সহধর্মিনী,১ম_পর্ব
লেখা: Shadbin ShaQil
–“আশ্হাদু আল-লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ্দাহু-লা-শারীকালাহু ওয়া আশ্হাদু আন্না মুহাম্মাদান আ’বদুহু ওয়া রাসূলুহু।”
লাশ সাদা চাদরটা দিয়ে ঢেকে দিন খালা।
কথাগুলো দরজার ওপাশ থেকে শুনে বুকের ভিতরটায় হঠাৎ মোচর দিয়ে উঠে।চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে আসছিলো।আমার সহধর্মিনী-আমার স্ত্রী,আমার ভরসা,আমার স্বপ্ন,আমার ভালোবাসা ‘মেহেরা’আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।ঝাপসা চোখের জ্বল মাটিতে গড়িয়ে পরার আগেই বাড়ির পিছনের বাগানে হাঁটতে থাকি,মাটিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠি।মেহেরার শেষ ইচ্ছে ছিলো গ্রামের বাড়িতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাবে,সবসময় বলতো,
–মেহেদি আমি তোমার মৃত্যু চোখের সামনে কোনদিন সহ্য করতে পারবোনা,আল্লাহ্ জেনো আমাকে তোমার আগে নিয়ে যায়।
তখন কথাগুলোকে গুরুত্ব দিতামনা আমি।তবে এটুকু জানতাম মন থেকে কেউ কিছু চাইলে সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দেয়না।মরনব্যাধি রোগে দীর্ঘদিন অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় ছিলাম,কিন্তু মেহেরা প্রত্যেকটা সকাল প্রার্থনা শুরু করতো নিজের জীবনের বিনিময় আমার সুস্থতার জন্য,আল্লাহ্ তার দোয়া কবুল করেছে।আমি যতই দিন দিন সুস্থ হচ্ছিলাম,মেহেরার অবস্থা ততই খারাপ এর দিকে যাচ্ছিলো।কোনদিন বুঝতে পারিনি তুমি আমার এতো আগে চলে যাবে।তোমার পবিত্র হৃদয়ের দোয়াতে এতো শক্তি ছিলো বুঝতে পারিনি।
৬ বছর আগে কথা…
পড়াশুনা শেষ করে মিরপুর শেওড়াপারায় নতুন বাসায় উঠেছিলাম আমি,আম্মা আর ছোট বোন মৌরি।
একের পর এক চাকুরীর ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম।প্রতিদিনের মতো সেদিনো একটা ইন্টারভিউ ছিলো,গেট থেকে বের হতেই রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যজ্জ্বল বেগুনি রঙের হিজাবী মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে।বান্ধবীর সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলো।সত্যি বলতে সেদিন মেহেরার হাসি মাখা মুখের প্রেমে পড়ে যাই আমি।
আগে অনেক ইন্টারভিউ দিলেও সেদিনের চাকরিটা হয়ে যায় আমার।কেনো জানি মনে হয়েছিলো এই মেয়েটা আমার জন্য অনেক বেশী লাকি।
প্রতিদিন ভার্সিটির জন্য এভাবে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো মেয়েটা,আর আমিও ঠিক ওই সময়ে অফিসের জন্য বের হতাম।সবচেয়ে মজার বিষয় ছিলো মেহেরার বান্ধবী ঊর্মী আমাদের বিল্ডিং এ থাকতো,তাই প্রথম কথা আমার ঊর্মীর সাথেই হয়।মেহেরার নাম থেকে শুরু করে ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস এর সব খবরাখবর ঊর্মীর কাছ থেকেই পেতাম আমি।সাহস নিয়ে ভালোবাসি কথাটা বলতেও অনেক সময় লেগে গেছিলো,তবে এই বিষয়ে ঊর্মী আমাকে অনেক সাহায্য করেছে বলতে হবে।
দুজনের জীবনে পথচলা প্রেম থেকে শুরু হলেও দুই পরিবারের সম্মতিতেই বিয়ে হয় আমাদের।
বিয়ের পর থেকে আমার সকাল শুরু হতো চোখে আর গালে মেহেরার চুলের পানির ছোঁয়া পেয়ে,যেভাবে ঘাসের মাঝে শিশির বিন্দু লেগে থাকে ঠিক সেভাবে মেহেরার ছোঁয়া অনুভব করতাম।দিনশেষে ব্যস্ততার পর বাসায় এসে যখন মেহেরার হাসিমাখা মুখ দেখতাম সবকিছু ভুলে যেতাম আমি।
মেহেরা পড়াশুনা শেষ করলেও চাকুরীর জন্য চেষ্টা করেনি।আমি অবশ্য কোনকিছুতেই বাধা দিতাম না।ধনী পরিবারের কোন শিক্ষিত মেয়ে এতো সুন্দর সংসার গুছিয়ে রাখতে পারে তাও আমার জানা ছিলো না।
খুব ভালো রান্না করতে পারতো আমার স্ত্রী, মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করতো।অবশর সময় বই পড়তো,বাচ্চাদের মতো কার্টুন দেখতো, আর চকলেট খেতে খুব ভালোবাসতো।
আমি ভাবতাম! সামান্য লাল গোলাপ আর কিটকাট চকলেটে যে মেয়ে এতো খুশি থাকতে পারে,তার চেয়ে ভালো বউ আর কেউ হতে পারতোনা আমার।
আমার জীবন এতোই সুখের কাটছিলো যে, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম জীবনে সমস্যা বলতেও কিছু থাকতে পারে।
৪ বছরের সংসারে আমি ২ সন্তানের বাবা হই,ছেলে মিনার আর মেয়ে মেঘলা। মেঘলার জন্মের পর থেকেই মেহেরার অসুস্থতা বাড়তে থাকে।এই ২ বছরে শুধু দেশে না,দেশের বাইরেও যেয়েও মেহেরার চিকিৎসা করিয়েছি,কিন্তু লাভ হয়নি কোন।আরো বেশী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি গতবছর আম্মার মৃত্যুতে। ছোটবোনের বিয়ের পর খুব কম দেখা হতো আমার মৌরির সাথে।
মেহেরার মৃত্যুর ঠিক ৬ মাস আগে থেকে যে আমার পাশে ছিলো সে হলো মেহেরার সবথেকে কাছের বান্ধবী ঊর্মী।
যদি ও ঊর্মীর মেহেরার গ্রামের বাড়িতে হঠাৎ এমন উপস্থিতিতে অবাক হই আমি।পরে জানতে পারি ঊমীর হাজব্যন্ড এর সাথে ডিভোর্স এর পর থেকে বাবার বাড়িতে ছিলো।মেহেরার অসুস্থতার খবর পেয়েই চলে আসে এখানে।
নিজের ভালোবাসার স্ত্রীর খাটিয়া বহন করার চেয়ে, ইচ্ছে হচ্ছিলো আমি ও পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই।জানাজা শেষে লাশ দাফন করতে যেয়ে মনে হচ্ছিলো ভিতর থেকে হৃদয় কেউ চাকু দিয়ে টুকরো করছে।lএই যন্ত্রনা যে কতোটা কষ্টের তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা।
সবাই কবরের কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর কিছু সময় বসে থাকি মেহেরার পায়ের পায়েল টা হাতে নিয়ে।আমার দেয়া উপহারগুলোর মাঝে এই পায়েল খুব পছন্দের ছিলো মেহেরার,মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পায়ে পড়া ছিলো।খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো চিৎকার করে কান্না করি,কিন্তু পুরুষ মানুষদের এভাবে কাঁদতে নেই।হাতের লাল গোলাপ গুলো মেহেরার কবরের কাছে রেখে দেই।হঠাৎ আমার হাতটা একটা নারীর হাত স্পর্শ করে।
–এভাবে কবরে ফুল দিয়েন না মেহেদি ভাই,একে তো গ্রামের বাড়ি,হুজুররা নানারকম কথা বলবে,আর আমিও যতদূর জানি কবরে ফুল দিতে নেই।
ঊর্মী বেশ শান্ত গলায় কথাগুলো বলে,
–মেহেরা লাল গোলাপ খুব ভালোবাসতো,অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতিদিন ১ টা করে ফুল নিয়ে যেতাম, এখন আর কেউ অভিমান করবেনা ফুলের জন্য।শেষবার ভালোবেসে ফুল দিচ্ছি, পাপ হবেনা।
সারাক্ষন মেহেরার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করে যন্ত্রনায় ভুগতাম,নিজের ছেলেমেয়েদের খেয়াল পর্যন্ত রাখতে ভুলে গেছিলাম।তবে একথা সত্যি ঊর্মী আমার বাচ্চাদের খেয়াল রেখেছে।
সাধারভাবেই কিছুদিন যাওয়ার পর আত্নীয়-স্বজন সবার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো,আমাকে দ্বিতীয় বিয়ে করাতে হবে,আর যা ভেবেছিলাম তাই হয়েছে,সবাই আমার জন্য এই পরিস্থিতিতে উপযুক্ত পাত্রী হিসেবে ঊর্মীকে ভাবছে।
আমার পক্ষে মেহেরা’র জায়গা অন্য কাউকে দেয়া অনেক কঠিন, কিন্তু ঊর্মী বাচ্চাদের যতই ভালোবাসুক সৎ মা নামের একটা দাগ সেখানে থেকেই যাবে।
মেহেরার মৃত্যুর ৮ মাস পর অবশেষে ঊর্মীর মাতৃত্বর কাছে হার মানি আমি।
কথায় আছে,পুরুষ মানুষ বউ ছাড়া থাকতে পারেনা।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্ত্রী মারা গেলে তাকে বিয়ে করে দেয়া উচিৎ। জীবন জীবনের মতো চলছিলো কিন্তু বিয়ের ১ বছর পর আমার জীবনে নতুন সমস্যার শুরু হয়।
ঊর্মী তখন ৩ মাসের অন্তঃসত্তা। একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে দেখি ঊর্মী ড্রইং রুমে বসে আছে।টিভি ছেড়ে একের পর এক অনবরত চ্যানেল ঘুরাচ্ছে আর বিড়বিড় করে একা একা কিছু বলছে।আমি যেয়ে কিছু বলে উঠার আগেই রিমোট ছুড়ে আমার মাথা ফাটিয়ে দেয়।সেদিনের রাতের ঘটনা পরের দিনই ভুলে যায় ঊর্মী।শুরুটা এভাবে হলেও পরের দিনগুলো সমস্যা আরো বেড়ে যায়,ঘুমের ঘোরে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে ঊর্মী।আর বারান্দার দিকে ইশারা করে বলে,
–মেহেদি! মেহেরা আমাকে আর আমার সন্তানকে মেরে ফেলবে।
কোনকিছুতেই সান্তনা দিতে পারছিলাম না,তবে আমি অবাক হতাম কিছুদিন ধরে আমিও বাসায় বেশকিছু অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করি।
রাতে টিভি অফ করে ঘুমোতে গেলে সকালে দেখতাম টিভি অন হয়ে আছে,আর ‘কার্টুন নেটওয়ার্ক’ চলছে,মাথায় পুরোনো খেয়াল চলে আসে তখন,প্রতিদিন এই সময় সকালবেলা টিভিতে মেহেরা টম এ্যান্ড জেরি দেখতো।
গভীর রাতে রান্নাঘরের ট্যাপ বন্ধ করে আসার পরও ফোটা ফোটা পানির আওয়াজ ঊর্মীর মতো আমিও পেতাম।তবে আমি এসব জিনিস ইগনোর করলেও ঊর্মীর সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারন করে।
যেদিন মেহেরার পায়েল আমি ঊর্মীকে দিয়ে দেই সেদিনিই ঊর্মী পায়ে বড় ধরনের আঘাত পায়।
শুধু আমি আর ঊর্মী না,২ মাসের মাঝে মিনার আর মেঘলাও অসুস্থ হয়ে পরে।একই দিনে ঊর্মী,মেঘলা,আর মিনার কে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।মৃত ব্যক্তির আত্তা ফিরে আসে গল্প সিনেমাতে অনেক শুনেছি,কিন্তু চোখের সামনে ঘটে যাওয়া জিনিসগুলো বিশ্বাস করতে না চাইলেও চিন্তায় ফেলে দেয় আমাকে।
চলবে…..