#ফাইন্ড_নোরা
#পর্ব_5
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
7.
অস্পষ্ট শব্দ গুলো যেন আরো বেশি যন্ত্রনা দায়ক এখন, কানে হাত দিয়ে বসে আছে মেয়েটা।
ইন্দু রমিজকে মেয়েটার কথা বলে নি। তাই আজ যখন সে রাতে থাকবে বলল তখন ওকে দোকানে পাঠিয়ে রান্না ঘরের পাশে স্তুপ করে রাখা কাঁথার পাশে বিছানা করে দিলো।
মেয়েটাকে দেখতে এসেছিল সাহেলা আপা। কথা বলে যা বুঝলো মেয়েটা অনেক দূর থেকে এসেছে এইখানের কাউকে সে চেনে না। তার এই অবস্তা কি জন্য, সে নিজেও জানে না। পুলিশের কথা বলায় মেয়েটা আঁতকে উঠলো। সে কিছুতেই পুলিশের কাছে যাবে না। এখনো ভয়ে আছে মেয়েটা। এক সাপ্তাহে এখন অনেক সুস্থ। কিন্তু মাঝেমধ্যে রাতের বেলা ভয়াবহ চিৎকার করে উঠে। ওকে ধরতে নিষেধ করে। পাগলের মতো করে। তখন ইন্দু যেন মাতৃত্বের স্বাদ পায় ওকে বুকে জড়িয়ে। তাই আবার মা হবার নেশা ওকে পেয়ে বসেছে। সে কিছুতেই রমিজ কে হাতছাড়া করতে চায় না এখন।
রমিজের বিশ্রী ভাষার গালাগালিতেও সে খিলখিল করে হাসছে এখন। ওপাশে একটা মেয়ে আছে সে খেয়াল নেই ওর।
ইন্দু বিপাকে পড়ল পরের দিন সকালে যখন রমিজ ওকে ওর গ্রামে নিয়ে যেতে চাইলো ওর সাথে একেবারে।
কিছুক্ষনের জন্য থেমে গিয়েছিলো ইন্দু কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে গিয়ে।
যেন সে বিশ্বাসেই করতে চাইছিলো না। রমিজের আবার জোর দিয়ে বলায় সে যেন খুশিতে মুখের ভাত গিলতেও পারছে না,ফেলতেও না।
ভেতর থেকে কিছু একটা পড়ার আওয়াজ হলে অন্য চিন্তায় ডুবে গেল ও। মেয়েটাকে কি করবে? এমনিতেই তো মেয়েটাকে সে আজীবন রাখবে পারবে না। এই পাড়ায় কারো চোখে একবার পড়লে মেয়েটার বাকি জীবন শেষ। ভেবেছিলো কেউ না কেউ এসে খুঁজে নিয়ে যাবে। কিন্তু খোঁজ নিলেও কেউ বোধহয় বেশ্যা পাড়ায় খোঁজ নেওয়ার চিন্তা করছে না।
শিলা ভাবীর ফোন আসায় মাথায় একটা বুদ্ধি এলো ইন্দুর। শিলা ভাবী অনেক দিন ধরেই বলছিলো একটা মেয়ের ব্যবস্থা করে দিতে। উনার মেয়েটা সারাদিন একা থাকে। রমিজ বেড়িয়ে যেতেই ইন্দু মেয়েটাকে একটা বড় বড় জবা ফুলে ভরা, হাত দিকে ঢোলা একটা জামা পরিয়ে দিলো। চপচপ করে তেল লাগিয়ে দিলো, মাথায় দুই দিকে বেনী করে লাল ফিতে লাগিয়ে দিলো। এইখানে থেকে ওর চেহেরাটা ফর্সা ভাব টা কিছুটা লালচে হয়ে গেল। তাছাড়া কাটা দাগ গুলো কালো হয়ে বেশ খারাপ করে দিয়েছে চেহেরাটা। তারপর ও একটু কাজল হাতের তালুতে নিয়ে ভালো একটু পানি দিয়ে দুই হাতে কচলিয়ে মেয়েটার মুখে আলতো লাগিয়ে দিতেই তামাটে ভাব টা কালো হয়ে গেল।
একেবারেই চেনা যাচ্ছে না এখন ওকে। যে কেউ দেখলে ওকে এই বস্তির মেয়েই বলবে। সে শুধু কথা বললেই বুঝতে পারবে সে আসলে এইটা না। তাই ইন্দু ওকে বুঝাতে চাইলো, ওকে এক জায়গায় নিয়ে যাবে যেখানে ওকে বোবা সেজে থাকতে হবে। যদি সে লুকিয়ে থাকতে চায়৷
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। মেয়েটা যেন একটা জীবন্ত পুতুল। কোন ইচ্ছে নেই৷ কোন আগ্রহ নেই। ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই৷ যেন সে এইখানেই থাকতে চায়। কিংবা আশাও নেই কেউ তাকে খুঁজে পাবে। মাঝেমধ্যে সে বিড়বিড় করে আফসোস করে সে মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো। এত টা ফাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকে আনমনে। ইন্দু আতঁকে উঠে। জিজ্ঞেস করার সাহস হয় না কি হয়েছিলো তার সাথে? কিন্তু সে তো জানে কি হয়েছিলো মেয়েটার সাথে। তাই আর সেসব মনে করাতে চায় না৷ ইন্দুর মোবাইল ও হাতে দিয়ে দেখলো কাউকে ফোন করতে, সে কারো নাম্বার জানে না।
তখন মেয়েটার চেয়ে নিজের অসহায় লাগে ইন্দুর। সেদিন আবেগে নিয়ে এলেও ধীরে ধীরে মাথা ব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিন্তু বের করে দেওয়া বা একা ছাড়ার কথাও সে ভাবতে পারছে না। মায়ায় পড়ল যে, ওর চোখ গুলো ভীষণ মায়াবী।
তাই ভাবলো শিমু ভাবীর ওখানে যদি দিয়ে দিতে পারে কোন চিন্তা থাকবে না। শিমু ভাবী মেয়ে নিয়ে একা থাকে৷ জামাই ছিলো। এখন ছাড়াছাড়ি হবে। কোন ছেলে নেই। তাছাড়া শিমু ভাবী একটু রাগী তবে মন ভালো। আর এইও মেয়ে মানুষ নিশ্চয় টুকটাক কাজ সে করে নিতে পারবে।
শিমু ভাবীর বাসায় গিয়ে বেল দিতেই শিমু ভাবীর জামাই মিজান আর তার পেছনে অন্য একজন তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে গেল, মেয়েটা ইন্দুর পেছনে মুখ লুকিয়ে রাখলো। ওরা বেড়িয়ে যেতেই শিমু ভাবী ভেতর থেকে হুংকার ছাড়লো।
-এক ঘন্টার কাজ কর তাও যদি এত দেরীতে আসো? আমি অফিস যাবো কখন?
ইন্দু মেয়েটাকে নিয়ে ডুকল ঘরে। পা ছড়িয়ে ফ্লোরে বসে আচঁল খুলে পান নিয়ে মুখে দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল-
– ভাবী আপনেরে কইছি না এক ব্যাটার লগে সংসার পাতমু৷ হেই কইছে ফরিদপুর নিয়া যাইবো কাল পরশু। তাই ভাবী-
কথা শেষ করার আগেই শিমু ভাবী আবার হুংকার দিলো,
– তারপর আবার লাথি ঝাটা খেয়ে ঢাকায় ফিরবে। তোমাদের এইসব আমার জানা আছে।
– না ভাবী এই ব্যাটা হেরম না।
-তো কেমন? ওর না আগে বউ ছিল? এখন তুমি পরে অন্য কেউ? পারলে ওর ছবি দাও আমি জেলে পুরে দিই।
বেজার অখুশি হয়ে ইন্দু বলল, ভাবী খালি ব্যাটা গো সন্দেহ করেন৷ ভাইজান এত ভালা তারেও আপনি সন্দেহ করেন বইল্লা তো –
শিমুর চোখ রাঙ্গানিয়ে দেখায় বাকি কথা শেষ করতে পারে নি ইন্দু। আবার হাসি মুখ করে বলল-
– ভাইজান আইছিলো মণির লগে দেখা করতে?
শিমু ডায়িং টেবিলে বসে ছিলো। প্লেটে পরে থাকা বিস্কুট গুলো বক্সে রেখে চনাচুর থেকে বাদাম খেতে খেতে বলল-
– না। ওর এক বন্ধু এসেছে, সে আবার আমারো বন্ধু ছিলো তাই দেখা করতে এসেছে।
শিমু এতক্ষনে লাল জবা ফুলে ভরা জমা পরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল-
-এইটা কে?
ইন্দুর যেন কোন গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে পড়ে গেল এমন ভাব করে বলল-
-আমার ভাই ঝি, আমি চলে যাব ভাবলাম আপনারে কাউকে দিয়া যাই। আর আপনিও বলছিলেন মণি সাথে থাকার জন্য একটা মেয়ে পেলে ভালো হইত।
শিমু মেয়েটার দিকে তাকাল, কেমন যেন নোংরা নোংরা লাগছে। কাপড় চোপড়ে৷ ইন্দুর কাপড় পরেছে তাই ওর আত্মীয় মনে হচ্ছে। মনে মনে খুশি হল। কারণ এখন মেয়ে পাওয়া আর সোনার হরিণ পাওয়া সমান।
কিন্তু তাও সন্দেহ গলায় বলল-
-ছোট মেয়ে বলেছিলাম। এত বড় মেয়ে না। আর চুরি টুরির অভ্যাস-
– না না ভাবী ওসব কিছু না। বড় ভালো মেয়ে৷ আর ছোট ছোট দুইটা মাইয়া রাখলে কে কারে সামলাবে? কন।
আর এই মেয়ে কথা বলতে পারে না তো তাই ভাই বিয়া শাদি দিতে পারে না। এইখানে পাঠাইছিলো। এহন তো আমিও যামু গা ভাবলাম আপনের এইহানে আনি৷
সব কথা শুনে তবে বলতে পারে না। ভীষণ ভালা মাইয়া। যা কইবেন অক্ষরে অক্ষরে হুনব।
শিমু চুপ করে আছে। মেয়েটার ত্বক কালচে লাগলেও বেশ মায়া চেহেরাটা। কেমন যেন সরল লাগছে। চোর মেয়ে গুলো চটপটে টাইপ হয়। আর ওদের ভাষা বাজে হয় মেয়ে শিখে ফেলে, কথা না বলতে আরো সুবিধা।
কিছু টা নরম হয়ে বলল-
– খাওয়া পরা সহ দিয়ে আমি দেড় হাজার টাকার একটাও বেশি দেব না।
ইন্দু মাথা নাড়ল, না ভাবী বেশি কম তো। এই টাকা দিয়া আপনি মাইয়া পাবেন?
শিমু উঠে প্লেট গুলো বেসিনে রেখে এসে বলল-
-তাহলে দরকার নেই।
তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে ইন্দু বলল-
– না না ভাবী, আচ্ছা আপনার কাছে মেয়ে সেইফ থাকব তাই ছাড়লাম। যা দেন আপনি৷ খাওয়া পরা তো দেবেন৷ কোন অভাব তো নাই আফনে গো বাসায়।
শিমু মনে মনে খুশিই হলো। কিন্তু দেখালো না। বলল- -আমি রেডি হব, তুমি আজ কাজ করে নাও, ওকে শিখিয়ে দাও সব আর তোমার টাকা নিয়ে যাবে।
ইন্দু মাথা নাড়ল। ওর মাথা থেকে একটা বোঝা নামলো। কিন্তু মেয়েটা পারবে কিনা বুঝতে পারছে না। মেয়েটাকে যত সম্ভব বুঝিয়ে দেওয়া চেষ্টা করছে কি কি করতে হবে। হাড়ি মাজা, কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা। মেয়েটা তাকিয়ে আছে বেশ বিস্ময় নিয়ে যেন এই কাজ সে কখনো দেখে নি।
ইন্দু আজেই মেয়েটাকে রেখে যাবে বলাতে শিমু একটু সন্দেহ চোখে তাকালেও আপত্তি করল না। কারণ ও অফিসে গেলে মেয়ে কে দেখার জন্য ওর মা এসে থাকে। মাকে আজ ছোট বোনের ডেলিভারির জন্য যেতে হয়েছে।
মেয়েকে একা রেখে যাওয়ার কোন মানে হয় না। ভেবেছিল অফিসে নিয়ে যাবে। কিন্তু এখন মেয়েটা থাকবে বলল। তাই রাজি হলো।
ছোট একটা রুম দেখিয়ে দিলো, সেখানে একটা বেড বিছানো। আশে পাশে সব জিনিস পত্র ঘরের। আগের কাজের মেয়ের রুম ছিলো। চুরি করে পালিয়েছে সে।
মেয়েটা চোখ বুলালো, ইন্দুর ঘরের চেয়ে হাজার গুন ভালো মনে হলো।
ইন্দু শিমুর কানে কানে বলল- ওকে পুরানো কিছু জামা দিয়েন ভাবী,বুঝেন তো-।
শিমু মাথা নাড়ল, ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। মেয়েটা সব দিকে চোখ বুলিয়ে দেখছে। চকচকে দেওয়ালের ঘরে চারটা রুম। সাধারণ ভাবে সাজানো সব। দেওয়াল জুড়ে অনেক ছবি। একটা রুমের দরজা খোলা যেখানে দুই দিকে ঝুটি করা একটা ছোট মেয়ে মনোযোগ দিয়ে রং করে যাচ্ছে।
ইন্দু মেয়েটাকে এইখানে থাকতে হবে এই বুঝিয়ে বলে, বেড়িয়ে যেতেই শিমু ডাক দিলো,
-ওর নাম কি?
ইন্দু থেমে গেল, তারপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চটপট করে বলল- মোহনা।
মেয়েটাও মাথা নাড়ল।
তারপর তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল। শিমু বেশ অবাকেই হলো, একটা সুযোগ পেলে অনেক ক্ষন কথা বলে ইন্দু। আজ এত তাড়া কেন ওর?
কিন্তু শিমুর ও অফিসে যাবার তাড়া৷ রান্না কাল রাতের করাই আছে। রান্নাটা শিমু নিজে করে। কাজের মেয়ে দিয়ে করাতে পছন্দ করে না।
মেয়েটাকে ডেকে ইশারায় বুঝিয়ে দিলো ভাত, তরকারী, থালা, বাটি কোথায় কি আছে।। ইশায়ার ওর মেয়ের দিকে দেখিয়ে বলল-
-একটার দিকে ওকে ভাত দিয়ে দেবে। তুমিও খেয়েও নিও।
ওর জন্য আলাদা প্লেট দেখিয়ে দিলো।
সিলিং এ দেখিয়ে বলল-
-আমি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছি উল্টাপাল্টা করার চেষ্টা করবে না।
মেয়েটা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়লো। শিমুর বেশ ভালোই লাগলো।
সে অন্য রুমে গেল রেডি হতে। মেয়েটাও ওর জন্য দেখিয়ে দেওয়া রুমে গেল।
বেল দিলো কেউ হঠাৎ, মেয়েটা বেড়িয়ে আসতেই শিমুও বের হয়ে এলো, বলল-
-আমি যাচ্ছি, তুমি রুমে যাও। আর কেউ আসলে দরজা খুলবে না। আমি যতক্ষন ফোন করে বলব না।
মেয়েটা আবার মাথা নেড়ে রুমে চলে গেল। শিমু আলতো করে হাসল। অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলো, শাড়ির পাড় তুলতে তুলতে দরজা খুলেই বলল-
– অভি তুমি?
এক গাল হেসে অভি বলল- মোবাইল ফেলে গেলাম।
ঘরে ঢুকে সোফায় পড়ে থাকা মোবাইল তুলে নিতেই যেন থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আশেপাশে তাকিয়ে যেন কিছু খুঁজতে চাইছে।
শিমু ডায়িং টেবিলের পাশে রাখা বেসিনে লাগানো আয়নায় দেখে শাড়ির পাড়ে পিন লাগাচ্ছিলো।
অভি ভেতরের রুমের দিকে পা বাড়াতেই বলল-
-কোথায় যাচ্ছো? ওদিকে আমার কাজের মেয়ের রুম।
অভি ‘ও ‘বলে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ‘আসছি’ বলে বেড়িয়ে গেল। তখন মেয়েটাও রুম থেকে বের হল। শিমু শাড়ির কুচি ঠিক করতে করতে দরজা লাগিয়ে বলল,
– মোহনা তুমি কাউকে দরজা খুলবে না।
ও মাথা নাড়লেও এইবার ফাঁকা চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
– চলবে।