নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_১৮

নীলচে_তারার_আলো,পর্ব_১৮
নবনী_নীলা

হিয়া পা টিপে টিপে শুভ্রের ঘরে এলো। এই ঘরে এইটা তার দ্বিতীয় প্রবেশ। প্রথমবারে বাড়ি মাথায় তুলেছে এবার হয়তো তাকেই তুলে আছাড় দিবে। হিয়ার মুখের সামনে শুভ্রের রাগী চোখগুলো ভাসছে। এই ম্যারিও এলিয়েনটার মতোন উধাও, হিয়া আস্তে করে শুভ্রের খাটের সামনে বসলো। তারপর খাটের নীচে খুজতে লাগলো। শুভ্র বারান্দায় ছিলো, ফোনে কথা বলতে বলতে ঘরে আসতেই দেখলো হিয়া খাটের নিচে মাথা ভরে কি যেনো দেখছে।

শুভ্র কানের কাছ থেকে ফোনটা নামিয়ে দিয়ে এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে হিয়ার পিছনে দাড়ালো।

” কি করছো এইখানে?”, হটাৎ শুভ্রের আওয়াজ পেয়ে হুরমুরিয়ে উঠতে গিয়ে ঠাস করে কাঠের সাথে বাড়ি খেয়ে মাথায় হাত পড়লো হিয়ার। অনেক জোরে লেগেছে কিন্তু ভয়ে চিৎকার করছে না সে। ঠোঁট কামড়ে ব্যাথা সহ্য করলো হিয়া। তারপর আস্তে করে মাথা বের করে বেড়িয়ে আসেতেই দেখলো। শুভ্র তার একদম পিছনে দাড়িয়ে আছে।

এইবার সে কি বলবে? শুভ্রের চোখে মুখে বিরক্তি ছাপ স্পষ্ট। সে এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কেনো হিয়ার সেটা জানা আছে। হিয়া একটা ঢোক গিলতেই শুভ্র বললো,”খাটের নিচে মাথা দিয়ে কি করছিলে তুমি?”

হিয়া মাথার সেই অংশ ডলতে ডলতে বললো,” এইটা আপনার রুম?… হে .. হে আমি তো দেখিই নি। ভুলে.. এসেছি।” বলেই এদিক সেদিক তাকিয়ে ম্যারিকে খুঁজতে লাগলো।

শুভ্র স্থির দৃষ্টিতে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,” এবার দেখেনিয়েছ? যাও নিজের রুমে।”

” সে তো আমি যাবোই.. আমি কি এইখানে থাকতে এসেছি নাকি?”,হিয়া প্রসঙ্গ বাড়িয়ে খালি এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। এনার ঘরে খরগোশ আছে জানলে তার খবর আছে।

” তোমাকে থাকতে দিচ্ছে কে?”,বলেই হিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ফোনের দিকে তাকালো।

” আপনার ঘরে থাকতে চেয়েছে কে?”, আনমনে বলে উঠলো হিয়া। বলেই নিজের মুখ চেপে ধরে শুভ্রের দিকে তাকালো। এই কথা শুনে শুভ্র নিশ্চয়ই রেগে গেছে। শুভ্র ফোনটা পকেটে ভরে হিয়ার দিকে এগিয়ে এসে বললো,” থাকতে যখন চাইছো না তাহলে এখনো এই ঘরে কি করছো?”

হিয়া মুখ থেকে হাত নামিয়ে শুভ্রের টেবিলের পাশে তাকালো। ধুর এই দুষ্ট খরগোশটা কোথায় গেলো? এই লোকটা তো বেড়িয়ে যাও বেড়িয়ে যাও শুরু করেছে। হিয়াকে এদিক সেদিক তাকাতে দেখে শুভ্র বিরক্তি নিয়ে বললো,” কি দেখছো তুমি?”

” দেখছি না খুঁজছি।”, মুখ ফসকে বলে ফেললো হিয়া। বলেই হিয়া আড় চোখে শুভ্রের দিকে তাকালো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

হিয়া আমতা আমতা করে বলল,” না মানে আপনার ঘরে কিছু ফেলে গেলে তো আর নিতেও আসতে পারবো না তাই খুঁজছি কিছু ফেলেছি কিনা..”বলেই হিয়া শুভ্রের খাটের পিছনে চলে গেলো ম্যারিকে খুজতে।

হিয়ার উপর এখন শুভ্রের রাগ হচ্ছে। তখন থেকে ভালো করে বলছে চলে যেতে তা না কথা পেঁচিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। আবার দেখো ইদুরের মতন গিয়ে খাটের পিছনে দাড়িয়ে আছে। শুভ্র এগিয়ে এসে হিয়ার হাত ধরে দেওয়ালের সাথে দাড় করাতেই হিয়া হকচকিয়ে তাকালো। শুভ্র শান্ত দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলো,” তোমার কি আজ আমার ঘরে রাত কাটানোর ইচ্ছে আছে?”

শুনেই হিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। হিয়া রেগে উঠে বলল,” সবসময় এমন আজে বাজে কথা বলেন কেনো? আপনার ঘরে রাত কাটানো ইচ্ছে আছে মানে কি?”

” ইচ্ছে না থাকলে এক্ষুনি এই ঘর থেকে যাও। নয়তো এরপর তোমার মামা ময়মনসিংহ থেকে এসেও তোমাকে এ ঘর থেকে নিতে পারবে না। খুব শখ না আমার ঘরে আসার, একেবারে রেখে দিবো।”, শুভ্র শান্ত গলায় বলল।

একেবারে রেখে দিবে মানে কি? শুভ্রের কথা শুনে হিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,” মানে?”

” মানে তোমার মাথা। মাথায় বাড়ি খেয়ে কি বোধশক্তি কমে গেছে? যাও নিজের রুমে যাও।”, বিরক্তির স্বরে বললো শুভ্র। হিয়া শুভ্রের বারান্দার দিকে তাকাতেই ম্যারির লেজ দেখতে পেলো। এইবার সে কি করবে? ম্যারিকে কিভাবে আনবে? আর কোনো জায়গা পেলো না এই ম্যারি।

” যাচ্ছি, এক মিনিট। আপনার বারান্দাটা এক নজর দেখেই চলে যাবো। কোনোদিন তো দেখিনি।”, বলেই বারান্দার দিকে এগুতেই শুভ্র হিয়ার ব্যাগ ধরে টেনে হিয়াকে আবারো আগের জায়গায় এনে বললো,” এখন কি ধমক দিয়ে বলতে হবে? ধমক দিলে তো আবার আতকে উঠবে, অজ্ঞান হয়ে যাবে। ভালো ভাবে বলছি ভালো লাগছে না তোমার?”

” ভালো লাগবে না কেনো? অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু একটু বারান্দায় যাই তাহলে আরো ভালো লাগবে। সত্যি বলছি এরপর চলে যাবো। আর জীবনেও আপনার রূমের আশেপাশে ঘেঁষবো না।”, বলেই হিয়া শুভ্রের হাতের নিচে দিয়ে একটা দৌড় দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। শুভ্র হিয়াকে এমনভাবে এর আগে দেখেনি। এটাই কি সেই মেয়ে যে তাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে গেছিলো। আর এখন তার রূমে এসে দৌড়াচ্ছে এভাবে। শুভ্র বিরক্তি নিশ্বাস ফেলে বারান্দায় আসলো। তারপর বুকের কাছে হাত ভাজ করে দাড়ালো। কি করতে চাইছে এই মেয়েটা?

হিয়া হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে হাত দুটো পিছনে রেখে। সে হাতে ম্যারিকে নিজের পিছনে লুকিয়ে রেখেছে সে। শুভ্রকে দেখেই হিয়া হাসতে লাগলো। কি বলবে সে কিছুই জানে না। সিংহের গুহায় তো ঢুকেছে এবার বের হবে কি করে। শুভ্র রীতি মতন দরজা আটকে দাড়িয়ে আছে যেতে হলে তার গা ঘেঁষে যেতে হবে। হিয়ার হাসি দেখে শুভ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক কিছু বলতে চায় কিন্তু বলছেনা নিজেকে কন্ট্রোল করে রেখেছে।

হিয়া হাসি থামিয়ে বললো,” আপনার বারান্দাটা অনেক সুন্দর।”,হিয়া জানে এইসব বলে কোন লাভ নেই। শুভ্রের দৃষ্টি তার দিকেই স্থির। শুভ্র ঠান্ডা গলায় একটা ভ্রু তুলে প্রশ্ন করলো,” তোমার পিছনে কি?”

এই প্রশ্ন শুনেই হিয়ার পুরো শরীরে শীতল হাওয়া বইতে লাগলো।মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বুকের ভিতরটায় যেনো ড্রাম বাজছে। হিয়া দুপা পিছিয়ে গিয়ে বললো,” কই কিছু না তো।”

শুভ্র সন্দেহের দৃষ্টিতে এগিয়ে এসে বলল,” তাহলে পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো?” হিয়া কোনো উত্তর দিলো। এইবার সে ধরা খেয়ে যাবে মনে হচ্ছে। হিয়া একদম দেওয়ালের সাথে মিশে দাড়িয়ে আছে। এই ম্যারিটা হাতের মধ্যে খালি নড়াচড়া করছে। কখন আবার হাত ফসকে নিচে লাফ দেয়।

শুভ্র হিয়ার সামনে এসে দাড়ালো তারপর বললো,” কি জন্যে আমার রুমে এসেছো? হাতে কি তোমার? হাত দুটো সামনে আনো বলছি।”

হিয়া না সূচক মাথা নাড়লো। শুভ্র রাগী চোখে তাকাতেই হিয়া হাত দুটো সামনে এনে শুভ্রের মুখের সামনে ধরলো। শুভ্র ভ্রু কুঁচকে ম্যারির দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যারি সামনে এমন অগ্নিমূর্তি একজনকে দেখে চোখ পিট পিট করে তাকালো।

শুভ্র প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো,” এইটা আমার ঘরে কি করছে? তুমি তাহলে এতক্ষণ এইটাকে খুঁজছিলে? নাকি তুমি ইচ্ছে করে আমার ঘরে একে ছেড়ে দিয়েছো?”

হিয়া আড় চোখে তাকালো তারপর বললো,” আমি কেনো ওকে এই ঘরে ছেড়ে দিবো?”,বলেই ম্যারিকে কোলে তুলে বললো,” ম্যারি তো ভুল করে চলে এসেছে। সে কিভাবে জানবে যে এইটা একটা নিষিদ্ধ ঘর। একজন ব্যাতিত কারো ছায়া এ ঘরে পড়ে না।”

” কোথায় পেয়েছো তুমি এইটা?”, গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো শুভ্র।

” এইটা এইটা করছেন কেনো? নাম আছে না? ম্যারি ওর নাম ওকে ম্যারি বলুন।”, ভ্রু কুচকে বললো হিয়া।

” জাস্ট শাট আপ। তুমি আর তোমার এই টুইন এক্ষুনি আমার ঘর থেকে বের হও।”, রেগে বললো শুভ্র। হিয়া মুখ বাঁকিয়ে ম্যারিকে আদর করতে করতে শুভ্রের ঘর থেকে বের হয়ে এলো। যাক এই যাত্রায় বাঁচা গেছে।

শুভ্র বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। বেছে বেছে নিজের মত আরেকটা খুঁজে বের করেছে এই মেয়ে। দুজনই প্রথম এসেই তার ঘরে হানা দিয়েছে।

🦋 হিয়ার মাথা ঘুরাচ্ছে। হিয়া সামনের বোতল থেকে পানি খেলো। টিভির সামনে বসে থাকলেও কিছুক্ষণ পর পর আড় চোখে পাশের সোফায় বসে থাকা ব্যাক্তিটির দিকে সে তাকাচ্ছে।

ব্যাক্তি ছাড়া একে কি বলে সম্মোধন করবে সেটা হিয়া বুঝতে পারছে না। একে কি ফুফুর ছেলে রায়হান বলবে নাকি বাসের হুডিওয়ালা এলিয়েন কিংবা পাহাড়ের সেই রবি ফটোগ্রাফার নাকি ডেলিভারি বয় মানে ম্যারির মালিক । কে এই ছেলে? উফফ ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছে হিয়া।

রায়হান হিয়ার বিভ্রান্ত চেহারাটা দেখে বেশ মজা পাচ্ছে। হিয়ার সাথে যে তার নিজের মামার বাড়িতে দেখা হবে সেটা রায়হানও ভাবেনি। এই মেয়েটার সাথে কি অদ্ভূতভাবেই না বার বার দেখা হয়।

রায়হানের কোলে উঠে লাফাচ্ছে ম্যারি। রায়হানের পশুপাখি অনেক পছন্দ তবে সে কখনো খরগোশ পালে নি। এই খরগোশ তার না। এই রকম আবাসিক এলাকায় কোথা থেকে এই পিচ্চিটা এলো কে জানে। শুধুমাত্র হিয়ার সাথে কথা বলতেই সে খরগোশটাকে নিজের বলে পরিচয় দিয়েছে। আর ম্যারি নামটা রায়হানের পোষা এক বিড়ালের নাম ছিল। যদিও সে যখন খুব ছোট তখন ম্যারি মারা যায়। রায়হানের খুব আদরের ছিলো সে বিড়াল।

হিয়ার পাশে বসে মোহনা তার প্রিয় মুভি দেখছে। রায়হান ইচ্ছে করেই রিমোট দিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে মোহনাকে একটু বিরক্ত করলো। মোহনা রীতিমত রেগে বললো,”এই তুই চ্যানেল বদলেছিস কেনো? এক্ষুনি চেঞ্জ কর।”

” আমি খেলা দেখবো। এতদিন পর এসেছি, কোথায় সবাই আমার আদর যত্ন করবে তা না বসিয়ে রেখেছো।”, বলতে বলতে ম্যারিকে আদর করলো।

মোহনা ভ্রু কুচকে বললো,” একদম ঢং করবি না। খেলা দেখতে হলে তুই তোর খরগোশ ছানার লাফালাফি দেখ।”বলতে বলতে পাশ দিয়েই ফুকুকে দেখে অভিযোগ করে বললো,” বড় ফুফু, দেখো তোমার বদমাইশ ছেলে আমাকে জালাচ্ছে।”

ছেলের অভিযোগ শুনে বরাবরের মতনই তিনি হাসলেন। রায়হান ফিসফিসিয়ে বললো,” রিমোট দিয়ে দিবো, আগে বলো আমাকে ডেকেছে কেনো মা?” প্রশ্নটা মোহনার জন্যে থাকলেও পুরোটা সময় রায়হান হিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলো। মেয়েটা টিভির দিকে তাকিয়ে থেকে গভির চিন্তায় ডুবে আছে।

রায়হানের প্রশ্ন শুনেই মোহনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তারপর কিছু একটা চিন্তা করে জিজ্ঞেস করলো,” আচ্ছা, তোর কি পছন্দের কোনো মেয়ে আছে?”

মোহনার হটাৎ এমন প্রশ্ন শুনে রায়হান আন্দাজ করতে পারছে কেনো তার মা তাকে ডেকেছে। ভেবেই তার হাসি পাচ্ছে। প্রশ্নের উত্তরে রায়হান মুচকি হেসে বললো,” হুম, আছে তো।”

হিয়া আড় চোখে তাকালো। কিভাবে খাপছাড়াভাবে বলছে এই ছেলেটা। হিয়া আড় চোখে তাকাতেই চোখাচোখি হলো রায়হানের সাথে। হিয়া না দেখার ভান করে চোখ সরিয়ে নিলো।

মোহনা আগ্রহ নিয়ে বললো,” কি নাম মেয়েটার?”

” আমার তো অনেককেই পছন্দ। কোন মেয়ের নাম জানতে চাচ্ছো তুমি?”, ঠোঁটে কোন হাসি রেখে বললো রায়হান।

মোহনা ভ্রু কুঁচকে বললো,” অনেককে পছন্দ মানে?”

” হ্যা, রাইট নাও দীপিকা পাড়ুকোন কে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ।”, বলেই হাসতে লাগলো সে।

” ফাজলামি করিস আমার সাথে? সত্যি করে বল।”, সিরিয়াস হয়ে প্রশ্ন করলো মোহনা।

রায়হান পরক্ষনেই একবার হিয়ার দিকে তাকালো তারপর বললো,” হুম, আছে একজন। খুব সাধারণ একটি মেয়ে।”

[ #চলবে ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here