাল ফুলিয়ে তাকাচ্ছে। বাবা পিছনে ফিরে মেয়েটির গালে একটা চুমু দিতেই মেয়েটির রাগ মুহূর্তের মধ্যে পড়ে গিয়ে হেসে দিল। বুঝাই যাচ্ছে, হয়তোবা বাবা অফিস যাচ্ছে আর মা-মেয়ে স্কুলে যাচ্ছে। এই ছোট খাটো পরিবারটাতে হয়ত সুখের অভাব নেই।
নিহির মনে হচ্ছে পৃথিবীতে এর চাইতে সুন্দর জিনিস বোধহয় আর নেই। এসব দেখতে দেখতে নিহির চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। একসময় তারও এমন একটা সুখের পরিবার ছিল। বাবারো একটা বাইক ছিল। নিহিকে তার মা স্কুল ড্রেস পড়িয়ে বাবার সাথে বের হতো। বাবা নিহি আর নিহির মা’কে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে নিজে অফিসে চলে যেত। আহা! কী সুন্দর সুখের সময় ছিল। আজ কই সেই দিনগুলো! ভাবতেই নিহি ডুকরে কেঁদে উঠলো।

রাহান নিহির রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে ভাবছে, ঢুকবে কী ঢুকবে না! কিন্তু এতদিন পরে এসে তার নিহুর সাথে কথা বলবে না তা কিভাবে হয়! রাহান দরজায় হাত দিতেই বুঝতে পারলো দরজা খোলা। সে রুমে ঢুকে দেখলো রুমে নিহি নেই। হাঁটতে হাঁটতে ব্যাল্কনিতে গিয়ে দেখলো নিহি রাস্তার দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখ দিয়ে অঝোরো ধারায় পানি পড়ছে। রাহান নিহির দৃষ্টি অনুযায়ী রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলো একটা বাইকের দিকে নিহি তাকিয়ে আছে। যেখানে একটা ছোট-খাটো সুখী পরিবার ফুটে উঠছে। নিহি কল্পনার রাজ্যে এতটাই ব্যস্ত যে, তার পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে-সেটাই বুঝতে পারলো না। রাহানের মুহূর্তের মধ্যে নিমিষেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। যেরকম খুশি খুশি মনে নিহির রুমে এসেছিলো তার চেয়ে বেশি দুঃখী হয়ে গেল। সে বাইকটার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো কেন নিহি কান্না করছে!তার নিহুপাখির কতটা কষ্ট হচ্ছে সেটা ভাবতেই আরো বেশি খারাপ লাগলো। রাহান আস্তে আস্তে করে পিছন দিকে সরে নিহির রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

নিহি’র এসব ভাবনার মাঝেই ওই বাইকটা চোখের আড়াল হয়ে গেল। সে চোখ মুছে রুমে এসে মুখটা আবারো ধুয়ে নিলো । এরপর আবারো নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। সে জানে, এখন নিহিকে রান্নাঘরে না দেখলে চাচি আবারো চেঁচামেচি শুরু করে দিবে। চাচা অফিসে থাকে সবসময় – শুধুমাত্র শুক্রবারেই চাচা বাসায় থাকে , যার ফলে শুক্রবার ছাড়া এমনি প্রতিটা দিনই চাচির রাজত্ব চলে এই বাসায়। এই ঘরে প্রতিটা দিনই নিহির জন্য অসহনীয়। তবুও নিহি এই মানুষগুলোর কাছে ঋণী। তার অসহায় সময়ে থাকার জন্য মাথার উপর অন্তত একটা ছাদ হলেও পেয়েছে। নাহলে বাবা-মা চলে যাওয়ার পর কই থাকতো নিহি, কীভাবে বেঁচে থাকতো! বাবা-মা রিলেশন করে বিয়ে করেছে যার ফলে বাবা-মায়ের বিয়ের পরেই মায়ের সাথে তার নিহির নানুরবাসার সবার সাথেই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। নিহির নানাই সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। নিহি তার চাচার কাছ থেকে শুনেছিল, নিহির একটা মামা ছিল-যিনি চুরি করে নিহির মায়ের সাথে যোগাযোগ করতেন কারণ তিনি বোনদের মধ্যে নিহির মা’কে ভীষণভাবে ভালোবাসতেন কিন্তু একদিন তিনিও তার বাবার কাছে ধরা খেয়ে যান। যার ফলে সেইদিনই সব যোগাযোগ ছিন্ন হয় আর কোনোদিন কারো সাথে যোগাযোগ হয়নি। এমনকি নিহির মায়ের মৃত্যুও তারা জানতে পারেনি হয়তো। জানলে অন্তত তার ওই মামাটা আসতো নিহির জন্য। নিহির চাচা নিহির মায়ের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী গিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন ওরা অনেক আগেই সবাই মিলে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে। যার ফলে নিহির বাবা-মায়ের ব্যাপারটা আর বলতে পারেনি তার চাচা।

নিহি এসবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে নিচে যেতেই চাচির অগ্নিদৃষ্টি নিহির উপর পড়লো। নিহি ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল।
নিহি রান্নাঘরে ঢুকে রেহেনা খালার সাথে হাতে হাতে কাজ করতে লাগলো কারণ রেহেনা খালা ইতিমধ্যে সব কাজই শেষ করে ফেলেছে।
গত বিকেল থেকে নিহির পেটে কিছু পড়েনি যার ফলে খিদায় পেট চো চো করছে। বারে বারে গা গুলিয়ে উঠছে। রেহেনা খালা এটা বুঝতে পেরে নিহির দিকে নাস্তা এগিয়ে দিলো।

-‘এই ধর। খেয়ে নেয় এগুলো। কাল থেকে কিছুই তো খাসনি। এখন এই সবগুলো ফটাফট শেষ করে ফেল তো দেখি।’

-‘তুমি খেয়েছো খালা?’

নিহি হাসিমুখে প্লেট হাতে নিয়ে রেহেনা খালার দিকে তাকিয়ে উক্ত কথাটি বলতেই রেহেনা খালার চোরা চোরা দৃষ্টিতে যা বুঝার বুঝে ফেললো। কারণ সে জানে, চাচি কোনোদিনও এতো বেশি নাস্তা নিহির জন্য রাখবে না। নিহি কাল থেকে কিছু না খাওয়ার কারণে রেহেনা খালা হয়তো সকালের নিজে নাস্তা না করে নিজেরটা সহ নিহির জন্য বাঁচিয়ে রেখে দিয়েছে। নিহি মাঝে মাঝে ভেবে পায় না, এই মানুষটা’র কাছ থেকে এতো ভালোবাসা পাওয়ার আধো কী নিহি যোগ্য?

নিহি হাসিমুখে প্লেটটা নিয়ে আগে খালার মুখে পুরে দিল খাবার।

-‘আরে! আমি খেয়েছি তো। এসব তোর জন্য।’

-‘হ্যাঁ, তা তো বুঝতে পেরেছি।’ নিহি এসব বলতে বলতেই আরকিছু খাবার নিজে খেতে খেতে আরকিছু খালার মুখে পুরে দিলো।

-‘সত্যি বলছি, এসব তুই খা নিহি। তোর খিদা পেয়েছে রে।’

নিহি হাসিমুখে নিজে কিছু খেয়ে আবার খালাকেও খাইয়ে দিল।

নিহি আর খালার খাওয়ার শেষ পর্যায়ে চাচি নিহিকে গালি গালি দিতে দিতে রান্নাঘরে ঢুকলো।

-‘ওই দেখ, ডায়নি আইসা গেছে।’ রেহেনা খালা মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো।

পারভীন বেগম এসে নিহিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-‘এখানে তো সব কাজ শেষ। তুই এসে পুরো বাড়িটা মুছে ফেল। আগে নিচের তলাটা মুছবি এরপর উপরের সব রুম ভালো করে মুছে ফেলবি।’

-‘মেডাম, এত্ত বড়ো বাড়ি, নিহি কীভাবে একা মুছবে! আমি নাহয় উপরেরতলা মুছি আর নিহি নিচের তলা মুছুক।’

-‘তোরে আমি বলিনি। ক্যান নিহি মুছতে পারবে না? তিনবেলা নিয়ম করে করে গিলতে তো পারে। নিহি যা।’

নিহি মাথা নিচু করে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে পানি নিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ মুছতেই চাচাতো বোন তিশা ঘুম থেকে উঠে উপর থেকে নিহিকে নাস্তার জন্য ডাক দিল।

-‘সিঁড়ির আর মাত্র কয়েকটা ধাপ আছে, ঐগুলো মুছে ফেলি? নাহলে কেউ আবার পা পিছলে পড়ে যাবে সিঁড়ি থেকে। আমি খালাকে বলি? তোমাকে নাস্তা দেওয়ার জন্য আপু?’

-‘না, তুই দিবি নাস্তা। আর তা এখনই।’ তিশা রাগী কণ্ঠে বলে উঠলো।

-‘কিন্তু…’.

-‘আমার মামনি যা বলছে তাই কর। নাস্তা নিয়ে আয় তুই। মুখে মুখে তর্কের জন্য থাপ্পড় আর দুইটা পড়লে ঠিক হয়ে যাবি।’

নিহি আর কোনো কথা বলার সাহস পেলো না। সে বালতিটা একপাশে রেখে নিচে তিশার নাস্তার জন্য এগিয়ে গেল।

নিহি নাস্তা নিয়ে তিশার জন্য উপরে উঠলে তিশা নাস্তা খেতে খেতে নিহির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

-‘নিহি তোর একটা ড্রেস আছে যে? বাবা কিনে দিয়েছিলো গত সপ্তাহে? এটা আমার জন্য একটু আন তো, আমি একটু পড়ব।’

নিহি মন খারাপ করে তার রুমে কাপড়টা নেয়ার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলো। এটা তার প্ৰিয় কাপড় ছিল। দোকানে দেখার পর তার পছন্দের জামাটা চাচাকে বলার পর চাচা কিনে দিয়েছিলো। আর এখন সেটাও দিয়ে দিতে হচ্ছে। নিহি জানে এই কাপড়টা সে আর পাবে না।

তিশা নিহি রুমে যাওয়ার পর চুপি চুপি বেরিয়ে সিঁড়ির উপরের ধাপে নিহির রেখে যাওয়া পাউডারের পানির বালতিটা পায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। যার ফলে পুরো সিঁড়ির ধাপ গুলো পিছলা হয়ে গেল।

নিহি রুমে আসার আগে তিশা নিজের রুমে আগের মতো বসে পড়লো।
নিহি কাপড় নিয়ে আসতেই তিশা বলে উঠলো,
-‘ধন্যবাদ নিহি তোকে। এগুলো নিয়ে যা, আমি আর খাবো না।’

নিহি প্লেটটা নিয়ে ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি তে এক পা দিতেই পা পিছলে নিজের ব্যালেন্স হারিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আর উপরে তিশা রুম থেকে বেরিয়ে নিহির দিকে তাকিয়ে শয়তানি হাসি দিল। নিহির মনে হচ্ছে সে বুঝি মারাই যাবে! মাথাটা ভীষণভাবে ব্যথা করছে। চোখগুলো খুলে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে। চোখের কোনায় পানি এসে জমাট বাঁধলো। চোখ বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তে আধো আধো চোখে ঝাপসা দৃষ্টিতে নিহি দেখতে পেলো, কেউ একজন উন্মাদের মতো তার দিকেই দৌড়ে আসছে। নিহি অস্পষ্ট সুরে ‘রাহান ভাইয়া ‘ বলে বিড়বিড় করে উঠলো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

#প্রেমসরনী
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব ৪

নিহির ঘুমন্ত মুখটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাহান। দেশে আসার পর থেকে তার নিহুকে ভালোভাবে দেখায় হয়নি। আজ সাতবছর পর তার নিহুকে সে প্রানভরে দেখছে। মুখটা আর আগের মতো নেই, একদম শুকিয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে নিহুর সেই আগের চঞ্চল রূপটাও মিলিয়ে গেল। রাহান নিজেই পরম যত্নে নিহির মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে। পাশেই রেহেনা খালা কেঁদে-কেটে চোখ-মুখ ফুলিয়ে নিহির পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর রাহানের পাশে পারভীন বেগম দাঁড়িয়ে রাগে ফুসছে। একটু দূরে দরজার পাশে তিশা ‘কিছুই হয়নি’ এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে। পারভীন বেগম বুঝতে পেরেছে এসবকিছু তিশার কারণেই হয়েছে। অন্যসময় তিশার এসব কাজের জন্য পারভীন বেগম খুশি হলেও আজ যেন খুশি হতে পারছে না কারণ আজ রাহান আছে, আর সে নিজেই পরম যত্নে নিহিকে কোলে নিয়ে রুমে এনে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছিলো যা পারভীন বেগম সহ্য করতে পারছে না। এতদিন মনে মনে যেটার ভয় পেয়েছিলো আজ তার নিজের মেয়ের কারণে সেটাই হলো। পারভীন বেগম তিশার দিকে কিছুসময় পর পর রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করছে।

-‘রাহান বাবা, নিহি তো ঘুমাচ্ছে। আমি আছি ওর সাথে। তুই রুমে গিয়ে রেস্ট কর।’

-‘মা, নিহি সিঁড়ি থেকে কীভাবে পড়লো?’ রাহান নিজের রাগ যথাসম্ভব সংযত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠলো।

রাহানের কথা শুনে পারভীন বেগম আর তিশা দু’জনের পিলে চমকে উঠলো। তারা মোটেও এমন কিছু ভাবেনি- যে রাহান এমন প্রশ্ন করবে।

-‘হহ্হ..হয়ত সি..সিঁড়ি মুছতে মুছতে পানি পড়ে ওখানে ওর পা পিছলে পড়েছিল।’ পারভীন বেগম রাহানের প্রতিত্তরে আমতা আমতা করে কোনোমতে বলে উঠলো।

-‘মা, নিহির জ্বর ছিল আর এখনো আছে। সেই অবস্থায় তুমি ওকে সিঁড়ি মুছতে দিয়েছিলে?সকালে বোধহয় নিহিকেই গালিগুলো দিচ্ছিলে তুমি!’

রাহানের কথায় পারভীন বেগম আমতা আমতা করতে থাকলো।

-‘বাবা, তুই ভুল বুঝছিস আমি তো,,,’

রাহান পারভীন বেগমকে কথাগুলো শেষ করতে না দিয়ে রেহেনা খালার উদ্দেশ্যে বলল,
-‘খালা, নিহিকে দেখে রেখো। আমি ড্রেসিং টেবিলের উপর আরেকটা ওষুধ রেখেছি ঐটা খাবারের পর খাইয়ে দিও নিহিকে। এই বাড়িতে অন্তত তোমার উপর ভরসাটা আছে।’ রাহান আড়চোখে তার মা পারভীন বেগমের দিকে তাকিয়ে উক্ত কথাগুলো বলে নিহির দিকে আরেক ফলক তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিশার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল। তিশা ভাইয়ের এমন রাগী চেহেরা দেখে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে রইলো। তার মানে কী..! নিহি পড়ে যাওয়ার সময় তিশার হাসিটা রাহান ভাইয়া দেখে ফেলেছে! তিশা আর কিছু ভাবতে পারলো না।

রাহান রুমে গিয়ে মাথা চেপে ধরে বসে রইল। সে নিহিকে কোলে করে রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে দেওয়ার পরে নিহির হাতে ফুটন্ত তেলের দাগ দেখেছিলো – যেগুলো মাত্র কিছু-সময়ের মধ্যে পড়েছে এমন। সকালেই মেয়েটা হাত চেপে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় রাহানের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো। তখনো মেয়েটা কান্নারত অবস্থায় ছিল। তার অজান্তে তার ছোট্ট পরীটা কী অনেক কষ্ট পাচ্ছে! রাহান আর কিছু ভাবতে পারলো না।
.
.
বিকেলের দিকে নিহি চোখ খুলতেই আবছা আবছা দৃষ্টিতে দেখতে পেল কেউ একজন তার দিকে ঝুকে তাকিয়ে আছে। নিহি এটা তার চোখের ভ্রম ভেবে উঠতে নিলেই সামনে ঝুঁকে থাকা মানবটার মাথার সাথে কপালের ধাক্কা খেয়ে ব্যথায় ‘আহ’ করে কপাল চেপে ধরল। নিহি এইবার বুঝতে পারলো এটা তার ভ্রম নয়, বাস্তবেই রাহান ভাইয়া তার রুমে তারই সামনে বসে আছে। নিহির তৎক্ষণাৎ চাচির কথা মনে পড়লো যে চাচি বলেছিলো নিহি যেন রাহানের আশেপাশে না যাই কিন্তু এখন তো স্বয়ং রাহান ভাইয়াই তার রুমে! চাচি দেখতে পেলে নিহির আর রক্ষা নেই ভেবে নিহি দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে দৌড়ে রুমের দরজা খুলে আশেপাশে উঁকি দিয়ে এসে রাহানের সামনে দাঁড়ালো।

-‘ভাইয়া, আপনি আমার রুমে! কিছু কী লাগবে? লাগলে তাড়াতাড়ি বলে চলে যান প্লিজ আমি পাঠাচ্ছি।’ নিহি মাথা নিচু করে মিনিমিনিয়ে বলল।

রাহান এতক্ষন ধরে নিহিকে পর্যবেক্ষণ করছিল। মেয়েটি কী পাগল হয়ে গেল না-কি! শোয়া থেকে উঠে রুমের দরজার আশেপাশে কী দেখছে! আজিব! এখন আবার বলছে চলে যেতে। রাহান মূলত এসেছিলো রেহেনা খালার কাছ থেকে নিহির জ্বর আবারো বাড়ার কথা শুনে। এমন কেন করছে নিহু!

-‘আরে রিলাক্স নিহুপাখি। আমার কিছুই লাগবে না। আমি তোর জ্বর আর আসছে কী না দেখতে আসছি।’ রাহান শান্ত-দৃষ্টিতে নিহির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।

‘নিহুপাখি’ ডাকটা নিহির কর্ণগোচর হতেই সে মাথা উঁচু করে রাহানের দিকে তাকাতেই দুজনের চোখ এক জায়গায় নিবদ্ধ হলো। ফলে নিহি দ্রুতই চোখ নামিয়ে ফেলল। এই চোখের দিকে তাকানোর সাহস নিহির নেই। এই চোখের দিকে তাকালেই নিহি বাস্তবতা ভুলে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাবে বহুদূর। কতদিন পর এই ডাকটা শুনলো নিহি তা ভাবতেই মনের ভেতর খুশির জোয়ার বয়ে চলল। এই ‘নিহুপাখি’ ডাকটা শুধুমাত্র রাহানই ডাকতো। নিহি মনে করেছিল আর সেই ভালো লাগার ডাকটা শুনতে পারবে না কিন্তু না! আজ আবারো শুনলো। রাহান ভাইয়া নিহিকে এখনো মনে রেখেছে।

-‘আচ্ছা, আমি যাই নিহু। তুই মেডিসিন ঠিকমত নিস্। আমি রেহেনা খালাকে তোর জন্য খাবার আনতে পাঠিয়েছি নিচে , ঐগুলো আনলে খেয়ে নিস্। আমার কাজ আছে। নিচে যাস না, তোর কাজ করতে হবে না, রেস্ট কর।’ এই বলে রাহান নিহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।

নিহির হঠাৎই মনটা ভালো হয়ে গেল। কিন্ত রাহানের ‘নিহুপাখি’ বলার জায়গায় নিহু বলাতে মনটা একটু খারাপ হলেও এতদিনের প্ৰিয় মানুষটা তার মতো ক্ষুদ্র মানুষটাকে মনে রেখেছে ভেবেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। রাহান ভাইয়া বদলে যায়নি, আগের মতোই আছে।

কারো ধাক্কাতে নিহির হুশ ফিরে। সে সামনে তাকিয়ে দেখলো রেহেনা খালা খাবারের প্লেট নিয়ে মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে।

-‘আরে খালা যে! তুমি কখন এলে!’

-‘তোর কল্পনার রাজ্যেতে হারিয়ে যাওয়ার আগেই এসেছি। এইবার বল কী এতো ভাবছিস। আজকে এতো খুশি খুশি ক্যান লাগছে?’ রেহেনা খালা প্লেটটা থেকে নিহির মুখে খাবার খাইয়ে দিতে দিতে বলল।

-‘আরে তেমন কিছু না খালা। আচ্ছা তখন কী হয়েছিল? আমি তো আমার ধারণা অনুযায়ী এতক্ষনে মারা যাওয়ার কথা!’ নিহি খাবার চিবাতে চিবাতে বলল।

-‘আরে দূর পাগলী! সিঁড়ি থেকে পড়লে কী কেউ মারা যায়! তুই পিচ্চিই রয়ে গেলি এখনো নিহি।’

-‘আরে বলো না খালা!’

-‘তুই মাত্র সিঁড়ির কয়েক ধাপ পড়েছিলি নিহি। রাহান ধরে কোলে নিয়ে ফেলেছিল তোকে। তাই কিছু হয়নি, একটু কপালে কাঁটা গিয়েছিলি তাও রাহান ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।’

রেহেনা খালার কথা শুনে নিহির মনে আবারো খুশির জোয়ার বইতে লাগলো। লজ্জা লজ্জাও লাগছে। সে তার রাহান ভাইয়ার কোলে ছিল! ইসস! যদি সেন্স থাকতো তাহলে তো নিহি বুঝি লজ্জায় মরেই যেত!

-‘শাকচুন্নি, তুই এখানে বসে বসে গিলছিস। আর ঐদিকে আমার তিশা মামনি দুপুর থেকে না খেয়ে আছে সেই ভাবনা কী আছে তোদের!’ পারভীন বেগম কর্কশ স্বরে কথাগুলো বলে নিহির দিকে তেড়ে আসতেই নিহি ভয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

-‘আর রেহেনা তোরে যেন নিহির আশেপাশে আর না দেখি। নিচে যা তুই।’

রেহেনা মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

-‘আমার মেয়ের জন্য গরম গরম রুচি আর চিকেন মাসালা করে নিয়ে আয় নিহি। পুরো দিনই তো রুমেই কাটালি, এইবার বের হো।’

নিহি ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নেড়ে নিচে রান্নার উদ্দেশ্যে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

কিছুসময় পর রাহান সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নিলেই নিহিকে রান্নাঘরে রুচি ভাজতে দেখে তার মাথা মুহূর্তের মধ্যে খারাপ হয়ে গেল। সে যাওয়ার সময় বারবার করে বলে দিয়েছিলো যাতে নিহি রেস্ট করে কিন্তু মেয়েটা,,! রাহানের কথাকে মূল্যই দিল না।রাহান নিহির দিকে রাগী দৃষ্টি নিঃক্ষেপ করে রুমে গিয়ে আওয়াজ করে দরজা আটকে দিল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here