#প্রতিহিংসার_অনুরক্তি-০৫
লেখিকা: সালসাবিল সারা
তিন বছর খুব কম সময় নয়।তিন বছরের এই কঠিনতম সময় অতিবাহিত করে জোহান আজ আবারও তার নিজের ঘরে ফিরে এসেছে সকল অভিমান ভুলে,
শুধুমাত্র তার মা-বাবার জন্যে।জোহান নিজের কাজে আজ বেশ অনুতপ্ত হচ্ছে।বিশাল গেইটের সামনে গাড়ি নিয়ে বসে রইলো সে এক ধ্যানে গেইটের পানে চেয়ে।তখনই তার গাড়ির জানালায় টোকা দিলো অনি,
–“আরে ভূতের মতো বসে আছিস কেনো, শালা?শরম লাগছে নিজের ঘরে ফিরে এসে?”
–“তোরা আগে যা।”
জোহানের গম্ভীর কণ্ঠ।
–“মামা,বাইক কি তোর গ্যারেজে পার্ক করে রাখবো?”
–“তো কি করবি?ওর বাইক নিয়ে কি আবার ঘুরতে যাবি?আমরা সিএনজি নিয়ে অফিসে চলে যাবো।”
অনির কথায় শালু জবাব দিলো।
–“তোদের যেমন ভালো লাগে তেমন কর।এখন বাসায় ঢুক।”
কথাটা বলে জোহান একবার হর্ন দিতেই সেই বিশাল গেইটের পাশের ছোট ফটক দিয়ে মাথা বের করলো দারোয়ান।জোহানকে দেখে মুচকি হেসে বড় ফটকের দুইধার সটান করে খুলে দিলেন উনি।প্রথম প্রবেশ করলো অনি এবং শালু।এর পিছু পিছু প্রবেশ করলো জোহানের গাড়ি।জোহান নিজের লাগেজগুলো নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।চারিদিক চোখ বুলিয়ে ধীর পায়ে ভেতরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে।আজ তার মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছে। নিজের বাড়িতে সারাজীবনের জন্যে ফিরে আসার প্রশান্তিতে জোহানের শরীরে একটা চাঙা ভাব এনে দিয়েছে।কলিং বেল চেপে সরু দৃষ্টি দিয়ে দরজার দিকেই চেয়ে রইলো সে।মিনিট দু-এক পরে তার মা দরজা খুলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। জোহানকে দেখে যতোই না অবাক হয়েছেন উনি তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে জোহানের সাথে থাকা তার লাগেজগুলো দেখে।জোহানের মা বুঝতে পেরেছে তার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। এইবার নিজের ছেলে মেহমানরুপী না বরং ঘরের একমাত্র ছেলে হিসেবে ফিরে এসেছে,এমনটা বুঝতে পেরে ফুপিয়ে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।জোহান ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো তার মায়ের পানে।
–“ভেতরে ঢুকবো?নাকি এইভাবেই কান্না করে যাবে?অদ্ভুত, মা।”
জোহানের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আনোয়ারা নিজের ছেলেকে বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।জোহান মুচকি হাসলো মায়ের এমন পাগলামো দেখে।
–“ফিরে আসলেও দোষ,চলে গেলেও দোষ। কান্নার কি আছে, মা?এইভাবে কাদলে কিন্তু আমি এখনই চলে যাবো।”
আনোয়ারা নিজের হাতের বাঁধন আরো শক্ত করলো,
–“আমার মৃত্যুর পরই তোর মন মতো কাজ করবি তুই।এর আগে না।”
জোহান আনোয়ারাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে,নিজের মায়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো,
–“সরি,মা।”
–“ভেতরে আয় বাবা। অনি,শালু তোমরাও আসো বাবা।”
আনোয়ারার কথায় সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো।অনি,
শালু ড্রইংরুমে আয়েশ করে বসলো।আর জোহান সোজা চললো তার বাবার কাছে।বাবার ঘরে কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকতেই জোহানের বাবা নিজের দুই হাত জোহানের দিকে এগিয়ে দিল,
–“জোহান!”
জোহান নিজের বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।জোহানের আজ ব্যাপক মন খারাপ লাগছে।এতো বছর সে কি ভুল করেছে,তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে।পূর্বেও সে এই বাড়িতে মা বাবাকে দেখতে এসেছে।কিন্তু,আজ সারাজীবনের জন্যে নিজের ঘরে ফিরে জোহানের মনে অন্য অনুভূতির জানান দিচ্ছে। নূর তাকে সেই কটু কথা না শোনালে আজও জোহান নিজের বাবা মায়ের সাথে বেহুদা জিদ নিয়েই বসে থাকতো এবং তার বাবা মায়ের এমন হাসিমুখটা আর দেখায় হতো না।
–“তোকে আমি আর যেতে দিবো না,জোহান।আমার বয়স হয়েছে,আমার এইভাবে নিজের ছেলে থেকে দূরে থাকতে মোটেও ভালো লাগে না।তোর সাথে যা করেছি আমি সব কিছুর জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি।”
নিজের বাবাকে জোহান থামিয়ে দিলো,
–“বাবা-মা কখনো ভুল হয় না,বাবা।সেই সময় আমি ঘটনার যথার্থতা থেকে অতিরিক্ত অভিব্যক্তি দিয়েছিলাম,যেটা আমার উচিত হয়নি।তুমি তো জানোই,আমার রাগ কন্ট্রোল করা বেশ মুশকিল।আমি দুঃখিত বাবা,সব কিছুর জন্যে সরি।আর কখনোই তোমাদের ছেড়ে আমি যাবো না।কোথাও না।”
জোহান তার বাবার হাঁটুতে মাথা রেখে মেঝেতে বসে রইলো।
জোহানের বাবার নয়ন অশ্রুসিক্ত।ছেলেকে ফিরে পেয়ে জোহানের বাবা যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন।ধীর গতিতে জোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন জোহানের বাবা।
অনি আর শালু বেশ আয়েশ করে নাস্তা চিবুচ্ছে।জোহান তার বাবার রুমে,বাবার সাথেই নাস্তা সারবে বলে জানিয়ে দিলো।সেইদিকে নাস্তা দিয়ে জোহানের মা ডাইনিং রুমে প্রবেশ করলো।শালু আর অনির উদ্দেশ্যে জোহানের মা বলে উঠলো,
–“এই ছেলের হঠাৎ কি হলো?কোনো খবর ছাড়াই চলে এসেছে বাসায়! তাও একেবারে!”
–“আন্টি, সবই নূরের কারিশমা।শুনেছিলাম জোহানকে নূর কিসব বলেছে,যার দরুণ জোহান রেগে তার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে এইখানে এসেছে।”
অনি ভরামুখে বললো।
–“আমার সোনার টুকরো নূর।আমি জানতাম এই মেয়ে একদিন এই অসাধ্য সাধন করবেই।কি বলে যে এই মেয়েকে আমি ধন্যবাদ জানাবো!আমার বুকের রতন আমার বুকে ফিরে এসেছে।আজ যেনো আমার ইদের দিন!”
–“সেই সোনার টুকরোকে আপনার ঘরের বউ বানিয়ে নিয়ে আসুন। এতেই আপনার ছেলের মঙ্গল হবে।”
শালুর জবাব।
–“নূর ই তো আমার ছেলের বউ হবে।তোমরা কি ভেবেছো,আমি আমার ছেলের মন সম্পর্কে জানিনা?সব জানি আমি।”
আনোয়ারার হাসিমুখের উত্তর।
–“তাহলে আর দেরী কেনো? যতো দ্রুত সম্ভব এই ঘরে নূর নামক লক্ষ্মী মেয়েটাকে নিয়েই আসুন।”
শালু আবারও বললো।
–“এতো সহজ না বাবা, তিন বছর আগের ঘটনা নিয়ে যেভাবে চটেছে জোহান;আল্লাহ্ ই জানেন এই ব্যাপারে তার কি মতামত এখন!”
–“কিসের মতামত?”
জোহানের প্রশ্নে ডাইনিং রুমে নিরবতা ছেয়ে গেলো।প্রসঙ্গ পাল্টাতে অনি দাঁড়িয়ে পড়লো,
–“শালু আর কতো খাবি?চল,ভাই।আজ অফিসে বেজায় কাজ,সেটা কি ভুলতে বসেছিস?”
–“ওহ, হ্যাঁ।আসি জোহান।তুই তোর সময়ে চলে আসিস।আন্টি আসি, আস্সালামুআলাইকুম।”
শালু হদতন্ত হয়ে বলে উঠলো।
–“ওয়ালাইকুম আসসালাম।সাবধানে যেও বাবা।”
অনি এবং শালু দ্রুত গতিতে হাঁটতে আরম্ভ করলো।
–“কিসের কথা বলছিলে মা তোমরা?”
–“কই কিছু না তো!এমনি তাদের পরিবারের খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম।”
আনোয়ারা উত্তর দিলো।
–“ওহ।আচ্ছা যা বলছিলাম, ঐ মেয়েকে বলবে না আমি এই বাসায় আছি।”
জোহানের থমথমে কণ্ঠ।
–“নূরকে?”
–“হ্যাঁ। ও যেনো না জানে আমি এই বাসায় চলে এসেছি।জানলে হয়তো এই বাসায় আর পা রাখবে না।আর তুমি তো তাকে দেখা ছাড়া থাকতেই পারো না।”
–“আর তুই?তুইও তো ওকে ছাড়া থাকতে পারিস না।প্রত্যেকটা দিন এক নজর হলেও নূরকে তুই দেখিস সশরীরে।এটা কিন্তু আমার মন বলে।”
আনোয়ারা মুচকি হাসলো।
–“আম..আমি কেনো সেই বেয়াদপ,মিথ্যুক মেয়েকে দেখবো?বেশি কথা বলো না তো মা।এমনি বলছিলাম আরকি,তুমি নূরকে বেশি আদর করো তাই।”
জোহান ইতস্ত হয়ে বললো।
–“ওহ! নূরের জন্যে অন্য ছেলে দেখছি তাহলে।বেচারীর বাবাও অসুস্থ।ছোট মেয়েটা আর কতদিন কষ্ট করে চলবে!ভালো একটা পরি…”
–“স্টপ, মা। ঐ মেয়ে শুধু আমার।ওর পাশে আমি কোনো ছেলেকে বাস্তবে তো দূরের কথা,কল্পনাও করি না।নূরকে আমি সেই আগে থেকেই চাই।”
জোহান সোজাসুজি জবাব দিলো তার মাকে।
জোহানের মা শব্দ করে হেসে জোহানের চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিলো,
–“ঘরের মেয়েকে ঘরের বউ বানিয়ে নিয়ে আসি?”
–“হুম, তা তো একদিন আনতেই হবে।কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।সে শর্ত পূরণে তুমি আর জহুরা আন্টি আমার সাহায্য করবে।নূরকে শুধু একটাই শাস্তি দিবো।এরপর সারাজীবনের জন্যে তোমার বৌমা হিসেবে নিয়ে আসবো তাকে।”
–“এইসবের কি দরকার?মেয়েটা এমনিও অনেক পেরেশানিতে থাকে।তার উপর এইসব?”
জোহান স্বশব্দে ডাইনিং টেবিলে হাত রাখলো,
–“তিন বছরের কোনো কিছু আমি ভুলিনি।বাড়িতে এসেছি,ভালো করে থাকতে দাও।আমার শর্ত মতোই কাজ হবে।নাহলে,আমি আবারও চলে যাবো এই বাড়ি থেকে।জোরপূর্বক তোমাদের আড়ালেই নূরকে বিয়ে করে সেই অ্যাপার্টমেন্টে থেকে যাবো।নূরকে তখন অনেক শাস্তি পেতে হবে,তোমাদের আড়ালে।রাজি তুমি এইসবে?”
জোহানের রাগী কণ্ঠ।
–“বুঝেছি বাবা।শান্ত হো তুই। যা বলবি তাই হবে জোহান।”
–“ভুলে যেও না মা। ঐ মেয়েকে আমিও ভালোবাসি।তার কদর আমি আরো বেশি করি। সন্ধ্যায় এসে শর্ত বলছি।এরপর জহুরা আন্টিকে রাজি করানো তোমার দায়িত্ব।নাহলে..”
–“আমি বুঝেছি,বাবা।”
–“কাজ আছে।যাচ্ছি।আল্লাহ্ হাফেজ।”
জোহান হনহন করে সম্মুখে পা বাড়ালো।
আনোয়ারা নিজের কপালে হাত রেখে বললো,
–“এই কেমন জিদ্দি ছেলে,মায়ের সামনে শর্ত রাখে!”
___________________
অনেকদিন পর নূরের আগমন ঘটলো ভার্সিটিতে।ভার্সিটিতে পা রাখা মাত্রই তার মস্তিষ্কে মেহরাব নামক মানুষটার কথা উঁকিবুঁকি দিচ্ছে।নূরের একটায় ভয়,
মেহরাব নূরের সম্মুখে এলে পমেল আবারও এইসব ঘটনা জোহানের কাছে পাচার করবে এবং জোহান এসে নূরকেই জলিল করবে।নূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চারদিকে তনয়াকে খুঁজতে লাগলো,
–“এই মেয়েকে বললাম সময়ের পূর্বে আসতে,আর এই মেয়ের কোনো খবরই তো দেখছি না।”
ব্যাগ থেকে নূর মোবাইল বের করে তনয়াকে ফোন দিতে নিলেই সেই পুরুষালি কণ্ঠ শুনতে পেলো নূর,যেই কণ্ঠ সে ঘুণাক্ষরেও শুনতে চাইনি,
–“হেই মহিয়সী নারী,এতদিন কেনো পায়নি তোমার দেখা; শুনি?”
নূর কোনো বাক না নিয়ে সোজা চলে আসতে নিলে আবারও মেহরাব বলে উঠলো,
–“ওহে নারী,তোমার মুখটা আজ বন্ধ কেনো,শুনি?”
মেহরাব এর কথায় এইবার কিছু অট্টহাসির শব্দ শুনতে পেলো নূর।নিজের এমন অপমান নূর কিছুতেই মুখ বুঝে সহ্য করতে পারলো না।পেছনে ফিরতেই সে দেখতে পেলো, মেহরাব এর সাথী হিসেবে কয়েকজন যুবক মোটর সাইকেল নিয়ে বসে আছে তার সাথে।নূর গলা খাঁকিয়ে মেহরাবকে জবাব দিলো,
–“এমন বাজে কবি এবং বাজে কবিতা আমার জীবনে আমি একটাও দেখিনি।”
নূরের কথায় সেই ছেলেগুলো মেহরাবের দিকে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে উঠলো।মেহরাব নিজের হাসিমুখ বন্ধ করে নূরের সম্মুখে আসতে নিলে নূর সামনে হাঁটতে আরম্ভ করলো।মেহরাব এসে আড়াল করে দাঁড়ালো নূরের সামনে,
–“এতো সহজে যেতে দিচ্ছি না।”
–“এই ছেলে,তুমি আমার কি হও? আমি তোমার কথায় থেমে থাকবো?”
কথাটা বলে নূর এগোতে নিলে মেহরাব এক হাত এগিয়ে দিয়ে থামালো নূরকে,
–“তুমি আমার চ্যালেঞ্জ।তোমাকে জিততে আমি তোমার সব হবো।প্রয়োজনে..”
–“প্রয়োজনে কি?এক চড় দিয়ে দুনিয়ার আয়েশী সব ভুলিয়ে দিবো।”
নূর তার এক হাত তুলে বললো।
নূর আরো কিছু বলতে যাবে,তখনই সে পমেলকে আসতে দেখলো।অতঃপর নূর মেহরাবকে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে নিজে সেই জায়গা থেকে দ্রুত গতিতে আরম্ভ করলো ছুটতে।মেহরাব নূরের ছুঁয়ে দেওয়া স্থানে নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলতে লাগলো,
–“চ্যালেঞ্জ এর পাশাপাশি তুমি এখন আমার জিদে পরিণত হচ্ছো,মিস নূর।তোমার এই বাঘিনী রূপটা আমার বেশ প্রিয়। আই লাইক ইট।”
মেহরাব এর মুখে রহস্যময়ী হাসি।
নূর পমেলের সামনে গিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। পমেল বিচলিত হয়ে নূরকে প্রশ্ন করলো,
–“কি হয়েছে ভাবীপা তোমার?”
–“কি হবে?কিছু না।”
পরপর দুইটা শ্বাস ফেলে বললো নূর।
–“ওহ,আমি না তোমাকে খুঁজতে এসেছি এইদিকে। তনয়া আপু বললো,তুমি হয়তো ক্যাম্পাসে চলে এসেছো।তোমাকে যেনো তার কাছে নিয়ে যায় আমি।”
–“কেনো?ওর কি হলো?ফোন করেই তো বলতে পারতো আমাকে এই কথাটা।”
–“পায়ে নাকি কিসব ব্যথা পেয়েছে।আর আপুর মোবাইলে চার্জ নেই।”
নূরের পাশাপাশি মেহরাব চলতে চলতে বললো।
–“আচ্ছা,দ্রুত চলো।”
তনয়ার কাছে নূর পৌঁছাতেই পমেল বিদায় জানালো।
–“কি হয়েছে পায়ে?”
নূরের চিন্তিত কণ্ঠ।
–“হালকা মোচড় লেগেছে।আর কিছুই না।একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু,তোর কি হলো? তুই চিন্তিত কিছু নিয়ে?”
–“কি নিয়ে চিন্তিত হবো না বল তো?একে তো জোহান ভাই আর আমার সম্পর্কের কোনো উন্নতি নেই,তার উপর ঐ মেহরাব নামের ছেলেটা আজকেও খারাপ ব্যবহার করলো আমার সাথে।আমি যদি সরে না আসতাম,তাহলে পমেল আমাকে দেখতো মেহরাবের সাথে আর এই খবর পেয়ে যেতো বিখ্যাত তিতামুখী জোহান ভাই।এরপর বুঝিস তো কি হতো আমার সাথে বা সেই বাজে ছেলেটার সাথে?”
নূরের মুখে বিরক্তির ছাপ।
–“উফ,তোর আর জোহান ভাইয়ের এমন দূরত্বের ভালোবাসা দেখতে আমি বেশ লাগে।আর যতটুক আসছে সেই ছেলের কথা।আরেকবার কিছু করলে সে,আমি নিজেই তার নাক-মুখ ভেঙে দিবো।তবে একটা জিনিস আমার বেশ ভালো লাগলো।”
–“কি?”
নূরের প্রশ্নমাখা কণ্ঠ।
–“এইযে এতদিনে তুই স্বীকার করেছিস তোর আর জোহান ভাইয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।”
নূরের মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়ে এলো,
–“বেশি বুঝিস!”
–“সবই বুঝি রে নূর।এইবার আমাকে ধর।ক্লাসের দেরী হচ্ছে।”
নূর মুচকি হেসে তনয়াকে উঠিয়ে ক্লাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
–“আমার তিতামুখীর সাথে আমার সম্পর্ক বেশ পুরানো,আর এই সম্পর্কে স্মৃতি জুড়িয়ে আছে হাজারো।”
নূরের মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠলো জোহানের কথা ভাবতেই।
__________________
ভার্সিটি থেকে এসেই নূর ঘুমিয়ে পড়েছিলো।আগে এই সময়ে ঘুমানোর সৌভাগ্য নূরের হয়নি।কিন্তু আজ থেকে জোহানের মায়ের নির্দেশে সকল টিউশন বন্ধ রেখেছে সে।প্রথমে নূর অমত জানালেও পরে জোহানের মায়ের কান্নার কাছে হার মানলো নূর। গতকালই নূর সকল টিউশনকে বিদায় জানালো।
খানিকক্ষণ পূর্বে তার মা কিছু সঙ্গত কারণে তাকে ডাকলেও সে কোনো রেসপন্স করেনি।কিন্তু এখন মোবাইলের রিংটোনে তার ঘুম যেনো চিরবিদায় জানিয়েছে। নূরের গভীর নিদ্রা ভাঙলেও নূর চোখ বন্ধ রেখে ফোন কানে ধরলো,
–“কে?”
–“তোর আনোয়ারা আন্টি।তোর মায়ের সাথেই এতক্ষণ কথা বলছিলাম।আমার নূর কি ঘুমাচ্ছিলো?”
–“হুম,আন্টি।বড্ড ক্লান্ত ছিলাম।”
–“আচ্ছা এইবার উঠে হাত মুখ ধুয়ে নে।আমি গাড়ি পাঠিয়েছি।জারা আর তুই ফটাফট চলে আয়।তোর মাকেও বললাম আসতে।কিন্তু,তোর বাবার জন্যে জহুরা আসবে না বলে জানালো।”
নূরের অক্ষিজোড়া অল্প খুলে ঘড়ির কাটায় চোখ বুলিয়ে আবারও বন্ধ হয়ে গেলো,
–“আন্টি,সন্ধ্যা ছয়টা বাজে।এখন যাবো তোমাদের বাসায়?কেনো?”
–“আরে বাবা,উঠে পড় তো।বিরিয়ানি রান্না করলাম। মেয়ে দুইজনকে ফেলে তো খাওয়া যায় না।উঠে পড়, জলদি।”
নূর আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো।কিন্তু তার অক্ষিজোড়া এখনো খুলতে নারাজ।বিকালের সময়টা মানুষের জন্যে তৃপ্তিময় মনে হলেও,বিকালের ঘুমটা নূরের কাছে নেশার মতো মনে হয়।এই ঘুম থেকে যেনো নূরের নয়নজোড়া সজাগ হতে চাই না।শুধু বলতে চায়,
–“আরেকটু ঘুমিয়ে নে,নূর।”
এমনটা ভাবতে ভাবতে নূর পুনরায় নিদ্রায় শায়িত হলো।
গাড়ি চলে আসায় নূরকে তার মা টেনে-হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে বলে উঠলো,
–“গাড়ি চলে এসেছে।এখনো কি ঘুমাবি?”
নূর চমকে উঠে দ্রুত চললো বাথরুমের দিকে।হাতমুখ ধুয়ে নতুন জামা গায়ে চড়িয়ে জারা সমেত নূর গাড়িতে উঠে পড়লো পনেরো মিনিটের মাথায়।
নূরের নয়নে এখনো ঘুমের আভাস।চোখজোড়া যেনো তার বটে আসছে।
‘
জোহান অফিস থেকে ফিরেই তার মায়ের সাথে কিছু জরুরী কথা বলার জন্যে তার মায়ের ঘরে প্রবেশ করলো।জোহানকে দেখে আনোয়ারা বলে উঠলো,
–“এসেছিস?”
–“হুম।তুমি আন্টিকে বলেছো?”
–“বলেছি।তোর আন্টি খুব দুঃখ পেয়েছে তোর এই শর্ত শুনে।”
–“পাওয়াটাই স্বাভাবিক।আন্টিকে বলে দিও,দুঃখের পর সুখ আসে।আন্টির মেয়েকে আমি বেশি কষ্ট দিবো না।আন্টির মেয়ে আমার জন্যেও অনেক জরুরী।আমার প্রথম অনুরক্তি সে।”
জোহানের সোজা উত্তর।
–“এতো যখন ভালোবাসিস,তাহলে সেইসব করা কি খুব দরকার?”
আনোয়ারা রেগে বললো।
–“সবই দরকার।কোনো কাজ নিজে না করেও সেটার শাস্তি পাওয়াটা কেমন হয়,এটা নূরের বুঝতে হবে।বাদ বাকি ঐ নিশিকেও আমি ছাড়বো না।কিন্তু,আমার জন্যে মুখ্য হলো আমার পরিবার।আর আমি অতি দ্রুত নূরকে এই বাড়িতে এনে আমার পরিবার সম্পূর্ণ করতে চাই।”
নিজের বক্তব্য শেষ করে জোহান আনোয়ারার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো।
আনোয়ারা আহত চোখে জোহানের চলে যাওয়া দেখছে।আনোয়ারার বুঝতে বাকি নেই,ছেলের জিদের কাছে এইবারও তাকে মুখ বুজে সব সহ্য করতে হবে তাকে।
–“সবকিছু এলোমেলো করেও যদি তুই নূরকে নিজের কাছে আটকে রাখিস,তোদের ভালোবাসার পূর্ণতা পায়;তাহলে আমি সর্বদা তোর পাশে আছি জোহান।আর আমার বিশ্বাস,তুই নূরকে কখনো নিজ থেকে দূরে সরিয়ে দিবি না।”
আনোয়ারা এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘
নূর সোফায় শুয়ে রইলো।তখনকার কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণে এখনো সে ঘুমে ঢুলুঢুলু। জারা এবং আনোয়ারা টিভি দেখছে।নূর এবং জারা তাদের বাসায় এসেছে মিনিট দশেক পূর্বে।নূর এসে আনোয়ারার সাথে কুশল বিনিময় করেই সোফায় শুয়ে ঝিমুচ্ছে।
–“জারা ফেইরী,কেমন আছো?”
জোহানের কণ্ঠস্বর শুনে নূরের অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো।ধরফর করে উঠে সোফায় বসতেই সুঠাম দেহী জোহানকে দেখতে পেলো সে।
–“জোহান ভাইয়া!”
জারা এক দৌড়ে জোহানের কোলে উঠে পড়লো।
–“ভালো আছি।তুমি?”
–“উম,ভালো।”
জোহান কথাটা বলে নূরের দিকে ফিরলো।নূরের মুখ এবং চোখ ঘুমের কারণে বেশ মায়াময়ী দেখাচ্ছে।জোহানের মনে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো নূরকে দেখে। নূর জোহান থেকে নজর ফিরিয়ে মাথা নিচু করে বসলো,
–“এই ছেলে এইখানে কিভাবে?আন্টি আমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেনি।যদি জানতাম এই তিতামুখী এইখানে,তবে আমি নিজে কখনোই আসতাম না এইখানে।এক মিনিট,এই ছেলে কি এখনই গোসল করেছে?”
নূর পুনরায় জোহানের দিকে তাকালো।জোহান এর হাত,পা,গলা এবং চুলে পানির আভাস পাওয়া যাচ্ছে।জোহানকে দেখতে একেবারে স্নিগ্ধ মনে হচ্ছে নূরের কাছে।নূরের চোখে ঘোর লেগে যায়।পলকহীন চেয়ে রইলো সে তার তিতামুখীর পানে।তার মনের ভাবনা,
–“এই সুন্দর মানুষের মুখের ভাষা কিভাবে এতো খারাপ হয়?জোহান ভাই এইখানে গোসল করেছে,তার মানে সে এইখানে ফিরে এসেছে?”
নূরের মনের প্রশ্নে ইতি ঘটলো আনোয়ারার কথায়,
–“তোরা বস,আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি।”
–“আন্টি, আমি পানি খাবো।”
–“আয়,জারা পরী।”
জারা আনোয়ারার সাথে চলে গেলো।নূর ইতস্তত হয়ে উঠে পড়লো সোফা থেকে।
তার দিকে জোহানের নেশাযুক্ত চাহনী নূরের গায়ের উত্তাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে।সে নিজে নিজে আওড়ালো,
–“আমিও পা..পানি খাবো,আন্টি।”
নূর এক কদম এগোনোর পূর্বেই জোহান এসে পথ আটকে দিলো নূরের,
–“দিনে বেঘোরে ঘুমিয়ে, রাতে ছেলেদের ঘুম হারাম করা হয়?”
নূর তাজ্জব বনে গেলো।তার মনে জোহানের জন্যে কতো সুন্দর একটা জায়গা আছে,আর জোহানের এমন ব্যবহারে সেই জায়গা থেকে নূরের ইচ্ছা হলো জোহানকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে।কিন্তু,নিজের মনের কাছে বারবার হেরে যায় নূর।তার জন্যে তার ভালোবাসার মানুষটি হলো জোহান।হোক না সে তিতামুখী,তারপরও সে জানে জোহানকে নূর কতটা চায়!
–“আ..আমি যায় করি,তোমার সমস্যা কি এতে?বারবার বলি সবাইকে নিজের মতো ভাববে না।”
–“আমার অনেক সমস্যা। তুই ই আমার প্রধান সমস্যা।এখন তো আমি এই ঘরে চলে এসেছি।তাই,রাতারাতি মেয়েবাজি করি,তোর এইসব কথা এখন একেবারে বেমানান।”
জোহান নূরের দিকে ঝুঁকে বললো। নূর একটু পিছু হটলো,
–“আমি কি করবো তাতে?তোমার বাসায় তুমি এসেছো।তাছাড়া তুমি কি করবে না করবে এটা তোমার ব্যাপার।আমার না।আমাকে অহেতুক দোষ দেওয়া বন্ধ করো।”
–“জোহান,নূর খেতে আয়।”
–“জরুরি কথা বলছি নূরের সাথে।তোমরা শুরু করো,আমি আর নূর আসছি।”
জোহান তার মায়ের কথায় বলে উঠলো।
জোহান নূরের বাহু চেপে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো,
–“কোন ছেলের সাথে ঘুরিস বল তো?রাতারাতি কার সাথে প্রেম করিস?”
–“আশ্চর্য তো!আজ পর্যন্ত দিনের বেলা কারো সাথে প্রেম করলাম না,আর তুমি বলছো রাতারাতি প্রেম করি?এখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্যে কি রাতের বেলা তোমার সাথে এসে থাকতে হবে?”
নিজের কথায় নূর নিজেই বোকা বনে গেলো।নূর নিচের ঠোঁট চেপে ধরে নিজের কপালে হাত রাখলো।জোহান বাঁকা হাসি দিয়ে নূরের কোমর চেপে তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো।নূর জোহানের বুকে হাত ঠেকিয়ে নিজেকে দূর করতে চাইছে জোহানের খপ্পর থেকে।
–“খুব শখ আমার রুমে আসার?হাহ?এতো শখ?আচ্ছা তোর এই শখ শীগ্রই পূরণ করে দিবো।”
নূর এতো লাজ কখনো অনুভব করেনি।জোহানের প্রত্যেক কথায় যেনো তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।জোহান নূরের এমন লাজমুখ দেখে নিজেকে সামলাতে না পেরে নূরের মাথায় নিজের অধর ছুঁয়ে দিলো।জোহানের মুখে ভালোবাসাময় হাসি।নূর মাথা নিচু করে রাখায় জোহানের এমন রূপ দেখা থেকে বঞ্চিত হলো।আনোয়ারা আবারও নূর এবং জোহানকে ডেকে উঠলে নূর নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো জোহান থেকে,
–“আমি মরে গেলেও তোমার রুমে আসবো না।অসভ্য,
তিতামুখী।”
–“জীবিত অবস্থায় নিয়ে আসবো, মরতে হবে না।”
জোহানের সোজা জবাব।
নূর জোহানের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে জোহানের পায়ে নিজের পা দ্বারা চাপ দিয়ে ডাইনিং এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
জোহান নূরের ভাবনায় ডুবে আছে।নূরকে নিজের করে নিতে জোহানের একটুও অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না।কিন্তু,নিজের ভেতরকার জিদের কাছে জোহান বারবার পরাজিত হয়ে যায়। নূর তার ভালোবাসার পাশাপাশি তার প্রতিহিংসাময় একটা জিদ।
–“কাল তোমার জন্যে বিশাল এক সারপ্রাইজ আছে,নুড়িপাথর।কালকের দিন হবে,আমার জিদ পূরণ আর তোমাকে নিজের করে নেওয়ার প্রথম ধাপের শুরু।জোহানের প্রতিহিংসামূলক ভালোবাসার প্রথম পদক্ষেপে তোমাকে স্বাগতম,ভবিষ্যতের জোহানের অর্ধাঙ্গিনী উরফে নূরিয়া নূর!”
জোহান নিজের মনের এমন পরিকল্পনায় বেজায় খুশি।
চলবে…..