#সর্দি_কন্যা,পর্ব (৪)
#রোকসানা_রাহমান
শরীরটাকে বৃষ্টির ফোঁটা থেকে রক্ষা করতে দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ছুটলাম। রান্নাঘরের ছাউনিতে আশ্রয় নিলে আম্মু আর নাজু আন্টির গলার স্বর পেলাম। আন্টি বোধ হয় আমাকে দেখলেন। তাড়াহুড়ায় ঘরের ভেতরে ঢুকলেন। চোখের পলকে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে এলেন। আমার মাথায় ধরে বললেন,
” আসো। ”
আমি চুপচাপ ছাতার নিচে দাঁড়ালাম। আন্টি আমাকে একদম রুমের কাছে এগিয়ে দিলেন। আমি নীরবে খাটের উপর বসতে আম্মুর আগমন ঘটল। দূর থেকেই বলল,
” তুই আমাকে খুঁজেছিস? জরুরি কিছু বলবি বলে? ”
আমি সন্দেহ চোখে তাকালাম। আম্মু সে চাহনি ধরতে পারল না। আমার উত্তরের অপেক্ষায় রইল। সেসময় চোখ পড়ল পেছনে। উষ্মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে, মুখে দুষ্টুমি! মোবাইল আর মানিব্যাগটা নাড়িয়ে নাড়িয়ে আমাকে দেখাচ্ছে। আমি রাগ চোখে তাকালাম। চোয়াল শক্ত করে নাক ফুলালাম। সে কোনো পাত্তাই দিল না! মুখ বাঁকিয়ে চলে যাওয়ার ভাব ধরল। আমি ধপ করে নিশ্বাস ছেড়ে বললাম,
” উষ্মার গানের গলা সুন্দর। ”
আম্মু ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। বুঝাই যাচ্ছে আমাকে বিশ্বাস করছেন না। আমি নরম গলায় বললাম,
” সত্যিই সুন্দর। ”
” তখন তো অন্য কিছু বলেছিলি। ”
” ইচ্ছে করে বলেছি। সবাই তো প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। আগুনের মতো ঝলকে ওঠে! ”
আম্মু সাথে সাথে কিছু বলল না। কেমন করে যেন তাকিয়ে রইল অল্পক্ষণ। তারপর হঠাৎ হেসে ফেলল। উৎসাহ নিয়ে বলল,
” তোর পছন্দ হয়েছে? আমি জানতাম হবে। ”
” আমার পছন্দ হয়েছে মানে কী, আম্মু? তুমি কি আমাকে…”
আম্মু আমার কথা শুনল না। ঠোঁটে হাসি নিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল। আমি পিছু পিছু একটু এগোলাম। সন্দেহ মনে বিড়বিড় করলাম, ‘ উষ্মার কথায়ই ঠিক? ‘
” আপনি নাকি কয়েলের ধোঁয়া সহ্য করতে পারেন না? ”
উষ্মার কণ্ঠস্বরে আমি চমকালাম। ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সে মশারি টাঙাচ্ছে। আমি জোর কদমে এগিয়ে বললাম,
” তুমি এখানে কী করছ? ”
উষ্মা সহজ গলায় উত্তর দিল,
” মশারি টাঙাচ্ছি। ”
” তোমার টাঙাতে হবে না। যাও, এখান থেকে। এখনি। ”
” যাব না। ”
উষ্মার বেয়াড়াপনায় আমার মেজাজ চটে গেল। খানিকটা চড়া গলায় বললাম,
” তুমি যাবে মানে যাবে। এখনি যাবে। ”
আমি উষ্মার ডানহাতের কনুই ধরে ফেললাম। টেনে দরজার দিকে হাঁটা ধরলে সে বলল,
” আমাকে কেমন লাগছে? ”
আমি থামতে বাধ্য হলাম। সে আবার বলল,
” আমাকে দেখে বলুন তো, কেমন লাগছে? ”
উষ্মার দিকে তাকালাম। গোলাপি শাড়ি, যত্ন করে চুল বাঁধা ও মুখে হালকা প্রসাধনী মাখাতে একটু অন্যরকম লাগছে। না, একদমই অন্যরকম। চোখের চাহনি গাঢ় হতে আনমনা হয়ে বললাম,
” টিপ বাঁকা হয়েছে। ”
বলতে বলতে আমি হাত দিয়ে টিপে স্পর্শ করতে সে মাথা পিছিয়ে নিল। চটপটে বলল,
” এটা টিপ নয়, আঁচিল। ”
আমার বুঝি হুঁশ ফিরল। ভ্রু কুঁচকে সন্দেহ চোখে আঁচিলের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এমন জায়গাও আঁচিল হয়? ডানদিকে সামান্য নড়ালে বিশ্বাসই হবে না এটা আঁচিল!
” বিশ্বাস হচ্ছে না? ছুঁয়ে দেখবেন? ”
আমি সচেতন হলাম। ছুঁয়ে দেখার আগ্রহ দেখালাম না। উষ্মা পুরোনো কথায় ফিরে গেল,
” বললেন না, কেমন লাগছে? ”
আমি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বিদ্রুপ করে বললাম,
” মনে হচ্ছে বাদরের গলায় মুক্তোর মালা! ”
” মানে কী? ”
আমি খানিকটা উঁচু গলায় বললাম,
” মানে সুন্দর লাগছে না। খারাপ লাগছে। বিশ্রী! ”
উষ্মা রেগে গেল। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,
” আমি জানতাম আপনি এমনই বলবেন। সেজন্যই আন্টিকে সাথে করে আনিনি। আপনার কাজই হলো আন্টিকে কষ্ট দেওয়া। ”
” আম্মুর কথা বলছ? ”
” জি। ”
” তোমার সাজের সাথে আম্মুর কী সম্পর্ক? ”
” অনেক সম্পর্ক। এই শাড়ি, গয়না তো আন্টিরই। উনি নিজ হাতে সাজিয়ে বলেছেন, আমাকে সুন্দর লাগছে। ”
আমি চট করে উষ্মার আপাদমস্তক দেখে নিলাম। উষ্মা সত্যি বলছে। এই শাড়িটা আম্মুরই। কানের দুল, গলার লকেটটাও আম্মুর। আমি নিজে ইদে বানিয়ে দিয়েছিলাম। উষ্মা আমার কাছ থেকে সরে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
” আপনার উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে। আপনি নিশ্চয় অন্য কারও ছেলে। আন্টি কুড়িয়ে এনেছে। এজন্যই আন্টির আনন্দ আপনার সহ্য হয় না। কষ্টে দিতে অন্তর কাঁপে না। ”
আমি উষ্মার কথা কানে নিলাম না। ছুটে এসে বললাম,
” এগুলো তুমি পরেছ কেন? ”
উষ্মা উত্তর দিল না। মশারি খুলে নিয়ে গরম চাহনি রেখে বলল,
” আপনাকে মশা খাক। মশার খাদ্য হওয়ার জন্যই আল্লাহ আপনাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে। ”
উষ্মা চলে যেতেই আমার মানিব্যাগ আর মোবাইলের কথা মনে পড়ল। হিসেবে তো ওগুলো ফেরত পাওয়ার কথা। আমি দৌড়ে দরজা পার হয়ে তাকে খুঁজলাম। নেই, আশপাশে কোথাও নেই। হতাশ হয়ে ফিরে এসে দেখলাম খাটের মাঝখানে মানিব্যাগ আর মোবাইল পড়ে আছে। আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। মেয়েটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা নয়। কথা রাখতে জানে। খাটের উপর উঠতে উঠতে জানালার দিকে তাকালাম। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। কালো অন্ধকার ঝাপসা দেখাচ্ছে। শীতল বাতাস গায়ে লাগতে সম্পূর্ণ শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। সেসময় মশার কামড় টের পেলাম। হাতে কামড়াচ্ছে, পায়ে কাপড়াচ্ছে, পিঠে কামড়াচ্ছে। কপালটাকেও ছাড়ছে না! হায় মাবুদ, এখন ঘুমাব কী করে?
___________
নতুন জায়গাতে আমার এমনিতে ঘুম আসে না। তারমধ্যে মশার উৎপাত! কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসতে বাধ্য হলাম। এদিকে খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট এসে বিছানার একপাশ ভিজিয়ে দিছে। কাঠের পাল্লা শব্দ করে দুলছে। বিরক্তিতে আমার মাথা ঝিম ধরে রইল। ঠিক করলাম বৃষ্টি কমলেই গ্রাম ছাড়ব। যত রাতই হোক।
আমি বসে বসে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিলাম। সেসময় বাতাসের সাথে নারী কণ্ঠের গুণগুণ শব্দ ভেসে এলো। আমার কান খাড়া করলাম। মনোযোগ বাইরে দিতে খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো। ভীষণ আশ্চর্য হলাম। চট করে ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনটা ছুঁইছুঁই। এতরাতে কে হাসছে? কে গান গাইছে? আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে পারলাম না। জানালার কাছে এসে বাইরে নজর রাখলাম। এদিক ছেড়ে ওদিকে তাকাতে বিস্ময়ের সীমানা ভেঙে গেল। বাঁশঝাড়ের ওখানে নারী অবয়ব! ছন্দ ধরে লাফাচ্ছে, ঘুরছে, হাত-পা ছুটে নাচছে। আমি দুইহাত দিয়ে জানালার শিঁক চেপে ধরলাম। কপাল ঠেকিয়ে আরও ভালো করে মেয়েটিকে দেখতে লাগলাম। সে লাফাতে লাফাতে এদিকে এগিয়ে আসছে। ঝাপসা অবয়বটি দৃষ্টিগোচরে রূপ নিতে আমি চেঁচিয়ে বললাম,
” এই মেয়ে, পাগল নাকি? এভাবে ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছ কেন? ”
উষ্মা দূর থেকেই চিৎকার করে বলল,
” ব্যাঙের মতো নয়, ব্যাঙের সাথে লাফাচ্ছি। ”
” ব্যাঙ? ”
উষ্মা লাফাতে লাফাতে আমার জানালার কাছে আসল। কাঁপতে কাঁপতে বলল,
” হ্যাঁ, ব্যাঙ। আমার পোষা। দেখুন কেমন নাচছে। ”
উষ্মা প্রসন্ন মনে কোথাও একটা ইশারা করল। আমি অন্ধকারে কিছুই দেখলাম না। বললাম,
” তুমি ব্যাঙ পালো? ”
” হ্যাঁ, অনেকগুলো। ”
” কী বলছ! ”
” বিশ্বাস হচ্ছে না? খাটের নিচে তাকান, তাহলেই বিশ্বাস হবে। ওখানে ওদের বাসা। ”
আমি সংকোচ নিয়ে খাটের নিচে উঁকি দিলাম। রুমে আলো না থাকায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। মোবাইলে আলো জ্বেলে ধরতে দেখলাম একটি ভাঙা কলস। যার মধ্যে ভেজা মাটি রাখা। মাটিতে শ্যাওলা জমে আছে।
” বিশ্বাস হলো? ”
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। আপনমনে বিড়বিড় করলাম,
‘ মানুষ ব্যাঙও পুষে? এটা পোষার মতো প্রাণী? ‘ ঘৃণায় আমার শরীর রি রি করে উঠল। ফাঁপা ঢেঁকুর উঠল ঘন ঘন। বমি করার ভাব উঠতে উষ্মা পেছন থেকে বলল,
” কী হলো আপনার? ”
আমি উত্তর দিতে পারলাম না। শুধু শুনতে পেলাম মেয়েটা পেছন থেকে সরে যেতে যেতে বলছে,
” অপেক্ষা করুন। আরেকটু চেপে থাকুন। আমি গামলা নিয়ে আসছি। আমার রুম নষ্ট করবেন না, প্লিজ! ”
চলবে