#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা ❤️সিজন_২,পর্ব_৩১
#সাহেদা_আক্তার
আমাকে দেখে ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে প্রকাশ করল না। ক্লাস শেষ হতেই বাইরে এসেই আকাশকে কল দিল।
– হ্যালো, ভাইয়া, কেমন আছো?
– হুম আলহামদুলিল্লাহ। তোর কি অবস্থা?
– ভালো। কিন্তু একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।
– তাই নাকি? কি? আজকে তো তোর ভার্সিটি টিচার হিসেবে জয়েন করার কথা।
– হ্যাঁ, আর আমি কাকে দেখেছি তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না।
– কাকে দেখে এত উত্তেজিত হয়ে গেছিস?
– ভাবিকে।
– হোয়াট? না না, মজা করছিস। ছোঁয়া নেই আয়ান। তুই…
– আমি সত্যি বলছি। এবং সে এখানে পড়ে।
– তুই ভুল দেখেছিস। এটা কি করে…
– এটাই। ওকে দাঁড়াও। আমি তোমাকে ভিডিও কল দিচ্ছি। কোনো কথা বোলো না। ওকে?
– হুম।
আয়ান আকাশকে ভিডিও কল দিল। ব্যাক ক্যামেরা ওপেন করে ক্লাসের সামনে গিয়ে জানালা দিয়ে ফোন ধরল। আমি তখন সাহেদার সাথে আয়ানকে নিয়ে মজা করছি। আমাকে দেখে ও একমুহূর্তের জন্য আটকে গেল। তারপর হঠাৎ করে বলে উঠল, আয়ান ওর কাছে ফোন নিয়ে যা। আয়ান ওর কথা শুনে সাথে সাথে জানালা থেকে সরে এসে ফোন কেটে দিল। ভয়েজ কল দিয়ে বলল, রিল্যাক্স ভাইয়া।
– কি করে রিল্যাক্স হবো!? ও ছোঁয়া। আমি এখুনি আসছি। ওয়েট।
– এই না না না। আমি আরো খোঁজ নেই। অপেক্ষা করো।
– হ্যাঁ। কর। একই দেখতে দুজন মানুষ থাকতেই পারে। তুই আজই খোঁজ নে।
– হুম, ডোন্ট ওরি ব্রাদার।
– হুম।
আয়ান ফোন কেটে দিল। আকাশ ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে রইল। বাংলাদেশে থাকবে বলে আবার ডাক্তারী শুরু করেছিল ও। চেম্বার শেষ করে যতদ্রুত সম্ভব বাসায় চলে আসল। কলিংবেল টিপতেই রেদোয়ান দরজা খুলে বলল, কেমন গেল আজ?
– ভালো, পর্ষী কোথায়?
– ঘুমিয়ে গেছে।
আকাশ পর্ষীর রুমে এল। মেয়েটা কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। কোনোকিছু জড়িয়ে না শুলে ঘুমাতে পারে না। এই দুমাস এভাবেই ঘুমানোর অভ্যাস করে নিয়েছে। আকাশ হালকা ডেকে বলল, আম্মু? রেদোয়ান বলল, মেয়েটা মাত্র ঘুমালো।
– ইট’স আর্জেন্ট। পর্ষী আম্মু।
পর্ষী ওর ডাকে জেগে গেল। উঠে বসে চোখ ঢলতে ঢলতে বলল, কি আব্বু? আকাশ ওর পাশে বসে বলল, তুমি তোমার আম্মুকে দেখেছিলে?
– হুম আব্বু।
– কোথায়?
– আমাদের নাচের ম্যাডামের সাথে। এ জন্য আমি নাচের স্কুলে ভর্তি হয়েছি।
– তাই? তারপর আর দেখেছো?
– হুম। আম্মু ওখানেই ছিল। কিন্তু খালামনি আমাকে নিতে আসতেই কোথায় যেন চলে গেল।
– তোমাদের ম্যাডামের নাম কি আম্মু?
– সাহেদা ম্যাম।
– আচ্ছা। এখন ঘুমাও।
– আব্বু?
– হুম।
– আম্মু আসবে না আমাদের কাছে?
– আসবে তো। ওয়ানা প্লে এ গেম?
– হুম হুম।
– ওকে। এখন ঘুমাও, কালকে থেকে আমরা একটা গেম খেলবো।
– কি গেম আব্বু?
– তোমার আম্মুকে ফিরিয়ে আনার গেম।
– সত্যি?
– তিন সত্যি।
পর্ষী খুশিতে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই আকাশ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ও ঘুমিয়ে পড়লে রেদোয়ানকে নিয়ে রুমের বাইরে চলে এল। এতক্ষণ মুন রুমের বাইরে থেকে সব শুনছিল। আকাশ বেরিয়ে আসতেই জিজ্ঞেস করল, এসব কি বললে!?
– ঠিকই বলেছি।
– কিচ্ছু ঠিক বলোনি। মেয়েটাকে মিথ্যা আশা দেওয়া ঠিক হয়নি। ছোঁয়া নেই। এটাই সত্যি।
আকাশ ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল, আমাকে এটা খুঁজে বের করতে হবে। ওর ফোনে ভিডিও কলের একটা স্ক্রিনশট রয়েছে যেখানে আমি সাহেদার সাথে কথা বলছি। মুন দেখে অবাক হয়ে বলল, এটা কে!?
– সেটাই দেখার বিষয়।
– কিন্তু কিভাবে!? আমরা আমরা…
– আমরা মুখ দেখিনি মুন। লাশ দেখেছি। তাই আমাকে সবটা জানতে হবে। সত্যিই কি ছোঁয়া মারা গেছে? না এই মেয়ে কেবল ছোঁয়ার মতো দেখতে?
মুন আর রেদোয়ান শক কাটিয়ে উঠতে পারছে না। আকাশ নিজের রুমে চলে গেল। অপেক্ষায় রইলো আয়ানের জন্য।
সকালে আয়ান থেকে একটা ম্যাসেজ এল। নাম্বার একটা। ম্যাসেজে লেখা, এই নাম্বারটা ছোঁয়ার নাম্বার হিসেবে অফিসে লেখা ছিল। আকাশ নাম্বারটা ডায়াল কলে তুলে নিল। কতক্ষণ ধরে নাম্বারটা দেখতে লাগল। ভেতরে অস্থির লাগছে। সত্যি ছোঁয়া তো? ফোন করবে কি করবে না করতে করতে ফোন করে ফেলল। তখন আমি মাত্র বাসা থেকে ভার্সটির জন্য বের হচ্ছি। ফোন ধরতেই ও চুপ করে রইলো। আমি হ্যালো হ্যালো করছি। কোনো আওয়াজ না পেয়ে কেটে দিলাম। আমার কন্ঠ শুনে ও ঠাঁই বসে রইলো বিছানায়। শিউর হয়ে গেল এটা আমি। তারপর উঠে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। আধা ঘন্টা পর আবার ফোন দিয়ে বলল, ভালোবাসি।
তারপর সে আমাদের ভার্সিটিতে গেস্ট টিচার হিসেবে দুই মাসের জন্য এল। পাশের বাসায় এসে উঠল। পর্ষী আর আকাশ এমন ভাব করতে লাগল যেন তারা কেউ কাউকে চিনে না। কারণ স্বভাবতই যদি বলা হয় আমার বিয়ে হয়েছে এবং এত বড় বাচ্চা আছে অবশ্যই আমি বিশ্বাস করব না।
আকাশের সব কাহিনী বলা শেষ হইতেই আমার মাথায় সব জটপাকাই গেল। আসলে জট পাকানো না জটটা এতটাই স্বচ্ছ হয়ে গেল যে আমার মাথা হ্যাঙ হইয়া গেল। আকাশ কইলো, তারপর আস্তে আস্তে সব খবর নিয়ে জানতে পারি সবকিছুর পেছনে রাতুল আর চাদনি রয়েছে। আমি চুপ কইরা রইলাম। তারপর কইলাম, আমাকে রুমে যেতে হবে।
– ছোঁয়া…
– প্লিজ… আমার সময়ের প্রয়োজন।
আমি রুমে চইলা আসলাম৷ সব শোনার পর নিজেকে কেমন যেন লাগতেসে। কি বিশ্বাস করে এতদিন ছিলাম আর কি ছিল! ঘোলাটে অন্ধকার থেকে আলোতে আসায় চোখে সইছে না। মনে হচ্ছে ঘোলাটে অন্ধকারই ঠিক ছিল।
.
.
.
.
ঘুম আসছে না। এপাশ ওপাশ করতেসি। রাতে খাওয়া দাওয়াও করি নাই। এখন রাত একটা বাজে। এই রাত বিরাতে পেটটা ডাকতেসে ষাঁড়ের মতো। কি করা যায়! সবাই তো ঘুমে। আমি উঠে গিয়া দরজাটা ফাঁক করলাম। সবাই ঘুমাচ্ছে যে যার মতো৷ যাক, এবার খানাটা নিয়া কাইটা পড়লেই হয়। ফ্রিজ খুইলা আমার লালু মিয়ার থইলাটা নিয়া মাত্র রুমে ঢুকতেসি। এমন সময় রাতুল ডাক দিল। পিছন ফিরে দেখি সে নিজের রুমের সামনে দাঁড়াই আছে। ফ্রিজ খোলার শব্দে বের হই আসছে। তার মানে ঘুমায় নাই।
সে কিছু বলার আগেই রুমে ঢুইকা দরজা মাইরা দিলাম। এতকিছুর পর আমার এখন কথা বলার মুড নাই। রাতের আন্ধারে ফকফকা লাইট জ্বালাইয়া বসলাম টেবিলটায়। লালু মিয়াকে এক কামড় দিতেই হঠাৎ আকাশের নীল ডায়রীটার কথা মনে পড়ল৷ ও বলল ও আমাকে ভালোবাসে তাহলে ডায়রীতে কার কথা বলল? আমি লালু মিয়া খাইতে খাইতে ড্রয়ারের ঘুপচি থেকে ডায়রীটা বের করলাম। পৃষ্ঠা উল্টাতে দেখলাম কি সুন্দর করে লেখা! ডায়রীতেও কেউ এত সুন্দর কইরা লেখে? হেডলাইন দিয়া লিখসে রচনার মতো। আহা! আমার গাজরের হাতের লেখা! কি সুন্দর! নিচের দুই গালে থাপড় দিয়া কইলাম, কনসেন্ট্রেট ছোঁয়া, কনসেন্ট্রেট। আমি পড়া শুরু করলাম।
পড়তে পড়তে গাল দুইটা ওর মতোই লাল হই গেল। গাজরটা একটা মিচকা শয়তান। দেখতে কি ভদ্র। যেন ভাজা মাছ উল্টাই খাইতে জানে না। আর ভেতরে ভেতরে ভাজা মাছ না শুধু ভাজা গরুও একলাই উল্টাই খাইতে পারবে। হুহ।
লেখা পড়া শেষ হইতেই মনে মনে হাসতে লাগলাম। আরেক পৃষ্ঠা উল্টাতে দেখলাম আমাদের দুইজনের একটা ছবি। দুষ্টুমি কইরা তোলা। ছবিটা দেখেই মনে হইলো অনেক ভালো একটা মুহূর্তের তোলা।
আমি ভাবছিলাম এখানেই লেখা শেষ। তাই এমনিই পৃষ্ঠা উল্টাইতেছিলাম যদি আর কোনো ছবি থাকে। হঠাৎ দেখলাম ডায়রীর শেষের দিকে আরো কিছু লেখা আছে। শিরোনাম পইড়া এক মুহূর্ত থামলাম। তারপর পড়া শুরু করলাম।
(ডায়রী)
💔 তুমিহীনা আমি:
কতদিন পর লিখতে বসলাম গুণতে ইচ্ছে হচ্ছে না আজ ছোঁয়া। হবে সাত আট বছর বা তার থেকেও বেশি। যখন তুমি আমার কাছে ছিলে না। তোমার পাগলামো গুলো লিখে রাখতাম এখানে। কিন্তু আজ দুটো দিন পার হয়ে গেছে তুমি নেই। কেউ এসে বলে না আজ টাওয়ালটা নাওনি কেন ওয়াশরুমে? কেউ বলে না মেয়েটা আছে দেখবে। আমার মাথার পাশের বালিশটা খালি পড়ে আছে। বুকটা তোমার খোঁজ করছে ছোঁয়া। তোমাকে বুকে টেনে না নিলে আমার বুকটা যে ফাঁকা হয়ে থাকে। এই দুটো দিন কত বড় মনে হচ্ছে। যে দুই দশক কেটে গেছে! কেন এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেলে? মেয়েটা তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাকে প্রশ্ন করছে, আম্মু কবে আসবে? আম্মু আসে না কেন? কি বলব তাকে আমি? বলে দাও আমাকে। এড়িয়ে যেতে পারি না। বলে ওর প্রশ্নের উত্তর না দিলে খাবে না ঘুমাবে না। তুমি ছাড়া আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি ছোঁয়া। সব এলোমেলো হয়ে গেছে তোমাকে ছাড়া। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বেঁচে আছি না হলে হয়ত তোমার কাছে চলে যেতাম। ছোঁয়া… আমি……
লেখাগুলোর কিছু জায়গায় কালি ছড়িয়ে গেছে। হয়ত কেঁদেছিল অনেক লেখার সময়। আমি কতক্ষণ লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কত আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে লেখাগুলো থেকে। শূণতায় ভর্তি। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করলাম লেখাটুকু। আমি হীনা না জানি কত কষ্ট সহ্য করেছে মানুষটা। যদি আজ আমি মরে যেতাম! বুকের বাম পাশটায় কেমন যন্ত্রণা করে উঠল। যে কষ্ট ও একলা সহ্য করেছে সে কষ্ট এখন ভাগ করে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলাম। নিজেকে শক্ত করে পড়া শুরু করলাম।
চলবে…