সহধর্মিনী
#৩য়_ও_শেষ পর্ব
লেখা : Shadbin ShaQil
–ব্লাক ম্যাজিক এর নাম শুনেছো মেহেদি? বাংলায় ‘কালো জাদু’ বলা হয়।এই জাদু বিদ্যার দ্বারা বছরের পর বছর মানুষ তিলে তিলে অসুস্থ করা যায়,কিংবা শেষ করে দেয়া যায়।
ঊর্মীর কথাগুলো কান দিয়ে ঢুকছিলো না,খুব ঘুম পাচ্ছিলো ঊর্মীর বানানো স্যুপ খেয়ে।গভীর ঘুমে হারিয়ে যাচ্ছি…
জ্ঞান ফেরার পর থেকে প্রত্যেকদিন খুব ঘুম পায় আমার।কখন সকাল হয় আর কখন রাত কিছু বুঝবার উপায় নেই।
বাইরে শোঁ শোঁ বাতাস বইছে,আজ রাতেই বাসায় হুজুর এসেছে দোয়া পড়ানোর জন্য।কিন্তু কেউ আমাকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে তার সাথে,হাতটার স্পর্শ খুব পরিচিত আমার,কোমল হাত,চুড়িগুলো বাতাসে ঝুনঝুন মৃদু শব্দ করছে,পায়ের পায়েলটা খুব পরিচিত।
আমি কৌতুহল হয়ে প্রশ্ন করি,
–মেহেরা! কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমায়?
কোন উত্তর পাইনি সেই প্রশ্নের আমি।
ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে ক্রমাগত কোথাও নিয়ে যাচ্ছে সেই হাতটা আমাকে,হ্যা! এটা মেহেরার হাত,আমার ভুল হতে পারেনা।তাই আমিও পিছু পিছু যাচ্ছি।
মেহেরা আমাকে একটা কবরস্থানের কাছে নিয়ে আসে,আমার দিকে না তাকিয়েই দূরে একটা ভাঙা কবরের দিকে ইশারা করে যেতে বলে।
আমি চমকে উঠি এটা তো সেই কবর যেখানে আমি নিজ হাতে মেহেরাকে শুইয়ে দিয়েছিলাম।আমি ক্রমাগত কবরের দিকে এগোতে থাকি।
কবরের কাছে যেয়ে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখি, সেই কোমল হাতের পায়েল পরা মেয়েটা নেই,আমি বেশ শান্ত ভাবে বলি,
–মেহেরা তুমি কোথায়?
এবার আমার চোখ চলে যায় কবরের দিকে,হঠাৎ চারদিক আলোকিত হয়ে উঠে,গোলাপের সুবাস ভেসে আসে।
এতো আলোর মাঝে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই সবকিছু,সেই পুরোনো দিনগুলোর কাহিনী। আমি বাসা থেকে ব্রেকফাষ্ট করে বেরুচ্ছি চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে,সেইদিনের সেই বেগুনি হিজাব পড়া মেয়েটাকে দেখছি।
মেহেরা আর ঊর্মী রাস্তার এক প্রান্তে দাড়িয়ে হাসছে,আর আমি অপর প্রান্তে দাড়িয়ে,সেদিন তাদের কথা শুনতে পাইনি আমি,আজ স্পষ্ট শুনছি!
ঊর্মীঃ মনে হয় ব্লিডিং এর নতুন ভাড়াটিয়া ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছি আমি,কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেনা।অবশ্য তার বোন আর মা’য়ের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে আমার।
মেহেরা খুব উচ্চস্বরে হেসে বলছে,নাম কি ছেলেটার?
–মেহেদি।
আমি দেখছি,শুনছি আর হা করে তাকিয়ে আছি আলোর মাঝে।
শুধু সেদিনের কাহিনী নয়,এর পরের দিনগুলোতে আমার চোখের অগোচরে যা যা হয়েছে সবকিছু এক এক করে ভেসে উঠছে চোখের সামনে।
আমি ঊর্মীর সাথে বন্ধুত্ব করি, আর ঊর্মী আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু করে। কিন্তু যেদিন আমি ঊর্মীর কাছে মেহেরা’কে ভালোবাসার কথা জানানোর জন্য হেল্প চাই সেদিন থেকে সে অন্য রুপ ধারন করে।সে এক ভয়ংকর রুপ!
মেহেরার সাথে আমার দেখা করা,কথা বলা কিংবা ঘুরতে যাওয়া সব দূর থেকে ফলো করছে ঊর্মী।
কিন্তু মেহেরার সামনে প্রকাশ করতে থাকে সে মেহেদি কে ভালোবাসেনা,সেদিন সব মজা করে বলেছে।
মেহেরা তার প্রতি আমার দূর্বলতা দেখে বহুবার প্রশ্ন করেছে ঊর্মীকে।কিন্তু ঊর্মী প্রত্যেকবার একই উত্তর দিয়ে এড়িয়ে গেছে।ঠিক তখনই আমার ভালোবাসার ডাকে সারা দেয় মেহেরা।
ঊর্মী সামনে সবকিছু মেনে নিয়ে আমাদের বিয়েতে আসলেও প্রান প্রিয় বান্ধবীকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
আমার বিয়ের দিন রাতে খুব কাঁদে ঊর্মী।কাঁদতে কাঁদতে সেই রাতেই এক তান্ত্রিক এর কাছে যায়।মেহেরাকে ব্লাক ম্যাজিক করার সব কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে তান্ত্রিক,যাতে মেহেরা তীলে তীলে শেষ হয়ে যাবে আর পৃথিবীর কোন ডাক্তার মেহেরার রোগ ধরতে পারবেনা।
বাসায় বেড়াতে আসার নাম করে চিরুনি থেকে মেহেরার মাথার চুল আর ব্যবহৃিত জিনিস নিয়ে যায়।মন্ত্র পড়া পানি বান্ধবীর কফিতে মিশিয়ে দিয়ে যাই।ভয়াবহ যাদুবিদ্যা দ্বারা মেহেরার রুহ পুতুলের মাঝে বন্দি করে ঊর্মী।বছরের পর বছর এভাবেই পুতুলটাকে যন্তনা দিয়ে মেহেরার কষ্ট বাড়াতে থাকে।ঊর্মীর না কোথাও বিয়ে হয়েছিল না ডিভোর্স হয়েছিল।
মেহেরার মৃত্যুর ৬ মাস আগে এই কারনেই ঊর্মী খুজে বেড় করে মেহেরারকে!
বান্ধবীর মৃত্যুর শেষ পরিনতি নিজের চোখে দেখতেই চলে আসে গ্রামে।ঠিক যেদিন পুতুল টাকে দুমরে-মুচরে ঊর্মী পানিতে ফেলে দেয়,মেহেরাও চিরতরে চোখ বন্ধ করে।
আবার আর একবার আমার কানে ভেসে আসে!
“আশহাদু আল্লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু ওয়া
আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান
আব্দুহু ওয়া রাসূলুহু।”
ঊর্মীঃ লাশ সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দিন খালা।
হঠাৎ সেই দিনের সেই কষ্ট আর সেই অনুভূতি আবার হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠে,ঘুমের ঘোড়ে আরেকবার চিৎকার দিয়ে উঠি, ‘মেহেরা’
বাড়িতে মিলাদ শেষে মোনাজাত হচ্ছে,
‘আল্লাহ্ হুম্মা আমিন।’
নিচে তাকিয়ে দেখি ঊর্মীর দেহ মাটিতে পড়ে আছে।সবাই এসে ঊর্মীর শরীর মাটি থেকে তুলে খাটে সুইয়ে দিয়েছে।আম্মা আমার কাছে এসে বললো,
–বাবা যে জরুরি কথাটা তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম,তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা,ঊর্মীর উপর মেহেরার আত্তা ভর করেছিলো,তবে এখন আর কোন ভয় নেই।যে হুজুর দোয়া পরিয়েছে উনি এখন সব ঠিক করে দিয়েছে।
–আপনি কিভাবে বুঝেছিলেন আম্মা?
–শহরে তোমাদের বাসায় যাওয়ার পর থেকেই ঊর্মীর আচরনে আমার সন্ধেহ হচ্ছিলো,কিন্তু বাস এক্সসিডেন্ট এর পর থেকে আমি পুরোপুরি শিউর হই।
নিজের মেয়েকে ‘মা’ ছাড়া আর কে ভালো চিন্তে পারে বলো?
আমার মেয়েটা তোমাকে বড় ভালোবাসতো বাবা তাই হয়তো আরেকবার ফিরে এসেছিলো।
আম্মা এক দীর্ঘশ্বাস নিলেন।
–আম্মা! মেহেরার একটা কাজ অসম্পূর্ণ ছিলো সেটা সম্পূর্ণ করতেই এসেছিলো,কাজ হয়ে গেছে তাই সেও চলে গেছে।
আম্মা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে,
–কি অসম্পূর্ণ কাজ বাবা?
–আমাকে কিছু কথা বলার ছিলো,যা আমি জানতাম না! সে বলে গেছে।
মৌরি কে বলুন মেঘলা আর মিনারকে নিয়ে তৈরি হতে আম্মা আমরা আজই শহরে চলে যাবো।
–আর ঊর্মী??
–আমি আর ওর চেহারাও দেখতে চাইনা,শহরে যেয়ে ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবো।ওকে বলবেন কোনদিন জেনো আর আমার সাথে ও যোগাযোগের চেষ্টা না করে।
–কিন্তু কেনো বাবা?
–আপনার মেয়ের হত্যাকারী ও আম্মা,আপনার কাছেই থাকলো,চাইলে যেকোনভাবে ওকে শাস্তি দিতে পারেন কিংবা ক্ষমা করে দিতে পারেন।কিন্তু আমার ভালোবাসা হত্যাকারীর সাথে আমি আর সংসার করতে পারবোনা।আমার কাছ থেকে দূরে থাকার যন্ত্রনাই ওকে শেষ করে দেবে।
একবার মেহেরার কবর জেয়ারত করে আমি এখনি রওনা দিতে চাই।আপনি ভালো থাকবেন।
‘সমাপ্ত’