ফাইন্ড নোরা,পর্ব_1

#ফাইন্ড নোরা,পর্ব_1
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা

1.
বিশাল বিশাল সব টিভি কম্পিউটার থেকে ঝিঁ ঝিঁ আওয়াজ বের হচ্ছে। যেন তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে।
ফাইল, চারকোনা অফসাইড অনেক গুলো কাগজ পত্র এলোমেলো ভাবে পুরো অফিস জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ছড়িয়ে আছে আসবাবপত্র গুলোও। ফুলদানি, ফাইল স্ট্যান্ড বাকা হয়ে ঝুকে আছে দেওয়ালে।

দেখে কেউ বলবে না এই টা একটা সরকারী অফিস। যা বাইরের দেশের সরকারী ভাবে আমন্ত্রিত লোকের কাজের জায়গা।

ঘন্টা দুয়েক আগেও এইটা একটা পরিপাটি চোখ ধাঁধানো রুম ছিল।

লিফট উঠার আওয়াজ হচ্ছে। স্যূট বুট পরা পঞ্চাশের কাছাকাছি আফসান হুসেইন উঠে এলেন। যিনি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর গোপনীয় নথি দেখার আইটি সেক্টরে আছে। তার ইমেলেই এসেছিলো বিশ্বের সেরা দশজনের একজন।

একটা কাগজ উড়ে গেল উনার পায়ের কাছে। ভালো করে চোখ বুলাতেই , ছুটলেন রুমের ভিতর। বিস্ময় আর আতংক মিলিয়ে বেড়িয়ে এলো-

-একি?

সারাঘরে এলোমেলো পড়ে আছে সব। দ্রুত ছুটলেন কম্পিউটার এর দিকে।
না কিচ্ছু নেই, কোন ডাটা নেই।

দ্রুত সিকিউরিটিদের কে ফোন দিলেন। না কেউ নেই।

সারাঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলেন কাউকে। বাথরুম, বারান্দা, সব রুমেই। না কোথায় ও নেই সে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব এলোমেলো জিনিসপত্রের ভীড়ে খুজে পেল দামী মোবাইল টা। বসে পড়লেন তিনি।
এই মোবাইলের নাম্বার ছাড়া সে কাউকে খুঁজে পাবে না। চেনে না কিছুই সে। কেউ চেনে না তাকে।
ভীষণ রকম ঘাম দিচ্ছে, টাই টা হাল্কা করে নামিয়ে নিলেন।
তাকেই জবাব দিতে হবে সব মহলে, দেশ ও বিদেশ। জবাব দিতে হবে সে মানুষ টার সহ খানিক কর্মচারীকে। ভয় আছে প্রাণের।

অনেক ভেবে চিন্তে পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফোন দিলেন নিজের গোপন ফোর্স কে। যা নাম ইয়েলো ফোর্স।

রিং হতেই রিসিভ, ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই বললেন – ফাইন্ড নোরা।

ব্যার্থতায় যেন আকড়ে ধরেছে। ছুড়ে মারলেন নিজের মোবাইল খানা।
কয়েক টা ডিগবাজি খেয়ে মোবাইলটা এক জায়গায় গিয়ে থেমে গেল।
ওখানে কিছু একটা পড়ে আছে। উঠে তা হাতে নিতেই চিৎকার করে উঠলেন।
-এর মূল্য দিতে হবে তোমায়।

2.
ভোর পাঁচ টা, এখনো জাগে নি শহর। আলো ফুঁটছে। একটা দুইটা কুকুর হাঁটছে রাস্তায়। রাস্তায় ঘুমিয়ে থাকা মানুষ গুলো আরো নড়েচড়ে ঘুমাচ্ছে। রং উঠা হলুদ বিল্ডিং এর গেইট খুলে বেড়িয়ে আসছে ইন্দু।
আজ ওর নাম রেশমা ছিলো। গেইটের ভেতর থেকে হাত বের করে টাকা দিতেই চেঁচিয়ে উঠল

– কি দিচ্ছো এইটা? ছয়শো টাকার কথা ছিলো, তিনশো তে ভাগাচ্ছো? এখুনি চেঁচাবো, রেশমা কে বোকা বানাও।
– থাম, এই নে আরো দুশো। ঘ্যানঘ্যন করিস না।

আর কিছু বলার আগেই গেইট টা বন্ধ করে দিলো।
রং বেরঙের শাড়ির কোণায় বাধা পান খানা মুখে দিয়ে রাস্তায় নেমে এলো।
শরীর টা টনটন করছে। এই ব্যাটা আস্ত জানোয়ার।
তাতে কি, হেটেই তো যেতে হবে। খালি পেটে পান পরায় পেট গুলাচ্ছে। রাস্তায় দোকান পাট সব বন্ধ। কি শান্ত, আর ঘন্টা খানিকে মাছির মতো ভো ভো করবে লোকজন।

বড় রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটের স্যাঁতস্যাঁতে গলি তে ঢুকল ইন্দু। এইখানে সব সেমি পাকা ঘর। একটার গায়ে একটা লাগানো। এইবাড়ির মুখ তো ও বাড়ির পেছন।
এর পেছনে আরো কিছু চটের বাড়ি। এর পেছনে বড় মাঠ। মাঠের ওপারে ইন্দুর ঘর। মাঠ পেড়িয়ে যাবার জন্য রাস্তা নেই। তাই একপাশের ভাঙ্গা দেওয়াল টপকেই যেতে হবে।

মাঠে এক কোণায় ময়লায় স্তুপ। সারাদিন কাক কুকুরে আওয়াজ। মুখে কাপড় চেপে পার হচ্ছিলো। কিছুটা দূরে ঘাসের উপর কাক বেশি চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ওপাশে আগে একটা মিল ছিলো। এখন বন্ধ। আশে পাশে লম্বা ঘাস।

ঘাসের মাঝে কি যেন নড়ছে। নাকে কাপড় বাধা অবস্তায় সামান্য এগিয়ে যেতেই একটা ধবধবে ফর্সা পা নড়ে উঠলো।
আরেক টু কাছে যেতেই আতৎকে উঠল ইন্দু।
সম্পূর্ণ বিবস্ত্র এক মেয়ে। সারা গায়ে রক্তের ছড়াছড়ি। চোখের দেখায় বুঝা যাচ্ছে। কি হয়েছে মেয়ে টার সাথে। হায়নার দল খুবড়ে খেয়েছে। শেষে ভাবলো মারা গিয়েছে। তাই ফেলে গেল।

আশেপাশে তাকালো ইন্দু। কেউ নেই। নিচু হয়ে বসতেই মেয়েটা যেন ধরতে চাইলো।
তবে শক্তি নেই।
মিলের দেওয়ালের গায়ে পাটের চট ঝুলছিলো। কোন মতে টেনে নিয়ে মেয়েটার গায়ে দিলো।
এখনো কেউ দেখে নি মেয়েটাকে। দেখলে হয়ত কেউ না কেউ চিনবে। এইসব ঝামেলায় পড়ে লাভ নেই। নিজের রাস্তা ধরাই ভালো।

ইন্দু ভাবল যে সব ছেলেরা টাকা দিয়ে রাতে ওদের নিয়ে যায় তারাও এসব হায়নার চেয়ে বেশ ভালো। অন্তত মর্জিতে তো করে। টাকাও দেয়। ঘর ও চলে। এদের মতো এই অবস্তা তো করে না।

কিছু পথ এগিয়ে যাওয়ার পর। আবার যেন মনে হলো এই পাড়ায় ভালো মানুষের সংখ্যা নেই। সবাই আরো খুবলে খাবে। নইলে মরে যাবে কিছুক্ষন পর। এইখান কার থানার লোকজন গুলো পারে না মরা মেয়েতে সুখ খুঁজতে।

আবার ফিরে গেল ইন্দু। মেয়েটা তুলে বসালো। মেয়ে চিপচিপে শরীর। তবে বেশ সুন্দর। ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,
-প্লিজ হেল্প মি।

মুখে ইংরেজি শুনে মনে হচ্ছে বড় ঘরের মেয়ে।
-উঠ মেয়ে, আমার কাঁধে হাত দাও।

মেয়েটা পাতলা, অনেকটা তুলেই নিয়ে যাওয়া যায়।
ইন্দু সর্ম্পূন ভর নিয়ে চেচিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একপ্রকার।

মেয়ে উহ আহ শব্দ করছে। থামা যাবে না। কেউ দেখে ফেলার আগেই নিয়ে যেতে হবে ঘরে। বেশ্যার ঘরে যেকোন মেয়েকে বেশ্যায় ভাববে সবাই।
একটু সুস্থ করতে হবে। তারপর নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করে নেওয়া যাবে।

টিনের ঘর, শেকল দিয়ে লম্বা করে বাশের সাথে টিনের দরজা লাগানো থাকে। ঘরের সামনে কিছু কাপড়ের স্তুপ। ওটা টেনে মেয়েটাকে বসিয়ে দরজা খুলল ইন্দু।

তাড়াতাড়ি দুইটা বালতি নিয়ে কল থেকে পানি নিয়ে আসতে হবে।

মেয়েটা মাথা হেলিয়ে বসেছে। চোখ বন্ধ। এক ইঞ্চি ফর্সা শরীর ও আস্ত নেই যে কাটা দাগ নেই৷
চোখের পাতাও বাদ নেই।
পানির বালতি নিয়ে চালের বস্তায় ঘেরা বাথরুম এ রেখে এলো। মগ আর ঘরের সামনে বাঁশ দিয়ে লাগানো কাপড় শুকাতে দেওয়া জায়গা থেকে কালকে ধোয়া পাতলা সুতির ওড়না টা নিলো। ইন্দু ব্যস্ত স্বরে বলল-

– ও মেয়ে উঠ। ধরো আমাকে। তোমাকে পরিস্কার করে দিই। তারপর কাপড় পরাবো।

মেয়েটা প্রাণপণ উঠতে চাইলেও পারছে না।
আবার ধরে কোন মতে নিয়ে গেল।

টুলের উপর বসিয়ে গায়ে পানি দিতেই চিৎকার করে উঠল মেয়েটা।

-চুপ।কেউ শুনে ফেলবে।

সুতির ওড়না টা ভিজিয়ে ধীরে ধীরে মুছে দিলো রান, হাত, গলা।
অনেক টা পরিস্কার লাগছে। মুখ টা ধুয়ে দিতেই মেয়েটা একদম বিদেশী লাগছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইল। আবার পানি দিয়ে ধুয়ে দিলো।

খালি গায়ে বসে আছে মেয়েটা। যেকোন ছেলে দেখলে এখনিই ঝাপিয়ে পড়বে।

রুমে গিয়ে ৬০ ওয়ার্ডের বাল্ব টা জ্বালানো। গত ইদে একটা জামা পেয়েছিল ইন্দু যে বাড়িতে কাজ করে। দুইবার পরা হয়েছে।

ধুয়ে ভাজ করে সুগন্ধি দিয়ে তুলে রাখা হয়েছে।
এই রুমে একটাই কাঠের আলমারী। আলমারীর উপর অনেক পুরানো কাঁথা, সব কয়টার পেটের দিকে ছিড়ে ছিড়ে ঝুলে আছে।
আলমারীর পাশে বাঁশের বেড়াতে ঝুলছে একটা আয়না, চিরুনি, ক্লিপ, কয়েক পাতা টিপ, একটা পাউডার আর তীব্র সুগন্ধি একটা মুখের ক্রিম।

একটা খাট। যার এক পাশে অনেক গুলো কাপড়ের স্তুপ। কয়েটা খালি কৌঠা। দুয়েক টাতে ঘরের জিনসপত্র।
তেল চিট চিটে দুইটা বালিস আর রং উঠা শাড়ি পাতানো আছে।

জামাটা নিয়ে মেয়েটাকে পরিয়ে দিলো। এনে খাটে বসাতেই মেয়েটা শুয়ে পড়ল।

চোখ বন্ধ করল। এক ফোটা পানি পাতায় আটকে বেড়িয়ে এলো।

মেয়ে মানুষের জম্ম পানি ফেলার জন্য। এই আর নতুন কি?

কাল রাতেও পেটে কিছু পরে নি ইন্দুর। সারারাত ধকল শেষে। খিদে পেয়েছে এখন।

বাইরে হইচই শুরু হয়ে গেল। পানি নিয়ে। ভো ভো আওয়াজ।
চা পাতার গন্ধ ভেসে আসছে। কারো কারো উচ্চ গলার আওয়াজ।

এইখানে ঘর কয় টা তার খবর কেউ রাখে না। কার ঘরে কে আসে কে যায়। কে রাত কাটাই তার খবর নেই।
এইখানের সবাই দিনের বেলা মানুষের বাসায় কাজ করে, মিলে কাজ করে, ছেলেরা রিক্সা চালায়, পুরোনো খবরের কাগজ জিনিসপত্র কিনে এনে বিক্রি করে। জুয়া চলে, মদ খায়, মেয়েরা সন্ধ্যা নামলে বড় রাস্তার মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সারাদিন ক্লান্তি ফেলে লাল লিপিস্টিকে খিলখিল করে হাসে।

বুকের থেকে টাকা গুলো বের করে একটা বোয়ামে ভরে রাখল। একশ টাকা নিয়ে একটা বড় মগ নিয়ে বের হলে৷ দুইদিন খাবার ছিলো না। আজ আনতে হবে।
মেয়েটারে কিছু খাওয়াতে হবে। আরো পড়ে একটু সালেহা আপুর কাছে গিয়ে ওষুধ আনতে হবে। ভাবলো ইন্দু।

সালেহা নিতাই দার দোকানে কাজ করে। ওষুধ বিক্রি করে। ডাক্তার বসে৷ মেয়েদের কত রোগ৷ ডাক্তার দেখাতে গেলে অনেক টাকা। ডাক্তার কাকে কি ওষুধ দেয়, সে দেখে রাখে।

কোন মেয়ের পেটে বাচ্চা চলে এলে। কিংবা না আসার ওষুধ। কারো খুব ব্যাথা হলে। টুকটাক জ্বর সর্দি। সব ওর কাছে গিয়ে বললেই দিয়ে দেয়।
পেটে ওষুধ গেলেই মনে হয় অনেক যত্ন হচ্ছে শরীরের তাই বোধ হয় কাজ হয় দ্রুত৷

কিসমতের দোকানের সামনে ভীড় জমে গেল। চা, পাউরুটি, নান রুটি, কলা বিস্কুট। যার যেটা লাগে আর কি।

লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে নিতে হয়।

– এক কাপ চা আর এক কাপ দুধ দাও, পাউরুটি দাও একটা।
এক কেজি চাল, আধা কেজি ডাল, আধা কেজি আলু, আধা কেজি পেয়াজ দাও।

কাপে টুংটুং করে চা নাড়তে নাড়তে কিসমত বলে,
– ইন্দু আপার আজ ভালাই ইনকাম হয়ছে দেখি।

– হলে তোর কি? সবাই কি আর তোর মত ফ্রিতে হাতাতে চায় বল?

দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা হো হো করে হেসে উঠতে সে চুপ হয়ে গেল।

– আহ, রসিকতাও বুঝো না, নাও চা, দুধ।

জিনিসপত্র পত্র সব নিয়ে একশ টাকার নোট টা দিলো,
-আরো তিরিশ টাকা।
– লিখে রাখ। পরে দিব।

ঘরে এসে চালে আর ডালে চুলায় তুলে দিয়ে চা রুটি খেয়ে নিলো।

মেয়েটার কাছে যেতেই মনে হলো মেয়েটা কাঁপছে।
গায়ে হাত দিতেই জ্বর। গায়ে একটা কাথা দিতেই কিছুটা থামলো।

মেয়েটার মাথা হাত দিয়ে ডাকল,
– এই মেয়ে কিছু খাও। আমি ওষুধ নিয়ে আসি। ওখানে কি ব্যাথা করছে?

মেয়েটা আরো কেঁপে কেঁপে উঠছে। পাশ বসতেই যে আকড়ে ধরতে চাইলো মেয়েটা।

তুলে জড়িয়ে ধরল ইন্দু। আহ মেয়েটার শরীরের অদ্ভুত গন্ধ। গা পুড়ে যাচ্ছে। বুক টা কেমন যেন ভিজে যাচ্ছে মায়ায়।

ওর মেয়েটা বেঁচে থাকলে হয়তএত বড়ই হতো । সে শীতের রাতে কাঁপতে কাঁপতে মরে গেল। এক ফোঁটা ওষুধ খাওয়াতে পারে নি ইন্দু।

চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে অনেক দিন পর কোন মেয়েকে এইভাবে ধরে।

বালিশ হেলেন দিয়ে বসিয়ে দুধে পাউরুটি ভিজিয়ে খাওয়ালো ইন্দু। বাচ্চাদের মতো খাচ্ছে মেয়েটা।
সন্তানের মতো কাউকে খাওয়ানোতে একটা মায়া আছে। শান্তি আছে। যা মেয়েরাই অনুভব করতে পারে।

মেয়েটা আবার শুয়ে পড়লো।
চুলাটা বন্ধ করে। আরেক শ টাকা নিয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে বের হলো ইন্দু।

-চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here