তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৪
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
সেদিন আরসালদের বাড়ি থেকে ফেরার পর দ্বিতীয়বার ঐ বাড়িতে পা রাখেনি সায়রা।না ঐ বাড়ির দিকে ফিরে চেয়েছে ,মাঝে এক পূর্ণদিন অতিবাহিত হয়েছে।আজ সকাল সকাল তৈরি হয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে সায়রা।বাড়ির নিচে নামতে আরসালের মুখোমুখি ।দুজনের মাঝ বরাবর গলির চিকণ সরু রাস্তার দূরত্ব ।চোখাচোখি হলো দুজন। আরসালের ক্রুদ্ধতায় মোড়ানো দৃষ্টি।অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নুয়িয়ে নিলো সায়রা।যতদ্রুত সম্ভব পা চালিয়ে।গলির মোর থেকে রিকশায় উঠে পড়ল সায়রা।পেছন ফিরলে সায়রা হয়তো দেখতো ,একজোড়া ক্রুদ্ধ দৃষ্টি চেয়ে আছে তার যাওয়ার পথে।
.
সবেমাত্র ইমার্জেন্সি রুম থেকে বেরিয়েছে তুর্জয়।দুদিন ধরে হসপিটালে প্রচণ্ড ভিড় ,গতপরশু মেইন স্ট্যান্ডে বিরাট এক এক্সিডেন্ট হয়েছে।অনেক মানুষ আহত।কিছু মানুষ ঘটনাস্থলেই, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে।এই হসপিটাল স্ট্যান্ডের কাছাকাছি হওয়ায় সব রোগী এখানেই উঠেছে।সেই থেকে হসপিটালের সব ডক্টর ভীষণ ব্যস্ত ,নিজেদের ধর্ম পালন করতে। আজ দুদিন তুর্জয় বাড়ি ফিরেনি।নাওয়া খাওয়া সব ভুলে হসপিটালে পড়ে।ডক্টরদের জীবনটাই হয়তো এমন!
এক নার্স এসে জানান দিলো ,কেউ তার সাথে দেখা করতে এসেছে। কেবিনে অপেক্ষা করছে। ক্লান্তভারী মুখখানায় এক চিলতে হাসির রেখা ভেসে উঠল।সে জানে কে এসেছে!
কেবিনের দরজা খুলতে খুলতে শুধালো,
–“কখন এলে? ”
সায়রা ইজি চেয়ারের হাতল চেপে চট করে পেছন ঘুরলো।হাসি হাসি মুখ করে বলল,
–“উমম! অনেকক্ষণ ”
–“আজ মেডামের পা এদিকে কি করে? তো কি খবর নিয়ে এসেছেন মেম”
–“সে আর বলোনা! অনেক কথা! ”
–“বলে ফেলো! আমি আপাতত ফ্রি আছি।”
সায়রার হাসি হাসি মুখখানা মুহূর্তেই বুজে গেলো।কপালে চিন্তার বলিরেখা।বুজে আসা নত স্বরে বলল,
–” সে ফিরেছে! ”
তুর্জয়ের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো ,কন্ঠে গম্ভীরতা এঁটে বলল,
–“কে ফিরেছে? ”
সায়রার কাঁচুমাচু উত্তর ,
–“তোমার ফুফাতো ভাই ,পরম মিত্র আরসাল ভাই! ”
তুর্জয় কিছুক্ষণ চুপ রইল।কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে হো হো করে হেসে উঠল ,
–“সে তো ভালো কথা ,এতে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? ”
–” এমা ভয় পাবো না? আমার যমরাজ হয়ে ফিরেছে! প্রতি মুহূর্ত আমার আত্মা ভয়ে পিটপিট করে।এই বুঝি প্রাণ হারালো।”
তুর্জয় আরেক দফা হেসে উঠল।সায়রা বাঁকা চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল ,
–“পরশু রিদ্ধিদির হলুদ ,তুমি যাবে তো? ”
–“যাবো না মানে? অবশ্যই যাবো! আমার বেস্টফ্রেন্ডের সাথে একমাত্র বেস্টির বিয়ে বলে কথা।আর আমি যাবো না? এটাও সম্ভব! ”
–“তা যেও! বিয়েতে দেখা হবে ।”
–“কেন ? তুমি হলুদে যাবে না? ”
–“ঐখানে তোমাদের বন্ধু যমরাজ থাকবে ,আমি যাবো না। ”
–“তোমার রিদ্ধিদি মানবে? ”
–“তা সময় এলে দেখা যাবে ।”
তুর্জয় কথা বাড়াল না।সে ঠিক জানে ,রিদ্ধি সায়রাকে ছাড়বে না।ঘাড় ধরে সায়রাকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে।গা থেকে এফ্রোন খুলে হাতে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল,
–“আরমিন কেমন আছে? আজ তো পাঁচ তারিখ! ওর পরিক্ষা শেষ? ”
আরমিনের কথা শুনতেই সায়রার ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি ফুটে উঠে।দাঁত বের করে হেসে, মিছে অভিমান এঁটে বলল,
–“আমি এসেছি আধঘণ্টা হলো, কই আমাকে তো এবার জিজ্ঞেস করলে না কেমন আছি? অথচ আরমিন আপার ঠিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে! কি ব্যাপার সামথিং সামথিং? ”
তুর্জয় বিস্তৃত হাসল।কথা কাটাতে জিজ্ঞেস করল,
–“এখন সরাসরি বাড়ি ফিরবে, নাকি অন্য কোন কাজ আছে! ”
–“না কাজ নেই! বাড়ি ফিরবো ।কেন তুমি কি ঐদিকে যাবে?”
–“হ্যাঁ ,অনেকদিন ফুপুকে দেখা হয় না।আরসালও বাড়ি ফিরেছে দেখা করে আসি।”
.
আকাশ পরিষ্কার।দুপুর গড়িয়ে বিকালে এসে ঠেকেছে।সূর্যের তাপ অনেকটাই দমে গেছে।দুর্বল কমলা আলোয় আকাশ সজ্জিত।বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে আরসাল।দৃষ্টি নিচে সরু রাস্তার দিকে।মাঝেমাঝে দুটো একটা রিকশা চলছে।লোকালয়ে ব্যস্ততার আমেজ । শিশুরা ছুটাছুটি করছে,শহুরে রাস্তাঘাট এমনি! সর্বদা ব্যস্ত ,অশান্ত!
মিনিট পাঁচেক কাটতেই।আরসালের দৃষ্টি সামনে বাড়ির গেটে ,থেমে থাকা বাইকে আটকায়।তুর্জয়ের বাইকের পেছন থেকে সায়রা নামছে।দুজনের মুখ বেশ হাসি উজ্জ্বল! ইশারা ইঙ্গিত দেখে বোঝা যাচ্ছে সায়রা তুর্জয়কে ভিতরে চলতে পীড়াপীড়ি করছে।তুর্জয় হাত উঁচিয়ে হাসি হাসি মুখ করে না করছে।সায়রার ঠোঁটের হাসি যেন কিছুতেই কমছে না।
এই দুদিন এই হাসি এতো খুশি কোথায় ছিল? কই আরসাল তো একবারো দেখেনি!
আরসালের দৃষ্টি তুখোড় হলো।কেমন জানো ঈর্ষান্বিত চাহনি !
.
নিজ ঘরে ঢুকতেই রিদ্ধিকে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকতে দেখল সায়রা।কাঁধ থেকে ব্যাগ নামাতে নামাতে কিঞ্চিৎ হেসে গলা উঁচিয়ে বলল,
–“বাবাহ! নতুন বউ আমাদের বাড়িতে? ব্যাপার কি বলোতো? ”
রিদ্ধি চট করে উঠে বসলো।মুখ ভেংচি কেটে জবাব দিলো ,
–“খালার বাড়িতে নতুন বউ আসতে পারবেনা ,এমন কোনো নিষেধাজ্ঞামূলক আইন জারি করা হয়েছে কি ? ”
সায়রা বাঁকা হাসলো,রিদ্ধির দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল,
–“তুমি যে খালার বাড়িতে না,বন্ধুর বাড়িতে এসেছ তা আমার বেশ জানা আছে।দুদিন পর তোমার বিয়ে ,আজ তুমি টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছ? ভেরী ব্যাড! তুমি যে এখানে সায়ন ভাইয়া কি তা জানে? নতুন বউদের এভাবে হুটহাট বেরোতে নেই! জানো না রিদ্ধিদি ! ”
–“ও আমার নানী আম্মা চুপ যা! স্ট্রেঞ্জ! এই যুগের মর্ডান মেয়ে হয়ে তোর পেট থেকে এমন বুড়ো বুড়ো কথা বের হয় কি করে ? বলতো সায়রা! ”
সায়রা ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে নিলো।রিদ্ধি আবার বলল,
–“যা দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে নে তো! আজ আমার সাথে আমাদের বাড়ি যাবি।খালামণির সাথে আমার কথা হয়েছে।তুই পাখি পিয়াস আরমিন যাচ্ছিস।বিয়ে অবধি সেখানেই থাকবি! ”
আমতা আমতা কন্ঠে বিরবির করল,
–“ওরা যাক! আমি বরং বিয়ের দিন মায়ের সাথে যাবো ,কেমন? ”
রিদ্ধি ক্ষেপে গেল।ভারী ধমকের স্বরে আওড়াল ,
–“এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিবো সায়রা। একদম ভণিতা করবি না ! কথা ছিল তুই আমার বিয়ের এক সপ্তাহ আগে যাবি।এতো ডং না করে দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে নে।”
সায়রা আর কথা বাড়ালো না।জানে রিদ্ধি কোনকিছু শুনবে না।নিজ সিদ্ধান্তে অটল সে।ব্যাগ বের করে ,কাপড় গুছাতে শুরু করে সায়রা।
.
বিষাক্ত ধোঁয়ায় অন্ধকার চারিদিক , সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ ।সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া হুড়হুড় করে হাওয়ায় মিলছে।চারবছর পর আবারো তিন বন্ধুর আড্ডা বসেছে।
ছোট থেকে আরসাল ,তুর্জয় ,রিদ্ধির হবু বর সায়ন,রিদ্ধি এক সাথে বেড়ে উঠা।স্কুল কলেজ এক সাথেই শেষ করেছে।রিদ্ধি সায়ন ছোট থেকেই পড়াশোনায় ড্যাম ।আর আরসাল তুর্জয় ছিল তুখোড়! পড়াশোনা খেলাধুলা আদারস এক্টিভিটি দুজন দুজনকে টক্কর দিতো।সেই থেকে এই পর্যন্ত! চিরকাল, দুজনের ভেতর সুপ্ত কম্পিটিশন চলছে।তা হোক পড়ালেখা বা জীবনের অন্যকোন স্থান।মুখে প্রকাশ না করলেও দুজন দুজনের প্রতিদ্বন্দ্বী!
তুর্জয় সায়ন খোশ মেজাজে থাকলেও আরসাল ভীষণ বিরক্ত । কেন বিরক্ত সেই কারণটাও স্পষ্ট না।সায়রাকে নিয়ে ? কিন্তু কেন? সায়রাকে তুর্জয়ের বাইকের পেছনে দেখেছে বলেই কি এতো বিরক্তি!
সায়রা যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে ঘুরুক! তাতে তার কি? সে তো সায়রাকে মানে না।কখনো মানবেও না! তবে?
পরক্ষণে মন নাড়া দিয়ে উঠল।ভেতরের দ্বিতীয় স্বত্বা বলল,অন্য কারো সাথে কেন ঘুরবে সায়রা ? হোক সায়রা তার না মানা হবু বউ ,অন্যকারো সাথে সায়রা ঘুরতে পারবেনা! একটু না!
সায়নের কথায় আরসালের ভাবনাচ্ছেদ হয়।সায়ন সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছে।সায়ন বলল,
–“কোথায় হারালি? এতো কি ভাবছিস? ”
–“কিছুনা ,বল! ”
–“সবাই বলছে তুই শুকিয়ে গেছিস! আমার চোখে পড়ছে না উল্টো তোর বডি ফিটনেস আগের তুলনায় আরো সুঠাম হয়েছে।লম্বায় কি এক দু ইঞ্চি বেড়েছিস? সেই যাই হোক স্কুল কলেজে সুদর্শনের তালিকায় বরাবরই তুই প্রথম সারির প্রথম স্থান দখল করে রাখতি।শতশত মেয়ের ক্রাশ! শুন ভাই আমার বিয়েতে তুই মাস্ক পড়ে আসবি।নয়তো দেখা যাবে বর না দেখে সবাই তোকে গিলে খাচ্ছে।”
সায়নের কথায় আরসাল বাঁকা হাসলো।চোখ ঘুরিয়ে তুর্জয়ের দিকে তাকাতে- ই হাসিটা নিভে গেল।চেহারা গম্ভীর ভাব এঁটে এলো ,চোয়াল শক্ত ।তুর্জয় সায়রার বারান্দার দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।তা দেখে আরসালের মেজাজ খারাপ হলো।প্রচণ্ড!
সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করল।আগুন জ্বালিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরলো।সিগারেটের নেশা আগে কখনো ছিল না।বন্ধুমহল একসাথে হলে , দু একটা টান দিতো।এই আর কি! কিন্তু গত চার বছরে সিগারেট আরসালের নেশা হয়ে উঠেছে ।মাথা গরম হলে সিগারেট তার চাই- ই চাই! এতে খানিকের স্বস্তি মিলে । বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করলো।কিন্তু হচ্ছেনা।কোন ভাবে হচ্ছে না। গম্ভীর স্বরে তুর্জয়কে ডাকল , ভণিতা বিহীন শিথিল স্বরে বলল,
–“সায়রা আমার হবু বউ তুর্জয়! নো ইউর লিমিটস,ডোন্ট ক্রস ইউর লাইন ।”
তখনো আরসালের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।আরসালের ঠাণ্ডা মাথার হুমকিতে তুর্জয় কিঞ্চিত হাসলো।আরসাল কি জেলাস? একটু বাজিয়ে দেখলে কেমন হয়?
তুর্জয় চেয়ারে গা হেলিয়ে দিলো। আরো আরাম করে বসলো। মুখভঙ্গি ভাবলেশহীন। বাঁকা হেসে বললো ,
–“বাহ! হবু বউকে নিয়ে এতো পজেসিভনেস! তুই কি জেলাস আরসাল ? ”
আরসালের ভণিতা বিহীন সোজাসাপ্টা উত্তর ,
–“আমি কেন জেলাস হবো! এভাবে অন্য কারো হবু বউকে বাইকের পিছনে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো ,দৃষ্টিকটু দেখায়।এই গলিতে আরো মানুষের বসবাস,খামাখা দুর্নাম রটবে ! ”
চলবে……