তোমার প্রণয় নগরে,পর্ব- ৩
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
বিরক্তি সহিত চোখা মুখ করে সায়রা ঠাই দাঁড়িয়ে।আধো ঘুম ভাঙায়,মাথাটা এখনো ঝিমঝিম করছে।আরসালের উপর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে তার।নিম্নতম মানবতা উনার ভেতর অবশিষ্ট নেই কি? এমন করে কেউ কাউকে ঘুম থেকে তুলে? ঘর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে? রাগে ফোঁস করে উঠল সায়রা।সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।শেষের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সায়রা চারিদিকে চোখ ঘুরাল ।হল ঘরে কেউ নেই।বাহিরে ঝপঝপ বৃষ্টির শব্দ।নিস্তেজ অন্ধকার বাড়ি ,যে যার যার রুমে ঘুমিয়ে। এ রাতে কার কাছে যাবে সায়রা?
ড্রিম লাইটের আলোয় আবছা আলোকিত চারিদিক । আলোছায়ার ভীতিকর খেলা।আচমকা সায়রার গাঁ শিউরে উঠল।ছমছমে অন্ধকার, নির্জন পরিবেশ।বুকটা প্রবল বেগে ধকধক করছে।বাড়িতেও যাওয়া যাবে না।বাবা হয়তো মেইন গেটে তালা ঝুলিয়ে চাবি নিজের রুমে নিয়ে গেছে।রাতটা এ বাড়িতে কাটাতে হবে।কি করবে ,কার কাছে যাবে? কোথায় ঘুমাবে? উপায় মিলল না তার।অবশেষে হল ঘরের সোফায় ঘুমিয়ে রাত কাটানো সিদ্ধান্ত নিলো।যেই ভাবা সেই কাজ।সারা গায়ে ওড়না মেলে সোফায় শুয়ে পড়লো সায়রা।
.
ঘুম ভাঙ্গল দূর থেকে ভেসে আসা আযানের প্রতিধ্বনিতে।ততক্ষণে মুনতাহা বেগমও জেগে গেছে।সায়রাকে সোফায় ঘুমাতে দেখে চমকাল ।মাথায় হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করল,
–“কিরে মা তুই এখানে কেন? ঘরে যেয়ে ঘুমা! ”
কাঁচুমাচু মুখ করে উঠে বসে সায়রা।রাতে ভালো ঘুম হয়নি,শরীর ভীষণ দুর্বল।হঠাৎ চোখ আটকায় গায়ে মেলে থাকা চাদরে।তার গায়ে চাদর আসলো কোথা থেকে? রাতে ঘুমানোর সময় তো ছিল না! কে দিয়ে গেছে?
আচমকা মুনতাহার ডাকে সায়রার ঘোর কাটে,গাল ফুলিয়ে গম্ভীর গলায় বিরবির করল ,
— “আমার সেখানে জায়গা কই? ঘরতো তোমার ছেলের ,সে এসে দখল করে নিয়েছে ! ”
মুনতাহা বেগমের আর বুঝতে বাকি রইল না ছেলে বাড়ি ফিরেছে।আল্লাহ্ তার ডাক শুনেছে ।চোখ মুখ উজ্জ্বল দ্রুতিতে হাসি উজ্জ্বল হয়ে উঠে।কন্ঠে একরাশ আনন্দ ঢেলে বলে,
–“যা মা উপরে কোনার গেস্ট রুম খালি পরে আছে,সেখানে গিয়ে ঘুমা! ”
সায়রা আর কথা বাড়াল না।কথা শেষ করে দেরী করল না মুনতাহা বেগম ,দ্রুত পায়ে ছেলের রুমের দিকে পা বাড়াল।চোখে মুখে আনন্দের আভা।আনন্দ হবে না- ই বা কেন? আজ চারবছর পর তার বুকের মানিক ঘরে ফিরেছে।
চাদর রহস্য আর বেদ করা হলো না সায়রার। দুর্বল শরীর ,ঘুমে নুয়ে আসা চোখ নিয়ে ঢোলতে ঢোলতে আবারো সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হয় সায়রা।
.
সায়রার ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে।ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতে।চোখ আটকাল হল ঘরের সোফার দিকে।সেখানে গোল বৈঠক বসেছে।যার মধ্যমণি আরসাল।তাকে ঘিরে তার চাচী ফুপু চাচাতো ফুপাত ভাই বোন বসে।উনাদের হাজারো কৌতূহল! যেমন ,এই কদিন আরসাল কোথায় ছিল? দেশে এসে বাড়ি ফিরেনি কেন ? এতো শুকিয়েছে কেন? সেখানকার খাবারদাবারের মান ভালো নয় কি !
আরসাল এক এক করে সবার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে।সায়রা ছোট নিশ্বাস ফেলল। হল রুমের দিকে আর পা বাড়াল না। মুনতাহা বেগম ডাইনিং টেবিলে নাস্তা লাগাচ্ছে।সায়রা পাশে যেয়ে দাঁড়ায়। পরিবেশনের জন্য সায়রা হাত বাড়াতেই, মুনতাহা বেগমের আদুরে ধমক,
–“একদম হাত লাগাবি না সায়রা! আমি করছি,তুই গিয়ে সোফায় বস।”
সায়রা ম্লান হেসে সোফায় গিয়ে বসলো। সায়রাকে দেখে আরসালের হাসি উজ্জ্বল মুখখানায় গম্ভীর ভাব এঁটে এলো।সায়রা জড়সড়ভাবে সোফায় বসে আছে। সবাই আরসালের মোবাইলে কিছু একটা দেখছে সায়রা কৌতূহল সহিত ভ্রুদ্বয় উঁচাতেই ,আরসাল তা লক্ষ করে মোবাইল বন্ধ করে ফেলল। বেশ অপমানবোধ করল সায়রা। সাথে কষ্টও হলো তার।আরসাল তাকে এতো বেশি ঘৃণা করে? এত! কই আগে তো এমন ছিল না। যা সায়রার চাই তা যে কোন ভাবে হোক আরসাল এনে দিতো।চোখের সামনে অতীত ঝলমল করে ভেসে উঠল সায়রার।
সায়রার বয়স তখন আট বছর।আর আরসালের তের।সেদিন শুক্রবার । ছুটির দিন।আরসালদের বাড়ি খেলতে এসেছিল সায়রা।খেলার ভেতর মজার ছলে সায়রা বায়না ধরেছিল সে কাঁচা আম খাবে ,তার মনে বেশ স্বাদ জেগেছে।জেদ ধরে বসে রইল সায়রা।
শীতের মৌসুম ।এই দিনে কাঁচা আম কোথায় পাবে? চিন্তায় মুখভার আরসালের।তখনি তার মাথার টনক নোড়ল।স্কুলের মাঠের মাঝ বরাবর একটা বারোমাসি আমের গাছ আছে।অবিলম্বে আরসাল স্কুলের পথে রওনা হলো।স্কুল বন্ধ থাকায় ,দেয়াল টপকিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়েছিল আরসালকে।এতে হাতে পায়ে ভীষণ চোট লাগে।গাছ বেয়ে আম পেড়ে নিয়ে এসে সায়রার সামনে রাখল।সায়রার মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি।এই হাসিতেই যেন আরসালের সব চোটের অবসান ঘটেছে।এই হাসির জন্য সে সব পারে ,সব! পরেরদিন বড়বাবার কাছে হেড মাস্টার সনালিশ করলো,এতে বড়বাবা ভীষণ রাগান্বিত হলো।শাস্তি স্বরূপ সারা দুপুর আরসালকে কান ধরিয়ে বারান্দায় রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।এতে আরসালের বিন্দু মাত্র কষ্ট লাগেনি,বরং ভালো লাগছিল ।কারণ এই বারান্দা থেকে সায়রাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল!
.
ডাইনিং টেবিলে সকলে নাস্তা করছিল।আরসাল সায়রা আহনাফ সাহেব ,আরসালের আরো কিছু কাজিন। সায়রা অবশ্য আরসাল থেকে বেশ দূরত্ব রেখে বসেছে। পুরো টেবিল আরসালের পছন্দের খাবারে সাজানো।সায়রা খাচ্ছে কম প্লেটে হাত নাড়ছে বেশি।মুনতাহা বেগম জোর করে প্লেটে এটা ওটা তুলে দিচ্ছে।আহনাফ সাহেব আরসালের উদ্দেশ্যে গম্ভীর স্বরে বলল,
–“এই সাতদিন কোথায় ছিলে? দেশে ফিরেছ এক সপ্তাহ ,বাড়িতে ফিরলে গত রাতে! কাণ্ডজ্ঞান নেই ,নাকি ? বাড়ির লোক কতটা চিন্তায় ছিল,তোমার কোন ধারণা আছে?”
বাবার কথা কানে তুলল না আরসাল। ভাবলেশহীন খেয়ে যাচ্ছে। তা দেখে আহনাফ সাহেব আরো বেশি ক্ষেপে গেল।পরিস্থিতি প্রতিকূল হচ্ছে দেখে ,মুনতাহা বেগম আওড়াল ,
–“আহা,থামো তো! সকাল সকাল কি শুরু করলে।সবে ছেলে বাড়ি ফিরেছে ,এসব কথার জন্য অনেক সময় পরে আছে।”
স্ত্রীর কথায় আহনাফ খাঁন আরো বেশি বিরক্ত হলো।ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–“এই যে তোমার আহ্লাদে ছেলে মাথায় চড়ে বসেছে।এতো অপরাধ করে তার মাঝে সামান্যতম অপরাধবোধ নাই।চারবছর আগে এক কাণ্ড করে গেছে।দেশে ফিরে আরেক কাণ্ড বাঁধিয়েছে! ”
রাগ হলো আরসালের।প্রচণ্ড রাগ।সামনে থাকা কাঁচের প্লেটটা মাটিতে ছুঁড়ে মারল ।বাড়িসুদ্ধে লোক ভয়ে কেঁপে উঠল।ক্রোধে আরসালের শরীর থরথর কাঁপছে।বাবার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে শক্ত স্বরে বলল,
–“তোমাদের আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে কেন? কাউকে আমাকে নিয়ে ভাবতে বলেছি? ”
আরসাল নাস্তা না সেরে রুমে চলে গেছে ,অনেকক্ষণ ।সায়রা ভীতু মুখে সেখানে বসে।তার বোকামি ছেলেমানুষির জন্য বাবা ছেলের সম্পর্কে এতোটা দূরত্ব চলে এসেছে ,তা সায়রার জানা ছিল না। আজ চাক্ষুষ দেখে ভেতরটা অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। ভীষণ ছোট মনে হচ্ছে নিজেকে।তার বলা দু’বাক্য যে একজন মানুষের উপর এতো জঘন্য আরোপ এনে দিতে পারে তা সায়রার জানা ছিল না।জানবেই বা কি করে? তখন বয়স কতই বা ছিল ,পনের! ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতাই কতটুকু? সেই রাতে সে তো অন্যকিছু ভেবে ঐকথা গুলো বলেনি।সরল মনে বলেছিল।আর পাঁচদিনের মতই বড় বাবার কাছে নালিশ করেছিল।তার সহজ কথা গুলোকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সবাই খারাপ ভাবে নিয়ে নিলো।
সায়রারও আর খাওয়া হলো না।অস্থির মন।চেয়ার ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসলো।আরসাল তার রুমে আছে।অনেক ভেবেচিন্তে সায়রা সিদ্ধান্ত নিলো ,আরসাল থেকে ক্ষমা চেয়ে নিবে।যেই অন্যায় সে করেছে,আরোপ লাগিয়েছে তার কো্নো ক্ষমা নেই।তবুও যদি এতে মনের তপ্ত অনুতাপ সামান্য কমে!
.
আরসালের রুমের সামনে দাঁড়াতে সায়রার কাঁপুনি ছুটেছে।ভিতরে যাবে কি করে?
কাল যা করলো,আজ খুন না করে ফেলে।অনেক সাহস জুটিয়ে দুবার দরজায় নক করলো।কোন সাড়া নেই।তৃতীয়বার নক করতে ভেতর থেকে থমথমে গম্ভীর আওয়াজ ,
“কাম ইন ”
সায়রা ছোট ছোট পায়ে ভিতরে ঢুকল।জড়সড় ভাবে দাঁড়য়ে আড়ষ্ট স্বরে বলল,
–“ভাইয়া ,আমার কিছু বলার ছিল ”
সায়রাকে দেখামাত্র আরসালের ক্ষিপ্ত মেজাজ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল।ঝাঁঝালো রুক্ষ স্বরে আওড়াল ,
–” গেট আউট! তোর সাথে কথা বলা তো দূর , চেহারাও দেখতে চাই না।”
সায়রার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে এলো ।টলটল চাহনি।পলক ফেলতে যেন অশ্রুধারা গাল বেয়ে নামবে।ভীষণ অপমানবোধ করলো।তারচেয়ে বেশি আহত হলো।এতো ঘৃণা ,এতো তুচ্ছতা?
দ্রুত পায়ে শুধু ঘর থেকে নয় ,বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সায়রা ।
চলবে…..