#ফাইন্ড_নোরা
#পর্ব_12
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
15.
দুই ঘন্টা পার হয়ে গেল অভির এখনো থামার নাম নেই। পাগলের মতো মারছে ছেলে গুলোকে হাত পা বেঁধে।
সবাই বাইরে থেকে তাকিয়ে আছে। পারভীনের খুব খারাপ লাগছে অভিকে এমন পাগলামী করতে দেখে৷ কিন্তু নোরার সাথে যা হয়েছে সেটা শোনার পর ওর নিজেরেই ইচ্ছে হচ্ছে লাঠি পেটা করতে। তবে অভি কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না।
কে করেছে? কেন করেছে? ওরা জানে না।
ওদের শুধু নোরাকে খুন করার অর্ডার দিয়েছিলো। ওরা ভেবেছে খুনিই যখন করবে তখন ওদের ইচ্ছে পূরণ করা যাক। এমন সুন্দর একটা মেয়ে।
কিন্তু যখন সেন্স হারিয়ে ফেলে ওরা ভেবেছে মারা গিয়েছে তাই ফেলে দিয়ে এসেছে৷
এমন বয়ান শোনার পর অভির পাগলামী আরো বেড়েছে।
শার্ট খুলে ফেলেছে সে। ঘামে চকচক করছে ওর পেটানো জিম করা শরীর।
পারভীন তাকিয়ে আছে দেখে আরিফ ওর পাশে এসে বলল-
– নায়কের মতো লাগছে নাকি?
পারভীন একটু হাসলো। সে হাসি মলিন। অভির জন্য এক সময় একটা অনুভূতি থাকলেও নোরার সাথে ওর সর্ম্পক হওয়ার পর সেটা কোন জায়গায় ছিলো না অভির কাছে। অভি আসার পর থেকে আরিফ সেটা খেয়াল করছে।
কিন্তু এখন এইসবের কোন মানে হয় না। পারভীন বলল-
– ওকে দেখে খারাপ লাগছে। নোরার সাথে যা হয়েছে তা শুনে ওর মধ্যে কি যাচ্ছে তা আন্দাজ করতে পারো? নোরাকে আমি দেখেছি। এমন তুলোয় মোড়া সোনার পুতুল সে। তার সাথে এমন –
-হ্যাঁ। অভির জায়গায় আমি থাকলে আমিও বোধহয় এমন করতাম।
পারভীন আস্তে করে মাথা রাখে আরিফের কাঁধে। আরিফ আলতো করে হাত দেয় পারভীনের পেটে৷ কারণ ওখানে তাদের এক টুকরো ভালোবাসা বেড়ে উঠছে।
ছেলে গুলোকে রক্তাক্ত করে তখনো ক্লান্ত হয় নি অভি। তাও বেড়িয়ে এলো।
আফসান হুইসেন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এত চাপ উনি নিতে পারছেন না। বিশেষ করে নোরার ব্যাপার টা জন্য এখন উনি পুরোপুরি নিজেকে দোষী ভাবছেন।
উনার লিস্ট অনুযায়ী সেসব মন্ত্রীদের জিজ্ঞাসা বাদ করা হয়েছে। কেউ কিছু স্বীকার করছে না। কারণ ওদের কাছে এখন সেসব নেই।
রবিন কে ট্রেক করার চেষ্টা করছে পারভীন। কিন্তু পারছে না।
অভি বের হয়ে পানি খেলো। আরিফ অভিকে গিয়ে বলল-
– কারো নাম বলল?
অভি পরাজয়ে ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো।
– ওদের কাজেই এমন। ওরা জানে না। টাকা পায় আর করে।
অভি কিছু না বলে ওর কালো শার্ট টা পরে নিতে লাগলো। তখন অভির মোবাইল বেজে উঠলো আবার।
মিজানের ফোন। অভি রিসিভ করতেই মিজান বলল-
– ওদের এনেছি, শিমুর কাজের মেয়ে আর ওর জামাই কে। থানায় আছে।
– আমি আসছি।
অভি আর এক মূহুর্তেও দেরী না করে বের হয়ে গেল দ্রুত। আরিফ অভির এই পাগলামী দেখে সত্যিই অবাক না হয়ে পারছে না। সারাদিন রাত ছুটছে তাও কোন ক্লান্তি নেই। আরিফ ও যেন মনে প্রাণে চাচ্ছিলো অভি নোরাকে পেয়ে যাক।
অভি যখন থানায় পৌঁছালো। তখন ইন্দুর জামাইকে পুলিশ মারছে।
ইন্দু ভয় পেয়ে একপাশে চুপচাপ হয়ে আছে। বুঝতে পারছে না, কি হয়েছে? কেন আনা হয়েছে?
অভি যেতেই থেমে গেল পুলিশ টা।
অভি ল-কাপে ঢুকলো। চেয়ার নিয়ে বসলো। ইন্দু দেওয়ালে পাশ ঘেঁষে বসে আছে।
মিতু আঁকা ছবিটা ইন্দুর জামাইকে দেখালো, ও ব্যাথায় কুকড়ে উঠছে, তাও মাথা নাড়লো, সে চিনে না।
এইবার ইন্দু কে দেখালো। ইন্দু প্রথমে ভয় পেয়ে গেল, তারপর আস্তে করে বলল-
-আমার ভাই ঝি-
অভি সে পুলিশ টার দিকে তাকাতে পুলিশ আবার তেড়ে এলো ইন্দুর জামাইকে মারার জন্য, ইন্দু চেঁচিয়ে উঠলো,
-ও স্যার বলছি বলছি, ওরে আর মাইরিয়েন না। মইরা যাইবো। হেয় কিছু জানে না। আমি জানি সব।
অভি চুপ করে তাকিয়ে আছে। ওর আসলেই কোন কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে না এইসব করতেও। না জানি আর কত কিছু শুনতে হবে? প্রতি পদে পদে যেন ধাক্কা খাচ্ছে। যা ওর সহ্যের সীমা পার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাও করতে হবে, যতক্ষন নোরাকে সে খুঁজে না পায়, নিজের জন্য না হোক, নোরা ওর জীবনে আবার ফিরে না এলেও৷ নোরার জীবন ওকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অভি এইটা করছে।
ইন্দু বলা শুরু করলো, সেদিন আমি ভোর বেলা খদ্দেরের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। আমাদের বস্তির পাশে যে বড় মাঠ টা আছে। ওর পাশে একটা বড় ডাস্টবিন আছে৷
এর পাশ দিয়ে ফেরার সময় আমি এই মেয়েরে দেখছিলাম। গায়ে এক রত্তি কাপড় আছিলো না৷ প্রথমে ভাবছি হেয় মরা। সারা গায়ে কাটা দাগ, রক্তের ছড়াছড়ি। একটু শক্তি আছিলো না নড়ার।
আমি কাছে যেতেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বাঁচাতে বলল, স্যার খুব মায়া লাগছিলো। তাই ওখান থেকে পাটের বস্তা দিয়ে মুড়ে বাড়ি লইয়া গেলাম। পরিস্কার করে কাপড় চোপড় পরাই, খাওয়ালাম, চিকিৎসা করালাম। চার দিন হেয় গায়ে জ্বর আছিলো।
কোন কথা বলত না৷ ভয় পাইতো। মেয়েটারে দেখে বুঝতে পারছি হেয় বিদেশী৷ বাংলা কইতে পারে না। তবে আমি বললে বুঝার চেষ্টা করতো৷ ভীষণ মায়া লাগতো স্যার। একেবারে বাচ্চা গো মতো বুকের ভেতর ঢুকে থাকতো।
এইখানে পুলিশ দের আমার জানা আছে স্যার মরা মাইয়াতে হেরা সুখ খুঁজে তারপর এমন সুন্দর মাইয়া?
আমি ডাক্তার আপা রে আনি ওর চিকিৎসা করাইছি স্যার। আমি ওরে বাঁচায়ছি। কোন ক্ষতি করি নাই। নইলে হেয় তো ডাস্টবিনেই মরে থাকতো।
অভির নিশ্বাস যেন আবার আটকে যাচ্ছে৷ দৃষ্টিটা এত ফাঁকা লাগছে।
ইন্দু বুঝলো অভি ওর কথা বিশ্বাস করছে স্যার। এইবার জোর দিয়া মিজানের দিকে তাকিয়ে বলল-
– মাইয়া টা ভাইজানের বউয়ের কাছে আছে। আমি দিয়া আইছি। আমি গ্রামে চলে যাইতেছিলাম হের লগে৷ তারে তো আর একা ফেলাই রাখা যায় না সে বস্তিতে। তাই শিমু ভাবীর কাছে দিয়া গেলাম। শিমু ভাবী রাগী হইলেও মাইয়া ভালো। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আপনে হেরে আনি জিগান।
অভি কিছু না বলে বের হয়ে গেল। তখন ইন্দু পেছন থেকে চিৎকার করে বলল-
-আমি ওরে বাঁচাইছি স্যার। আমি না থাকলে হেয় মইরা যাইতো। আমরা কোন দোষ করি নাই স্যার।
অভি নোরার ছবিটা টেবিলে রেখে আস্তে আস্তে ওয়াশরুমের দিকে গেল।
দরজা বন্ধ করে বসে পড়লো। এতক্ষনের সবার কথা গুলো যেন আর নিতে পারছে না।
নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো। এতে ওর কষ্ট কমছে না আরো বাড়ছে। আর নিতে পারছে না। ইচ্ছে করছে নিজের মাথায় গুলি চালিয়ে দিতে।
মিজান ডাকছে, অভি , অভি-
একটু পর উঠে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে তাকালো। যেন নিজেকেই বলছে,কোথায় তুমি নোরা?
হা করে বড় একটা নিশ্বাস ফেলল, তারপর মুখে পানি দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছে৷
মিজান আবার ডাকছে। অভি বের হলো, দেখলো, মিজান কারো সাথে কথা বলছে, মোবাইল রেখে, অভির দিকে তাকালো, বলল-
-শিমু ফোন দিয়েছে, নোরা ফিরেছে বাসায়।
আমি শিমু কে স্বাভাবিক থাকতে বলেছি, আর ওখানে পুলিশ আছে।
অভি যেন নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এক মূহুর্তের জন্য যেন থেমে গেল৷ তারপর ছুটল, যেন এখনিই ওর রেস শুরু হয়েছে। গাড়ি তে না উঠেই ছুটতে শুরু করল।
মিজান গাড়ি নিয়ে ওকে ধরে ফেলল-
– গাড়িতে উঠ গাধা।
মিজান আর অভি যখন গাড়িতে উঠলো, তখন অভির মোবাইলে ফোন এলো। অভি প্রথমে রিসিভ করল না। তারপর আবার করতেই ধরল।। ধরতেই ওর বোন নীলা তীক্ষ্ম স্বরে বলে উঠলো,
– তুই কি দেশে এসেছিস?
– হ্যাঁ,
– কত দিন?
– এই পনের বিশ দিন।
-এত দিন দেশে আছিস। আর আমাদের খবর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিস নি? সে তো একটা মেয়ে তোকে খুঁজতে এলো তাই আমি সন্দেহ করে তোর অফিসে ফোন দিলাম। অনেক জোরাজুড়ির পর বলল,তোর নাম্বার দিলো।
– কোন মেয়ে?
– কি জানি, দেখে তো কোন বস্তির মেয়ে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ইংলিশে কথা বলে। তোর কথা জানতে চাইছে। তুই দেশে এসেছিস কিনা?
আমি “না” বলাতে,” ও” বলে বেড়িয়ে গেল৷ আর কিছু বলল না। কি ব্যাপার বল তো? কে এই মেয়ে? তোকে খুঁজে কেন? আর তুই দেশে কেন এসেছিস?
অভি যেন কোন কথায় খুঁজে পাচ্ছে না। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না নীলা কার কথা বলছে। নোরার হয়ত মনে ছিলো অভির বাসার ঠিকানা। তাই শিমুর ওখান থেকে ওকে খুঁজতেই গিয়েছিলো। ও ভেবেছে অভি তো নিশ্চয়ই আসবে ওকে খুঁজতে।
নীলা তখনো বলে যাচ্ছে, মা তো গাল ফুলিয়ে বসে আছে এখন। বাসায় আসবি কখন?
– আসবো, খুব দ্রুত।
অভি ফোন রেখে দিয়ে মিজানের দিকে তাকালো, ওর গলার স্বর যেন বের হচ্ছে না। মিজান বলল-
-কি হয়েছে?
– নোরা আমাকে খুঁজতে গিয়েছিলো নীলা আপুর বাসায়।
মিজান এক গাল হেসে বলল, আরে শালা।
শিমুর বাসার সামনে গাড়ি থামাতেই, অভি দ্রুত নেমে পড়লো। আরেক টু হলে হুমড়ি খেতে পরতো।
ঘরে ঢুকে দেখলো, শিমু সোফায় বসে আছে মিতুকে নিয়ে। অভি ওর দিকে তাকিয়ে বলল-
-কোথায়?
শিমু ইশারায় রান্নাঘরের দিকে দেখালো। শিমু এখনো ভয়ে আছে। ও যেন বিশ্বাসেই করতে পারছে না। এমন একটা মেয়ে ওর কাছে ছিলো। মিজান ওকে স্বাভাবিক থাকতে বলেছে যাতে আবার পালিয়ে না যায় সে। তাই কিছু না বলে ও যা করতে চায়, করতে দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মিতু ও যাতে কিছু না বলে তাই ওকে ধরে বসে আছে।
অভি রান্না ঘরের দিকে এগুচ্ছে আর ওর বুকের ধুপধুপ শব্দ যেন নিজে শুনতে পাচ্ছে। যেন কোন ঘোরে হাটছে ও।
অভি রান্না ঘরে যেতেই দেখতে পেল কাউকে পেছন থেকে, বেসিনে ভাতের হাঁড়ি বসিয়ে ভাতের ফেন ফেলছে, গরম ধোঁয়া উঠছে।
অভি আস্তে করে ডাক দিলো, নোরা?
ও ফিরে তাকালো, প্রথমে বুঝতে পারলো না। তারপর অবাক হলো, এরপর বিস্ময়।
ভাতের হাড়ি টা তখনো ধরে আছে।
বিস্ময়ে সাথে বলল- অভি?
অভি যেন জোরে একটা ধাক্কা খেল। নিজেকে সামলাতে পারছে না। রান্নাঘরে দরজায় নিজেকে লাগিয়ে ফেলল, দরজাটা পেছনের দিকে গিয়ে দেওয়ালে বারি খেল। ঠাস করে শব্দ হলো। অভির মনে উপর কি যাচ্ছে ও ঠিক বুঝাতে পারছে না। হাত পা কাঁপছে। একেবারেই যেন শূন্য হয়ে গেলো ওর মাথাটা। কিছুই যেন নেই ওর মাথায় এখন। যাকে এতদিন পাগলের মতো খুঁজেছে। সে যখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তখন অনূভুতি টা কেমন হয়, তা সে ব্যাখা করার জন্য কোন শব্দেই যেন নেই।
নোরা ভাতের হাঁড়ি টা ওখানে রেখে অভির দিকে এগিয়ে এসে বিস্ময়ের স্বরে, ওর গালে হাত দিয়ে বলল-
– অভি-
অভি প্রথমে কেঁপে, তারপর নোরাকে আচমকা জোরে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিলো। নোরা কিছু বুঝতে পারছে না। অভি এইভাবে কাঁদছে কেন?
অভি কান্নার শব্দ আর মাত্রা দুটোয় যেন বেড়ে যাচ্ছিলো। কাঁদতে কাঁদতে নোরা চেপে ধরেই রান্নাঘরের ফ্লোরে বসে পড়লো।
-চলবে।