#ফাইন্ড_নোরা
#পর্ব_4
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা
6.
সেদিনের অফিস টা এখন আবার চকচকে আর পরিপাটি । এখন অনেকের চলাচলে বোঝার উপায় নেই এইখানে কি হয়েছিলো সে রাতে?
অভি আর মিজান নোরা ঢুকতে চাইলে ঢুকতে দেওয়া হলো না।
বাধ্য হয়ে একটা রুমে অপেক্ষা করতে লাগলো। দেওয়াল জুড়ে সুন্দর কারুকাজ। যেন মোটা কার্পেটে মোড়া দেওয়াল। রুপালি কারুকাজের টেবিল চেয়ার। তাতে রাখা টি পট আর কাপ।তাতেও আছে সোনালী কারুকাজ। অফিস রুমটায় বসলে মনে হচ্ছে বাইরেরগ দুনিয়ার কোন কিছু যেন ভেদ করে এপারে আসবে না।
মিজান এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। এমন সরকারী অফিসে ওর আসা হয়নি। অভির কথায় ওকে এই কেইসে নেওয়া হয়েছে। অভির কোন দিকে নজর নেই৷ ও চেয়ারের হাতলে হাত রেখে দুই আঙ্গুল কপালের উপর দিয়ে রেখেছে।
একটু পরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঢুকলেন আফসান হুইসেন। দারুণ বুদ্ধিমত্তা চেহেরা উনার। চোখে চশমা। চশমার কোন ফ্রেম নেই। থুতনির চারপাশে জিরো আকারের দাঁড়ি৷ সাদা হওয়াতে উনাকে বেশিই ভালো লাগছে। উনার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু কথার ব্যস্ততায় ভেতরের ক্লান্তি বাইরে আসতে চাইছে না।
মোবাইলে কথা বলতে বলতে কোটের বোতাম খুলে চেয়ারে বসে মিজানের দিকে তাকিয়ে হাসারর চেষ্টা করলেন।
মিজান সম্মানের সাথে মাথা নাড়ালো। উঠে দাঁড়িয়ে যেতে চাইলে ইশারায় বসতে বললেন। অভি এখনো সেভাবেই আছে।
কথা শেষ করে এক গাল হাসি টেনে হাত বাড়িয়ে বললো-
-ওয়েলকাম। তোমার কথা অনেক শুনেছি।
অভি ওভাবে আছে দেখে মিজান ধাক্কা দিল কনুই দিয়ে। যেন ঘুম ভাঙ্গলো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
– ভালো কিছু নিশ্চয়ই না।
সামান্য বাঁকা হয়ে ঝুঁকে, পাশে রাখা টেবিল থেকে কিছু বের করতে করতে বললেন,
– অবশ্যই ভালো। বাংলাদেশের কারো আমেরিকার মতো দেশে গোপন এজেন্ট হিসেবে এত বছর ধরে কাজ করে যাওয়া, ইটস নট এ স্মল থিং! ওরা কাজই দেখে, মানুষ নয়।
– আমাদের দেশেও তো মানুষ নয় কাজ দেখে। নইলে এত সিকিউর অফিস থেকে কাউকে কীভাবে গায়েব করে দেওয়া যায়?
– আই এম ভেরি সরি অভি। আই টেইক মাই রেসপন্সিবিলিটি। আমার কথায় ওমর ওকে এইখানে পাঠিয়েছিলো, বাট আমার চার জন সিকিউরিটি মারা গেল। এতে প্রমাণ হয় ওরা কিন্তু তাদের ডিউটি ঠিক ভাবেই পালন করেছে।
– তাহলে কিডন্যাপাররা শক্তিশালী বেশি এইটা বলতে চাইছেন?
আফসান হুসেইনের এই ধরনের বাঁকা কথা শোনার অভ্যাস যে নেই তা তার চোখে মুখে ফুটে উঠছে।।
– শোনো অভি-
কথাটা বলার আগেই অভি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
– নোরা কি কাজে এসেছিলো আমি দেখতে চাই।
– এইটা কনফিন্ডেশিয়াল, আমি-
অভির গলার স্বর এইভাব একটু বেড়েই গেল,
– she don’t know anyone here, no one even know her, why someone kidnapped her?
অবশ্যই যে কাজে ওকে আনা হয়েছে, তার জন্য ওর আজ এই অবস্হি।
আফসান হুসেইন কিছুটা হতচকিয়ে গেলেও উনি জানেন কীভাবে সামলাতে হয়। কাকে কতটুকু দেখাতে হয়। তার জন্য এত বছর উনি এই কাজে আছেন।
পাশের টেবিল থেকে আরেকটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন-
– এই কাজে এসেছিলো। দেশের সুরক্ষার জন্য আমরা একটা প্যাটেন্ট তৈরী করার চেষ্টা করছিলাম, তার জন্য আমাদের এমন কিছুর দরকার ছিলো যার জন্য-
অভি ফাইল টা উল্টাতে উল্টাতে বলল-
– যার জন্য আপনাদের পারমিশন নেই, তাই নোরা কে দিয়ে সব হ্যাক করানো হচ্ছিলো?
– না না, সেরকম নয়। অবশ্যই আমাদের পারমিশন আছে। কিন্তু সেটা বাইরে আসা যাবে না৷
ফাইলটা উল্টে দেখে সন্দেহ জনক কিছু না পেয়ে অভি ফাইলটা টেবিলে অনেকটা ছুঁড়ে মেরে বলল-
– এইখানে সব নেই, বাকিসব কই..?
আফসান হুসেইন দেশের মন্ত্রীদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী একজন, উনার কোন উম্মাদ এজেন্টকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। উনি এইবার উনার ক্ষমতা যেন গলায় ভর করতে চাইলেন। বললেন-
– দেখ অভি, তুমি সেরা বলেই হয়ত ওমর তোমাকে এইখানে পাঠিয়েছে। আমরা আমাদের থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি মিডিয়া ব্যবহার করতে পারছি না কারণ নোরা অলরেডি বিভিন্ন দেশে কাজ করেছে। ওকে কি কাজে আনা হয়েছে তার জবাবদিহি আমাদের শুধু দেশের মানুষকে নয়,বাইরের দেশেও করতে হবে। এখন তুমি আমাদের হয়ে, আমাদের টিম তোমাকে সব ধরনের –
কথাটা শেষ করার আগেই অভি উঠে দাঁড়িয়ে গেল, ফাইলের থেকে একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে গেঞ্জি ঠিক করতে করতে বলল-
– আমার কোন টিমের দরকার নেই, আমি একাই টিম। শুধু একটা সাহায্য করবেন আমার কাজে কেউ বাধা দেবেন না যদি আপনারা যেভাবে চান সেভাবে নোরা খুঁজে পেতে চান। আর সন্দেহের তালিকাগুলো দেবেন।
– হ্যাঁ, পেয়ে যাবে। তবে টিম টা তোমার ভালোই লাগবে। ইউ স্যূট মিট দ্যাম। তাছাড়া নোরা পুরো প্রজেক্টটা লিড করেছে ও দেশের অনেক গোপন সিস্টেম সর্ম্পকে জানে এখন। ওকে দিয়ে মিস লিডও করানো যেতে পারে, আমাদের জন্য একটা বিশাল রিস্ক ও। তাই ওকে খুঁজে পাওয়া জরুরী, ও যদি বেঁচে-
মিজান অভির দিকে তাকালো, অভি রেগে যাচ্ছে। ও কিছু করার আগেই মিজান আটকাতে চাইলো, কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গেল, অভি ক্ষেপে গেল,
– কি বলতে চাইছেন? মরে গেলে তো বেঁচে গেলেন আপনারা। আর ওর বেঁচে থাকা রিস্ক এখন?
ওর ফ্যামিলি এবং ওর পজিশন সর্ম্পকে কোন ধারণাই বোধহয় আপনার নেই, যদি একবার মিডিয়ার ওর গায়েব হওয়ার কথা লিক হয়, নোবডি ক্যান সেইভ ইউ এন্ড ইউর গর্ভমেন্ট।
আফসান হুইসেন অভির অগ্নিমূর্তি দেখে ঘেমে উঠলেন। তারপর ও হাসার চেষ্টা করলেন,
– আমার কথার অর্থ সেটা ছিল না। ইউ মিসআন্ডারস্টান্ড-
তখন উনার ফোন বেজে উঠায় যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ফোন রিসিভ করে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় পেছন ফিরে বলল-
– আমার পিএ তোমাদের টিমের কাছে নিয়ে যাবে।
মিজান এইবার কথা বলল,
– তুই এখনো আগের মতো আছিস। আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম গায়ে না হাত তুলে দিস। এইখান থেকে আর বের হতে পারতাম না। গায়েব হয়ে যেতাম। উনার ক্ষমতা সর্ম্পকে তোর ধারণা আছে? প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বেশী আমার মনে হয়। এখন নেহাৎ গর্তে পড়েছে। নইলে আমাদের কথা শোনার ও টাইম নেই ওনার।
অভি এখনো রাগে ফুঁসছে। অভির গায়ে হাত দিয়ে মিজান ওকে শান্ত হতে বললো। সবাই জানে অভির মন ভীষণ শক্ত। কিন্তু যখনিই ব্যাপার টা নোরার হয় তখন অভি যেন অতি সাধারণ।
তখনই কালো কোট পরা একজন দরজা খুলে বলল-
– চলুন।
ওরা ওর পেছন পেছন যেতে শুরু করল। বিশাল বিশাল একইরকম দেখতে করিডোর। কোন দিকে যাচ্ছে মিজান বুঝতে পারছে না। কিংবা এই জায়গায় পুলিশ হয়েও সে নার্ভাস। অভির কানে ফিসফিসিয়ে বলল-
– গুম টুম করে দেবে নাকি?
অভি নাক দিয়ে শব্দ করে হাসল। কিছুটা হেঁটে ওরা লিফটে উঠলো। লিফট নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মিজান আবার অভির দিকে তাকালো। অভির কোন ভাবন্তর নেই। যেন সে রোজ আসে এইখানে।
লিফট থামতেই অন্ধকার গলিতে হেঁটে গেল। ওদের তিনজনের জুতার আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। মিজানের মনে হচ্ছিলো কোন ইংলিশ মুভির সিনে সে হাঁটছে। সামনে গিয়ে হয়তো বড় বড় মনিটর ওয়ালা বিশাল অফিস রুম।
না তেমন কিছু নেই। সাধারণ একটা অফিসের মতোই। গাদাগাদি ফাইল। ছয় সাত জন কর্মী। অভি আর মিজান যেতেই সবাই একবার তাকালো।
তখন একজন এগিয়ে আসলো। নীল চেকের শার্ট। মাথায় সামান্য টাক। কালো ফ্রেমের চশমা, বয়স হয়ত বেশী না। কিন্তু টাকের জন্য ওকে বয়স্ক লাগছে।
অভির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল-
– আপনার যা জানার আমাকে জিজ্ঞেস করবেন অভি।
অভি হাত বাড়িয়ে দিলো বলল- আমাকে চেনেন নাকি?
একটা মেয়ে পেছন থেকে হাই হিলে টক টক শব্দ করে দুই হাতে দুইটা কফির মগ নিয়ে এগিয়ে এসে বলল-
– চেনে না, রীতিমতো তোমার কাছে কৃতজ্ঞ বলা যায়।
মেয়েটাকে দেখে অভি হেসে দিলো।
– পারভীন? তুমি? কুয়েত থেকে এইখানে?
– কি করবো? তুমি রিজেক্ট করলে, মনে কষ্ট নিয়ে দেশে এলাম। মা ধরে বেঁধে এই বেচারা কে বলির পাঁঠা বানিয়ে আজীবন জ্বালানোর জন্য ঝুলিয়ে দিলো।
মিজান এইবার মেয়েটা আর ছেলেটার দিকে তাকালো।কেমন যেন বেমানান লাগছে।
মেয়েটা হাই হিলে ছেলেটার চেয়ে লম্বা। ছেলেটার কাঁধে হাত রেখে বলল-
-তবে এনাকে যেমন দেখতে তেমন তিনি নন। বলতে পারো ছুপা রুস্তম।
– তা না হলে নিশ্চয় সে এই অফিসে থাকতো না।
তিনজনেই হেসে উঠলো। অভি অবার বলল-
-তুমি নোরা কে দেখেছো তাহলে।
– না তা ঠিক না। আমরা এইখানেই থাকি তেলেপোকার মত। কেউ আসলে আমাদের দেখে বাইরের কেউ না। তবে ওর সাথে আমি দেখা করেছিলাম। পাঁচ মিনিটের মতো। তোমার সাথে সর্ম্পকিত কারো সাথে সে যোগাযোগ বা কথা বলতে চায় না। জানালো। এর পরদিন ও গায়েব।
-সেদিনের সিসি ক্যামেরা কি বলে?
– আসলে এইখানে তেমন কিছু হওয়ার সম্ভবনা থাকে না। তাই সব সময় সে লম্বা করিডোর, খালি প্যাসেজ। এইসব। ক্যামেরা অন ছিলো।
হুইসেন স্যার যখন অফিসে ফোন দিলো নোরা কিডন্যাপড। তখন আমাদের লোকেরা রিয়ালাইজ করলো এতক্ষন যা চলছিলো তা রেকর্ড ভিডিও। আর আমরা দুজন সেদিন ছিলাম না। আমাদের এনিভার্সেরি ছিলো।
ওর জামাইর দিকে তাকিয়ে বলল-
-আরিফ ছাড়া এইটা আসলে কেউ বুঝতে পারে নি।কারণ বাইরে সিকিউরিটি থাকে রাতে সবাই ঘুম দেয় যে এক দুইজন থাকে।
-সন্দেহজনক কিছু?
আরিফ তখন একটা ফাইল এগিয়ে দিয়ে বলল-
-সন্দেহ জনক বলতে এই সিকিউরিটিটা ছিলো যে এর আগের দিন ছুটি নিয়েছিলো। এবং ওর একাউন্টে ভালো একাউন্ট এসেছিলো৷ আমরা খুঁজতে গেলাম। ওর বাসায় ওর লাশ পেলাম।
অভি মিজান দুজনেই ফাইল টা দেখল। ওর ছবি এবং লাশের ছবি।
আর কোন সিকিউরিটি বেঁচে ছিলো না। যার কাছ থেকে আমরা ইনফরমেশন পাবো। সবাইকে নিঃশব্দে খুন করেছে।
– এই প্রজেক্টটা তো গোপনীয়। বাইরের কে কে জানে?
– আসলে হুসেইন স্যার যত গোপনীয় বলছে তত গোপনীয় না। নোরা দকে আনার জন্য একটা মিটিং ডাকা হয়েছিলো তার মধ্যে বিশ জন ছিলো। সাথে তাদের পিএ আর অনেকে। এখন তারা কাকে কাকে বলেছে আমাদের জানার কথা না। আমরা সবাইকে ডেকে এনে ইনভেস্টিগেশন করেছি। তাদের একাউন্ট ও চেক করেছি। সন্দেহজনক কিছু নেই।
– তাদের লিস্ট আমাকে দাও।
পারভীন একটা কাগজ এগিয়ে দিল৷ সবার নাম ছবি আর বাসার ঠিকানা লেখা আছে।
– ওদের ফ্যামিলি মেম্বার দেন ব্যাংক একাউন্ট চেক করছো? দেশের বা দেশের বাইরের?
আরিফ আর পারভীন একে অপরের দিকে তাকাল।
– না।
-তাহলে ওগুলো চেক করো। আর আমাকে জানাও।
পারভীন অভির দিকে একটা মোবাইল এগিয়ে দিলো। এইখানে সবার নাম্বার আছে।
মোবাইল দেখতেই অভি বলে উঠলো,
-নোরার ফোন এবং জিনিসপত্র কোথায়?
পারভীন ইশারা করাতেই একজন একটা বক্স এনে দিলো। একটা ব্যাগে নোরার মোবাইল। ওর জিন্স৷ টপস। ল্যাপটপ। আরো অনেক কিছু। কাপড় গুলো স্পর্শ করে যেন নোরাকে ছুঁয়ে দেখছে। পারভীন সামনে এসে দাঁড়িয়ে হেসে বক্সের ভেতর থেকে একটা ফ্রেম ওয়ালা ছবি এগিয়ে দিয়ে বলল-
– এইটা ওর বালিশের কাছে ছিলো।
অভি হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইলো। মিজান দেখলো। অভি আর নোরা একটা সেল্ফি ছবি। দুজনে হাসি মুখ করে একে অপরের সাথে গাল লাগিয়ে রেখেছে৷
– এইটা আমি নিয়ে যাচ্ছি।
– তুমি নিতে পারো না।
অভি চোখ তুলে তাকালো। নোরার মোবাইলটাও পকেটে ঢুকিয়ে ছবিটা নিয়ে হাঁটা দিলো।
পারভীন পেছন থেকে ডাক দিলো, অভি-
মিজান ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে তবে অভি লিফটে উঠে গেল ততক্ষণে।
-চলবে