দ্বিতীয়_বসন্ত,পর্ব-৮
লেখনীতে:নুরুন্নাহার_তিথি
মিসেস ইফা বলে,
–আজ তোকে বেশি ক্লান্ত লাগছে? অতো সকালে কই গেছিলি?
কথাটা বলে মিসেস ইফা ছেলের দিকে জুসের গ্লাসটা বাড়িয়ে দেয়। রুদ্ধ শোয়া থেকে উঠে জুসের গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেলে। তারপর মায়ের দিকে গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–রিথীর ভার্সিটিতে গেছিলাম।
মিসেস ইফা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
–তুই খুব ভালো করেই জানিস, রিথী তোকে মানবে না। রিথী নিদ্রর জায়গা কাউকেই দিবে না। তাও ওকে বিয়ে করলি। যাক বিয়ে তো করলি কিন্তু এর পরের ধাপ কি ভেবেছিস? আর যাই হোক আমি আমার ছেলের জীবন নষ্ট হতে দিবো না।
রুদ্ধ ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–উফ মা! তুমি টেনশন করো না। দেখবে রিথী ঠিক মেনে নিবে। আর আমার কি এখনি সংসার করতে হবে নাকি বলো! রিথী সময় নিক। আমার সাথে থাকতে থাকতে একসময় আমাকেও ভালোবেসে ফেলবে। আর রিথী যাকে ভালোবাসে সে তো এই ইহজগৎে নেই তাই আমাকে ছেড়ে যাবার ভয়ও নেই। আমি ওর মনে নিজের জন্য ভালোবাসা ঠিক তৈরি করে নিবো। রিথীর ভালোবাসা খুব গভীর। একবার কাউকে ভালোবাসলে তাকে ভুলে না সে। নিদ্রকেও ভুলবে না। আর নিদ্রকে ভুলার কি দরকার? নিদ্র ওর প্রথম স্বামী। যেখানে আমাদের দেশের আইনও বিধবা মেয়েদের দ্বিতীয় বিয়ে হবার পরেও মৃত স্বামীর পরিচয় পত্রের দরকার হয়, সেখানে মন থেকে মুছে ফেলাটা অনেক বড় বিষয়। তুমি তোমার বউমা বরণের ব্যাবস্থা করো।
মিসেস ইফা আর কিছু না বলে মলিন হেসে রুদ্ধর রুম থেকে প্রস্থান করে। রুদ্ধ মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে স্মরণ করতে থাকে সকালে রিথীর হাসি মাখা মুখটা।
রিথী বিকেলেই বাড়ি ফিরেছে। বাড়ি ফিরে দেখে নিদ্রর মা, ভাই ও মামা এসেছেন। নিদ্রর বাবা নিদ্রর মৃত্যুর খবর শুনে হার্ট এ্যাটাক করে বসে। এরপর সপ্তাহ খানেকের মাথায় আইসিউতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। বড় ছেলের মুত্যুটা তার কাছে কঠিন শোকের ছিল। নিদ্রকে নিয়েই তার সকল আশা, ভরসা, সব ছিল। ভালোবাসতেন অনেক বড় ছেলেকে। তাই হয়তো এই শোকটা নিতে পারেনি।
রিথী নিদ্রর মাকে সালাম দেয়। প্রতিউত্তরে ভদ্র মহিলা সালামের জবাব দিয়ে উঠে গিয়ে রিথীকে নিয়ে এসে নিজের পাশে বসান। এরপর আকুল স্বরে বলেন,
–কেমন আছো মা? নিজের কি হাল করেছো তুমি!
রিথীর চোখ ছলকে উঠে। হৃদয়ে কাঁপন ধরে এক সন্তানহারা মায়ের, এক স্বামীহারা স্ত্রীর আকুল স্বরে। সে তো স্বামী হারিয়েছে আর তার সন্নিকটে বসা মানুষটা স্বামী, সন্তান দুটোই হারিয়েছে। সন্তান হারানোর শোকের মাঝে ভরসার মানুষটাও চলে গেছে না ফেরার দেশে।
নিদ্রর মা মিসেস নিশাত বলে,
–শুনো মা, তোমার জীবনটা এখনো পরে আছে তাই সেটাকে নষ্ট করো না। নিদ্র চলে গেছে বলে যে তুমি তোমার পুরো জীবনটা হেলায়-ফেলায় নষ্ট করবে সেটা কিন্তু না। প্রতিটা মানুষের সময়সীমা থাকে। সেই মানুষটা সেই সময়সীমার বাহিরে এক মিনিটও কি এত সেকেন্ডও শ্বাস নিতে পারে না। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিন আল্লাহর হাতে। আমরা শুধু আল্লাহর কাছে পার্থনা করতে পারি। আর কিছু না। আল্লাহ যদি চান এক সেকেন্ডে সব বদলে দিতে পারেন। তাই বলছি, কালকের বিয়েটা মেনে নেও। আমি তোমার শ্বাশুড়ি হয়ে না এক মা হয়ে বলছি। সন্তান হারানোর কষ্ট আমি বুঝি তাই আমি চাই না তোমার মা সেই একই কষ্ট এখনি পাক। বাবা-মায়ের আগে সন্তানের মৃত্যু হলে কেমন কষ্ট হয় সেটা বর্ণনাতীত।
এই বলে মিসেস নিশাত চোখ মুছেন। রিথী আর সেখানে থাকে না চলে যায় সেখান থেকে। নিজের রুমে এসে দরজা লক করে বিছানায় বসে এরপর গ্লাসে পানি ঢেলে খায়। তখন রিথীর ফোনের মেসেজের টোন শব্দ হয়। রিথী গ্লাসটা রেখে মেসেজ ওপেন করে দেখে,
” “প্রহর শেষে আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস,
তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ।”
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
এই বসন্তরানী, তোমার ওই প্রগাঢ় আঁখিযুগল আমার হৃদয় দহনের কারন। এই দহন ক্রিয়া তুমিহীনা কেউ থামাতে পারবে না। চলে এসো আমার রাজ্যে, তোমার জন্য বসন্তরানী সাঁজাবো এক ফুলের সমারোহ!”
রিথীর কেমন যেনো খটকা লাগছে। এবার সে ফিরতি মেসেজ করে,
“আপনি কে আমি চিনি না তবে আশা করবো আমায় এভাবে বিরক্ত করবেন না। জোর করে কিছু হয়না। ভালো থাকবেন।
ধন্যবাদ।”
রুদ্ধ মেসেজ দিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিল। তখন ফিরতি মেসেজ দেখে ওর মন খারাপ হয় কিছুটা। ভালোবাসলে বুঝি তার অনবরত ফিরিয়ে দেয়া হৃদয়ক্ষরন হয়! হয় তো। তার চোখে নিজের অনুভূতি গুলোর নাম না দেখলে হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়। রুদ্ধেরো এমনটা হচ্ছে। তবে সে ভালোবাসা তো কমাতে পারবে না। কিছুদিন থাকুক রিথী তার নিজের মতো। তারপর সে আবার ভালোবাসার অনুরুক্তি নিয়ে হাজির হবে।
কয়েকদিন কেটে যায়,,
প্রায় সপ্তাহ খানেক হলো রুদ্ধ রিথীকে কোনো মেসেজ দেয়নি। এপ্রিল মাস এসেছে। কিছুদিন পর বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষের একদিন আগে রুদ্ধের জন্মদিন। রুদ্ধ ভাবছে মেসেজ করবে কিনা! কিছুক্ষণ ভাবার পর মনে হলো,
“বউ আমার, আমি সামান্য মেসেজ করতেও ভয় পাচ্ছি! সেইম অন ইউ রুদ্ধ!”
রুদ্ধ মেসেজ করে। রিথী কয়দিনে মেসেজের কথা প্রায় ভুলতে বসেছে। তৎক্ষণাৎ ক্লাসের মাঝে হুট করে আসা মেসেজ টোনের শব্দে মেসেজ ওপেন করে দেখে,
“এই বসন্তরানী, ভুলে গেলে আমায়? কিন্তু আমি কেনো পারছি না বলতে পারো? তোমার বসন্তে আমি হয়তো নেই তবে আমার বসন্ত তোমার নামে বসন্তরানী। তোমার হৃদয় রাঙাও আজ আমার বসন্তে। হুহ! না রাঙালে তুমি! আমিও আর ডাকবো না তোমায়।”
রিথীর কেনো জানি মুখে হাসি এলো। মেসেজটা দেখে মনে হচ্ছে কেউ গভীর অভিমানে মুখ ফুলিয়ে আছে। রিথী আর কিছু না করে ক্লাসে মন দেয়। রুদ্ধ অপেক্ষা করছে নিজের জন্মদিনের। সেদিন আবার বসন্ত ঋতুর শেষ দিন। তাই সেদিন সে রিথীর বাসায় যাবে আর রিথীকে নিয়ে ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে যাবে। সেখানে সে ঋতুরাজের শেষ সাঁজে তার বসন্তরানীকে সাঁজাবে।
প্রহর যায়, প্রহর আসে। সময়ের সচল চাকায় মানুষ পরিবর্তন হয় কিন্তু মনের তো পরিবর্তন হয় না। হয় চিন্তা, ধারনার। মন যদি ক্ষনে ক্ষনে কারো প্রতি পরিবর্তন হয় তো সে মন কোনো কাজের না। শত আঘাত না পেলে মন পরিবর্তন হয় না। অভিমান হয়, অভিযোগ জমে তবে এগুলোর পাল্লা ভারী হলে তখন মন পরিবর্তন হতেও পারে।
রুদ্ধ ও রিথীর জীবনটা এখন সময়ের দোলাচল দেখার অপেক্ষা।
কয়েকদিন ধরে সানভি চেষ্টা করছে রুদ্ধর সাথে আলাদা কথা বলতে কিন্তু রুদ্ধ পাত্তা দিচ্ছে না। রুদ্ধর কেনো জানি সানভির এসব ন্যাকামো প্রচন্ড পরিমান বিরক্ত লাগে। তাই সে সবসময়ের মতো এড়িয়ে চলে ওকে। কিন্তু সানভি নাছোড়বান্দা! ওর পেছোন ছাড়েই না। ইদানিং সানভি ভার্সিটির সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে,
“রুদ্ধ এক বিধবা ও বয়সে বড় মহিলাকে বিয়ে করে দয়া দেখাচ্ছে। আর কিছুদিন পর সেই দয়া আর থাকবে না তখন ঠিক এই সানভির কাছেই ফিরতে হবে।”
রুদ্ধর ধৈর্যে বাধ ভেঙে যাচ্ছে। সে সকলের সামনে সানভিকে টেনে এনে চিৎকার করে বলে,
“লিসেন সানভি, কাউকে ভালোবাসাকে দয়া বলবে না। ভালোবাসাতে দয়া থাকে না। আমার ওয়াইফ যেমনি হোক, ওকে আমি ভালোবাসি। সে তো কোনো অন্যায় করেনি। ওর প্রথম স্বামী মারা গেলে ওর কি করার থাকতে পারে? ও তো কোনো পরপুরুষের কাছে যায়নি। ওর নামে বাজে কিছু রটাবে না। এন্ড এট লাস্ট লুক ইউরসেল্ফ! হিংসাতে এতোটা জর্জরিত যে কাউকে তোমার সহ্য হচ্ছে না। নিজেকে আরো জঘন্য নিচে নামাতে তোমার বাঁধছে না। সম্পর্কের মাঝে তৃতীয় ব্যাক্তি হবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছো। এসব মানুষকে আমি ঘৃণা করি। রিথী তো আমার সাথে মিসবিহেভ করছে না বা আমাকে ধোঁকা দিচ্ছে না। তো তোমার কেনো এতো সমস্যা? প্লিজ স্টপ ইউর ননসেন্স।”
অপমানে জর্জরিত সানভি মাথা নিচু করে শুধু রাগে ফুলছে। নিজের হাতে নিজেই খামচি মারছে। এরপর সেখান থেকে হনহন করে চলে যায়। সারিকাও সানভির পিছু নেয়। মালিহা রুদ্ধর কাছে স্যরি বলে চলে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,