সহধর্মিনী,২য়_পর্ব
লেখা: Shadbin ShaQil
— শরীরটা একটু সুস্থ লাগছে মেহেদি।হাসপাতালে ভালো লাগছে না,চলো বাসায় চলে যাই।
ঘুমের ঘোরে স্ত্রীর গলার ভয়েসে চমকে উঠি,কখন যে হাসপাতালের বারান্দার চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই জানিনা। পিছনে তাকিয়ে ঘুম চোখে উত্তর দেই,
— এখন তো অনেক রাত,সকালে যাই?
–না এখোনি যাবো মেহেদি,প্লিজ চলো।
–আচ্ছা আমি মিনার আর মেঘলাকে নিয়ে আসি।
কেবিনের বিছানা থেকে ঘুমন্ত মিনার আর মেঘলাকে কোলে নিতে যাবো, পিছন থেকে বোন মৌরি চেঁচিয়ে উঠে,
–কি করছো ভাইয়া?ওদের নিয়ে এতো রাতে কোথায় যাচ্ছো?
–মৌরি! তুই কখন এলি?তোর ‘ভাবী’…
বলতে যেয়ে থেমে যাই,গলা আটকে আসে।মনে পড়ে ঊর্মীতো পাশের কেবিনে আছে,একটু আগে ‘মেহেরার’ সাথে কথা বলেছি আমি!
মৌরিঃ রাতের ট্রেনে ঢাকা এসেছি,তোমাকে ঘুমন্ত দেখে জাগাইনি।
মোরি আমার কোল থেকে মেঘলাকে নামিয়ে শুইয়ে দিলো,কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল বিন্দুমাত্র ছিলোনা,মাথা ঘুরছে! না,এটা দুঃস্বপ্ন হতে পারেনা,মাত্র কথা বলেছি আমি মেহেরার সাথে,আবার দ্রুত বারান্দায় চলে আসি,কিন্ত চারদিক অন্ধকার খালি পড়ে আছে,প্রচন্ডভাবে মাথাটা ব্যথা শুরু হয়।এর মাঝেই একজন নার্স এসে ঊর্মীর গর্ভপাতের খবর দেয়,কিছুক্ষন আগে হাসপাতালের বাথরুমে পড়ে গেছে,জন্মের আগেই সন্তান পৃথিবী থেকে চলে গেছে,আমি শুধু এটুকুই তখন জানতে চাই,
–আমার স্ত্রী ঊর্মী সুস্থ আছে তো?
সেদিন রাতে আর কথা বলতে পারিনি, আমি,পরেরদিন বিকেলে ঊর্মীর কাছে যেয়ে অনেক অবাক হই।কালরাতে মেহেরা যেভাবে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছে,ঊর্মী ঠিক সেভাবে হাসছে।
–মেহেদি অনেক কষ্ট পেয়েছ, আমি বুঝতে পারি।তবে আল্লাহ্ আমাদের দুজন সন্তান দিয়েছে,যা হয়েছে ভুলে যাও।এখানে আর থাকতে চাইনা,বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা কর।আর মৌরিও আমাদের সাথে কিছুদিন থাকুক।
ঊর্মীর কথা শুনে আমার সাথে সাথে মৌরিও ঊর্মীর দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে ‘হুম’ বলি।
বাসায় আসার পর থেকে ঊর্মীর শরীরের সামান্য দূর্বলতা ছাড়া তেমন আর কোন সমস্যা হচ্ছিলো না,তবে যে জিনিশটা আমাকে অবাক করে তা হলো,ঊর্মী আর আগের ঊর্মীর মতো আচরণ করছেনা।সবকিছুতে আমার মনে হচ্ছিলো আমি মেহেরার প্রতিচ্ছবি দেখছিলাম।
ঊর্মী কোনদিন হিজাব পড়েনি কিন্তু হঠাৎ করে মেহেরার মতো নানা রঙের হিজাব পড়া শুরু করে,শুধু তাই নয়,সকালে টিভিতে টম এ্যান্ড জেরি দেখে বেশ উচ্চস্বরে হাসতে থাকে,এমনভাবে শুধু মেহেরাকেই হাসতে দেখেছি আমি।বাসার জানালার পর্দা থেকে শুরু করে,বিছানার চাদর এবং পাপসের পর্যন্ত রং বদলে ফেলে।কিন্তু ঊর্মী কখনো, না উচ্চস্বরে এভাবে হাসতো,না এমন কালার পছন্দ করতো।
অফিসের যাওয়ার পথে আজ নতুন করে কেউ কিটকাট চকলেট আর লাল গোলাপের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর, একদিন মেহেরার মায়ের বাসায় উপস্থিতি ঘটে।নাতিদের দেখতে ইচ্ছে হলেই মাঝে মাঝে এভাবে তিনি চলে আসতেন বাসায়।এসেই প্রথমে তিনি আমাকে তথ্য দিলো,
–এবার আমাদের সবাইকে একবার,মেহেরাদের বাড়ি যেতে হবে।মেহেরার কবরটা ভেঙে গেছে,কবরস্থান টা ঠিক করে বাঁধানোর সাথে সাথে মেহেরার নামে বাড়িতে মিলাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে।যার কারনে সবাইকে শরীক হতে হবে।আমার এই ব্যপারে অমত করার কোন প্রশ্নই আসেনা তাই আমার আর বাচ্চাদের সাথে সাথে মৌরিও যেতে বেশ উৎসাহ দেখায়।কিন্তু ঊর্মী শোনার সাথে সাথেই বেশ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠে,
–আম্মা এসব মিলাদ কিংবা দোয়া যাইহোক না কেন,কোন দরকার নেই এসবের।বন্যায় এরকম অনেক মানুষের কবর ভেঙে যায়,আর তাছাড়া এসব দোয়া পড়ানো শরীয়াত বিরোধী কাজ।
ঊর্মী মেহেরার মাকে আম্মা ডাকছে তাতে আমার কোন সমস্যা নেই।কিন্তু এরকম আচরনে যে আম্মা অনেক কষ্ট পেয়েছে তাতে আমার বিন্দু মাত্র সন্দেহ ছিলোনা।তাই আমিও তখনই বলে দেই,
–আমরা সবাই তো যাবোই,সাথে তুমিও যাবে ঊর্মী,এই বিষয়ে আর একটাও কথা শুনতে চাইনা আমি।
ঊর্মীর চোখে মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাই সেদিন।
গ্রামের বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে সময় ঠিক করে বাসের টিকিট কেটে ফেলি।সবাই মিলে বাসা থেকে নামতেই একটা কালো বিড়াল আমাদের সামনে থেকে দৌড়ে যায়,যে বিষয়টা ভালো লক্ষন না সেটা নিয়ে আম্মা আর মৌরি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে,আমি এসবকে কুসংস্কার বলে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাই।
আমার সাথে রাগারাগিকে কেন্দ্র করে বাসে ঊর্মী গোমড়া মুখে বসে আছে।যখনই কথা বলতে যাই,রাগন্বিত অবস্থায় আমার দিকে তাকায়,একবার এমন ভাবে তাকায় সাথে গাড়ির চাকা পামচার হয়ে যায়।পরক্ষনে আমি বলে উঠি,
–এমনভাবে এখনো রেগে আছো কেনো ঊর্মী?দেখলে মনে হয় ভূতে ধরেছে তোমাকে।
–হ্যা তোমার স্ত্রী মেহেরার আত্তা ভর করেছে আমার উপর।
আমি হেসে ঊর্মীর কাঁধে মাথা রাখি,আর ঊর্মী শান্ত গলায় প্রশ্ন করে,
–কাকে বেশি ভালোবেসেছ মেহেদি? আমাকে? নাকি মেহেরাকে?
–এটা কেমন প্রশ্ন? তুমিতো আগে কোনদিন এমন প্রশ্ন করোনি!
–আজ করছি! বলো…
–মেহেরার জায়গা মন থেকে মুছে ফেলতে পারবোনা,তবে এখনকার সময় অনুসারে তোমাকেই ভালোবাসি।
আমার কথা শেষ না হতেই চলন্ত বাস ব্রেক ফেল করে।হেল্পার সহ বাস ভর্তি মানুষের চিৎকার কানে ভেসে আসে।মিনার আর মেঘলাকে পাশের সিটে ধরতে যেয়েই কিছুর সাথে জোড়ে ধাক্কা খাই,কাচের জানালা ভাঙার শব্দ আসে,মাথা ঘুরে পড়ে যাই আমি।
পুরোপুরিভাবে জ্ঞান ফিরতে আমার ২ দিন সময় লাগে।কখন কীভাবে গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত এসেছি জানা নেই আমার,চোখ খুলে পাশে আম্মাকে দেখতে পাই।
–মেহেদি! বাবা,তোমার সাথে জরুরি কথা আছে আমার।
সাথে সাথে ঊর্মী রুমে প্রবেশ করে,
–আম্মা মেহেদি কে বিশ্রাম নিতে দিন,কথা পরেও বলা যাবে।
আম্মার চোখে মুখে এক ভয়ের ছাপ।
আমি ঊর্মীর দিকে তাকিয়ে বলি,
–ঊর্মী! মৌরি আর বাচ্চারা কোথায়?
–বাসে যত মানুষ ছিলো,তুমি ছাড়া বাকি সবাই সুস্থ আছে,তোমার মতো কেউ এতো আহত হয়নি।
–আমি কেনো হলাম?
–ভালোবাসার মানুষের সাথে প্রতারণা করেছ,শুকরিয়া করো এখনো বেঁচে আছো।
চলবে….