#ও_আসবেই আবার
১ম পর্ব
লেখা: #Masud_Rana
এই ক্লিনিকে এখন পর্যন্ত হাজারের উপরে এবরশন করানো হয়েছে। কিন্তু ৮ বছরের একটা গর্ভবতী মেয়েকে এই প্রথম কেউ গর্ভপাত করাতে নিয়ে এলো। এই বয়সী একটা মেয়ের প্রেগনেন্ট হওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। মেয়েটার পেট অস্বাভাবিক রকম ফুলে আছে। ডাক্তার আমিন বিস্মিত দৃষ্টিতে মেয়েটা এবং তার বাবার দিকে তাকালেন। ক্লিনিকের প্রধান নিয়মানুযায়ী তিনি পেশেন্টকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। কোনো বিষয়েই না। অথচ মনে এক সঙ্গে কতগুলো প্রশ্ন এসে জড়ো হলো!
‘আপনি কী করে নিশ্চিত হলেন আপনার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা, হতেও তো পারে ওটা টিউমার?’ এতটুকু প্রশ্ন করার অধিকারও তাকে দেয়া হয়নি। হতভম্ব ভাব কিছুটা কাটিয়ে উঠে ডাক্তার আমিন মেয়েটাকে সাথে করে নিয়ে চেকআপ রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়েটা নির্লিপ্ত ভাবে তাকে অনুসরণ করে চলল। ভারী পেটের জন্য তার চলার মধ্যে সামান্য জড়তা দেখা গেল না।
চেকআপ রুমের সবাইও ডাক্তার আমিনের মতোই অবাক হয়েছে এইটুকু বাচ্চা একটি মেয়ের এমন ফুলো পেট দেখে। এটা অন্যান্য হাসপাতালের ক্লিনিক হলে হয়তো কেউ কেউ অনুমান করার সুযোগ পেত মেয়েটার হয়তো টিউমার হয়েছে। কিন্তু এই ক্লিনিকে কেবলমাত্র গর্ভপাত ছাড়া আর কোনো অপারেশন করানো হয় না। মোটামুটি আধা-ঘন্টা সময় নিয়ে চেকআপ পূর্ন করলো ডাক্তার আমিন। মেয়েটার চেহারায় এখন পর্যন্ত কোনো বিরক্তি,ভয়,সংকোচের ছায়া ফেলেনি। ডাক্তার যা করতে বললেন চুপচাপ করে গেল। মনিটরের স্ক্রিনে মেয়েটার গর্ভের ভেতরের স্থির অংশ দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট একটা মানব ভ্রূণ। বয়স হবে ১২ সপ্তাহ। স্ক্যানগুলো প্রিন্ট করে বিস্মিত আমিন আবার মেয়েটার দিকে নজর দিলেন। এই মেয়েটা সম্পর্কে তীব্র কৌতুহল জাগছে আমিনের মনে। এটাকে অন্যান্য স্বাভাবিক গর্ভপাতের অপারেশনের মতো একই জিনিস কিছুতেই ভাবতে পারছে না যে শুধু পেশেন্টকে থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে গর্ভের বোঝা নামিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত মনে আবার চেম্বারে ফিরে আসবেন তিনি। এই ধরনের কেস পুরো জীবনে ২য় আরেকটা দেখেননি তিনি। যদিও মেডিকেলের ইতিহাসে এর চেয়ে কম বয়সী বেশ কিছু মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কথা উল্লেখ আছে। ১৯৩৯ সালে পেরুর এক ৫ বছর বয়সী মেয়ের সন্তান জন্ম দেয়ার কাহিনীও তিনি পড়েছেন। এর পরবর্তী সময়ে ধর্ষণের শিকার হয়ে ৮,৯,১০ বছরের অসংখ্য মেয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ারও অসংখ্য নথি রয়েছে। এই ধরণের সব ইতিহাসই তার কাছে অবিশ্বাস্য এবং বানোয়াট মনে হতো। কারণ ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পূর্বে কোনো মেয়ের পক্ষেই জন্মদানের ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব নয়।
একটা গল্পের কথাও মনে পড়ছে তার। মাসুদ রানা নামের একজনের লেখা ‘ও আসবেই’ নামের একটা গল্পে এমন একটা মেয়ের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছিল। যদিও সেটা ব্যাখ্যাহীন অবাস্তব পিশাচ কাহিনী ছিল।
এই ধরনের সিচুয়েশনে এর আগে তিনি পড়েননি। মেয়েটার সাথে কী ঘটে থাকতে পারে! তার মনে সৃষ্ট হওয়া এই বাচ্চা মেয়েটি সম্পর্কে যত জিজ্ঞাসা তার উত্তর একমাত্র মেয়েটার বাবা দিতে পারবেন। কিন্তু পেশেন্ট সম্পর্কিত কোনো প্রশ্ন করাই এখানে নিয়ম বহির্ভূত। আবার অন্য ভাবে চিন্তা করতে গেলে ক্লিনিকের নিয়মানুযায়ী যে মেয়ের গর্ভপাত করানো হবে তার সাথে কোনো লোক আসতে পারবে না। মেয়েটার বাবার এই হাসপাতালে উপস্থিতি এটাও নিয়ম বহির্ভূত। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে এম্বুলেন্স টিম মেয়েটাকে তার বাড়ি থেকে আনতে গিয়ে এত অল্প বয়স্ক দেখে তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং মেয়েটার বাবাকেও নিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। হয়তো ক্লিনিকের উপর মহল থেকে তাকে আসার অনুমতিও দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে কী তিনি গর্ভপাতের অপারেশন শুরু করবেন!
মেয়েটাকে একটা পেশেন্ট ওয়ার্ডে বসিয়ে রেখে চেম্বারে ফিরে এলেন ডাক্তার আমিন। মেয়েটার বাবাকেও মেয়েটার মতো অস্বাভাবিক লাগছে। মাঝারি উচ্চতার লোকটা চেয়ারে কুঁজো হয়ে বসে আছেন,মেয়েটার মতোই নির্লিপ্ত ভাব, পরনে কালো প্যান্ট আর সাদা টি-শার্ট। ডাক্তার আমিন পায়ের শব্দ তুলে চেম্বারের চেয়ারে গিয়ে বসলেও লোকটা মুখ উঁচু করে তার দিকে তাকালো না। লোকটাকে বোঝার চেষ্টা করছেন আমিন। নিয়ম অনুযায়ী সে লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারবে না, কিন্তু লোকটা যদি স্বেচ্ছায় তার আর মেয়েটার কাহিনী বলে তবে কার কী সমস্যা! একটু কেশে ডাক্তার আমিন বললেন, ‘আমাদের ক্লিনিকের নিয়মানুযায়ী ক্লিনিকের ভেতর আগুন ধরানো সম্পূর্ণ নিষেধ। তাই চা-কফি কিছুই অফার করতে পারছি না আপনাকে।’ আগুন ধরানোর ব্যবস্থা না থাকলেও ওয়াটার হিটার আছে। তবে চা-কফি তৈরির কোনো উপকরণই ক্লিনিকে রাখা হয়নি। লোকটার সঙ্গে আলাপ করতেই এমন একটা কথা তুলেছে আমিন।
লোকটা কোনো উত্তর দিল না। ডেস্কের উল্টোপাশের চেয়ারে এখনো কুঁজো হয়ে বসে আছে। যেন ঝিমোচ্ছে! ঘুমিয়ে গেল নাকি! আমিন কিছুটা অবাক হলো। লোকটার নাম জানা নেই তার। পেশেন্ট সম্পর্কে কোনো ডকুমেন্টই ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ রাখেন না। কাঁচের ডেস্কে পানির গ্লাস দিয়ে কয়েকটা আঘাত করলেন ডাক্তার আমিন। ঝনঝন শব্দে পুরো ঘর ভরে উঠল। তবুও লোকটা মাথা উঁচু করছে না। টেবিলে একটা মোটা বই ছিল। আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে যেন ওটা লক্ষই করেনি, হাতের ধাক্কায় মেঝেতে ফেলে দিলেন তিনি ওটা। এই শব্দেও মরে না গেলে কেউ এমন নির্লিপ্ত ভাবে কুঁজো হয়ে বসে থাকতে পারে না। বিরক্ত হয়েই এবার ডাক্তার আমিন ডাকলো লোকটাকে, ‘এক্সকিউজ মি!’ মুহূর্তেই লোকটা মাথা তুলে তার দিকে তাকাতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন যেন তিনি। আমিন কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। বলল, ‘আপনার মেয়ের চেক-আপ করিয়েছি আমরা। এক ঘন্টার মধ্যেই তাকে ও.টিতে নিয়ে যাব।’ লোকটার মুখের ভাব পরিবর্তন হলো না, ঠোঁট একটু ফাঁকা হয়ে অনেক কষ্টে যেন বেরিয়ে এলো শব্দটা, ‘ধন্যবাদ।’
‘আপনি নিশ্চয়ই আমাদের ক্লিনিকের অপারেশনের শর্তগুলো পড়েছেন। গর্ভপাতের সময় কোনো গোলমেলে জটিলতার কারণে যদি কোনো পেশেন্ট মারা যায় তার দায়িত্ব আমরা বহন করবো না। যদিও এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ জন পেশেন্ট মারা গেছে এই ৪ বছরে। হাজারের উপর নিরাপদ অপারেশন করেছি আমরা। আপনার মেয়ের অপারেশনও সর্বচ্চ সাবধানতার সাথে করা হবে।’
‘ধন্যবাদ’
লোকটা আবার মুখ মেঝের দিকে ঘুরিয়ে কুঁজো হয়ে বসলো। আবার ঘুমাবে মনে হচ্ছে। হতাশ হয়েই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ডাক্তার। কৌতুহলতা আর না বাড়ানোই ভালো। লাভ নেই! ক্লিনিকে বাচ্চা মেয়েটা বাদেও আরেকটা মেয়ে ভর্তি আছে। ক্লিনিকের নিয়মানুসারে পেশেন্ট এর কোনো তথ্যই সংগ্রহ করা হয় না। তাই আনুমানিক বলা যায় মেয়েটার বয়স ২২-২৫ এর ভেতর হবে। মেয়েটা কিছুটা বাঁচাল প্রকারের। ডাক্তার আমিনকে দেখেই বকবক শুরু করে দিয়েছিল। কী করে কলেজের এক বন্ধুর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, এক সাথে চুটিয়ে প্রেম করে, এবং এক রাতে একটা প্রাইভেট কারে কী করে ছেলে বন্ধুটির সাথে আবেগের উত্তেজনায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছেলেটা পয়সা ওয়ালা, পরিবারও প্রভাবশালী, তাই এত টাকা খরচ করে এই ক্লিনিকে গর্ভপাতের আয়োজন করে দিয়েছে। মেয়েটার বকবক শুনে বিরক্তই হতে হয়েছে ডাক্তার আমিনকে। মনে হয়েছে ডাক্তার যেমন পেশেন্টকে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না , পেশেন্টরাও অযথা ডাক্তারের সঙ্গে বকবক করতে পারবে না, এমন একটা নিয়ম চালু করা উচিত। ঐ মেয়েটার গর্ভপাত অপারেশনটাই আগে করা যাক। ঘড়িতে রাত ১১ টা বাজে। ১২ টার দিকে হাসপাতালের বাকি দুই ডাক্তার চলে আসবেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরে ৮ বছরের মেয়েটার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
মূলত এই ক্লিনিক সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করার তেমন কিছু নেই। কয়েকজন বড় ডাক্তার মিলে এই অবৈধ গর্ভপাতের ক্লিনিকটা চালু করেছিল শহরেরই একটি অজনপ্রিয় এলাকারর ভেতর গোপনে। টার্গেট ছিল ধনী-বিত্তবান পরিবার গুলোর ছেলেদের উপর যারা কিনা সময়ে , অসময়ে কোনো মেয়ের সাথে কেলেঙ্কারিতে যুক্ত হয়ে এমন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। এবং হাসপাতালের জটিলতা , সামাজিক পরিচয় ফাঁস হওয়ার ভয়ে হাসপাতালে নিজের প্রণয়নিকে নিয়ে যেতে সাহসে কুলোয় না তাদের জন্য। এরা একটা এবরশনের জন্য মোটা অঙ্ক দিতেও আপত্তি তোলে না। এখানকার দক্ষ ডাক্তার, বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গোপনীয়তা ক্লিনিকটাকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে প্রথম বছরেই। কৌশলী ভাবে পেশেন্ট আনা-নেয়া করা, ক্লিনিকে মোটা বেতন দিয়ে বিশ্বস্ত কর্মচারী রাখা, আর দক্ষ পরিচালনার কারণে এখনো সমাজের সচেতন মানুষদের নজরে আসেনি এটি। যার ফলে পুলিশি বা আইনি কোনো ঝামেলায় ফাঁসতে হয়নি এই ৪ বছরে একবারও। তাছাড়া বিশ্বস্ততা ও বিপদের ভরসার জন্য অনেক প্রভাবশালী মানুষই এটাকে সাপোর্ট করে উটকো ঝামেলা থেকে রক্ষা করে আসছে। এখানে কাজ করা প্রতিটি ডাক্তার, স্টাফরাও মাস শেষে মোটা অংকের বেতন তোলেন।
এই মোটা অংকের বেতনের জন্যই গত ২ বছর ধরে এই ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত আছেন ডাক্তার আমিন।
রাত ১২ টার আগেই ওপর মেয়েটার গর্ভপাত অপারেশন শেষ হয়েছে। ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফেলা হয়েছে তাকে। সকালের আগে ঘুম ভাঙবে না। রাত ১২টার কিছু পরেই বাকি ২ ডাক্তার এসে হাজির হলেন। ডাক্তার আমিন উত্তেজিত হয়ে তাদের কাছে গিয়ে মেয়েটার প্রেগনেন্সির বিষয়ে কথা বলতে বলতে আলট্রাসনোগ্রাফির ফাইলটা এগিয়ে দিলেন। দুই ডাক্তারের কাউকেই এটা দেখে অবাক হতে না দেখে ডাক্তার আমিন নিজেই অবাক হলেন। ডাক্তার মামুন এবং ডাক্তার অমিত জানালেন উপর মহল থেকে এই অদ্ভুত প্রেগনেন্সির বিষয়ে তাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। আজ যে এই মেয়েটাকে আনা হবে তাও তারা জানতেন। তবে তেমন বিস্তারিত কিছু তাদেরও জানানো হয়নি। তবে ডাক্তার আমিনের অনুমান কিছুটা ভুল, মেয়েটার বয়স ৭ বছর।
ডাক্তার আমিন স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ডাক্তার মামুন তাকে আস্বস্ত করলেন, শুধুমাত্র এই কেসটার ক্ষেত্রে ক্লিনিকের নিয়ম শিথিল থাকবে। অর্থাৎ মেয়েটা বা মেয়েটার বাবার কাছ থেকে আমরা প্রশ্ন করে সব কিছু জেনে নিতে পারবো। তারপর আমরা মেয়েটার অপারেশন করবো। তিনজন ডাক্তার একত্রে ডাক্তার আমিনের চেম্বারে গিয়ে ঢুকলো তীব্র কৌতূহলতা নিয়ে মেয়েটার বাবার সঙ্গে কথা বলতে। তার এখানেই থাকার কথা। কিন্তু চেম্বারে ঢুকে অবাক হয়ে দেখলেন কেউ নেই সেখানে। ডাক্তার আমিন যেন পাগল হয়ে গেলেন। পুরো ক্লিনিক তন্নতন্ন করে খুঁজেও লোকটার দেখা পেল না কেউ। কোনো স্টাফও বলতে পারলো না কোথায় গিয়েছে লোকটা। এটা অসম্ভবই বটে। কারণ ক্লিনিকের কারো অনুমতি ছাড়া একটা ইঁদুরও এর ভেতর ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না এমন কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখানে। প্রাইভেসির জন্য নেই সিসি ক্যামেরা। তাদের মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার অমিত উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘মেয়েটাও কী উধাও হয়ে গেছে নাকি, আছে?’ কেমন চমকে উঠলেন আমিন। তিন জনেই ছুটে গেলেন রোগীদের ওয়ার্ডের দিকে। ৬ নম্বর ঘরে মেয়েটার থাকার কথা। মেয়েটার নির্লিপ্ত মুখটা ভেসে উঠলো কল্পনায় ডাক্তার আমিনের। তার কেন যেন মনে হচ্ছে কিছু একটা এলোমেলো ঘটে গেছে ওখানে! ……………………….
.
.
. . . চলবে . . .