ইচ্ছে_দুপুর,পর্বঃ৫
খাদিজা আরুশি আরু
ওনার কথা শুনে আমি ওড়নায় মুখ লুকিয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছিলাম।এখনকার কান্নাটা স্যারের জন্য নয় বরং ময়ূরীর জন্য।মেয়েটা কতো কি না সহ্য করেছে।অথচ আমরা কতো অল্পতেই আশা ছেড়ে দেই।উনি কিছুক্ষণের জন্য থামলেন।হয়তো তার গলায়ও কান্নার দলা আটকে আছে।একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উনি আবার বলতে শুরু করলেন।
—চিঠিটা পড়ে আমার মাথা ঘুরছিলো।মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচের মাটি সরে গিয়েছে।কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বাসায় ফোন দিলাম।ময়ূরীর কথা জিজ্ঞেস করায় মা বললো,”ময়ূরী নিজের ঘরে আছে”।ফোন দিতে বলায় বললো,”গোসলে গেছে”।বুঝলাম মা কিছু একটা লুকাচ্ছে আমার থেকে।যখন রেগে গিয়ে ঝারি দিলাম তখন ফোনের ওপাশ থেকে মায়ের কান্নার শব্দ ভেসে এলো।আমি তখন থরথর করে কাঁপছি।কোনো এক অশুভ সংবাদের জন্য নিজেকে তৈরি করছি। নিজেকে সামলে গলার স্বর নরম করে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,”মা,কি হয়েছে ময়ূরীর?আমাকে বলো”।মায়ের কান্নার বেগ আরো বাড়তে লাগলো।কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন, “দিদিভাই আত্নহত্যার চেষ্টা করেছে পাঁচদিন হলো ছোটখোকা।এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে।অবস্থার কোনো উন্নতি নেই।ডাক্তার বলেছে তাদের কিছু করার নেই।সব উপরওয়ালার হাতে।যদি বেঁচে ফিরে তবে তা হবে মিরাক্কেল।তুই পারলে ফিরে আয় ছোটখোকা।আল্লাহ না করুক,মেয়েটার ভালো মন্দ কিছু হয়ে গেলে তুই তো শেষ দেখাটাও দেখতে পাবি না”।আমি আর কোনো কথা বলতে পারলাম না।ফোনটা কেটে মেঝেতে বসে পড়লাম।তখন দেশে ফিরা অসম্ভব ছিলো।তখন দেশে ফিরা মানে আমার গত সাড়ে নয় মাসের কষ্টকে জলাঞ্জলি দেয়া।তবে সে মুহূর্তে আমার মেয়ের কষ্টের সামনে আমার এটুকু ক্ষতি আমার চোখে লাগছিলো না। আমার পরিচিত অনেক লোক ছিলো সে দেশে।তিন ঘন্টার মধ্যে টিকিট করে দেশের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।দেশে ফিরার পর ভাইয়াকে কল দিলাম হাসপাতালের ঠিকানার জন্য।ফোন করার পর ভাইয়া আমাকে সোজা বাসায় আসতে বললো।আমার মনে তখন দুইরকম চিন্তা ঘুরছে।এক,ময়ূরীও বিন্দির মতো আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো না তো!দুই,ময়ূরী নিঃশ্চই সুস্থ এখন।বাড়ি ফিরার পর আমি দেখলাম বাড়ির সামনে অনেক লোকজন।ভেতরে গিয়ে দেখি বসার ঘরে সবাই কাঁদছে।বুঝতে পারলাম আমার জন্য কোনো দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।পরে জানতে পারলাম মা আমার সঙ্গে কথা বলে ফোন রাখার পরপরই হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানায় ময়ূরী মারা গেছে।আর কিছুক্ষণ আগে বাবা,ভাইয়া ওরা আমার মেয়েটাকে কবর নামক অন্ধকার ঘরে শুইয়ে দিয়ে এসেছে।মেয়েটাকে শেষ দেখাও হলো না।যদি জানতাম আমার দেশান্তর হওয়া আমার সর্বশান্ত হবার কারন হবে তবে কখনো যেতাম না।তারপর বেশ কিছুদিন ট্রমায় ছিলাম।সারাদিন ময়ূরীর ঘরে ওর জিনিসপত্র নিয়ে বসে থাকতাম।যখন একটু স্বাভাবিক হলাম তখন খোঁজ নিলাম ওই ছেলেগুলোর সম্পর্কে।একদিন পুলিশসহ হাতেনাতে ধরলাম।আমার কাছে ময়ূরীর চিঠিটা ছিলো সুতরাং ওদের শাস্তি দিতে তেমন সমস্যা হয় নি।তারপর আর এদেশে মন টিকে নি।আবার ক্যালিফোর্নিয়াতে এপ্লাই করলাম।এ্যাপলিকেশন এপ্রুভ হলো।তারপর সেখানে দীর্ঘ সাতবছর থাকার পর আমার সহকর্মী এক বাংলাদেশী ডাক্তারকে বিয়ে করে দেশে ফিরি।তারপর যে আমার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি নি তা নয়।যোগাযোগ এখনও আছে,তবে আগের মতো টান অনুভূত হয় না।
স্যারের সব কথাগুলো শোনার পর আমার কান্নার বেগ আরো বাড়লো।একটা মানুষকে সৃষ্টিকর্তা এতো কষ্ট কেনো দিলেন কে জানে!আমাকে স্বাভাবিক করতে স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—ইচ্ছে মা,এবার তোমার কষ্টগুলো বলোতো শুনি।
সে মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিলো আমার জীবনে তো তেমন কোনো কষ্টই নেয়। যা আছে তা হলো হঠাৎ পরিবর্তন। আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলেছিলাম,
—আপনার এতো কষ্ট শুনার পর আমার কাছে আমার কষ্টগুলোকে তুচ্ছ মনে হচ্ছে।আমার কষ্ট পরে একদিন বলবো নি আপনাকে।
—তুমি হয়তো ভাবছো আমি অনেক কঠোর হৃদয়ের মানুষ।তাই কাঁদছি না।আসলে পরিস্থিতি আমাকে কঠোর বানিয়ে দিয়েছে।আমার পরের ঘরে একটা ছেলে আছে তবে সে ময়ূরীর মতো আমার অন্তরে জায়গা করতে পারে নি।তা তোমাকে তো আগে দেখিনি কখনো।ফাস্ট ইয়ার?
—হ্যাঁ।আরে,আপনার পরিচয়টাতো জানা হলো না।
—আমি তোমাদের প্রফেসর।
—কোন সাবজেক্ট?
স্যার মুচকি হেসে বললেন,
—সেটা ক্লাসে গেলেই দেখতে পাবে।যাও মা, নিজের ঘরে যাও।তোমার দুঃখটা তোলা রইলো।আরেকদিন আয়োজন করে শুনবো।
স্যারের স্বাভাবিক ব্যবহারে সেদিন ভীষণ অবাক হয়েছিলাম।তারপর সত্যিই স্যার আমার কষ্টগুলো শুনেছিলেন।এই একটা মানুষ যে আমার জীবনের সব খুঁটিনাটি বিষয় জানেন।আমার বিয়ের কথাটাও একমাত্র স্যারই জানতেন।অতীত নিয়ে ভাবছিলাম হঠাৎ স্যারের ডাকে বাস্তবে ফিরে আসি।
—কিরে ইচ্ছে মা,তখন থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি ভাবছিস?আমি যে একটা জরুরি কথা বলতে এলাম তা কি শুনবি না?
—ওহ,হ্যাঁ স্যার বলুন।
স্যার আমাকে মাঝে মাঝে তুমি সম্বোধন করেন।আবার মাঝে মাঝে তুই।স্যারের সম্বোধনগুলো আমার বড্ড প্রিয়।
—আজকে ডিএম আমার কাছে এসেছিলো।
—তো কি হয়েছে?এ আর নতুন কি?সে তো প্রায়ই আপনার কাছে আসে।তার সঙ্গে তো আবার আপনার অনেক সখ্যতা।
—এবার সে নিজের কথা বলতে আসে নি ইচ্ছে।সে এসেছে একটা আবদার নিয়ে।বলতে পারিস একটা প্রস্তাব নিয়ে।
—কি প্রস্তাব?
—সে তোকে বিয়ে করতে চায় ইচ্ছে।
—হাহ,তা কি করে সম্ভব?আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে।
—সেটা তুই জানিস,আমি জানি কিন্তু ডিএম জানে না।
—আপনি বললেইতো হতো।
—তুই এখানকার কাওকে তোর বিয়ে সম্বন্ধে কিছু জানাস নি।সুতরাং আমার বলাটা বাজে লাগে।ডিএম আমার প্রিয় ছাত্রদের একজন।আমার অনেক আদরের।আর তুই আমার মা,আমার মেয়ে।তোর জীবনের সব ঘটনা আমি জানি তাই আমি চাই তুই ভেবে দেখ।
স্যারের কথা শুনে আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।বিড়ালের মতো মিনমিন করে বললাম,
—কি ভাববো?
—তুই কিন্তু একদিন বলেছিলি, পাশ করার পর তোর বরকে ছেড়ে দিবি।
—তা সেটা তো এখনও বলছি।
—তাহলে ডিএম এর প্রস্তাবে রাজি হতে সমস্যা কোথায়?তুই তো বলেছিলি তোর ডিএমকে ভালো লাগে।ডিএম শিক্ষিত, আমার বিশ্বাস তুই পুরো ঘটনাটা বুঝিয়ে বললে ও বুঝবে।তুই ভেবে দেখ।দরকার পড়লে সময় নে।তবে সিদ্বান্ত হ্যাঁ হোক বা না, সেটা ডিএমকে তুই বলবি।আমি না।
—আচ্ছা।
—আসছি তাহলে?
—হ্যাঁ।
আমি সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারি নি।একবার মনে হচ্ছিলো এ কিসের বিয়ে,এটা তো নিছকই নাটক।আবার ওই মানুষটার প্রতি টান অনুভব করছিলাম।আর যাই হোক,সে যদি আমাকে সংসারের বেড়াজালে বেঁধে কাঁধে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিতো তবে তো আমি ডাক্তার হতে পারতাম না।কিন্তু অন্যদিকে ডিএম এর প্রতি ভালোলাগাটাও ছাড়তে পারছিলাম না।শেষে সিদ্বান্ত নিলাম ডিএমকে সব বলবো।তারপর আগে তার সিদ্বান্ত শুনবো তারপর নিজে কোনো একটা সিদ্বান্ত নিবো।হতেইতো পারে আমার বিয়ের খবর শুনে তার আমাকে বিয়ে করার সুখস্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো।
পরদিন সকালে লাইব্রেরীতে উঁকি দিয়ে দেখি ডিএম খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে।একটা মানুষ কি করে এতো পড়তে পারে কে জানে!সকালে লাইব্রেরীতে তেমন কেউ থাকে না তাই সে মুহূর্তে কথা বলার জন্য লাইব্রেরীর থেকে ভালো জায়গা কিছু হতে পারে না।তাই ওনার কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলাম।কোনো প্রকার ভূমিকা ছাড়া সবটা বললাম।উনি তেমন কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।খুব অবাক লাগছিলো তবুও নিজেকে সামলে নিলাম।আর যাই হোক,এতো বড় মেডিকেল কলেজের শিক্ষক কখনো ঠকবাজ হতে পারে না।
পরদিন উকিলের কাছে গিয়ে ডিভোর্সের আবেদন করতে গেলে সে জানালো বরের নাম ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।বরের নাম জানতে তুর্জকে ফোন দিলাম।সেদিন আমার বরের মেসেজটা তুর্জকে ফরওয়ার্ড করার পর তুর্জ বাড়িতে অনেক ঝামেলা করেছিলো।সত্যি,এমন ভাই পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।আমার বরের প্রতি আমার যতোটা অনীহা ছিলো তার থেকে হাজার গুণ বেশি তুর্জর ছিলো।ফোন করে নাম জানতে চাইবার পর তুর্জ কিছুটা অবাক হয়ে বললো,
—আপু,তুই সত্যি তোর বরের নাম জানিস না?তোদের বিয়ের তো চার বছর হলো।
চলবে…