ইচ্ছে_দুপুর,পর্বঃ৬
খাদিজা আরুশি আরু
—হলো তো কি হয়েছে?সে আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে নাকি?মনে হয় বোবা।না,বোবা হলে বাচ্চাদের পড়ায় কি করে!ধুর বাবা,তুই এতো ভণীতা না করে নাম বলতো।
—তা না হয় বললাম,কিন্তু আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আপু।ভাইয়াকে আমি প্রথমে যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম সত্যি বলতে মানুষটা ততোটা খারাপ নয়।তোকে কতোবার সবটা বলতে চেয়েছি কিন্তু তুই কখনো সে সুযোগই দিস নি।আচ্ছা তুই বাড়ি কবে আসবি বলতো?
—গত চার বছরে একবারও গিয়েছি বাড়িতে?
—তা তো রাগ করে আসিস নি।তবে এবার তো এমবিবিএস শেষ হলো।এবারও আসবি না?
—না।
—তাহলে যাবি কোথায়?ভাইয়ার বাড়ি?জানিস,ভাইয়া যখন প্রতিমাসে আমাদের বাড়িতে আসে,প্রতিবার ভাবতাম এবার হয়তো তুইও সঙ্গে আসবি তবে প্রতিবারই হতাশ হতাম।তুই তো আমাদের সঙ্গেও তেমন কথা বলতি না।একটু কুশল বিনিময় করেই ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন রেখে দিতি।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—সে প্রতিমাসে তোদের বাড়িতে কেনো যেতো?
—কেনো আবার?তোর শ্বশুর শ্বাশুড়িকে দেখতে আসতো।ভাইয়া এলেই তোর অনেক সুনাম করে।যেনো তোরা কতো সুখী দম্পতি।কিন্তু তোর কথা শুনে তো অন্যকিছু মনে হচ্ছে।সত্যি করে বলতো, ভাইয়ার সঙ্গে সত্যি তোর কখনো দেখা হয়নি?
—যেখানে ফোনে কথাই হলো না সেখানে দেখাতো দূরের কথা ভাই।তুই প্লিজ নামটা বল।
—দিগ্বিজয় মাহবুব, ডাকনাম দুপুর।নামটা সুন্দর…
—নাম সুন্দর দিয়ে আমি কি করবো! অদ্ভুত…
তুর্যর কথা পুরো না শুনেই ফোনটা কেটে দিলাম।ডিভোর্সের জন্য আবেদন করে হোস্টেলে ফিরে এলাম।ভেবে খুব অবাক হচ্ছিলাম যেই আমার সঙ্গে মানুষটার কখনো কথা হয় নি,দেখা হয় নি সে আমার বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই!স্বামী হওয়ার সব দায়িত্ব সে অকপটে পালন করে গেছে।শুধু আমার বা তার নিজ পরিবারের প্রতি নয়,আমার পরিবারের প্রতিও সে তার দায়িত্ব পালনে অবহেলা করে নি।
আমার সঙ্গে হয়তো সে কখনো দেখা করতে আসে নি,তবে ঠিকই নিজের বাবা মাকে আমার খবর নিতে প্রতিমাসে পাঠাতো, আমার বাবাকে দিয়ে ফোন করাতো, আমার একাউন্টে টাকা পাঠাতো।এতোগুলো ভালো মানুষের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করতে যাচ্ছি ভেবে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিলো।
কোর্ট থেকে নোটিশ এসেছে সাতদিন হলো।যে দেশের আইন কচ্ছপের ন্যায় সে দেশে ডিভোর্স কেইস ফাইল করার এক মাসের মাথায় সব কাজ হয়ে গেছে ভেবে হাসি পাচ্ছিলো।হাহ…এ দেশে সুষ্ঠু বিচার না হলেও সম্পর্ক ভাঙ্গতে সময় লাগে না।অবশ্য আর যাই হোক বিয়ের চার বছরে যে বর বউয়ের দেখাই হয় নি সে বিয়ে ভাঙ্গতে বেশি ঝামেলা হবার কথাও নয়।
তুর্জর মেসেজ করা ঠিকানাতে নিঃশ্চই এরকমই একটা নোটিশ পাঠিয়েছে কোর্ট থেকে।আগে প্রায়ই মেসেজে টুকটাক কথা হতো।কিন্তু যেদিন নোটিশ পাঠানো হলো তারপর থেকে আর উনি যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন নি।আমিও নিজ থেকে যোগাযোগ করি নি।যার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে কি লাভ!
উকিল এগারোটায় ডেকেছেন।আমি, আহসান স্যার,ডিএম সোয়া দশটার দিকে রওনা হলাম।আমাদের এখান থেকে কোর্ট তেমন দূরে নয়।পৌঁছতে পৌঁছতে পৌনে এগারোটা বেজে গেলো।
উকিলের সামনে বসে আমার বরের জন্য অপেক্ষা করছি কিন্তু বারোটা বেজে গেলো তার আসার নামই নেই।আসবে না নাকি!ভেবেছিলাম শেষবেলায় এসে অন্তত মানুষটার মুখদর্শন হবে।কিন্তু আমার এমন ভাগ্য সেটাও হলো না।আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন করার পর উকিল সাহেব বললো পেপারটা ওনারা আমার বরের বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।আমি তাতে আপত্তি জানালাম।বললাম,
—আপনাদের কষ্ট করতে হবে না।আমি নিজ দায়িত্বে ওনার ঠিকানায় ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিবো।
আহসান স্যার বললেন,
—ইচ্ছে মা,তুই কেনো…
—স্যার,প্লিজ!
ডিএম হঠাৎ বললেন,
—স্যার, ইচ্ছের যা ভালো লাগে ও করুক না।আমার আপত্তি নেই।
–হুম।
আমার ডিভোর্সের নোটিশ পাঠানোর কথা নিঃশ্চই আমার বাড়িতেও পৌঁছে গেছে।তাইতো আজকাল কেউ আর খবর নেয়ার জন্যও ফোন করে না।তুর্জটাও ফোন করে না।সেদিন ডিএম কে বিয়ে করার সিদ্বান্তের কথা তুর্জকে বলবো ভেবেছিলাম।কিন্তু তুর্জর মুখে ওনার সুনাম শোনার পর কেনো যেনো বলতে মন চায় নি।
এক সপ্তাহ পর আমার আর ডিএম এর বিয়ের দিন ঠিক করা হলো।সে রকম আহামরি কিছু নয়।সামান্য কোর্ট মেরেজ আরকি।
টকটকে লাল জামদানী পরে আহসান স্যারের সঙ্গে কোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।আজ আমার আর ডিএম এর বিয়ে।ব্যাগে আমার সাইন করা ডিভোর্স পেপার।কেনো যেনো ওনাকে পেপারটা পাঠানোর সাহস করে উঠতে পারছি না।ম্যারেজ রেজিস্টারে সাইন করে তারপর পেপারটা ওনাকে পাঠাবো এমনটাই ভেবে এসেছিলাম।কিন্তু যা হলো তা ছিলো আমার ভাবনার বাহিরে।
লাল জামদানী গায়ে জড়ানোর পর থেকেই কেমন অসস্তি বোধ করতে লাগলাম।বারবার আমার বিয়ের রাতের কথা মনে পড়ছিলো।তখন আমি কতো ছোট।যাকে চিনি না জানি না হুট করে তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিলো।দূরে থেকেও কতো সুনিপুণভাবে আমার পড়াশুনার তদারকি করেছেন।একবারের জন্যও ধৈর্য্যহারা হননি।কি অদ্ভুত,যে মানুষটার প্রতি কাল অবধি আমার কোনো ভালোলাগা ছিলো না,যে কেবল আমার জীবনের একটা নীরব চরিত্র আজ এ সুন্দর মুহূর্তে বারংবার তার কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে আমার জীবনের সফলতার প্রতিটি পদক্ষেপেই তো সে তার অস্তিত্বের চিহ্ন রেখে গেছে।
ম্যারেজ রেজিস্টারে ডিএম সই করে দিয়ে আমার দিকে পেপারটা এগিয়ে দিলেন।আমার তখন খুব অসস্তি হচ্ছিলো।একটা সই,তারপর আমি অন্যজনের হয়ে যাবো।যে মানুষটা নিরবে আমার প্রতি তার দায়িত্ব পালন করে গেছে তাকে আমি ঠকাতে যাচ্ছি,এতো বড় পাপ ধর্মে সইবে তো!
কলম হাতে উকিলের সামনে বসে আছি।ধরধর করে ঘাম ঝরছে।কলম ধরে রাখা হাতটা থরথর করে কাঁপছে।হঠাৎই শব্দ করে কেঁদে উঠলাম।আমার কান্না দেখে উপস্থিত সবাই বেশ অবাক হলো।আহসান স্যার এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,
—ইচ্ছে মা,কি হয়েছে?কাঁদছিস কেনো?আমাকে বল,তোর সব সিদ্বান্তে আমি তোর পাশে আছি।তোর মনে যা আছে আমাকে সব বল মা…
—আমি বিয়ে করবো না স্যার।আমি আমার বরের বাড়ি যাবো।
—ইচ্ছে!
—হ্যাঁ স্যার।
—তোদোর তো ডিভোর্স হয়ে গেছে।
—হয় নি স্যার।আমি পেপার পাঠাই নি।আসলে পাঠাতেই পারি নি।মন চায় নি।
পাশ থেকে ডিএম বললো,
—ইচ্ছে,তোমার আপত্তি না থাকলে আমি তোমাকে নিয়ে যাই?
—না,আমি আপনার সঙ্গে যাবো না।আপনাকে আমি রিজেক্ট করেছি।এতো বড় মাপের মানুষ আপনি, আপনাকে রিজেক্ট করার অপরাধে যদি আমার সঙ্গে অসভ্যতা করেন রাস্তায়?ছেলদের কোনো বিশ্বাস নেই।কিন্তু আমার বর ভালো,তাকে বিশ্বাস করা চলে।
—তুমি কি তাকে ভালোবাসো ইচ্ছে?
—ভালোবাসি কিনা জানি না।তবে সম্মান করি,বিশ্বাস করি।
—ভালোবাসা ছাড়া সংসার হয় না ইচ্ছে।
আমি তখনও কেঁদে যাচ্ছি, কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,
—ভালোবাসার সংসারের চেয়ে বিশ্বাসের সংসারের স্থায়িত্ব অনেক বেশি।ভালোবাসার সংসারও বিশ্বাসের অভাবে নড়বড়ে হয় কিন্তু বিশ্বাসের সংসার,হাজার ঝড় ঝাপটাতেও ভাঙ্গে না।আর ভালো তো আমি আপনাকেও বাসি না।আপনাকে আমার ভালোলাগে,আর ভালোলাগা যে কারো জন্যই সৃষ্টি হতে পারে।সেক্ষেত্রে আমার বরের সঙ্গে সংসার ভেঙ্গে আপনার সঙ্গে সংসার গড়ার কোনো যৌক্তিকতা আমি দেখছি না।
শেষের কথাগুলো বলার সময় কেনো যেনো আমার বেশ আনন্দ হচ্ছিলো।ততোক্ষনে আমার কান্নাও থেমে গেছে।গালে হালকা শুকনো চোখের জলকণা হাত উল্টে মুছে নিলাম।আহসান স্যারের সামনে গিয়ে একগাল হেসে বললাম,
—আপনি জানতেন আমি এমন কিছু করবো তাই না স্যার?তাই আমাকে সিদ্বান্ত নিতে বলেছিলেন,আর চুপচাপ সবটা দেখছিলেন?
—আজ আমার ইচ্ছে মা সম্পূর্ণভাবে সংসার করার জন্য প্রস্তুত।তো ডাক্তার ইচ্ছেবিলাসী মাহবুব সংসার নামক পরিক্ষাক্ষেত্রে আপনাকে সুস্বাগতম।
—ডাক্তার ইচ্ছেবিলাসী মাহবুব নয়, বলুন মিসেস ইচ্ছেবিলাসী মাহবুব।
—তোর বরটা বড়ই ভাগ্যবান।
—আমার ভাগ্য ভালো যে,আমার মতো এমন একটা পাগল বউকে সে নিজের মতো করে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ দিয়েছে।
সেদিনই তুর্জর পাঠানো ঠিকানায় আহসান স্যারের সঙ্গে রওনা দিলাম।মনে মনে বেশ আনন্দ হচ্ছিলো।আমার হাসি থামছিলোই না।আমার আনন্দ দেখে আহসান স্যারের চোখ বারবার ভিজে যাচ্ছিলো।বুঝতে পারলাম,স্যারের ময়ূরীর কথা মনে পড়ছে।হয়তো বেঁচে থাকলে এখন ময়ূরীরও আমার মতো একটা সংসার হতো।কিন্তু আমাদের সমাজের তথাকথিত হায়েনারা তাকে বাঁচতে দিলো না!
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো ভেতর থেকে।তারপর আবার আমার বরের দিকে মনোনিবেশ করলাম।মনে মনে নিজেকে নিজেকে নিজে বললাম,
—মিসেস ইচ্ছেবিলাসী মাহবুব, এবার তোমার দুপুরময় দিনের শুরু…তুমি তৈরি তো?
চলবে…