কাকতালীয়,শেষ অধ্যায়

কাকতালীয়,শেষ অধ্যায়
মৌপর্ণা

১০ বছর পর…!

“তোমার বোধয় শীত করছে অর্চিতা! AC টা একটু কমিয়ে দেব?”

বিগত ১০ মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর, শোভন কেই এই বরফ ভাঙার উদ্যোগ টা নিতে হলো!

“হ্যাঁ, খুব ভালো হয়..মানে যদি কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে AC টা বন্ধ করে, গাড়ির কাঁচ টা খুলে দিলে খুব ভালো হতো।” বেশ সোজাসোজি কথাটা বলে দিলো মিঠি….

“না-না সমস্যা থাকবে কেন? ”
কথা টা শেষ হতে না হতেই শোভন AC টা বন্ধ করে, গাড়ির জানালা টা খুলে দিলো..ঘড়ির কাঁটা ৮ টা ছুঁয়েছে মিনিট ২ এক আগে,গাড়ি ছুটে চলেছে সারিসারি গাছ পালা, উঁচু-উঁচু মাল্টিপ্লেক্স বিল্ডিং পেরিয়ে, মিঠি জানালার বাইরে একমনে চেয়ে রইলো!উফ্ফ বিয়ে টা কি করতেই হবে? মিঠির নারী-আন্দোলনকারী জেঠিমা, বাইরে তো কত স্লোগান – অথচ বাড়িতে “নাঃ মিঠি, মা তো ঠিকই বলছে – সব কিছুর একটা বয়েস আছে, সামনের মাঘে তুই ২৯ এ পড়বি! খেয়াল আছে তোর!”হ্যাঁ খুব খেয়াল আছে আমার, কিন্তু সবাই দিভাই হয়না! আর আমি হতেও চাইনা…ভালো আছি তো আমি একটা ভরা পরিবার আর একটা ১০-৫ টার সরকারি চাকরি নিয়ে! হ্যাঁ আমি সাধারণ..আমি দিভাইয়ের মতন ফর্সা নই, নই আমি দিভাইয়ের মতন সুন্দরী, কিন্তু তাই বলে কি একটু সম্মান পাওয়ার ও যোগ্যতা নেই আমার!এর আগে মোট ৯ জন শুধু ছবি দেখে…হ্যাঁ শুধু একটা ছবি দেখে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিয়ের সম্বন্ধ! অথচ তাদের মধ্যে কেউ নাকি ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, অভিজাত্য পরিবার তাদের! থাক এ রকম অভিজাত্য পরিবার! বিয়ের সম্বন্ধটা যে আগেই ভেঙে গিয়েছে এটাই বা কম কিসের!

“রবীন্দ্র সংগীত পছন্দ আপনার? ”

শোভন এর প্রশ্ন শুনে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলো মিঠি!

“হ্যাঁ…কি? রবীন্দ্র সংগীত….হ্যাঁ ভালোই লাগে, কখনো-কখনো!”

“আচ্ছা..!” একটু থেমে শোভন বললো
“তো – রবীন্দ্র সংগীত চালাবো? এখন শুনবেন?”
হ্যাঁ ঠিক আছে..

গাড়ি সিগন্যাল এ দাঁড়িয়ে…একটা বছর ৭ এর বাচ্চা, গাড়ির বাইরে টোকা দিয়ে ভিক্ষে চাইছে! শোভন মুহূর্তেই গাড়ির পেছনে রাখা ব্যাগ টা হাত দিয়ে টেনে, ব্যাগ এ রাখা একটা বিস্কুটের প্যাকেট বাচ্চা টার হাতে তুলে দিলো!

“আসলে কি বলুন তো অর্চিতা, এদের হাতে টাকা একদম দেওয়া উচিত নয়! আমি তো এদের বলি যে যেটা ইচ্ছে বল আমায়! আমি খাওয়াচ্ছি! কিন্তু টাকা নয়..”

কথা টা শুনেই যেন মিঠির শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো..বছর ১০ আগেকার সেই আবছা চেহারা টা যে তার কোনদিন মনে পড়লো না! উউফফফ! কেন মনে পরে বারবার সেই এক কথা….!দিভাই এখন থাকলে নিশ্চই বলতঃ – “মিঠি সেই মানুষ টা কে প্লিজ এবারে মন থেকে সরা…প্লিজ! আর হ্যাঁ এই সব ভাবিস, বলেই তোর বিয়ে টা হচ্ছেনা, কারণ তুই ঠিক ঠাক সহযোগিতা করছিস না কাউকে এই ব্যাপারে”
কে জানে এই সহযোগিতার সঠিক মানে টা কি?

গাড়ি কিছুক্ষণ আগে নির্ধারিত এক রেস্তোঁরার পার্কিং এ এসে দাঁড়িয়েছে….
চেয়ার টা একটু বাইরে দিকে টেনে শোভন অর্চিতা কে বসবার ইশারা করলো।মুখোমুখি বসলো শোভন ও অর্চিতা, দু-একটা বিধিবৎ কথা হলো ওদের মধ্যে,যেমন কি খেতে ভালো লাগে? অর্চিতার দেখা শেষ সিনেমা, অফিস এর কাজ কর্ম, বন্ধু বান্ধব ইত্যাদি।প্রতিবারের মতন শোভন একের পর এক প্রশ্ন করে চলেছে আর অর্চিতা উত্তর গুলো দিয়েই চলেছে!
এবারে ওয়েটার এসে দাঁড়ালো ওদের টেবিলের পাশে,

“স্যার অর্ডার টা..”

“হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চই! অর্চিতা আপনি বলুন।”

কথা টা বলতে – বলতেই মেনু কার্ড টা ঘুরিয়ে দিলো শোভন অর্চিতার দিকে!

“আমি কি বলবো? যেটা আপনার ইচ্ছে মানে…”

অর্চিতা কথা টা শেষ করার আগেই ওয়েটার তাদের রেস্তোঁরার বিশেষ একটি মেনু হাত দেখিয়ে ট্রাই করতে বললো…

“বেশ ঠিক আছে দাদা! অর্চিতা তোমার আপত্তি না থাকলে আমরা এটা ট্রাই করতে পারি।

“আপনি এতো চুপচাপ বসে আছেন! কোনো সমস্য হচ্ছেনা তো? ”

“নাহঃ! ঠিক আছি একদম!”

মনে-মনে মিঠি জানে, আজ সে কেন এতো চুপচাপ, সত্যি এমন কি বা বলেছিলো মিঠি – শুধু এইটুকুই তো বলেছিলো….শোভন বাবুর বয়েস তার তুলনায় একটু বেশি…..কথা টা শেষ হতে না হতেই বাড়ির সবারির প্রতিক্রিয়া দেখে আজ সে সত্যি অবাক! অথচ দিভাই এর সময় সে কত সম্বন্ধই না প্রত্যাখ্যান করেছে…..কেন তবে তার বেলায় নিয়ম টা এতো আলাদা!

“আসলে আমি তখন থেকে আপনাকে প্রশ্ন করেই চলেছি, কিন্তু আপনি কিছুই বলছেন না! আপনার মনে আমাকে নিয়ে যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, আপনি নির্ধিধায় আমায় জিগ্যেশ করতে পারেন!”

এতক্ষণে মিঠি শোভন এর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো –

“আপনি কি আমাকেই প্রথম…..মানে আমার আগে কারোর সাথে বিয়ের কথা বার্তা কিছু হয়েছিল?”

“আপনার আগে – হ্যাঁ…মোট ৪ জনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল, কিন্তু শেষ-মেশ ব্যাপার টা আর
এগোয়নি……”

“কেন? আপনার পছন্দ হয়নি তাদের দেখে? না সরি ইট’স ওকে!”

শোভন এবারে মিঠির দিকে চেয়ে বেশ হাসি মুখেই বললো –

“বাবা চলে যাবার পর পুরো লড়াই টা আমি একাই লড়েছি অর্চিতা! বাড়ি ঘর, ধার দেনা, দিদির বিয়ে, সব মিলিয়ে ভাবতে ভাবতে বোধয় নিজেকে ঠিক কোনোদিনও ভালোবাসতে পারিনি….আমি খুব সাধারণ একটা মানুষ! শুধু সম্মান ও ভালোবাসার বদলে সম্মান ও ভালোবাসা চায়…যাদের সাথে এর আগে বিয়ের কথা বার্তা হয়েছিল তারা বোধয় আমায় না চিনেই ঠিক করলেন তাদের সিদ্ধান্ত! ছবি দেখেই তারা আর এগোতে চায়নি….! ”

একটু চুপ করে শোভন আবার বললো –

“কিন্তু যা হয় ভালোর জন্যেই হয় বোধয় জানেন, যারা একটা মানুষের খোলস দেখে তার সাথে থাকার বিচার করে, তাদের সাথে আমি হয়তো সারাটা জীবন থাকতে পারতাম না অর্চিতা!”

শোভন এর কথা টা শেষ হতে না হতেই, মিঠি কেমন বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো শোভন এর দিকে! অনেকক্ষণ পর মন টা বেশ হালকা লাগছিলো তার!

আজ মিঠি ও শোভন এর আশীর্বাদ!
শ্যামবাজারের দ্বিতল বাড়ি আজ, সেজে উঠেছে ফুলে, আয়োজনে, লোকজনে!শোভন ও মিঠি পাশাপাশি বসে রয়েছে, দুই বাড়ির লোক একে-একে এসে আশীর্বাদ দিচ্ছেন হবু দম্পতি কে! আজ কথা বার্তায় মিঠি অনেক গুলো কথা শুনতে পেলো যেমন শোভন কত মানুষের উপকার করেছে, শোভন সংসারের সব দায়িত্ব একাই পালন করেছে ইত্যাদি!

মিঠির মনে পড়লো কোথায় যেন সে পড়েছিল – প্রতিটা সম্পর্কের শুরু এক অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমার সফর এর মতন হওয়া উচিত, এমন সম্পর্ক যেটা সময়ের সাথে সাথে আরো উজ্জ্বল হয়!

আশীর্বাদের ও খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ! মিঠি কে ঘিরে বসে রয়েছে শোভনের ভাই বোন, দিদি আর শুরু হয়েছে কত গল্প!
ইতিমধ্যেই শোভনের ছোটবেলা নিয়ে কথা হতেই শোভনের দিদি শ্রাবনী বলে উঠলো –

“মিঠি এই দেখো…..ভাইয়ের ছোটবেলার ছবি….”

মিঠিও শ্রাবনীর ফোন টা হাতে নিয়ে একের পর এক ছবি দেখেই চলেছে!হটাৎ একটা ছবি দেখে মিঠি থমকে গেলো, এই ছবি তে, এই ঘড়ি টা

“দিদিভাই……………”

মিঠির কথা শেষ না হতেই শ্রাবনী বলে উঠলো –

” মিঠি উনি আমাদের বাবা! এসব কত আগেকার ছবি জানো! এই ঘড়ি টা বাবার খুব প্রিয় ছিল…………
আর এই ঘড়ি টা যে ভাইয়ের কত কাছের তা তুমি হয়তো জানোনা এখনো!!তারপর ১০ বছর আগে বোধয়, সাউথ কলকাতার এক পুজো প্যান্ডেলে হারিয়ে যায় ঘড়ি টা! ভাইয়ের সে কি মন খারাপ! আর জানো সেই থেকেই ভাই আর পুজোর ঠাকুর দেখতে যায়না! আর এমনি ও খুব…………………”

শ্রাবনীর কথা শেষ হবার আগেই, মিঠি এক লাফে খাট থেকে নীচে নেমে পরে…….হনহন করে এগিয়ে গিয়ে আলমারি টা চাবি দিয়ে দ্রুত খুলে ফেলে, বের করে আনে – সেই ঘড়ি!

“দেখো তো দিদিভাই, এটাই কি সেই ঘড়ি? আর ঘড়িটা হারিয়ে গিয়েছিলো ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর – মহাষ্টমীর সন্ধ্যায় ত্রিধারা সম্মেলনীর বাইরে!!!”

এতক্ষণে শ্রাবনীর ও মিঠির দুজনেরই দুচোখ বেয়ে অশ্রু নেমে এসেছে!
শুক্লা, বোন নীচে গিয়ে শোভন কে বল – এখুনি ওপরে এই ঘরে আসতে! খুব দরকার আছে!!

End

মৌপর্ণা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here