কাকতালীয়,পর্ব:০১

কাকতালীয়,পর্ব:০১
মৌপর্ণা

“মনীষা আর কতক্ষণ? ”

বেশ অধৈর্য্য গলায় বলল মিঠি।

“আর ৫ মিনিট মিঠি, পাক্কা ।”

স্কুল এর গন্ডি পেরিয়ে এই বছর, প্রথম মিঠি বন্ধুদের সাথে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। তার জন্যে মনীষা দের কম ঝোক্ষী পোয়াতে হয়নি। মিঠির মা কে রীতিমতো বুঝিয়ে রাজি করাতে হয়েছে –

“Please কাকিমণি সারা বছরে এই ৪ দিনে ব্যাস একটা মাত্র দিন তাও বেশি ক্ষণ নয়, আমরা তো সকালেই ভেবেছিলাম, কিন্তু সকালে প্যান্ডেলে লাইট থাকেনা তাই থিম ভালো ভাবে ফোটেনা। আমি নিজে ওকে এগিয়ে দেব।”

“Sorry Sorry অনেকক্ষণ না রে।”

এতক্ষণে মনীষা দের দেখা মিললো ! মনীষা দের মানে মনীষা-অভির আর রিয়ান-তুলির। যুগল দের একই রঙে একসাথে দুর্দান্ত দেখাচ্ছিল।
“বাহ্ ভীষণ সুন্দর লাগছে রে তোদের।”

“হুম, কিন্তু তুই এরকম সরস্বতী ঠাকুরের মতো এসেছিস কেন?”

রিয়ান কথা টা শেষ করতে না করতেই সবাই হো-হো করে হেসে উঠলো।মনীষা সবাই কে হালকা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলল –

“নাহঃ রে মিঠি, বেশ ভালো লাগছে তোকেও!”

তরুণ-তরুণীদের দল এতক্ষণে রাস্তা পেরিয়ে ঠাকুর দেখার লাইনে দাঁড়িয়েছে। এতো ভিড় সত্যি মিঠি আগে কখনো দেখেনি। ভিড়ের চাপাচাপি তে একটু কষ্ট হলেও,তার চেয়ে এতো ভিড় দেখার আনন্দ টাও যে বেশ অন্য স্বাদের। রাস্তার দুধারে লাগানো বাঁশের ব্যারিকেড, দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন হোর্ডিং, তার মধ্যে দিয়েই হেঁটে চলেছে কয়েক হাজার-লক্ষ মানুষ, ভিড় ঠেলে, পায়ে পা মিলিয়ে প্রতিমা দর্শনের উদ্দেশ্যে। ভিন্ন ছন্দের গান বেজে চলেছে ভিন্ন-ভিন্ন রাস্তায়, মণ্ডপে, তবুও যেন সব সুর মিলে-মিশে তৈরি করেছে এক নতুন ছন্দ – “পুজো পুজো ছন্দ”। পুরো রাস্তা আলোক সজ্জায় মোড়া, কে জানে কোথা থেকে শুরু হয়েছে এই আলোর আর কোথাই বা গিয়ে তার শেষ। রাস্তার মোড়ে ভিন্ন-ভিন্ন স্বাদের ফাস্ট ফুড সেন্টার, আর তাতে উপচে পড়া লোকের ভিড়। সত্যি ভোর রাতে গাড়ি থেকে বসে কি সত্যি এতটা উপভোগ করা যায়?
মিঠি আমাদের পেছনই থাকিস কিন্তু, ভীষণ ভিড় এখানে, মোবাইল পার্স সাবধান! মনীষা মিঠির দিকে তাকিয়ে বলল।

“হ্যাঁ, মিঠি ম্যাডাম হারিয়ে গেলে আমাদের বড়ো বিপদ।”

“আঃ অভি চুপ কর না, কেন ওর পেছনে লাগছিস বলতো?”

মিঠি জানে ওদের মধ্যে সে বড্ডো বেমানান, ওরা জুটিতে-জুটিতে গল্প করতে-করতে এগিয়ে চলেছে কিন্তু তাতে মিঠির কোনো কষ্ট নেই, সে তো এই ভিড় টাকে উপভোগ করে চলেছে।

“মিঠি, এবার একজন কে খুঁজেই নে, আর কতদিন একা থাকবি? ”

রিয়ান এতো ভিড়ের মধ্যেও বারে-বারে মিঠির লেগ-পুল করেই চলেছে।মাঝে মাঝে সত্যি বিরক্তিকর লাগছিলো মিঠির, উফ্ফ! এই এক জিনিস নিয়ে তো কম খোঁচা খেতে হয়না! ঠিক করে প্রতিবাদ ও করতে পারেনা সে, শুধু চুপচাপ শুনে যায়। কি করবে সে, জীবনের বেশির ভাগ সময় টা ফিজিক্স-কেমিস্ট্রির Equation-Reaction বুঝতেই চলে গিয়েছিলো তার, আর তাছাড়া কাউকে কখনো মনেও ধরেনি। সে নিয়ে নিজের আফসোস না থাকলেও বারে-বারে এই খোঁচা দেওয়া কোথা মোটেই ভালো লাগে না তার।

এই সব ভাবতে-ভাবতে মিঠির নজর পড়লো রাস্তার মোড়ের উল্টো পাশে এক ছোট্ট দোকানের দিকে। এতোগুলো ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা কি করছে? ভালো করে কিছুক্ষণ লক্ষ্য করতেই মিঠি বুঝলো ওদের এতো আনন্দের কারণ। নাহঃ কোনো দামি খাবার নয়, কেউ ওদের পরোটা আর আলুরদম জাতীয় কিছু খাওয়াচ্ছিল, আর তাতেই এতো আনন্দ। ভিড় আস্তে-আস্তে এগিয়ে চলেছে, মিঠি এক দৃষ্টিতে ওই বাচ্চা গুলোর হুল্লোড় দেখেই চলেছে…..
এবারে মিঠির চোখ পড়লো এক তরুনের দিকে, আচ্ছা ! ইনি তবে এই বাচ্চা গুলোর আনন্দের কারণ। বাচ্চাদের ভিড় যেমন যেমন বেড়ে চলেছে, সেই তরুণ হাতে হাতে এগিয়ে চলেছেন পরোটা আর আলুরদমের প্লেট।এখনো এরকম ভালো মানুষ হয়? মিঠির নিজের মনেই হাসছিলো, কিন্তু বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সেই ভালো মানুষের মুখটা দেখতে পেলোনা সে। পরণে হলুদ কুর্তা আর হাতে একটা বহু পুরোনো কিন্তু ভীষণ আলাদা দেখতে একটা রোলেক্স এর ঘড়ি! এতো ভিড়ে এই লোক সমুদ্রের মাঝে এর চেয়ে বেশি কিছু দেখা গেলো না।

“কি হলো দিদি এগিয়ে চলুন তাড়াতাড়ি,

সত্যি তো মিঠি লক্ষ্য করেনি ভিড় এগিয়ে বাঁক নিয়েছে বাম দিকের রাস্তায়। মিঠি এগিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ, কিন্তু মনটা টা আজ কেমন যেন করছে…..
যেন একটা পিছুটান ।

প্রতিমা দর্শন হয়েছে অনেকক্ষণ।
একটা কোল্ড-ড্রিঙ্কস এর দোকানে দাঁড়িয়ে অভি-মনি, রিয়ান-তুলি খুনসুটি করেই চলেছে। মিঠিও যোগ দিচ্ছে কখনো-কখনো, আবার মাঝে মাঝে আনমনা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু কেন, এর আগে তো কখনো এরকম হয়নি।

একটু বিশ্রাম নিয়ে তরুণ-তরুণীদের দল এগিয়ে চলেছে পরের পুজো পরিক্রমার দিকে।

“শোন্ না মনি, এই ঠাকুর টা দেখেই ফিরবো রে আমি।”

“কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি? ”

“নাহঃ রে মা কে কথা দিয়ে এসেছি যে, আমাকে আর জোর করিস না রে। ”

“আচ্ছা-আচ্ছা, বেশ বাবাঃ ঠিক আছে। এখন তাড়াতাড়ি চল দেখি।”

ভিড়ে-ভিড়ে ওরা আবার লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে। সন্ধ্যে থেকে রাত নামতেই যেন মানুষের ভিড় বেড়ে চলেছে দ্বিগুণ গতিতে। এবার ভিড়ে সত্যি ভীষণ হাঁসফাঁশ করছিলো মিঠির। শাড়ির আঁচল টা বোধয় সামনে দিয়ে ধরলে ভালো হতো। এই ভেবে যেমনি মিঠি হাত টা একটু পেছনে নিয়েছে, আঁচল টা শক্ত করে ধরবে বলে, ওমনি ঘটলো এক অঘটন।মিঠির হাতের ফাঁক দিয়ে ফোন পড়ে গেলো রাস্তায়!

“আমার ফোন! আমার ফোন! দাদা আমার ফোন টা পড়ে গিয়েছে!”

মিঠি বেশ চিৎকার করতে-করতে বেশ শক্ত করে ভিড় হাত দিয়ে ঠেলে এক ঝটকায় রাস্তায় বসে পড়লো। ফোন টা একবার চোখের দেখা দেখলেও হাতের নাগালে পেলো না মিঠি, বরং এতক্ষণে ভিড়ের ঠেলায় দম বন্ধ হয়ে এলো। এতক্ষনে মিঠি আর ফোন নয় নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলো। বহু চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারলো না। গায়ের ওপর দিয়েই হেঁটে চলেছে ভিড়। মাটির প্রতিমার দর্শন তখন বেশি দামি যে ঘরের প্রতিমা এর চেয়ে। কেউ সে আর্তনাদ শুনতে পেলনা। ধীরে ধীরে চোখের সামনে টা কেমন অন্ধকার হয়ে এলো।

এমন সময় মিঠি অনুভব করলো কেউ যেন তার কনুই টা বেশ শক্ত করে ধরে তাকে তোলার চেষ্টা করছে। এরপর আর কিছু মনে ছিলনা মিঠির ।

মিঠির যখন একটু একটু জ্ঞান ফিরছে, সে আবছা আলোয় দেখলো সে একটা ক্যাবে তে বসে, ট্যাক্সির গেট টা অর্ধেক খোলা আর সামনে বোধয় রিয়ান অভি একজনের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু কথা বলছিলো। মনি, মিঠির পাশে বসে, মাথায় হাত বুলোচ্ছে, এতক্ষনে মিঠি কে চোখ খুলতে দেখেই বলল –
” কিরে ? ঠিক তো? একটু জল খা।”

“হ্যাঁ রে ঠিক আছি এখন!”

মিঠি কে কথা বলতে শুনেই অভি গাড়ি তে উঠে এসে বসলো।এতক্ষনে রিয়ান আর তুলি কে গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো মিঠি। ওরা হাত নারিয়ে মিঠি কে সাবধানে ফিরতে বল্ল।

ঘন্টা দুয়েক পর যখন গাড়ি প্রায় শ্যামবাজারের দিকে এগোচ্ছে মিঠি বলল –

“মনি, আজকের কথা টা বাড়ি তে কিছু বলিস না। মানে ফোন হারিয়ে গিয়েছে, এটা তো বলতেই হবে, এর চেয়ে বেশি আর কিছু বলিস না প্লিজ!”

“বেশ ঠিক আছে! তুই Relaxed থাক, আমরা কিচ্ছু বলবো না। ”

এতক্ষণে মিঠির চোখ পড়লো, ওর ব্যাগের ফাঁকে আটকে থাকা ঘড়িটার দিকে। একি! এটা তো বহু পুরোনো ভীষণ আলাদা দেখতে সেই ঘড়ি! যে ঘড়িটা মিঠি দেখেছিলো সেই হলুদ কুর্তা পড়া যুবকের হাতে!

“মনি, তোরা আমাকে টেনে তুলেছিলিস ভিড় থেকে?”

“দেখো মেয়ের কান্ড, তোর কিচ্ছু মনে নেই! আমরা তো সামনে দাঁড়িয়ে তোকে খুঁজছিলাম, ওই একটা দাদা, তোকে ভিড় থেকে টেনে বের করে আনলো। তারপর সেই তো ক্যাব ডেকে………”

মনির পুরো কথা শেষ না হতেই মিঠি বলল –

“একটা হলুদ রঙের কুর্তা পড়েছিল কি? ”

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ! হলুদ রঙের এর কুর্তা! তোর মনে পড়েছে তাহলে?”

“আর এই ঘড়িটা ছিল তার হাতে।”

“হ্যাঁ, এবাবাঃ এটা এখানে এলো কি ভাবে? এবার কি হবে? কোনো কন্টাক্টস ও নেই!”

এতক্ষণে ক্যাব এসে দাঁড়িয়েছে – মিঠিদের শ্যামবাজারের দ্বিতল- লাল বাড়িটির সামনে!

“ম্যাডাম, এই পর্যন্তই বুকিং দেখাচ্ছে জিপিএস এ, এখানেই সাইড করবো তো?”

মৌপর্ণা
To be continued

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here