তোমার_খোঁজে_এই_শহরে,পর্বঃ৩৩ :#ভোরের_আলো

গল্পের নাম: #তোমার_খোঁজে_এই_শহরে,পর্বঃ৩৩ :#ভোরের_আলো
লেখিকা :#নবনী_নীলা

ইয়াদ টয়াকে আগের সেই কাশফুলের মাঠটায় নিয়ে আসলো। সেদিনের পর টয়া কোনোদিন আর এই মাঠে আসেনি। আজ এতো বছর পর আবার এলো সে। কিছু যে পরিবর্তন হয় নি এমনটা নয়। অনেক কিছু বদলে গেছে তবে আজও চারিপাশ কাশফুলে ভরে আছে।

টয়া আর ইয়াদ পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আগে জায়গাটা অন্ধকার থাকতো রাতের বেলায়। এখন চারপাশটা কি সুন্দর আলোয় ভরা। টয়া মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। বাতাস বইছে, হালকা হিমশীতল বাতাস। বাতাসে টয়ার খোলা চুলগুলো উড়ছে। অপরূপা লাগছে তাকে ইয়াদ চোখ সরাতে পারছে না।
হিমশীতল বাতাসে টয়ার হালকা শীত করছে কিন্তু তাও বাতাসটা তার অনেক ভালো লাগছে। সে দুই বাহু জড়িয়ে ধরে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা উপভোগ করছে।

ইয়াদ পিছন থেকে এসে জরিয়ে ধরলো। টয়া ছড়ানোর চেষ্টা করলো না।ইয়াদ টয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,” আমাদের জীবন থেকে কতগুলো সময় চলে গেছে।” তারপর টয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দাড়করিয়ে বললো,” আমি আর কোনো সময় নষ্ট হয়ে যেতে দিতে চাই না।” বলতে বলতে ইয়াদ পকেটে হাত ভরে একটু একটু পিছিয়ে গেলো।

পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ইয়াদ। টয়া অবাক হয়ে দেখছে। এর মাঝে ইয়াদ হাত দিয়ে তুরি বাজাতেই অজস্র গোলাপের পাঁপড়ি টয়ার গা বেয়ে পড়লো। সেগুলো উড়ে বেড়াচ্ছে চারিপাশে। একপাশে সাদা কাশফুল অন্য পাশে ছোট্ট সেই লেক আর সবুজ ঘাসের উপর পরে আছে লাল গোলাপের পাঁপড়ি। টয়া সেই সৌন্দর্যে যেনো হারিয়ে গেলো।

বুকের ভিতরটা অদ্ভুত ভালোলাগায় ভরে গেলো। ইয়াদ টয়ার সেই হাসির মাঝে হারিয়ে গিয়ে বললো,” I’m not a sweet talker। আমি তেমন কিছুই পারি না তবে I promise আমি তোমার এলোমেলো চুল বেঁধে দিবো। আর হ্যাঁ রাতে অন্ধকারে ভয় পেলে তোমায় জরিয়ে রাখবো নিজের সাথে। আমি তোমায় আগলে বেচেঁ থাকতে চাই।” ইয়াদ এভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে না। তবে আজ খুব জানাতে ইচ্ছে করছে তার। কথাগুলো বলতে বলতে ইয়াদ পকেট থেকে ডান হাতটা বের করলো। হাতটায় একটা আংটি।

যা হচ্ছে, টয়ার তা বিশ্বাস হচ্ছে না। এতো সুন্দর মুহূর্ত যে তার জীবনে আসবে সে কখনো ভাবতেই পারে নি। ইয়াদ হাতে ধরে থাকা আংটিটার দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর একটু হেসে বললো,” তুমি কি আমার হবে?”

সাধারণত ইয়াদ এসব বলতে অভ্যস্ত না।

টয়ার এমন অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি। এ এক অন্যরকম ভালোলাগা যা বলে বোঝানো যায় না। বিস্ময়ে টয়ার চোখ ছল ছল করে উঠলো। মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে সেই চোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। সবকিছু এতটাই সুন্দর যে বিশ্বাস হচ্ছে না তার। চোখের সামনে পুরনো দিনগুলো ভেসে উঠেছে। ইয়াদ অন্য হাতে টয়াকে এগিয়ে আসতে ইশারা করলো। টয়া আস্তে আস্তে এক পা দু পা করে এগুতে লাগলো। ইয়াদের যতো কাছাকাছি যাচ্ছে তত সবটা স্বপ্নের মত লাগছে। চোখ মেললেই যদি স্বপ্নটা ভেঙ্গে যায়। বুকের ভেতর অজানা ভয় কাজ করছে।

সেই ভয়ে টয়া দৌড়ে গিয়ে ইয়াদকে জরিয়ে ধরলো। চোখ মেলে ইয়াদের দিকে তাকাতেই সবটা সত্যি মনে হলো টয়ার। ইয়াদ টয়াকে অন্য হাতে জরিয়ে রেখে আংটিটা দেখিয়ে বললো,” will you?”। টয়া হা সূচক মাথা নাড়ল। ইয়াদ আংটিটা টয়ার হাতে পরিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

🌟

” তোমরা সারারাত একসাথে বাইরে ছিলে?”, থমথমে গলায় বললো টয়ার দাদাভাই। চোখ মুখ তার শক্ত দেখেই বুঝা যাচ্ছে রেগে আছে সে। ইয়াদ আর টয়া তার সামনে দাড়িয়ে আছে। সূর্য ওঠার অনেক আগেই ইয়াদ টয়াকে পৌঁছে দিয়েছিলো কিন্তু গেট দিয়ে ঢুকতেই টয়ার দাদাভাইকে পায়চারী করতে দেখে আর তিনিও ওদের দেখে ফেলে।

টয়ার দাদাভাইকে সবটা নিরব জানিয়েছে। নিরব বারান্দা দিয়ে আবছা টয়ার মতো কাউকে দেখে কিন্তু সে সিউর ছিলো না। সত্যিটা জানতেই টয়ার রুমে যায়। এদিকে রিতু দরজা না লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো তারপর আর কি নিরব সবটা বুঝে ফেলে।

আর টয়ার দাদাভাই এমনিতেই ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে যায়। তিনি উঠে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করেন তারপর চা খেয়ে পত্রিকা পড়েন। দাদাভাই উঠার সাথে সাথে নিরব সবটা তাকে জানায়। ইয়াদ আর টয়ার অপেক্ষায় তিনি নীচে পায়চারী করছিলেন। ওদের দেখে থমথমে গলায় নিজের সাথে আসতে বললেন। টয়া বেশ ভয়েই আছে , ঘটনাটা কতদূর যাবে তা ভেবে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। টয়ার ভয় দেখে ইয়াদ টয়ার হাত ধরে আছে। বাসায় সবাই ঘুমাচ্ছে তাই দাদাভাই ছাদের সাথের রূমে নিয়ে এলেন কথা বলার জন্য। একটা হলুদ বাতির আলো জ্বলছে।
নিরব পিছু পিছু এসে বাহিরে দেওয়ালের সাথে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে সবটা শুনছে। নীরবের পিছু পিছু রিতু চলে এলো। তার জন্যই তো টয়া আর ইয়াদকে বিপদে পড়তে হলো। নিরব বাহিরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আর রিতু দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে থমথমে পরিবেশ।

ইয়াদ কিছু বলতে যাবে তখনি টয়ার দাদাভাই বললো,” কিছু কথা বলার দরকার ছিল আমার তোমাকে। ভালোই হয়েছে আজ সেই সুযোগটা পেলাম।”

টয়া বুঝতে পারছে কি নিয়ে কথা বলবে দাদাভাই হয়তো বলবে যে বিয়েতে তার মত নেই তাই বিয়েটা হবে না। ইয়াদ এটা শুনে কি রিয়েক্ট করবে টয়া বুঝতে পারছে না। উফফ আজ কি যে হবে?

” জ্বি বলুন।”, শান্ত গলায় দাদাভাইকে বললো ইয়াদ। টয়া বার বার ঢোক গিলছে।

” আমার এই বিয়েতে মত নেই। আর আমি চাই না তোমার সাথে টয়ার বিয়েটা হোক।”, পরিষ্কার করে বললেন তিনি।

টয়ার ঘাম ছুটতে লাগলো।
ইয়াদ কিছুটা অবাক হলো কিন্তু বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলো। ” হটাৎ সিদ্ধান্তের এমন পরিবর্তন?”, মাথা ঠাণ্ডা কোরে বললো ইয়াদ। ব্যাপারটা ইয়াদ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না কারন টয়া লিগ্যাল ভাবে তার ওয়াইফ তাই ওনার ইচ্ছে না থাকলেও কিছু করার নেই। তবুও না করার কারণ তো জানতে হবে।

ইয়াদের এমন প্রশ্নে রাগী চোখে তিনি বললেন,” তোমায় কেনো আমি কৈফিয়ত দিতে যাবো? এটাই আমার শেষ কথা, এই বিয়েটা হবে না।”

ইয়াদ রেগে গেলো। লোকটা কারন না বলে এভাবে বাধা দিচ্ছে কেনো। তাও সে নিজের রাগ সামলে বলল,” কিন্তু বিয়েটা তো হয়ে গেছে।”
তৌহিদ সাহেব মানে টয়ার দাদাভাই তিনি বেশ অবাক হলেন। বাহিরে দাড়িয়ে নিরব চমকে গেলো। যদি বিয়ে হয়েগেছে জানত তাহলে হয়তো এই কাজগুলো সে করতো না। নীরবের কিছুটা অনুতপ্ বোধ করছে।

” মানে।”, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো তৌহিদ সাহেব।
” হ্যা আগেই বিয়ের পেপারে সাইন করা হয়েছে আমাদের।”, শক্ত করে টয়ার হাত ধরে বললো ইয়াদ।

টয়া মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। পরিবেশ আবার থমথমে হয়ে গেছে। তৌহিদ সাহেব কিছুতেই বিয়েটা মেনে নিতে পরছে না ইয়াদকে দেখে তো মনেও হচ্ছে না যে সে মিথ্যে বলছে।

” তুমি কি ভেবেছো আমি কিছুই জানি না? সবটা আমার জানা। সাত বছর আগে রাগের মাথায় কি কি বলেছো সবটাই আমার জানা।”, তৌহিদ সাহেব রাগে গজগজ করে বললো।

টয়ার চোখ কপালে উঠে গেলো। দাদাভাই কি করে এসব জানলো এগুলো শুধু নিরব জানতো তাহলে কি নিরব? ভাবতে থাকতেই তৌহিদ সাহেব বলে উঠলো,” তোমার হাতে কি হয়েছে? ভেবেছো জানি না।রাগের মাথায় নিজেকে এভাবে ক্ষত বিক্ষত করেছ। তোমার মতো বদমেজাজি ছেলের কাছে কি করে নিজের বোনের হাত তুলে দেই। ভবিষ্যতে যে আবার এই ঘটনা গুলো রিপিট হবে না তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে?”
ইয়াদ চুপ করে আছে কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারছেনা। সে ভুল করেছে এটা তো সত্যি।

” তুমি ছেলে ভালো না আমি সেটা বলছিনা তবে তোমার এই বদমেজাজ ইন ফিউচার আমার বোনকে সহ্য করতে হবে। রাগের মাথায় আবার বড়ো কিছু করলে ভাবতে পারছো কি হবে? এতো বড় হয়ে নিজের রাগ সামলাতে পারলে না। ভবিষ্যতে যে সামলে নিবে তা ভেবে নেই কি করে।”, ইয়াদ ভালো করেই জানে তৌহিদ সাহেবের জায়গায় তিনি ঠিক কিন্তু তাই বলে টয়াকে সে হারাতে রাজি না।

ইয়াদ কিছু বলার আগেই টয়া মাথা নিচু রেখে বললো,” দাদাভাই, আমি সামলে নিবো এই বদমেজাজী ছেলেটাকে।”

ইয়াদ আর তৌহিদ সাহেব দুজনেই একসাথে টয়ার দিকে তাকালো। তৌহিদ সাহেবের আর বলার জায়গা রইলো না। কারন বোনের ইচ্ছাটাই তার কাছে সব। টয়া যে এখনও ইয়াদকে চায় সেটা তার জানা ছিলো না। আর এতক্ষন তার এতগুলো কথা ঠাণ্ডা মাথায় যে ইয়াদ শুনেছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে যে সে বদলাচ্ছে।

নিরব টয়ার কথা শুনে আর দাড়ালো না সেথায়। মেঘাচ্ছন্ন চোখে এগিয়ে যেতেই রিতু নীরবকে দেখে দৌড় দিতে গেলো কিন্তু মুখ উল্টে পরে গেলো। নীরবের মেঘাচ্ছন্ন মুখটার থেকে মেঘ কেটে গেলো। রিতুকে দেখলে নিরব কেনো জানি মুখ ভার করে রাখতে পারে না। নীরব আজ আর রিতুকে জ্বালালো না। এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে রিতুকে টেনে তুললো। নীরবের কাজে রিতু অবাক হয়ে গেলো। এতো ভালো আচরণ রিতুর হজম হলো না। নীরবের হাত ধরে উঠে দাড়ালো রিতু। তারপর রিতুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সামনের এগিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। এখনো সূর্য উঠেনি তবে একটু পরই উঠবে বোঝা যাচ্ছে।

বাহ্ এতো দেখি ভদ্রতার চরম পর্যায় পৌঁছে গেছে। রিতু এগিয়ে গেলো নীরবের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো তাও নিরব কিছু বললো না। রিতু সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,” ভূল করে কি সুপার গ্লু খেয়ে নিয়েছেন? মুখ দেখি বন্ধ হয়ে আছে।” নিরব ভ্রু কুঁচকে রিতুর দিকে তাকালো। হয়েছে এবার বিরক্ত করে মারবে। নিরব একটা নিশ্বাস ছাড়ল।

রিতুর ভদ্র নীরবকে ঠিক পছন্দ হলো না। নীরবের বাহুতে ঘুষি দিতে বললো,” আরে আজব কথা বলেন না কেনো? ঠিক আছে কথা বলবেন না তো থাকুন একা। আপনার জন্যে এমনেই অনেক বিপদে পড়েছি।”বলে চলে যেতেই নিরব রিতুর হাত ধরে ফেললো। তারপর বললো,” সামনে দেখো।” রিতু ভ্রূ কুচকে সামনে তাকালো অসম্ভব সুন্দর লাগছে আকাশটা। পূর্বের আকাশটা আস্তে আস্তে আলোয় ভরে যাচ্ছে। মনোমুগ্ধকর সে দৃশ্য।

ইয়াদ টয়ার হাত আরো শক্ত করে ধরলো। টয়া এখনো মাথা নুইয়ে আছে। দাদাভাই কি রাগ করেছে তার কথায়। বুকের ভিতরটা ধক ধক করছে,কিছু বলছে না যে দাদাভাই। তৌহিদ সাহেব কিছুক্ষণ রাগ দেখিয়ে তাকিয়ে রইলো তারপর একটু কেশে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললো,” হুম,তোমরা দুজনে জলদি নীচে আসো একসাথে চা খাবো।”

ভোরের আলোয় সবটা যেনো আরো সুন্দর হয়ে গেলো। টয়া আর ইয়াদ দুজনই চমকে গেলো।
মনে মনে সব মেনে নিয়েও থমথমে মুখ করে বেরিয়ে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলেন তিনি। টয়ার চোখে মুখে প্রফুল্ল ফুটে উঠেছে। ইয়াদ অবাক হয়ে বললো,” মেনে নিলো। এতো সহজে।”
টয়া হেসে ফেললো। দাদাভাই ইয়াদের ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে। ভেবেই মজা পাচ্ছে সে। তারপর হা সূচক মাথা নেড়ে ইয়াদের হাত ধরে ছাদের রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

এতো সুন্দর দৃশ্য রেখেও নিরব রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে নিজের অজান্তেই। রিতুর নীরবের দিকে চোখে পড়তেই চোখ আটকে গেলো। দুজনেই মুগ্ধতায় মজে গেছে। টয়া আর ইয়াদ বের হতেই চোখ গেলো নিরব আর রিতুর দিকে। এভাবে ওরা দুজন দুজনকে দেখছে কেনো? ইয়াদ আর টয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

টয়া আস্তে আস্তে বললো,” নতুন এই ভোরে আবার কোন গল্পের সূচনা হচ্ছে?”
টয়ার কথায় ইয়াদ হেসে ফেললো তারপর হালকা কেশে উঠে ওদের দৃষ্টি আকর্ষন করল। নিরব আর টয়া দুজনই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।

_______________[ সমাপ্ত ]________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here